জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর (Marks 4) একাদশ শ্রেণি | XI 2nd Semester

সূচিপত্র

জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর (Marks 4) একাদশ শ্রেণি | XI 2nd Semester

জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর
জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর

১। জাতীয় জনসমাজ কাকে বলে?

জাতীয় জনসমাজ: জাতীয় জনসমাজ কথাটি এসেছে ইংরেজি শব্দ ন্যাশনালিটি (Nationality) থেকে। এটি হল জনসমাজ এবং জাতির মধ্যবর্তী পর্যায়। জাতীয় জনসমাজ জনসমাজেরই একটি উন্নত স্তর। যখন কোনো জনসমষ্টির – মধ্যে গভীর স্বাতন্ত্র্যবোধ দেখা দেয় এবং সেই জনগোষ্ঠী, অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বলে মনে করে, তখন তাকে জাতীয় জনসমাজ বলে। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী জাতীয় জনসমাজের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন, যা নিম্নে আলোচনা করা হল-

[1] গার্নার: গার্নার-এর মতে, কুল বা বংশগত অথবা অন্যান্য ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ জনসমষ্টিই হল জাতীয় জনসমাজ।

[2] লর্ড ব্রাইস: লর্ড ব্রাইস জাতীয় জনসমাজকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “জাতীয় জনসমাজ হল ভাষা, সাহিত্য, ভাবধারা, রীতিনীতি প্রভৃতির দ্বারা যুগ-যুগান্তরের বন্ধনে আবদ্ধ এমন একটি জনসমাজ যারা অনুরূপভাবে ঐক্যবদ্ধ অপরাপর জনসমষ্টি থেকে নিজেদেরকে পৃথক বলে মনে করে”।

[3] ল্যাস্কি : ল্যাস্কি-র ভাষায় বলা যায়, সীমিত ও পরিমাণগত উপাদানের উপর ভিত্তি করে যেহেতু জাতীয় জনসমাজকে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়, তাই জাতীয় জনসমাজের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা প্রদান করাও সম্ভব নয়।

[4] জিমার্ন: জিমার্ন-এর মতে, জাতীয় জনসমাজ হল এমন একটি ধারণা যা ধর্মের ন্যায় আধ্যাত্মিক আবার চিন্তা, অনুভূতি ও জীবনধারণের জন্য স্বাভাবিক।

[5] কোকার: কোকার জাতীয় জনসমাজকে মূলত অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি ফল রূপে বর্ণনা করেছেন।*

মূল্যায়ন: তাই উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত জনসমষ্টিকে জাতীয় জনসমাজ বলে আখ্যায়িত করা যায়, যারা জাতিগত, ধর্মগত, বংশগত, ভাষাগত, সংস্কৃতিগতভাবে অভিন্ন হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকেও সমভাবে ঐক্যবদ্ধ।

২। জাতীয় জনসমাজের উপাদানগুলি আলোচনা করো।

অথবা, জাতীয় জনসমাজের উৎপত্তির প্রধান উপাদানসমূহ আলোচনা করো।

অথবা, জাতীয় জনসমাজের বাহ্যিক ও ভাবগত উপাদানের উল্লেখ করো।

জাতীয় জনসমাজের উপাদানসমূহ

জনসমাজকে জাতীয় জনসমাজে পরিণত করার পশ্চাতে যে উপাদানগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেগুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা- বস্তুগত বা বাহ্যিক উপাদানসমূহ এবং ভাবগত উপাদানসমূহ।

[1] বস্তুগত বা বাহ্যিক উপাদানসমূহ

উল্লেখযোগ্য বাহ্যিক উপাদানগুলি হল-

(i) ভৌগোলিক ঐক্য

একই ভৌগোলিক ভূখণ্ডে দীর্ঘদিন ধরে বেশ কিছুসংখ্যক মানুষ বসবাস করার ফলে তাকে ঘিরে জনসমাজের মধ্যে একটি গভীর একাত্মবোধ গড়ে ওঠে। এই ভৌগোলিক ঐক্য (Geographical Unity) সেই জনসমাজকে প্রথমে জাতীয় জনসমাজে এবং পরে জাতিতে রূপান্তরিত করে তাদের মধ্যে স্বদেশপ্রেম সঞ্চারিত করে।*।

