সরকারের বিভিন্ন রূপ বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর Class 11 Second Semester WBCHSE
১। ব্যাপক ও সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? গণতন্ত্রের সর্বাধুনিক সংজ্ঞাগুলি আলোচনা করো
২। গণতন্ত্রের উদ্ভবের কারণগুলি ব্যাখ্যা করো
৩। গণতন্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো
৪। গণতন্ত্রের প্রকৃতি আলোচনা করো
৫। গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
৬। গণতন্ত্র কাকে বলে? এর বিভিন্ন রূপগুলি আলোচনা করো
৭। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝো? এইরূপ গণতন্ত্রের গুণ বা সুবিধাগুলি আলোচনা করো
৮। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের দোষ বা অসুবিধাগুলি আলোচনা করো
৯। প্রতিনিধিত্বমূলক বা পরোক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? এইরূপ গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
১০। পরোক্ষ গণতন্ত্রের সপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো
১১। পরোক্ষ গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো
১২। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
১৩। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র কাকে বলে? সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
১৪। গণতন্ত্রের সুবিধা ও অসুবিধাগুলি ব্যাখ্যা করো
১৫। গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো।
১৬। গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো।
১৭। গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তগুলি কী কী?
১৮। একদলীয় শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করো।
১৯। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে টীকা লেখো
গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
রাষ্ট্রচিন্তায় আদর্শ শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের স্থান সবার শীর্ষে। প্রাচীন গ্রিসে সাম্য ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে যে গণতান্ত্রিক ধারণার উদ্ভব ঘটে, আধুনিক একবিংশ শতাব্দীতে তা এক মহান আদর্শে রূপান্তরিত হয়েছে। গণতন্ত্র আজও এক সর্বোৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থারূপে স্বীকৃত। বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রের জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল ফ্রান্সের গৌরবময় বিপ্লবের (১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দ) মধ্য দিয়ে এবং যা স্থায়ী হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক অবধি। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ) গণতন্ত্রের সংকট ডেকে আনে।
গনতন্ত্রে আঘাত
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, বিংশ শতাব্দীতে গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। আধুনিক যুগকে এই কারণে গণতন্ত্রের যুগ বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে গণতন্ত্র এক ভয়ঙ্কর সংকটের মুখোমুখি হয়। জার্মানি ও ইতালির দুই রাষ্ট্রনায়ক যথাক্রমে হিটলার ও মুসোলিনি গণতান্ত্রিক আদর্শকে ধ্বংস করার জন্য নাৎসিবাদী ও ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রবর্তন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও ইতালির পরাজয় ঘটলেও নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের পরিসমাপ্তি ঘটেনি। এ সময় বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে নয়া নাৎসিবাদ এবং নয়া-ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কো-এর একনায়কতন্ত্র, দক্ষিণ রোডেশিয়ায় স্মিথ-এর স্বৈরাচারী শাসন, তাইওয়ানে চিয়াং কাইশেক- এর শাসনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
গনতন্ত্রের পথে অন্তরায়
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, গণতন্ত্র এখনও তার পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি। গণতন্ত্র সম্পর্কে মানুষের যে প্রত্যাশা, তা এখনও অপূর্ণ থেকে গেছে। অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রচলিত রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য অর্থহীন হয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ল্যাস্কি-র মতে, অর্থনৈতিক সাম্যের অভাবে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট। রাষ্ট্রীয় সম্পদ এখানে মুষ্টিমেয় ধনী ব্যক্তির করায়ত্ত।
আধুনিককালে বুর্জোয়া উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাষ্ট্রনেতা তথা শাসকশ্রেণির কাছে দুটি উপায় বর্তমান বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রা মনে করেন। একটি হল, বুর্জোয়া শ্রেণিকে নিজেদের অনমনীয় মনোভাব দূর করে সমাজের শ্রেণিবৈষম্যের পুনর্বিন্যাস করতে হবে এবং অপরটি হল, রাজনৈতিক গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সাধারণত শাসকগোষ্ঠী তথা বুর্জোয়া পুঁজিপতি শ্রেণি দ্বিতীয় উপায়টিই গ্রহণ করে থাকে, যার ফলে বাস্তবে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়। অনেকে অবশ্য গণতন্ত্রের সংকটের জন্য নাগরিকদের নির্লিপ্ততাকে দায়ী করেছেন।
লয়েড-এর বক্তব্য হল, “নাগরিকদের নির্লিপ্ততার কারণে গণতন্ত্র আজ সংকটের সম্মুখীন হয়েছে” অর্থাৎ নাগরিকদের নির্লিপ্ততা এবং উদাসীনতার কারণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা মুষ্টিমেয় শ্রেণির করায়ত্ত হয়েছে। এর ফলে দেশের সম্পদের অংশীদারীত্ব থেকে গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ বঞ্চিত থেকে গেছেন।
উপসংহার
তবে প্রশ্ন হল, জনগণের শাসন হিসেবে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প আছে কি না। অনেকে বলেন যে, গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস হারানো, জনগণের প্রতি বিশ্বাস হারানোর সমার্থক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্নস-এর মতে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ত্রুটি অস্বীকার করা যাবে না এ কথা সত্য, তবে এজন্য প্রাচীন পরিত্যক্ত শাসনব্যবস্থাগুলিকে আঁকড়ে ধরে থাকা ঠিক নয়। এই কারণে আজও গণতন্ত্রের বিকল্প গণতন্ত্রই। গণতন্ত্রকে ত্রুটিমুক্ত করে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থায় রূপান্তরিত করার দায়িত্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিটি নাগরিকের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর মতে, “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ… মানুষ্যত্বের অন্তহীন, প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ বলে মনে করি।” রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, একমাত্র গণতন্ত্র হল এমন এক শাসনব্যবস্থা, যা জনসাধারণকে স্বশাসনের আস্বাদ এনে দিয়েছে। এই কারণে বলা হয় ‘সুশাসন স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প নয়’।
২০। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা উদ্ভব সম্পর্কে যা জানো লেখ
কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার উদ্ভব
বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় শাসনব্যবস্থার একটি রূপ হিসেবে কর্তৃত্ববাদের আলোচনা করা হলেও এর উদ্ভব আধুনিককালে হয়নি। বরং, অতীতেও কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার অস্তিত্বের সন্ধান মেলে। এই প্রেক্ষিতে প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল তথা বর্তমানকাল পর্যন্ত কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বিবর্তন ও উদ্ভব আলোচিত হল-
রাজতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ : কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রাথমিক রূপটি রাজতন্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে দেখা যায়। সাবেকি ও মধ্যযুগে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যাবতীয় ক্ষমতা এককভাবে রাজার হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। তার নির্দেশই আইন হিসেবে বিবেচিত হত। এমনকি রাজার বিরোধিতা করার কোনো অধিকার প্রজার ছিল না। বিরুদ্ধাচারণ শাস্তি যোগ্য অপরাধ ছিল।
একই সঙ্গে, রাজার সম্প্রসারণবাদী মনোভাব, সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষাও কর্তৃত্ববাদের প্রতিফলন হিসেবে লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ- রোমান সাম্রাজ্য, চিনা রাজতন্ত্র ও মধ্যযুগের ইউরোপীয় রাজতন্ত্রের কথা বলা যায়।
কমিউনিজম: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে রাশিয়ায় জারের বিরুদ্ধে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে লেনিনের নেতৃত্বে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে বলশেভিক বিপ্লব (Bolshevik revolution) বা রুশ বিপ্লব (Russian Revolution) সংঘটিত হয়। বিপ্লব শেষে লেনিন-এর নেতৃত্বাধীন লাল ফৌজ (Red Army) জয়লাভ করে এবং তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যেই লেনিন রাশিয়ার কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন এবং কর্তৃত্ববাদের কমিউনিস্ট ধারা সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে। পরবর্তীকালে চিন, উত্তর কোরিয়া কমিউনিস্ট কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়।
বিশ্বযুদ্ধের সংকটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে কর্তৃত্ববাদের উদ্ভব: যুদ্ধ, শিল্পায়ন, বিপ্লব এবং ঔপনিবেশিকতার অবসানের পর বহু দেশ সাংবিধানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের তীব্রতার কারণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এমতাবস্থায়, সম্মোহনী নেতৃত্বের উত্থান এবং তার প্রতি জনগণের আনুগত্য প্রদর্শন কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ প্রশস্ত করে। বিশেষত দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালে হিটলারের অধীনে নাৎসি জার্মানি এবং মুসোলিনির অধীনে ফ্যাসিবাদী ইতালির উত্থানের কথা বলা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে কর্তৃত্ববাদী শাসন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে প্রায়শই সামরিক অভ্যুত্থান বা বৈপ্লবিক আন্দোলনের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থান ঘটতে দেখা গিয়েছিল। যদিও স্পেন, পর্তুগাল, গ্রিসের মতো উন্নত দেশগুলিও এইরূপ শাসনের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করেছিল।