(ⅱ) বংশগত ঐক্য

জাতীয় জনসমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বংশগত বা কুলগত ঐক্যের (Racial Unity) উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কোনো সংঘবদ্ধ জনসমষ্টি যখন নিজেদেরকে একই পূর্বপুরুষের বংশধর বলে মনে করে, তখন তাদের মধ্যে সুদৃঢ় একাত্মবোধ ও স্বজনপ্রীতির মনোভাব লক্ষ করা যায়।

(iii) ভাষাগত ঐক্য

জাতীয় জনসমাজ গঠনে ভাষাগত ঐক্য (Linguistic Unity) একটি অপরিহার্য উপাদান। ভাষার মধ্য দিয়েই মানুষ একে অপরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে। তাই জার্মান দার্শনিক ফিক্টের মতানুসারে জাতীয় ঐক্য উদ্ভবের অন্যতম প্রধান উপাদান হল ভাষা, যা জাতির সাহিত্য, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।*3

(iv) ধর্মীয় ঐক্য

ধর্মীয় ঐক্য (Religious Unity)-এর ভিত্তিতে তথা একই ধর্মাবলম্বী জনগণ নিজেদের বিশ্বাসের ঐক্যে খুব সহজেই পরস্পরের নিকট এসে একাত্মতা লাভ করতে পারে, যা জাতীয় জননসমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(v) রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা

জাতীয় জনসমাজ গঠনে সম রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার (Common Political Aspiration) বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। জাতীয় জনসমাজ হল সেই গোষ্ঠী, যা একই আইনের অধীনে বসবাস করার ইচ্ছায় রাষ্ট্র গঠন করে। জাতীয় জনসমাজ একদিকে যেমন রাষ্ট্র গঠনে প্রেরণা জোগায়, তেমনই রাষ্ট্রীয় সংগঠনও জাতি গঠনে সহায়তা করে।

(vi) অর্থনৈতিক সমস্বার্থ

অর্থনৈতিক সমস্বার্থ হল জাতীয় জনসমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান উপাদান। সমজাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ (Common Economic Interest)-এর মাধ্যমেই কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে ঐক্যের পরিবেশ গড়ে ওঠে। এটি ছাড়া একটি জাতির বিভিন্ন অংশের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

[2] ভাবগত উপাদানসমূহ

জাতীয় জনসমাজ গঠনে ভাবগত উপাদানের গুরুত্বকে প্রায় সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্বীকার করে নিয়েছেন।* ভাবগত উপাদান প্রধানত দুটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল, যথা- অতীতের স্মৃতি এবং ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার আকাঙ্ক্ষা। এক্ষেত্রে মার্কসবাদীরা ভাবগত উপাদানকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন না, কারণ তাঁদের মতে, বাহ্যিক উপাদানগুলির অভাব ঘটলে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠা সম্ভব হবে না।

উপসংহার: উপরোক্ত আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, বাহ্যিক উপাদানগুলি থাকুক বা না থাকুক- এই ভাবগত উপাদানই একটি জনসমাজকে জাতীয় জনসমাজে উত্তীর্ণ করতে পারে।

৩। জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ

উদ্ভব: র‍্যামসে ম্যুর-এর মতে, জাতীয়তাবাদের অনুভূতি সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে লক্ষ করা যায়। এরপর চতুর্দশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদের ধারণা পরোক্ষ ও অস্পষ্ট ছিল। অন্যদিকে ষোড়শ শতাব্দীতে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি ইতালির জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ধারণা সঞ্চারিত করার চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। তা সত্ত্বেও অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীকে জাতীয়তাবাদের সুবর্ণযুগ বলে চিহ্নিত করা হয়।

বিকাশ: জাতীয়তাবাদের বিকাশে বেশ কিছু পর্যায় লক্ষ্য করা যায়, যা হল নিম্নরূপ-

(i) মধ্যযুগ ও নবজাগরণের অধ্যায়ে জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত

মধ্যযুগীয় সমাজজীবনে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে শক্তিশালী রাজ্যকে কেন্দ্র করে জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়। এই অবস্থায় ইউরোপে নবজাগরণের ঢেউ আছড়ে পড়ে, যার আলোকে সুস্পষ্ট জাতীয় চেতনার উদ্ভব ঘটে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্নস-এর মতে, ইউরোপে নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলনের সময়ে জাতীয়তাবাদের ধারণাটির উৎপত্তি ঘটে।*1

(ii) পোল্যান্ডের বিভক্তিকরণ, ফরাসি বিপ্লব ও জাতীয়তাবাদ

পোল্যান্ডের বিভক্তিকরণ (১৭৭২ খ্রি.)-এর ঘটনা থেকে আধুনিক অর্থে জাতীয়তাবাদের বিকাশের সূত্রপাত ঘটে। তবে জাতীয়তাবাদের বিবর্তনে ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রি.) একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই বিপ্লবে ঘোষণা করা হয় যে, জাতিই হল সকল ক্ষমতার উৎসস্থল এবং এই বিপ্লবের মাধ্যমে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী প্রচারিত হয়।

(iii) উনবিংশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা

নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর ভিয়েনা কংগ্রেসে (Congress of Vienna) মেটারনিখ নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদের আদর্শকে উপেক্ষা করে ইউরোপ পুনর্গঠনে সচেষ্ট হলে বিভিন্ন অংশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বিপ্লবের রূপ গ্রহণ করে। আবার, জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রবক্তা ইতালির দার্শনিক ম্যাৎসিনি ইতালির জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য জাতীয়তাবাদের আদর্শ প্রচার করেন।

(iv) বিংশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদের সুত্রপাত

বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির অধ্যায় (ভার্সাই সন্ধি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সংগঠিত হতে শুরু করে এবং কালক্রমে তা মুক্তিসংগ্রামে পরিণত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে এবং পরবর্তী পর্যায়ে এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে জনগণ চরম মুক্তিসংগ্রামে শামিল হয়। এইভাবে বিংশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদের আদর্শ এক বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেছে।

উপসংহার: উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধ থেকেই জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়, যা মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে।

৪। জাতীয়তাবাদ কাকে বলে? এর প্রকৃতি আলোচনা করো।

জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা

জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক ধারণা। এটি এমন এক মতাদর্শ, যা জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার দাবিকে বাস্তবায়িত করে। একটি জনসমাজে যখন বিবিধ কারণে গভীর একাত্ববোধ সৃষ্টি হয় তখন তা জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয়। জাতীয়তাবোধের সঙ্গে দেশপ্রেম মিলিত হলে তাকে জাতীয়তাবাদ বলা হয়।

জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি

জাতীয়তাবাদের ইতিবাচক প্রকৃতি

জাতীয়তাবাদ একটি সুমহান গণতান্ত্রিক আদর্শ, যা যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নাগরিক তথা মানবজাতিকে মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই আদর্শ, জাতিকে সকল প্রকার বিদ্বেষ দূর করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়।

ম্যাৎসিনি-র অভিমত

ইতালির জাতীয়তাবাদের জনক ম্যাৎসিনি মনে করতেন, সমাজের প্রত্যেকটি জাতির মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা বর্তমান। তাঁর মতে, মানবসমাজ হল স্বাজাত্যবোধের সমন্বয়ে গঠিত এক সমবায়। সমাজস্থ সকল জাতি যদি সহযোগিতা, সহমর্মিতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র গঠনের অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়, তাহলেই সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নতি সাধন সম্ভব হবে।