সাম্প্রতিককালের কর্তৃত্ববাদ: বর্তমানকালে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাতে নির্বাচন ব্যবস্থার আড়ালে কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হয়। এরূপ শাসনব্যবস্থাকে প্রতিযোগিতামূলক কর্তৃত্ববাদ বা মিশ্র কর্তৃত্ববাদ বলা হয়ে থাকে। মিশ্র কর্তৃত্ববাদে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল করে দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ বর্তমানে রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন, তুর্কির এরদোগান-এর কথা বলা যায়।
প্রাযুক্তিক কর্তৃত্ববাদ: বর্তমানে উচ্চ আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে আধুনিক কর্তৃত্ববাদী শাসকগণ জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে থাকেন। এক্ষেত্রে শাসক সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরদারি (Surveillance) চালানো, সরকারবিরোধী যে-কোনো তথ্যকে সেন্সর করা, সরকারের বিপক্ষে যে- কোনোরকম প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা (Censor) আরোপ করা, তথ্যের কারচুপি করার মতো ইত্যাদি মাধ্যমকে ব্যবহার করে থাকেন।
২১। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার উদ্ভবের পশ্চাতে মূল কারণগুলি ব্যাখ্যা করো
কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা উদ্ভবের পশ্চাতে কারণসমূহ
কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা উদ্ভবের পশ্চাতে বিবিধ কারণগুলিকে চিহ্নিত করা যায়। এগুলি হল-
রাজনৈতিক অস্থায়িত্ব এবং সংকট: কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা উদ্ভবের প্রধানতম কারণ হল, দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির উদ্ভব। দেশের মধ্যে অভ্যুত্থান, গৃহযুদ্ধ বা গণতন্ত্রে উত্তরণের ব্যর্থ প্রচেষ্টা ইত্যাদি পরিস্থিতিতে কর্তৃত্ববাদী নেতা রাজনৈতিক শৃঙ্খলা এবং স্থায়িত্ব রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে পারে।
সামাজিক মেরুকরণ: কর্তৃত্বপরায়ণ নেতা জাতি, ধর্ম, শ্রেণি ও মতাদর্শভিত্তিক বিভাজনকে বাড়িয়ে তুলে সামাজিক উত্তেজনাকে বৃদ্ধি করে এবং কোনো একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে অন্যদের হুমকির থেকে নিরাপত্তা দানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করার নামে সামাজিক মেরুকরণ ঘটায়। এই মেরুকরণ দ্বারা সৃষ্ট উত্তেজনা দমন করার জন্য অনেকসময় কর্তৃত্ববাদী সরকারের উদ্ভব হয়।
সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক কারক: যেসকল সমাজে পূর্বেই কর্তৃত্ববাদের ইতিহাস রয়েছে অথবা ক্ষমতা একজন শক্তিশালী কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত থাকে, সেই সকল সমাজ কর্তৃত্ববাদী শাসন গড়ে ওঠার জন্য অনুকূল পরিবেশ প্রদান করে। অর্থাৎ কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, শক্তিশালী নেতৃত্বের উদ্ভব ইত্যাদিও কর্তৃত্ববাদের উত্থানে অনুঘটকের কাজ করে থাকে।
অর্থনৈতিক দুর্দশা: দেশে অত্যাধিক বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি এবং দারিদ্র্য, জনমনে অসন্তোষ, ক্ষোভের সঞ্চার করে। বিদ্যমান শাসক বা সরকার আর্থিক উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ হলে জনগণ এমন এক শক্তিশালী নেতার সন্ধান করে, যিনি আর্থিক সমস্যা দূরীকরণে সক্ষম হবে। এরূপ পরিস্থিতিই শক্তিশালী কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের উত্থানে সহায়তা করে।
দুর্বল গণতান্ত্রিক শাসন: দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, আইনের অনুশাসনের অভাব, নির্বাচনে কারচুপি ইত্যাদি গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থাকে ভঙ্গুর করে তোলে। ফলস্বরূপ, সহজেই কর্তৃত্ববাদী নেতারা দুর্নীতি দমন এবং শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন।
বাহ্যিক সমর্থন: অনেকসময় বহিরাগত রাষ্ট্রনেতাদের সমর্থন কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র গঠনের পথকে উৎসাহিত করে। এক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদী শাসক বহিঃরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সাহায্য, সামরিক সহায়তা বা কূটনৈতিক স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে বৈধতা প্রদান ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে।
জাতীয়তাবাদী আবেগের ব্যবস্থার কর্তৃত্ববাদী নেতারা প্রায়শই জাতীয়তাবাদী আবেগকে কাজে লাগিয়ে কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থা স্থাপনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করতে চায়। এরূপ নেতারা নিজেদেরকে জাতির রক্ষক হিসেবে চিত্রিত করে। তারা জনগণকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি প্রদানের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করে থাকেন।
সামরিক সমর্থন: বেশ কিছু ক্ষেত্রে, কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা দেশের সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থনে বা মদতে ক্ষমতা অর্জন করে। এক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় বা সম্ভাব্য হুমকি দমনে সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করতে পারে।
উক্ত কারণগুলি সম্মিলিতভাবে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার উত্থানে ভূমিকা পালন করেছিল।
২২। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা বলতে কী বোঝো? এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
কর্তৃত্ববাদী শাসনববস্থা
কর্তৃত্ববাদ এমন এক মতাদর্শ, যেখানে ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও কর্মকান্ডের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বা কর্তৃপক্ষের প্রতি অন্ধ আনুগত্যকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। চরম ক্ষমতা (Absolute Power)-র উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য করায়ত্ত করা এবং সেই ক্ষমতাকে রক্ষা করাই হল কর্তৃত্ববাদের মূল কথা। রাষ্ট্রের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা যখন কোনো বিশেষ ব্যক্তি, কয়েকজন ব্যক্তি, এলিট গোষ্ঠী বা কোনো রাজনৈতিক দলের হস্তে কুক্ষিগত থাকে, তখন তাকে কর্তৃত্ববাদ বলে।
কর্তৃত্ববাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ
কর্তৃত্ববাদের কতকগুলি নিজস্ব মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
কেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব: কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থাগুলি একজন একক শাসক (স্বৈরশাসক), অভিজাত গোষ্ঠী বা এলিট শাসক, সামরিক জুন্টা বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল দ্বারা পরিচালিত হয় অর্থাৎ যাবতীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত একজন শাসক বা শাসকগোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। *1
সীমিত রাজনৈতিক বহুত্ববাদ: কর্তৃত্ববাদে গণতন্ত্রের মতো বহুদল ও বহুমতের কোনো স্থান নেই। তার পরিবর্তে কর্তৃত্ববাদ সীমিত বহুত্ববাদকে সমর্থন করে। যে সংগঠনগুলি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানায়, কর্তৃত্ববাদে সেই ধরনের রাজনৈতিক বিরোধিতাকে প্রান্তিক করে দেওয়া হয়, অথবা রাজনৈতিক বিরোধিতাকে সহযোজিত করা হয়, নতুবা দমন করা হয়। এমনকি শাসক নিজের ক্ষমতাকে বজায় রাখতে পৌর সমাজ ও বিরোধী দলগুলিকে নিষিদ্ধ করতে পারে এবং নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।
দমনপীড়ন ও নিয়ন্ত্রণ : কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা এবং বিরোধী মতামতকে দমন করার লক্ষ্যে দমনপীড়ন, সেন্সরশিপ, ভীতি প্রদর্শন এবং নজরদারি ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এমনকি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিপক্ষ, কর্মী এবং সাংবাদিকদের প্রায়শই হয়রানি, নিগ্রহ, বিচারবহির্ভূত হত্যা বা হিংসার শিকার হতে হয়। অনেকসময় তাদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও কারাবন্দি করে রাখা হয় বা আইনি নিপীড়ন করা হয়।
নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম: কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় গণমাধ্যম বা মিডিয়া সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকে। এখানে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মতো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে না। জনমত গঠন, শাসনের বিষয়সূচি প্রচার এবং ভিন্নমতের সমালোচনা করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম এবং প্রচারণা (Propaganda)-কে ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদী নেতারা প্রায়শই সেন্সরশিপ, ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন।
দুর্বল আইনের অনুশাসন: কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলিতে আইনি কাঠামো সাধারণত দুর্বল হয় এবং আইনের অনুশাসন প্রায়শই অভিজাত শাসকশ্রেণির স্বার্থের অধীনস্থ হয়। ফলে আইন ও আইনি প্রতিষ্ঠানগুলি ন্যায়বিচার, সাম্য ও মানবাধিকারের নীতিগুলিকে প্রতিষ্ঠা করার পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিপীড়ন করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। কর্তৃত্ববাদী শাসনের কার্যকলাপকে বৈধতা প্রদানের চেষ্টা করে।