জাতীয়তাবাদের মূল মন্ত্র

আদর্শ জাতীয়তাবাদের মূল মন্ত্র হল, ‘নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও’। এই আদর্শে আদর্শায়িত হয়ে মানুষের মধ্যে যে ঐক্যের অনুভূতি গড়ে উঠেছে, তা বিশ্বসভ্যতার জ্ঞানভান্ডারকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে চলেছে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মানুষের ন্যায্য অধিকারগুলিকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।

জাতীয়তাবাদের নেতিবাচক প্রকৃতি

তবে, অনেকসময় জাতীয়তাবাদ তার আদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে সংকীর্ণ জাত্যভিমানে পরিণত হয় এবং জন্ম হয় উগ্র জাতীয়তাবাদের, যা কেবল নিজ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার স্বার্থে অপর জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করে, সমাজের বিভিন্ন জাতির মধ্যে ঘৃণা, হিংসা, বিদ্বেষ সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বশান্তিকে বিঘ্নিত করে সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি করে।

মূল্যায়ন

পরিশেষে বলা যায়, জাতীয়তাবাদের আদর্শ যেমন একদিকে বিভিন্ন জাতিকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনে এবং বৈদেশিক শোষণের হাত থেকে মুক্তিলাভের জন্য সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে, তেমনই অপরদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদ অপর রাষ্ট্রকে আক্রমণ করে, সাম্রাজ্যবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় ইন্ধন জোগায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জার্মানির জাতীয়তাবাদ একসময় উগ্র জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়, যার সর্বশেষ পরিণতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

৫। জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ

জাতীয়তাবাদের মতাদর্শ, স্বাজাত্যবোধের প্রেরণা, ভাবগত নীতি, সামাজিক অনুভূতি যেভাবেই বিচার করা হোক-না-কেন, জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এগুলি হল-

(i) পরিবর্তনশীল চরিত্র

জাতীয়তাবাদ কোনো স্থিতিশীল ধারণা নয়, বরং একটি পরিবর্তনশীল ধারণা। আদিম সমাজের গোষ্ঠীগত চেতনাই ক্রমে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের বিকাশে সাহায্য করেছে। মধ্যযুগে ভৌগোলিক যোগাযোগের বাধা, মধ্যযুগীয় কুসংস্কার প্রভৃতি কারণে জাতীয়তাবাদের বিকাশে শিথিলতা সৃষ্টি হলেও রেনেসাঁস, সার্বভৌমিকতা, আমেরিকার বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, শিল্পবিপ্লবের উৎকৃষ্ট ফল হিসেবে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি ও বিকাশ ঘটেছে।

(ii) রাষ্ট্রের প্রধান উপাদান

জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেল-এর মতে, রাষ্ট্রের সৃষ্টি ও গঠনে জাতীয়তাবাদ একটি মুখ্য উপাদান, যা নতুন রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠনে অনুপ্রেরণা জোগায়। ফলে জাতীয়তাবাদ পরাধীন দেশগুলির কাছে মুক্তির দিশারি রূপে কাজ করে।

(iii) জাতীয়তাবাদের গঠনশীল ভূমিকা

গণসার্বভৌমিকতার তত্ত্বে গুরুত্ব আরোপ, জাতির অধিকারবোধ প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের সৃষ্টি ও গঠন, পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামোকে ভেঙে নতুন কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানকে রূপ দেওয়া, প্রতিকূল শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা, জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে বজায় রাখা- এগুলি জাতীয়তাবাদের গঠনশীল ভূমিকার অন্তর্গত।

(iv) দ্বৈত প্রকৃতির অস্তিত্ব

জাতীয়তাবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল একই সঙ্গে ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকার অস্তিত্ব। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্য অতিক্রম করে জাতীয় রাষ্ট্র সম্প্রসারণে উদ্যোগী হলে তা নেতিবাচক প্রকৃতির। আবার জাতীয়তাবাদ যখন জাতিগুলির অন্তর্নিহিত গুণাবলির বিকাশ ঘটিয়ে মানবসভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে তা ইতিবাচক প্রকৃতির।