সীমিত নাগরিক স্বাধীনতা: কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় সাধারণত নাগরিকদের বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভাসমিতি ও সংঘ গঠনের মতো পৌর অধিকারগুলিকে সংকুচিত করা হয় এবং শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা সমালোচনামূলক অভিব্যক্তির উপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। এক্ষেত্রে শাসনব্যবস্থার স্থায়িত্বের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে এবং জনবিক্ষোভকে সীমিত করতে পারে।
রাজনৈতিক বিরোধিতা অস্বীকৃত: কর্তৃত্ববাদে কোনোরকম রাজনৈতিক বিরোধিতার অধিকার অস্বীকৃত। কর্তৃত্ববাদ অনুসারে, রাজনৈতিক বিরোধিতা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে বিবেচিত হয়। কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ রাজনৈতিক বিরোধিতা করলে, তার বা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় এবং দমন করা হয়।
২৩। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার অন্যতম রূপ হিসেবে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাখ্যা করো
সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ
সামরিক স্বৈরতন্ত্র হল কর্তৃত্ববাদের একটি ধরন। মূলত সামরিক বাহিনীর নেতা বা উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হলে তাকে সামরিক স্বৈরতন্ত্র বলা হয়।
এই শাসনব্যবস্থাকে বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত করা যায়। এগুলি হল-
সামরিক নেতৃত্বের উপস্থিতি: এরূপ শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে সামরিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে পরিচালিত হয়। বিশেষত সামরিক বাহিনীর জেনারেল বা উচ্চপদস্থ সামরিক নেতৃত্বের দ্বারা সরকার পরিচালিত হয়।
বলপ্রয়োগের ব্যবহার: সামরিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও সমাজের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য এবং বিরোধী কণ্ঠস্বর, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের উদ্দেশ্যে শাসক বলপ্রয়োগের উপর নির্ভর করে। এমনকি হিংসার প্রয়োগ করে থাকে। এছাড়াও রাজনৈতিক বিরোধীদের কারারুদ্ধ করে রাখে।
নাগরিকদের পৌর অধিকার দমন: নাগরিকদের বিভিন্ন পৌর স্বাধীনতা যেমন-বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভাসমিতির স্বাধীনতা, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ব্যাপকভাবে সীমিত করা হয়। এরূপ সরকার ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করার উদ্দেশ্যে সামরিক আইন (Martial Law) বা অন্যান্য জরুরি ব্যবস্থা আরোপ করতে পারে।
রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার অভাব: সামরিক কর্তৃত্ববাদে যে-কোনো প্রকার রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা অনুপস্থিত থাকে, কারণ কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাতে অপর কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বই পরিলক্ষিত হয় না। শাসকের আধিপত্য সুনিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনি কারচুপি করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।
আমলাতান্ত্রিক এবং প্রাযুক্তিক প্রশাসন: আমলাতান্ত্রিক এবং প্রযুক্তি প্রশাসনের উপর গুরুত্ব আরোপ-সহ সামরিক শাসনগুলি শৃঙ্খলা ও দক্ষতাকে অধিকমাত্রায় অগ্রাধিকার দেয়।
শাসনব্যবস্থা বৈধকরণ: সামরিক শাসকরা দেশকে ও দেশবাসীকে যাবতীয় বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। প্রায়শই জাতীয় নিরাপত্তার উদ্বেগকে সম্মুখে রেখে নিজেদের শাসনকে ন্যায্যতা ও বৈধতা প্রদান করার চেষ্টা করে। এছাড়াও বেসামরিক সরকারকে দুর্নীতিগ্রস্ত, অযোগ্য ও সংকট মোকাবিলায় অক্ষম বলে দাবি করে, নিজেদের শাসনের বৈধতা সুনিশ্চিত করতে চায়।
অভ্যন্তরীণ দলাদলি: সামরিক শাসনব্যবস্থায় সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন শাখার মধ্যে বা বিভিন্ন শাখার নেতাদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই প্রত্যক্ষ করা যায়, যা অন্তর্কলহ ও দলাদলির সৃষ্টি করে।
উদাহরণ: সামরিক কর্তৃত্ববাদের কয়েকটি উদাহরণ হল-মায়ানমারের সামরিক শাসন (১৯৬২-২০১১ সাল ২০২১ সাল-বর্তমান), চিলিতে জেনারেল অগাস্টো পিনোচ-এর নেতৃত্বাধীন সামরিক অভ্যুত্থান (১৯৭৩ খ্রি.) ইত্যাদি।
তবে পরিশেষে বলা যায়, সামরিক শাসনগুলি নিজেদের বৈধতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের উপর নির্ভর করে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলিকে সমূলে বিনাশ করে। ফলে একদিকে দেশের অভ্যন্তরে যেমন সরকার বিরোধী মত সৃষ্টি হয়, তেমনি অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সমাজও পারস্পরিক শাসনের নিন্দা করে নানান বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, যা সামরিক শাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করে।
২৪। ব্যক্তিকেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করো
ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন হল এমন এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা, যেখানে শাসন, সমাজ এবং অর্থনীতি সকল দিকের উপর একজন নেতার একাধিপত্য স্থাপিত হয়। ফলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তাই এই শাসনব্যবস্থাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদ বলা হয়। একে অনেকে Patrimonialism বলেও অভিহিত করেছেন।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ
এই শাসনব্যবস্থাকে কতকগুলি বৈশিষ্ট্য দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ: এরূপ শাসনব্যবস্থায় একজন ব্যক্তির হাতেই যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। সরকারের বিভিন্ন শাখা, রাজনৈতিক দল অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি শাসকের শাসনকে বৈধতা প্রদানে সচেষ্ট থাকে।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংস্কৃতির উদ্ভব: এইরূপ শাসনব্যবস্থায় নেতাকে অবশ্যই সম্মোহনীমূলক ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হয়। এই সরকারের নেতৃত্বকে অতিমানবীয় (Superhuman) হিসেবে মহিমান্বিত করা হয় এবং নেতার প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যের উপর জোর দেওয়া হয়।
দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান: এরূপ শাসনব্যবস্থায় বিচার বিভাগ, আইনসভা, নির্বাচন সংস্থা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলি সর্বাংশেই রাষ্ট্রনেতার অধীনে থাকে, ফলে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানগুলি নেতার আদেশ-নির্দেশ বাস্তবায়নে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
স্বেচ্ছাচারী নিয়ম প্রণয়ন: এই শাসনব্যবস্থায় যাবতীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত শাসক এককভাবে গ্রহণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে শাসক আইন বা প্রতিষ্ঠানিক নিয়মনীতি মেনে সিদ্ধান্তগ্রহণ করার পরিবর্তে ব্যক্তিগত পছন্দ, ইচ্ছা ও স্বার্থের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তগ্রহণ করে থাকেন।
বিরোধীদের দমন: এরূপ কর্তৃত্ববাদে রাজনৈতিক বিরোধিতার কোনো স্থান নেই। রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং ভিন্নমতকে দমন করার জন্য হিংসা ও সেন্সরশিপের প্রয়োগ করা হয়। বিরোধীদের বিনা বিচারে কারাবন্দি করা হয়। এমনকি রাষ্ট্রনেতা নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকেও কাজে লাগাতে পারে।
অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: কর্তৃত্ববাদী নেতা জাতীয় অর্থনীতির উপর উল্লেখযোগ্যভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। দেশের আর্থিক উন্নয়নের পরিবর্তে নেতা তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য অর্থনৈতিক নীতিগুলিকে বাস্তবায়িত করতে পারেন।
পৃষ্ঠপোষকতা ও দুর্নীতি: নেতারা প্রায়শই আনুগত্য সুনিশ্চিত করতে এবং নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে বিশ্বস্ত অনুগতদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সুবিধা বন্টন করে থাকে এবং পুরস্কার প্রদান করতে পারে। যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণের জন্ম দেয়।
উদাহরণ: ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উন, এ ছাড়া ইরাকের সাদ্দাম হোসেন-এর চরম শাসন বা লিবিয়ায় গাদ্দাফি-এর লৌহ মুষ্ঠির শাসনও উল্লেখযোগ্য।
পরিশেষে উল্লেখ্য, এরূপ শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে নেতার ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব এবং সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। নেতার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় আবশ্যিকভাবে অস্থিতিশীলতা দেখা দেবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
২৫। রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করো
যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়, তখন তাকে রাজতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদ বলে। এই রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মুখ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ-
রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ
বংশানুক্রমিক ব্যবস্থা: রাজতন্ত্রের সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য হল বংশানুক্রমিকভাবে, ঐতিহ্যগতভাবে রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে থেকে একজন বংশগত উত্তরাধিকারসূত্রে রাজা হিসেবে নিযুক্ত হন।
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ: রাজতন্ত্রে সাধারণত রাজার হাতেই শাসনকার্য, আইন প্রণয়ন এবং বিচারকার্য সম্পাদন করার দায়িত্ব এককভাবে ন্যস্ত থাকে। তিনিই প্রকৃতপক্ষে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করেন।
সীমিত রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেহেতু শাসক নির্বাচনের কোনো ব্যাপার নেই, সেহেতু পৃথকভাবে নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার স্বীকৃত হয় না। রাজার বিরোধিতা করার অধিকারও প্রায় নেই বললেই চলে। তাই জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সীমিত সুযোগ পরিলক্ষিত হয়।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ: রাজতন্ত্রে পুলিশ, সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগ-সহ প্রধান প্রধান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি রাজার অনুগত থাকে এবং এই প্রতিষ্ঠানগুলি রাজতন্ত্রের স্থায়িত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
ঐতিহ্য এবং বৈধতা: রাজতন্ত্র অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঐতিহ্যগতভাবে বা ধর্মীয় উৎস থেকে বৈধতা লাভ করে এবং প্রজারা এ কারণেই প্রশ্নাতীতভাবে রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। রাজতন্ত্রে রাজাকে জাতি ও সংস্কৃতির রক্ষক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তথ্যের নিয়ন্ত্রণ: রাজতন্ত্রে গণমাধ্যমের সাহায্যে কেবল রাজার ভাবমূর্তিকে প্রচার করা হয়। এখানে সংবাদপত্র ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাও সীমিত থাকে।
দমনপীড়ন: রাজতন্ত্রে রাজার বিরুদ্ধাচারণ করা বা রাজদ্রোহ গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে রাজার বিরোধিতা করলে হিংসার প্রয়োগ করে তা দমন করা হয়।
এ ছাড়া সম্রাট পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা বজায় রাখতে পারেন।
উদাহরণ: বর্তমানে সৌদি আরব, ব্রুনেই, ওমান প্রভৃতি দেশে রাজতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে সৌদিআরবে রাজা সালমন বিন আব্দুল্লাহজিজ দেশের উপর উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছেন।
তবে পরিশেষে বলা যায়, বর্তমানে বিশ্বের খুব কম সংখ্যক দেশে রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব রয়েছে। আধুনিককালে অধিকাংশ রাজতন্ত্রই সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের রূপ পরিগ্রহ করেছে, ফলে পূর্বের মতো কর্তৃত্ববাদী দমনপীড়ন কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
২৬। মিশ্র কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো
যে রূপে গণতন্ত্রের বৈশিষ্টগুলির সঙ্গে কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্যগুলির সংমিশ্রণ ঘটে তাকে মিশ্র কর্তৃত্ববাদ বলে।
মিশ্র কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ
মিশ্র কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বিবিধ বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
নিয়মিত নির্বাচন: মিশ্র কর্তৃত্ববাদে নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে একাধিক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করতে পারে। তবে নির্বাচন ব্যবস্থা অবাধ ও স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয় না।
সীমিত রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা: বিরোধী দল এবং প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি থাকলেও তাদের উপর আইনি বিধিনিষেধ আরোপিত হয় ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়, যা তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও আচরণকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করে তোলে।
গণমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ: শাসকদল নিজেদের দলীয় মতাদর্শ ও লক্ষ্য প্রচার করার উদ্দেশ্যে গণমাধ্যমকে ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করে, যা গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতাকে ব্যাহত করে।
বিচার বিভাগের উপর প্রভাব: প্রায়শই ক্ষমতাসীন দল স্বার্থরক্ষার জন্য বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে থাকে। শাসনব্যবস্থার ক্রিয়াকলাপকে বৈধতা প্রদান করার জন্য আদালতকে ব্যবহার করে বিরোধী প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণা করতে পারে বা আইনি উপায়ে ভিন্নমত দমন করতে পারে।
পৌর সমাজের উপর বিধিনিষেধ: যেসকল পৌর সংগঠনগুলি সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির ভূমিকা পালন করে, সেই সকল পৌর সংস্থার উপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয় অথবা তাদের কাজকর্মে অযাচিত হস্তক্ষেপ করা হয়।
আন্তর্জাতিক স্তরে গণতন্ত্রের মুখোশ: হাইব্রিড শাসনগুলি আন্তর্জাতিক বৈধতা অর্জন এবং বিদেশি সাহায্য বা বিনিয়োগকে আকর্ষণ করার জন্য গণতন্ত্রের একটি মুখোশ বজায় রাখে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক স্তরে তারা বিভিন্ন সংগঠনে অংশগ্রহণ করে এবং কিছু গণতান্ত্রিক নিয়মকে সমর্থন করে।
দমনপীড়ন ও ভীতি প্রদর্শন: এরূপ শাসনব্যবস্থায় বিরোধীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার, কারাদন্ড প্রদান করার পাশাপাশি তাদের উপর কড়া নজরদারি রাখা হয়। নিরাপত্তা বাহিনী তথা পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা বিরোধীদের ভীতি প্রদর্শন করা হয়।
পৃষ্ঠপোষকতা এবং দুর্নীতি: ক্ষমতাসীন দল প্রায়শই সম্পদ, চাকুরি ও সুযোগসুবিধা বণ্টনের মাধ্যমে সমর্থকদের অনুগত করে রাখতে চায়, যা একদিকে শাসকদের সমর্থনের ভিত্তিকে দৃঢ় করলেও অন্যদিকে শাসনব্যবস্থাকে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে।
উদাহরণ: প্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়া এবং হুগো শ্যাভেজের নেতৃত্বাধীন ভেনিজুয়েলা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
মূল্যায়ন: পরিশেষে বলা যায়, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেই নির্বাচনে কোনো একটি রাজনৈতিক দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সেই দলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। এমতাবস্থায়, বিরোধী দলের দুর্বল অস্তিত্ব এবং নিষ্ক্রিয়তা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের আধিপত্যকে প্রতিরোধ করতে পারে না। উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাবে ক্ষমতাসীন দল চরম কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে।
২৭। গোষ্ঠীকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
গোষ্ঠীকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা
কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় একটি রূপ হল গোষ্ঠীকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা। গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বা অলিগার্কিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলতে বোঝায়, যেখানে একটি ক্ষুদ্র অভিজাত গোষ্ঠীর পরিবার অথবা সংস্থার হাতে যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে। এইরূপ শাসনব্যবস্থা সম্পদ, সামরিক শক্তি, রাজনৈতিক প্রভাব বা সামাজিক মর্যাদা, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ ইত্যাদি একটি ছোটো গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করে।
গোষ্ঠীকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ
গোষ্ঠীকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ: গোষ্ঠীকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের যাবতীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ব্যক্তিগোষ্ঠী বা কোনো অভিজাত পরিবারের হাতে কুক্ষিগত থাকে। ফলস্বরূপ, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জাতীয় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা থেকে দেশের বৃহত্তম অংশ তথা জনগণকে বঞ্চিত করে রাখে।
সম্পদ ও প্রভাবের গুরুত্ব: অর্থনৈতিক সম্পদ এবং সামাজিক প্রভাবের কারণেই অভিজাতগোষ্ঠী ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। সমাজে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তিই কর্তৃত্বের উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন করে এবং জনগণকে অনুগত করে রাখতে সাহায্য করে।
রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার অভাব: অভিজাতগোষ্ঠীগুলি দেশের শাসনব্যবস্থায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার স্বার্থে যে-কোনো রকম রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে দমন করতে শাসকগণ নির্বাচন ব্যবস্থায় কারচুপি, ব্যক্তির রাজনৈতিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, বিরোধীপক্ষকে দমন করা ইত্যাদি কৌশলের প্রয়োগ করে থাকেন।
অন্যান্য এলিট গোষ্ঠীদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক : অভিজাত শাসক বা এলিটরা সমাজের অন্যান্য এলিট গোষ্ঠীর সঙ্গে সামাজিক সংযোগ-সম্পর্ক স্থাপন করে একটি শক্তিশালী সমর্থনের ভিত্তি প্রস্তুত করে, যা তাদের আধিপত্য রক্ষাকে সুদৃঢ় করে তোলে।
সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ: গোষ্ঠীকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সাধারণত অভিজাত শ্রেণি তথা এলিট শ্রেণি জাতীয় সম্পদের উপর একক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে থাকে, যা তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব বজায় রাখার জন্য ব্যবহার করে।
উদাহরণ: প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্র স্পার্টায় এরূপ শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল।
উপসংহার: তবে পরিশেষে বলা যায়, আধুনিককালে অধিকাংশ দেশেই শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি ও রূপ নির্বিশেষে রাজনীতিতে অভিজাত বা এলিট শ্রেণির উপস্থিতি ও প্রাধান্য লক্ষ করা যায়, যার প্রধানতম কারণ হিসেবে অনেকেই অভিজাতদের সামাজিক, আর্থিক প্রভাব ও প্রতিপত্তিকেই চিহ্নিত করেছেন।
২৮। পরোক্ষ সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাখ্যা করো
পরোক্ষ সামরিক শাসন
পরোক্ষ সামরিক শাসন হল এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী সরকার, যেখানে সামরিক বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে শাসনকারী কর্তৃপক্ষ না হলেও রাষ্ট্রের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে।