(v) ঐক্যবোধের প্রসার

জাতীয়তাবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ঐক্যবোধের প্রসার ঘটানো। এই চেতনাই দেশের বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী ও ধর্মের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এর দরুণ পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সঞ্চারিত হয়।*2

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, জাতীয়তাবাদ হল এমন একটি মহান আদর্শ, যা একদিকে মুক্তির কথা বলে, অন্যদিকে মানুষের মধ্যে জাত্যভিমান সৃষ্টি করে। এর ফলে মানুষের মনের মধ্যে অন্য জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য বিদ্বেষী মনোভাবের সৃষ্টি হয়।

৬। জাতীয়তাবাদের সপক্ষে মূল যুক্তিগুলি নির্দেশ করো।

জাতীয়তাবাদের সপক্ষে মূল যুক্তি

বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাঁদের তাত্ত্বিক আলোচনায় জাতীয়তাবাদের ইতিবাচক দিকগুলিকে যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা নিম্নে আলোচিত হল-

(i) একটি মহান আদর্শ

জাতীয়তাবাদকে জাতীয় জীবনের এক মহান আদর্শ ও একটি গভীর অনুপ্রেরণা হিসেবে অভিহিত করা হয়। জাতীয়তাবাদ সমগ্র জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে দেশের জন্য আত্মত্যাগ করতেও অনুপ্রেরণা জোগায়। প্রতিটি জাতি জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হলে সামগ্রিকভাবে সারা বিশ্বের মানবসভ্যতার দ্রুত সমৃদ্ধি ঘটাতে পারে।

(ii) পরাধীন জাতির কাছে মুক্তির অগ্রদূত

জাতীয়তাবাদ পরাধীন জাতিসমূহের কাছে মুক্তির অগ্রদূত রূপে পরিচিত। কারণ জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের আপ্রাণ সংগ্রাম চালায়। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে যে মুক্তিসংগ্রাম চলেছিল তার উৎস যে উপনিবেশবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

(iii) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়ক

জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সহায়ক। জাতীয়তাবাদের আদর্শ কালক্রমে উদারনৈতিক গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার আদর্শের জন্মদাতা হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এইরূপ জাতীয়তাবাদী আদর্শ বিভিন্ন জাতিকে নিজেদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করে, অপরদিকে তাদের গণতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে।

(iv) মানবসভ্যতার অগ্রগতির সূচক

জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার বিকাশের সহায়ক, কারণ এর মাধ্যমেই পরাধীন জাতির মুক্তির মন্ত্র ধ্বনিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতীয়তাবাদই তৃতীয় বিশ্বের (উদাহরণস্বরূপ- এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া, লিবিয়া, উগান্ডা প্রভৃতি) জাতিগুলিকে নতুন চেতনা ও শক্তিতে উদ্বুদ্ধ করে মানবসভ্যতার উন্নতিতে সাহায্য করেছে।

(v) সুশাসান সহায়ক

জাতীয়তাবাদ দেশের শাসনব্যবস্থাকে স্থায়ী, স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল করে তোলে। জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ জনসমাজ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার ফলে দেশে শাসক-শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে বলেই আইনের নির্দেশ ও আইন মান্য করার মধ্যে সমতা বজায় থাকে।

(vi) জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক

জাতীয়তাবাদের প্রচারকেরা জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী হিসেবে দেখেন না, তারা জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক হিসেবে দেখেন। জাতিসমূহের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে কর্তব্য ও দায়বদ্ধতা, আন্তর্জাতিক আইন ও সংগঠনের প্রতি আস্থা আন্তর্জাতিকতার লক্ষ্যকেই সফল করে।

পরিশেষে বলা যায়, জাতীয়তাবাদের পক্ষে যুক্তিগুলি মানবসভ্যতার কাছে আশীর্বাদ রূপে বিবেচিত হয়।