পরোক্ষ সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্যসমূহ
পরোক্ষ সামরিক শাসনের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
আনুষ্ঠানিক বেসামরিক সরকার: আনুষ্ঠানিকভাবে বেসামরিক সরকার যাবতীয় ক্ষমতা ভোগ করলেও বাস্তবে সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর হাতে কুক্ষিগত থাকে, ফলে জাতীয় নীতি সামরিক বাহিনীর স্বার্থের অনুকূল হয় এমনকি সামরিক স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে পারে এরূপ বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ক্ষমতায় নিয়োগ করা হয়।
জাতীয় নীতিতে সামরিক প্রভাব: জাতীয় নীতি বিশেষত, জাতীয় নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং কূটনৈতিক বা বৈদেশিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
অভিভাবকমূলক ভূমিকা: সামরিক বাহিনী নিজেকে জাতির অভিভাবক হিসেবে তুলে ধরে এবং জাতির নিরাপত্তার স্বার্থে বেসামরিক রাজনৈতিক নেতাদের পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে, যা এরূপ শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
নিরাপত্তা বাহিনীর উপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ: জাতীয় শৃঙ্খলা রক্ষা ও বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করতে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী যথা পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগের উপর সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হয়।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ: সামগ্রিকভাবে না হলেও নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে। যেমন-কোনো রাজনৈতিক নেতার অপসারণের জন্য সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থান, নির্বাচন ব্যবস্থাকে নিজেদের অনুকূলে প্রভাবিত করা ইত্যাদি।
বেসামরিক অভিজাতদের সঙ্গে জোটগঠন: সামরিক বাহিনী তাদের প্রভাব ও বৈধতা বৃদ্ধির জন্য প্রায়শই বড়ো ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা, প্রযুক্তিবিদ বেসামরিক ক্ষেত্রের অভিজাত বা এলিটদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে।
অর্থনৈতিক স্বার্থের সংরক্ষণ: সামরিক বাহিনী দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পদের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে থাকে। যেমন- রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলি মূলত সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হয়।
উদাহরণ: পাকিস্তানে নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও দেশের রাজনীতি সামরিক বাহিনীর অঙ্গুলিহেলনেই পরিচালিত হয়ে থাকে। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, তুরস্কের মতো দেশেও এরূপ সামরিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।
মূল্যায়ন: তবে পরোক্ষ সামরিক শাসন অন্যান্য কর্তৃত্ববাদী রূপ অপেক্ষা জটিল। কারণ, এরূপ শাসনব্যবস্থায় সামরিক বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী না হলেও তারাই প্রকৃত নিয়ন্ত্রকের (De facto) ভূমিকা পালন করে এবং বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেবল পুতুল সরকারে (Puppet Government) পরিণত হয়।
২৯। কর্তৃত্ববাদের সুবিধা বা গুনাবলি আলোচনা করো
কর্তৃত্ববাদের সুবিধা বা গুণ
কর্তৃত্ববাদী সরকার একচেটিয়া ও নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য বহুল সমালোচিত হলেও কর্তৃত্ববাদী সরকারের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে, যেগুলিকে অস্বীকার করা যায় না। যথা-
দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণের সক্ষমতা: দেশে কোনোরকম জরুরি অথবা আপৎকালীন অবস্থা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা সংকটজনক পরিস্থিতি উপস্থিত হলে তা মোকাবিলা করার জন্য কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে সক্ষম। কারণ এরূপ শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা কেবল একজন শাসক বা মুষ্টিমেয় শাসকশ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকায় দ্রুত ও সহজেই সিদ্ধান্তগ্রহণের উপযোগী।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় যেহেতু বিরোধী মতের অস্তিত্ব থাকে না, নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না, সেহেতু দ্রুত এবং ঘনঘন সরকার পরিবর্তনের সুযোগ থাকে না, ফলে এইরূপ শাসনব্যবস্থায় একটি স্থায়ী সরকার গড়ে ওঠে।
দ্রুত আর্থিক উন্নয়ন: কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন একক নেতৃত্বের পরিচালনায় চালিত হয় বলে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক বাধা বা জটিলতা থাকে না। এর ফলে দ্রুত উন্নয়ন ঘটানো এবং রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত প্রকল্পগুলির দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।
সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা: কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী সরকার আইন ও প্রবিধানগুলি (Regulation) কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়। এর ফলে একদিকে যেমন সমাজে সম্ভাব্য অপরাধ হ্রাস করা সম্ভব হয়, তেমনি অন্যদিকে জনশৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হয়।
সুস্পষ্ট দিশা প্রদর্শন: কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার একটি সুস্পষ্ট দিশা বা পথনির্দেশিকা থাকে। এর ফলে বিরোধী দল ও জনমতের বাধা ছাড়াই সহজে উন্নয়নমূলক কাজকর্মের রূপায়ণ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতির বাস্তবায়ন করতে পারে। এ ছাড়াও তারা ধারাবাহিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতির বিষয়সূচি অনুসরণ করতে পারে।
দুর্নীতি হ্রাস: কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় কঠোর দুর্নীতি বিরোধী আইন ও ব্যবস্থা প্রয়োগের মাধ্যমে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি হ্রাস করা সম্ভব হয়।
জাতীয় নিরাপত্তার উপযোগী: কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় বিরোধী মতামত, সরকারের অন্যান্য শাখার অনুমোদন ছাড়াই অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় নিরাপত্তাজনিত হুমকি মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম।
ব্যয়ভার হ্রাস: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মতো কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না বলে নির্বাচনি ব্যয় হ্রাস করা যায়।
উক্ত সুবিধাগুলি সত্ত্বেও কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার দোষগুলিই বেশি। ফলে এই শাসনব্যবস্থা কাম্য নয়।
৩০। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার অসুবিধা বা ত্রুটিগুলি ব্যাখ্যা করো
কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার অসুবিধা বা ত্রুটি
কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার একাধিক ত্রুটি বিদ্যমান। এগুলি হল-
স্বাধীনতার অভাব: কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় জনগণের পৌর ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা যথা-মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমবেত হওয়ার অধিকার ইত্যাদি নাগরিকদের প্রায় থাকে না বললেই চলে। এ ছাড়া এরূপ শাসনব্যবস্থায় ব্যাপক পরিমাণ নাগরিকদের মানবাধিকারও লঙ্ঘিত হয়। বিশেষত, বিরোধী নেতৃবর্গ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক প্রতিবাদীরা বিভিন্ন প্রকার হয়রানি ও ভীতির সম্মুখীন হয়, যা ব্যক্তির জীবনের অধিকারকে লঙ্ঘন করে।
দুর্নীতি: কর্তৃত্ববাদে শাসকের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হয় এবং শাসন সংক্রান্ত কাজকর্মের জন্য জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয় না, যা দুর্নীতির সুযোগকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে। এই দুর্নীতি জনজীবনকে কলুষিত করে এবং জাতীয় অগ্রগতিকে ব্যাহত করে।
স্বৈরাচারের আশঙ্কা: কর্তৃত্ববাদে কোনো বিরোধী দল বা বিরোধী শক্তি কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে না, তাই এই ব্যবস্থায় শাসকের যথেচ্ছভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার আশঙ্কা থাকে।
উদ্ভাবনী ও সৃজনশীলতার অভাব: কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তাভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশকে দমিয়ে রাখার কারণে নাগরিকদের মধ্যে নতুন নতুন উদ্ভাবনীমূলক চিন্তা প্রকাশের ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটার সুযোগ খুবই কম। এরূপ পরিস্থিতি বৈজ্ঞানিক, প্রাযুক্তিক অগ্রগতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করে।
সামাজিক অস্থিরতা: কর্তৃত্ববাদে যেভাবে ভিন্নমতকে দমন করা হয় এবং শাসকের মতকে বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয়, তার ফলে জনগণের মনে অসন্তোষ ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এমনকি জনগণের মধ্যে বৈপ্লবিক চেতনা এবং প্রতিরোধের জন্ম দিতে পারে, যা সামাজিক অস্থিরতা, প্রতিবাদ এমনকি বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করে। এই অস্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক সংহতিকেও ব্যাহত করতে পারে।
গণতান্ত্রিক বৈধতার অভাব: কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা সর্বদা বৈধতা লাভ করে না, যা প্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন ও জনসার্বভৌমিতার নীতিগুলিকে ক্ষুণ্ণ করে। এই শাসনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার অভাব থাকায় কর্তৃত্ববাদ এমন নীতি প্রণয়ন করে, যা জনকল্যাণ অপেক্ষা শাসন টিকিয়ে রাখাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দমন: কর্তৃত্ববাদী শাসনগুলি প্রায়ই সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, ধর্মীয় অনুশীলন এবং ব্যক্তিগত জীবনধারার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়। এই শাসনব্যবস্থা শৈল্পিক অভিব্যক্তি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে দমন করে সাংস্কৃতিক সমসত্ত্বকরণ (Cultural Homogenization)- এর উপর গুরুত্ব দেয়। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের উপর নিষেধাজ্ঞার কারণে সাংস্কৃতিক স্থবিরতার জন্ম দেয়।
উক্ত ত্রুটিগুলি সত্ত্বেও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, জাতীয় নিরাপত্তাবিধানের ও ক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদের উপযোগীতাকে অস্বীকার করা যায় না।
৩১। সর্বগ্রাসীবাদ বা সর্বাত্মকবাদের উদ্ভবের কারণসমূহ ব্যাখ্যা করো
সর্বগ্রাসীবাদ বা সর্বাত্মকবাদের উদ্ভবের কারণসমূহ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্র উদ্ভবের পশ্চাতে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক বিবিধ কারণগুলি পারস্পরিকভাবে জটিল প্রেক্ষাপট রচনা করে দিয়েছিল। সর্বগ্রাসীদের উদ্ভবের কারণগুলি হল-
রাজনৈতিক অস্থায়িত্ব : দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ পরিস্থিতি, রাজনৈতিক উত্তেজনা, অর্থনৈতিক মন্দা, দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি, দুর্নীতি, আইনের শাসনের অভাব জনমনে গণতন্ত্রের প্রতি বিরাগ সৃষ্টি করে, যা সর্বগ্রাসী নেতার উত্থানের পথ প্রশস্ত করে।
রাজনৈতিক মেরুকরণ: সমাজে মতাদর্শ, জাতিসত্তা, ধর্ম বা শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে যে বিভাজন গড়ে ওঠে, সর্বগ্রাসী শাসক নিজের ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করার স্বার্থে এবং যাবতীয় বিরোধী কণ্ঠস্বর ও ভিন্নমতকে দমন করার উদ্দেশ্যে বিভাজনগুলির বৃদ্ধি ঘটিয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটান, যা সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রের উত্থানে সাহায্য করে।
সম্মোহনী নেতৃত্ব: সর্বগ্রাসী শাসনগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদ্যমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের অক্ষমতার কারণে জন্ম লাভ করে। এক্ষেত্রে একজন সম্মোহনী নেতৃত্বের আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে ওঠে, যিনি জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে দেশের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার, জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দিয়ে কাল্পনিক শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখায়। এরূপ সম্মোহনী নেতার অধীনেই সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্র আবির্ভূত হয়।
সর্বগ্রাসী মতাদর্শ : সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র উদ্ভবের পশ্চাতে কারণ হল একটি শক্তিশালী সর্বগ্রাসী মতাদর্শের অনুপ্রেরণা। সর্বগ্রাসী শাসনব্যবস্থায় একটি অনমনীয় কঠোর মতাদর্শ দ্বারা জনগণকে প্রভাবিত করা হয় এবং তাদের অনুগত করে রেখে ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র গড়ে তোলা হয়, যার লক্ষ্য বহিঃশত্রু বা হুমকিকে নির্মূল করা। রাষ্ট্রীয় আধিপত্য, মতাদর্শগত বিশুদ্ধতা এবং জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বকে প্রচার করা হয়।
পরিচিতির রাজনীতি: সর্বাত্মকবাদী নেতারা জনগণকে একত্রিত করা এবং স্বৈরাচারী কার্যকে ন্যায্যতা প্রদান করার উদ্দেশ্যে জাতীয়তাবাদী অনুভূতি এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
বিস্তারবাদী মানাভাব: কর্তৃত্বশালী নেতার সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা সর্বাত্মকবাদী শাসনব্যবস্থার উদ্ভবের পথ প্রশস্ত করে।
বাহ্যিক সমর্থন: অনেকসময় সর্বগ্রাসী শাসক বহিঃরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সাহায্য, সামরিক সহায়তা বা কূটনৈতিক স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমে সর্বগ্রাসী শাসনকে বৈধতা প্রদান করতে পারে।
ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার: যেসকল দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, সেই সকল দেশে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের উদ্ভবের সম্ভাবনা সবথেকে বেশি থাকে। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবিধ সময় সর্বাত্মক রাষ্ট্র গড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।
তবে বাস্তব বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে বলা যায়, সর্বগ্রাসীবাদের উত্থানে কেবলমাত্র একটি কারণ এককভাব ভূমিকা পালন করে না, বরং একাধিক কারণ একত্রিতভাবে ভূমিকা পালন থাকে।
৩২। সর্বগ্রাসীবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
সর্বগ্রাসীবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ
সর্বগ্রাসীবাদী সরকার বা শাসনব্যবস্থার কতকগুলি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলি হল
সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা : সর্বগ্রাসীবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ। শুধুমাত্র আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ নয় বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের ব্যক্তিগত জীবন বা সমাজজীবনকেও নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা, মতপ্রকাশ, ধর্মাচরণ জীবনযাপন সবকিছুই ব্যাহত হয়। এখানে রাষ্ট্রই হল জনগণের বিবেকস্বরূপ। তাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
আইনের অনুশাসালের অনুপস্থিতি: সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রে শাসকের নির্দেশই আইন ফলে আইনের অনুশাসনের উপস্থিতি অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এইরূপ শাসনব্যবস্থা দমনপীড়নের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।
রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি: সর্বগ্রাসীবাদে রাষ্ট্রের অবস্থান ব্যক্তির আগে। এখানে রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি, ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়। এজন্যই সর্বগ্রাসীবাদে বা ব্যক্তিস্বাধীনতা অনুপস্থিত এবং রাষ্ট্রই ব্যক্তির ভালো-মন্দের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুপস্থিতি: সর্বাত্মকবাদ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং কোনোরকম গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি দেয় না। এ কারণেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই জনগণ দেশের রাজনৈতিক কার্যে বা শাসনকার্যে অংশ নিতে পারে না। জনগণ কোনোরূপ ভোটাধিকারের ক্ষমতা ভোগ করে না।
নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম: সর্বগ্রাসীবাদে গণমাধ্যম অর্থাৎ সংবাদপত্র, টেলিভিশন, ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়ার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। পরিবর্তে গণমাধ্যম সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় অধীনে থেকে কাজ করে। এরূপ শাসনব্যবস্থায় গণমাধ্যমের প্রধান কাজ হল শাসকের সপক্ষে মতপ্রচার করা।
পুলিশি নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস: সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্র জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র নয়। বরং এখানে পুলিশি রাষ্ট্র গঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এখানে বিরোধীদের দমন এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, জনগণের উপর নজরদারি চালানোর জন্য গুপ্তচর বাহিনী নিয়োগ, ভীতি প্রদর্শন করা হয় এবং গুপ্তচর বাহিনীর রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্বিচারে গ্রেপ্তার, আটক, নির্যাতন, দমনপীড়ন ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপ চালানো হয়।
অতিমানব তত্ত্ব: সর্বগ্রাসীবাদে রাষ্ট্রনায়কের এমন এক ভাবমূর্তি তৈরি করা হয় যেন তিনি সাধারণ মানব নয়, একজন অতিমানব। তিনি কোনো ভুল করতে পারেন না, তিনিই সমগ্র জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা। তাকে দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব এবং জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে চিত্রিত করা হয়। ইতালিতে মুসোলিনি, জার্মানিতে হিটলারের এমন অতিমানব ভাবমূর্তি গড়ে তোলা হয়েছিল। সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্র অনেকাংশেই নেতৃত্বের ‘Personality Cult’-এর উপর নির্ভর করে।
অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ: অধিকাংশ সর্বগ্রাসী শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, কৃষির সমষ্টিকরণ, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত শিল্প স্থাপন ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
একদলীয় শাসনব্যবস্থা: সর্বাত্মকবাদী শাসনব্যবস্থায় শাসক দল ছাড়া অন্য কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের অথবা বিরোধী কণ্ঠস্বরের অস্তিত্ব থাকে না। এক্ষেত্রে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের ক্ষমতাশালী নেতৃত্ব শাসকবিরোধী শক্তিকে মুছে ফেলতে নির্বিচারে গ্রেপ্তার, গুপ্তহত্যা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ হিটলারের নাৎসি জার্মানির কথা বলা যায়।
সহিংসতা: এইরূপ রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রপরিচালনা করতে গিয়ে স্বৈরাচারী শাসক ভিন্ন ও বিরুদ্ধ মতামত প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে হিংসা প্রয়োগ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। উপরন্তু রাষ্ট্রের এই সহিংস ক্রিয়াকলাপকে ন্যায়সংগত ও বৈধ বলে প্রতিপন্ন করতে চায়। স্বৈরাচারী শাসক রাষ্ট্রীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে হিংসার আশ্রয় নেওয়ার মধ্যে কোনো অন্যায় দেখে না। যেমন-হিটলারের নাৎসি জার্মানিতে এবং স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে যথাক্রমে ইহুদি এবং কুলাক (রাশিয়ান ধনী কৃষক)-দের উপর নির্বিচারে দমনপীড়ন চালানো হয় এবং তাদের হত্যা করা হয়।