৭। জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো।

জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে যুক্তি

জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে যুক্তিগুলি হল-

[1] জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দেয়

অভ্যন্তরীণ এমনকি বাহ্যিক প্রকৃতিতে অসহিষ্ণুতা, সন্দেহ, হিংসা ও বিরোধ জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস সাক্ষী যে, জাতির সংকীর্ণতা থেকে উগ্রতা এবং আধিপত্যের মনোভাব এসেছে। এর ফলে বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা, হিংসা ও হানাহানির সৃষ্টি হয়েছে।

[2] অন্যায় ও অমঙ্গালর উৎস

জাতীয়তাবাদের দুটি রূপের মধ্যে অন্যতম একটি রূপ হল বিকৃত জাতীয়তাবাদ। এই বিকৃত জাতীয়তাবাদের রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হেজ মন্তব্য করেছেন, জাতীয়তাবোধ, জাতীয় রাষ্ট্র ও দেশপ্রেমের সংমিশ্রণে যে জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ঘটেছে তা চরম অন্যায় ও অমঙ্গলের উৎসস্থল।

[3] গণতান্তর বিরোধী

উগ্র জাতীয়তাবাদ জনমতকে উপেক্ষা করে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে। এর ফলে বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়। বিভাজন সৃষ্টির এই প্রচেষ্টা সমতার নীতিকে অগ্রাহ্য করে। অ্যান্ড্রু হেউড (Andrew Heywood) বলেন, জাতীয়তাবাদের আড়ালে ব্যক্তির স্বতন্ত্র অবস্থান ও চেতনাকে অধীনে এনে রাজনৈতিক নেতারা জনসাধারণকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করেন। *’

[4] সাম্রাজ্যবাদের জন্মদাতা

উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে হেয় করে তাদের উপর প্রভুত্ব কায়েমের চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে জাতির আত্মস্বার্থ ও অহংবোধ থেকে সাম্রাজ্যবাদের জন্ম হয়। যেমন-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার জার্মান জাতিকে উগ্র ও বিকৃত জাতীয়তাবাদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ করে তার সাম্রাজ্যবাদী নীতিকে বাস্তবে রূপায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন।

[5] সংকীর্ণ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ সভ্যতার সংকট

সংকীর্ণ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ সভ্যতার পক্ষে বিপজ্জনক। এর কারণ স্বাধীনতা বা মানবতা নয়, এই জাতীয়তাবাদ ক্ষমতা ও অর্থের লড়াইয়ের সৃষ্টি করে। এইরূপ জাতীয়তাবাদের নীতি হল- অন্য জাতির সংস্কৃতিকে দমন করা এবং শুধুমাত্র নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিশ্বের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করা।

[6] বিশ্বশান্তি বিঘ্নকারী

জাতীয়তাবাদের উগ্ররূপ যুদ্ধবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে বিশ্বশান্তি বিঘ্নকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এরা ন্যায়-অন্যায়, আলাপ-আলোচনা প্রভৃতিকে অবজ্ঞা করে যুদ্ধকে একমাত্র পথ হিসেবে গণ্য করে।*2

পরিশেষে উপরোক্ত জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে যুক্তিগুলির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, উগ্র জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার শত্রু বলে বিবেচিত হয়।

৮। তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি পর্যালোচনা করলে কয়েকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। সেগুলি হল-

ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী শক্তি

তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ মূলত ঔপনিবেশিকতাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য জনগণের মনে এক সংগ্রামী স্বদেশ চেতনার জন্ম দিয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে খণ্ডিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে, জাতি গঠনের উদ্যোগ জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসেবে ভারত, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, অ্যাঙ্গোলা প্রভৃতি দেশের কথা উল্লেখ করা যায়।