আদর্শগত শুদ্ধতা: সর্বগ্রাসী শাসনব্যবস্থা একটি সর্বব্যাপী ও অনমনীয় মতাদর্শ গড়ে তোলা ও প্রচারের উপর গুরুত্ব আরোপ করে, যা রাষ্ট্রীয় নীতি এবং সামাজিক নিয়মের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। শক্তিশালী জনমত গঠন করতে এবং জনগণের আনুগত্য সুনিশ্চিত করতে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার মাধ্যমে আদর্শকে প্রচার করা হয়।
কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ: রাষ্ট্র বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনী, শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যম এবং অর্থনীতি-সহ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের উপর কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করে।
গণসংহতি থাপন: সর্বগ্রাসী শাসনব্যবস্থায় শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে সমগ্র দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। এক্ষেত্রে যুব সম্প্রদায়, শ্রমিক সংগঠন এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের মতো গণসংগঠনগুলিকে অনুগত করে রেখে গণসংহতি স্থাপনের ও আনুগত্য বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়।
৩৩। ফ্যাসিবাদী সর্বাত্মকবাদ কাকে বলে? ফ্যাসিবাদী সর্বাত্মকবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাখ্যা করো
ফ্যাসিবাদী সর্বাত্মকবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ
ফ্যাসিবাদ একটি অতি-জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শ, যা একজন স্বৈরী নেতা ও তাঁর কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে এগুলি হল-
অনমনীয় মতাদর্শ: ফ্যাসিবাদ সর্বদা উগ্র জাতীয়তাদের উপর গুরুত্ব আরোপ করে রাষ্ট্রীয় বা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এক্ষেত্রে শাসক জাতিগত বিশুদ্ধতার ধারণা প্রচার করে থাকেন। যেমন- হিটলার-এর নাৎসি দলের কথা বলা যায়। নাৎসি দল জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে জার্মান জাতির বিশুদ্ধ রক্তের তত্ত্ব প্রচার করে বলেছিলেন, জার্মানরা হল আর্য জাতিভুক্ত। তারাই বিশুদ্ধ রক্তের অধিকারী, তাই জার্মান হল শ্রেষ্ঠ জাতি।
নেতৃত্ব: সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র সর্বদা একজন ক্ষমতাশালী সম্মোহনী নেতার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে। এরূপ শাসনব্যবস্থায় দেশের নেতার হাতেই যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে এবং তিনিই দেশের মানুষের বিশ্বাস, মতাদর্শ, শিক্ষা ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: ফ্যাসিবাদী সরকার সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে, যাবতীয় শিল্প রাষ্ট্রের অধীনে গড়ে ওঠে, ব্যক্তিগত উদ্যোগকে সীমিত করে রাখা হয়, কৃষিক্ষেত্রে সমষ্টিকরণে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং দেশের যাবতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা শাসকের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে।
প্রচারণা এবং সেন্সরশিপ: সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রে শাসক, দেশের সকল গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়াকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেন্সরশিপ আরোপ করে। রাষ্ট্রীয় শাসককে মহিমান্বিত করার জন্য গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে, পাশাপাশি ভিন্নমতের প্রচারণা রোধ করে সরকার জনমত ও জনআচরণকে প্রভাবিত করে।
দমনপীড়ন: রাষ্ট্র বিরোধীদের নির্মূল করার জন্য এবং দমন করার জন্য গোপনে পুলিশি অত্যাচার চালায়, এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়। মিথ্যা মামলায় বিরোধী মত প্রকাশকারীদের কারাবন্দি করে রাখা, শারীরিক অত্যাচার করা, গণমৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। যেমন-নাৎসিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প (Concentration Camp)-এর কথা বলা যায়, যেখানে ইহুদিদের আটক করে শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জার্মানিতে হিটলার-এর গুপ্তচর বাহিনীর নাম ছিল গেস্টাপো এবং ইতালিতে মুসোলিনি-র নেতৃত্বাধীন গুপ্তচর বাহিনীর নাম ছিল কালো কুর্তা।
৩৪। কমিউনিস্ট সর্বাত্মকবাদের সংজ্ঞা দাও। কমিউনিস্ট সর্বাত্মকবাদের বৈশিষ্টাগুলি আলোচনা করো
কমিউনিস্ট সর্বাত্মকবাদ
কমিউনিস্ট সর্বাত্মকবাদ মূলত কমিউনিস্ট দলের নেতৃত্বে স্থাপিত হয়। যে রাষ্ট্রে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট দল দেশব্যাপী একাধিপত্য স্থাপন করে, তাকেই এককথায় কমিউনিস্ট সর্বাত্মকবাদ বলা হয়।
কমিউনিস্ট সর্বাত্মকবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ
কমিউনিস্ট সর্বাত্মকবাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলি আলোচ্য-
মার্কসীয় মতাদর্শ: কমিউনিস্ট সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্র মার্কসবাদী- লেনিনবাদী নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, যার মূল লক্ষ্য হল ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপসাধনের মাধ্যমে শ্রেণিহীন, রাষ্ট্রহীন সমাজ গঠন করা।
নেতৃত্ব: এইরূপ শাসনব্যবস্থায় সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্ব (Dictatorship of the Proletariet) প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপিত হয়। সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কমিউনিস্ট দল নেতৃত্বদান করে এবং কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ভোগ করে।
অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থায় উৎপাদনের সকল উপকরণের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। অর্থাৎ, উৎপাদনের উপকরণগুলি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন এবং যাবতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলি কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রহণ করা হয়। ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার মতোই এই শাসনব্যবস্থাতেও ব্যক্তিগত শিল্পোদ্যোগের কোনো স্থান নেই।
প্রচারণা ও সেন্সরশিপ: কমিউনিস্ট আদর্শকে প্রচার করার উদ্দেশ্যে এবং নেতৃত্বের ভাবমূর্তিকে গৌরবান্বিত করার জন্য ব্যাপকভাবে প্রচারণা ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে সরকারি গণমাধ্যম কেবলমাত্র কমিউনিস্ট দলের সপক্ষে প্রচার করে। শাসকদল বিরোধী কোনো তথ্য বা সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে কঠোর সেন্সর ব্যবস্থা আরোপ করা হয়। ফলে ভিন্নমত বা বিরোধী মতের কোনো স্থান থাকে না।
দমনপীড়ন: রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য গণনজরদারির ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি বলপূর্বক শ্রমশিবির (Forced Labor Camps) গড়ে তোলা হয়। বিরোধী রাজনৈতিক মতামতের কোনো স্থান থাকে না। বিরোধীদের উপর মানসিক ও শারীরিক নিপীড়ন, নির্যাতন চালানো হয়।
উদাহরণ: জোসেফ স্তালিন-এর নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯২২-১৯৫২ খ্রি.), মাও জে দং-এর নেতৃত্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী চিন (১৯৪৯-১৯৭৬ খ্রি.) এবং কিম জং উন-এর নেতৃত্বাধীন উত্তর কোরিয়া (২০১১ খ্রি. – বর্তমান) কমিউনিস্ট সর্বগ্রাসীবাদের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
৩৫। ধর্মভিত্তিক সর্বাত্মকবাদ কী? এর বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করো
ধর্মভিত্তিক সর্বাত্মকবাদ
ধর্মভিত্তিক সর্বাত্মকবাদ মূলত ধর্মীয় মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। গ্রিক শব্দ ‘Theocracy’ শব্দটির অর্থ হল ঈশ্বরের শাসন বা ‘Government by God.’ এই শাসনব্যবস্থায় ঈশ্বরকেই কর্তৃত্বের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শাসকগণ মূলত ধর্মের নামে সমাজ ও রাজনীতিতে যে আধিপত্য বিস্তার করে থাকে তাকেই এককথায় ধর্মভিত্তিক সর্বাত্মকবাদ বা ধর্মীয় সর্বগ্রাসীবাদ বলা হয়।
ধর্মভিত্তিক সর্বাত্মকবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ
ধর্মভিত্তিক সর্বাত্মকবাদী নমস্কার শাসনব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করে এর কতকগুলি বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করা যায়। এগুলি হল-
মতাদর্শগত প্রভাব: এইরূপ শাসনব্যবস্থায় সরকার মূলত ধর্মীয় আইন (Religious Law) ও নীতি (Principles)-এর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। অর্থাৎ, এটি এমন একটি সরকার বা শাসনব্যবস্থা, যা সরাসরিভাবে ধর্ম থেকে নিজের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং ধর্মগ্রন্থের উপর ভিত্তি করে আইন প্রণয়ন করে। মূলত ইসলামিক দেশে শরিয়ৎ আইনের কথা বলা যায়, যা ইসলামিক ধর্মগ্রন্থ কোরান (Quran)-এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
নেতৃত্ব: ধর্মীয় সর্বগ্রাসীবাদে ধর্মীয় নেতারাই যাবতীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখেন এবং তারা নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি বা দূত বলে প্রচার করে, ঐশ্বরিক কর্তৃত্ব দাবি করেন।
অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: ধর্মীয় সর্বাত্মকবাদে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি পরিলক্ষিত হয় না ঠিকই তবে, ধর্মের নামে রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ জনগণের উপর নানান কর আরোপ করে এবং কর আদায়ের মাধ্যমে আর্থিক শোষণ কায়েম করে।
প্রচারণা ও সেন্সরশিপ: এইরূপ শাসনব্যবস্থায় মূলত প্রাধান্যকারী ধর্মের প্রচার করা হয় এবং বিরোধী যে-কোনো ধর্মমতকে দমন করা হয়। ধর্মীয় সর্বগ্রাসীবাদে জনগণের কোনো ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার স্বীকৃত থাকে না। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ করা বা ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠান পালনের কোনো অধিকার প্রদান করা হয় না।
দমনপীড়ন: ভিন্ন ধর্মীবলম্বীদের উপর এইরূপ সরকার ব্যাপক দমনপীড়ন চালায় এবং বলপূর্বক সকলের উপর ধর্মীয় আইন প্রয়োগ করে।
উদাহরণ: আফগানিস্তানে সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী তালিবানের শাসন, ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেইনির ইসলামিক রিপাবলিকের শাসন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
৩৬। সর্বগ্রাসীবাদের সুবিধা বা গুণাবলি আলোচনা করো
সর্বগ্রাসীবাদের সুবিধা বা গুণ
সর্বগ্রাসীবাদী সরকার সমাজের উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করে এবং সরকারি ও ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি দিকের উপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। এই শাসনব্যবস্থার কতকগুলি সুবিধা বা গুণ হল-
দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ ও রূপায়ণের উপযোগী: সর্বগ্রাসীবাদী রাষ্ট্রে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকার ফলে সরকারি নীতি প্রণয়ন, কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় কোনো বিলম্ব হয় না। ফলে দ্রুত প্রশাসনিক সমস্যার নিষ্পত্তি, সংকট বা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য কোনোরূপ বিতর্ক বা সমঝোতা ছাড়াই ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় এবং সেই ব্যবস্থা বা সিদ্ধান্তকে দ্রুত বাস্তবায়িত করা যায়।
সংকটকালীন সময়ের উপযোগী: সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেহেতু সর্বাত্মক রাষ্ট্রনায়কের একক সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, সেহেতু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ অথবা বৈদেশিক আক্রমণ ইত্যাদি সংকটকালীন সময়ে রাষ্ট্রনায়ক সমস্যা সমাধানে জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেন।
আর্থিক বিকাশে সহায়ক: সারা দেশের জন্য একক কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকার ফলে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রে শাসক এককভাবে উন্নয়নমূলক কর্মসূচির পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। এক্ষেত্রে প্রাযুক্তিক উন্নয়ন, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন, বলপূর্বক কৃষির সমষ্টিকরণের মাধ্যমে দ্রুত আর্থিক বিকাশের পথকে ত্বরান্বিত করে। উদাহরণস্বরূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়নে এরূপ নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি গড়ে তুলেছিলেন।
একক কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ: সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের প্রশাসনে সমগ্র দেশে একক কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার ক্ষীণ উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। এমতাবস্থায় প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড রূপায়ণের পথ মসৃণ হয় ও সুষ্ঠু কার্যসম্পাদন সম্ভব হয়।
সামাজিক শৃঙ্খলা ও কাঠার অনুশাসন: সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ লক্ষ করা যায় বলে এরূপ সমাজব্যবস্থায় সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা যায় না। এজন্যই সর্বগ্রাসী শাসনব্যবস্থায় একটি স্থিতিশীল এবং অনুমানযোগ্য সমাজ গড়ে তোলা যায়।
জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় উপাযাগী: সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রকে শ্রেষ্ঠ ও সর্বাত্মক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলে ধরা হয়। সর্বাত্মকবাদে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রনেতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শক্তিশালী মতাদর্শ গড়ে তোলা হয়, যার মাধ্যমে রাজনৈতিক অচলাবস্থা, দলাদলি এবং বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্য স্থাপনের পথ সুগম করা যায়।
জাতীয় নিরাপত্তার উপযোগী: জাতীয় নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সর্বাত্মকবাদী শাসনব্যবস্থা উপযুক্ত। কারণ শাসক সহজেই জাতীয় প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তার স্বার্থে তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ, জাতীয় সম্পদ এবং জাতীয় জনসমাজকে একত্রীকরণ এবং বিদ্রোহ ও গুপ্তচরবৃত্তিকে প্রতিরোধ করতে পারেন।
সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচিগ্রহণ: সর্বনিয়ন্ত্রণবাদে রাষ্ট্র শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং জনকল্যাণের লক্ষ্যে ব্যাপক সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে এবং সম্পদ বণ্টনকে সুনিশ্চিত করতে পারে।
উক্ত গুণগুলি আলোচনা সত্ত্বেও বলা যায় এরূপ শাসনব্যবস্থা ব্যক্তিস্বাধীনতা বিরোধী তাই, বিবিধ গুণ থাকলেও এই ব্যবস্থা কাম্য নয়।
৩৭। সর্বগ্রাসীবাদের অসুবিধা বা ত্রুটিগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো
সর্বগ্রাসীবাদের অসুবিধা বা ত্রুটি
সর্বগ্রাসীবাদের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দোষ বা ত্রুটি রয়েছে। এগুলি হল-
ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী: সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রে ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বাধীনতার স্থান খুবই সীমিত। রাষ্ট্রনেতা ব্যক্তিদের সার্বিক পৌর, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ও স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রিত করে। যেমন-ব্যক্তির বাক্ ও মতামত প্রকাশ, সমাবেশ, ধর্মাচরণ, রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ-সহ জীবনের বেশিরভাগ দিক নিয়ন্ত্রণ করে।
অগণতান্ত্রিক : সর্বনিয়ন্ত্রণবাদ গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি মতাদর্শ। গণতন্ত্র জনগণের শাসনের উপর গুরুত্ব দেয়, কিন্তু সর্বনিয়ন্ত্রণবাদ ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। সর্বগ্রাসী শাসনব্যবস্থায় কেবলমাত্র শাসক স্বাধীন এবং দেশের নাগরিকরা শাসকের অধীনস্ত। জনগণের মতামতের কোনো গুরুত্ব সর্বগ্রাসীবাদে দেওয়া হয় না।*1
একদলীয় প্রাধান্য: সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রে একদলীয় ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে। একটি রাজনৈতিক দলই সার্বিকভাবে যাবতীয় রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করে। এর ফলে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষার বিস্তার ঘটে না। একক দলের যাবতীয় সিদ্ধান্ত জনগণকে বিনা বাধায় মেনে নিতে হয়।
ব্যক্তি পরিসরে রাষ্ট্রের প্রবেশ: সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের সবথেকে বড়ো ত্রুটি হল ব্যক্তির ব্যক্তিগত পরিসরে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র বলার প্রধানতম কারণই হল ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ চিন্তা, উদ্যোগ, বিশ্বাস, মতামত, জীবনধারা সবকিছুকেই রাষ্ট্র গ্রাস করে, যা ব্যক্তির জন্য এক দমবন্ধ করা পরিবেশ গড়ে তোলে।
সৃজনশীলসত্তার বিরোধী: সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রে শিল্পকলা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছুই যেহেতু রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাই শিল্প সাহিত্যকেও রাষ্ট্রসর্বস্ব করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। ফলে এই শাসনব্যবস্থা উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার শত্রু।
নজরদারি ও সেন্সরশিপ: শাসক গণমাধ্যমের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে এবং তথ্য প্রচারের উপর ক্রমাগত নজরদারি চালায়। শুধু তাই নয়, শাসক গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে বিরোধী বা ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ করে এবং আত্মগৌরব প্রচার করার মাধ্যমে ক্ষমতাকে ধরে রাখতে চায়।
দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতার অভাব: এই শাসনব্যবস্থায় নাগরিকদের তথ্য জানার অধিকারকে স্বীকার করা হয় না, ফলে প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধহীনতাও এই শাসনব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি।
অর্থনৈতিক স্থবিরতা সৃষ্টি: কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনেকসময় অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। কারণ উদ্ভাবনীমূলক অর্থনীতি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রায় থাকে না বললেই চলে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন: সর্বগ্রাসী শাসনব্যবস্থা ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য পরিচিত। কারণ এই শাসনব্যবস্থায় অত্যাচার, দমনপীড়ন, বিনা বিচারে কারাদণ্ডের পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিশেষ করে ভিন্নমতাবলম্বী, সংখ্যালঘু এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এগুলির সম্মুখীন হয়।
ক্ষমতার অপব্যবহার: সর্বাত্মকবাদী ব্যবস্থায় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকায় শাসক জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা ছাড়াই অবাধ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে এবং শাসক এরূপ অবাধ ক্ষমতা অপব্যবহার করে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে।
আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা: রাষ্ট্রশাসকের স্বৈরী ও আগ্রাসী মনোভাবের কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রগুলিকে অধিকাংশ সময়ে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সহযোগিতা হ্রাস করা হয়।
উক্ত ত্রুটিগুলি আলোচনা সত্ত্বেও বলা যায় জরুরি ও আপতকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
Read More – Class 11 history suggestion 2nd Semester