নেতিবাচক বৈরী মানোভাব

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদের জন্ম হয় ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে এক নেতিবাচক বৈরী মনোভাবের মধ্য দিয়ে। ঔপনিবেশিক শক্তির অপশাসন ও নিপীড়নের ফলে জনগণের মধ্যে সরকার বিরোধী মানসিকতা প্রবল হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে জনগণের নেতিবাচক শক্তির প্রতিনিধি হিসেবে এই জাতীয়তাবাদ আত্মপ্রকাশ করে।

সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য

তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ পরাধীন দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্যের জন্ম দেয়। বিশ্বের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির দ্বারা শাসিত তৃতীয় বিশ্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এইসব দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো ঐক্য ছিল না। কিন্তু জাতীয়তাবাদ পরাধীন দেশের এইসব জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করে জাতীয় সংহতিবোধের বিকাশ ঘটায়।

স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা

ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসনাধীন তৃতীয় বিশ্বের অধিবাসীরা জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণায় স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রতী হয়েছিল।এ ছাড়া এই দেশগুলিতে স্বাধীনোত্তর পর্বে জাতীয়তাবাদের কিছু ভিন্নধর্মী বৈশিষ্ট্যও দেখা যায়। যথা-

জাতীয় ঐক্যের বিনাশ ও সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে প্রাক্-স্বাধীনতা আমলের সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য স্বাধীনতার পরবর্তীকালে শিথিল হয়ে পড়ায় ঐক্যবদ্ধ জাতীয় সত্তার মধ্যে ভাঙন দেখা যায়, ফলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন শক্তি যথা-ধর্মীয় সংকীর্ণতা, বর্ণগত বিদ্বেষ ও ভাষাগত বিরোধ জাতীয় সংহতিকে দুর্বল করে দেয়। এমনকি দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষও প্রকট হয়ে ওঠে।

স্বাধীনতা সংরক্ষণে ব্যর্থ

তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশে জাতীয়তাবাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় স্বাধীনতা অর্জিত হলেও, পরবর্তীকালে তা সংরক্ষিত করতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এমনকি দেখা যায়, সামরিক বাহিনী বা কোনো প্রভাবশালী মুষ্টিমেয় শাসকগোষ্ঠী শাসনক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে নাইজেরিয়া, মায়ানমার, ফিলিপিনস্ প্রভৃতি দেশের সামরিক একনায়কতন্ত্রের কথা বলা যায়।

৯। এক জাতি এক রাষ্ট্র- ধারণাটি ব্যাখ্যা করো।

এক জাতি এক রাষ্ট্র: রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন নির্দিষ্ট কোনো জাতীয় জনসমাজ আত্মসচেতনতার ভিত্তিতে যখন নিজেদের পৃথক সত্তা ও স্বতন্ত্র জাতীয় বৈশিষ্ট্যগুলিকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানায়, তখন তাকে একটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলে অভিহিত করা হয়। এই ধরনের জাতিগুলি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত থেকে নিজেদের রাজনৈতিক ভাগ্যকে নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয়ে থাকে। অনেকে মনে করেন, রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত জাতিগুলি মূলত নিজেদের স্বতন্ত্র ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাবধারা, ভাষা ইত্যাদি রক্ষা করার তাগিদেই পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে অনড় হয়। জাতিভিত্তিক এইরূপ রাষ্ট্রতত্ত্বের মূল নীতি বা স্লোগানই হল- এক জাতি এক রাষ্ট্র (One Nation One State)। অর্থাৎ, এই নীতি অনুসারে, এক-একটি জাতি নিয়ে গড়ে উঠবে এক-একটি রাষ্ট্র। আর এরূপ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সক্রিয় উদ্যোগ ও সহযোগিতায় উক্ত জাতিটি নিজ ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি তথা সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করবে। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের এই জাতিকেন্দ্রিক দাবি ‘এক জাতি এক রাষ্ট্র’ নীতির দ্বারা সমর্থিত। এই তত্ত্বের একজন অন্যতম প্রবক্তা হলেন উনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ব্রিটিশ রাষ্ট্রচিন্তাবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল (John stuart Mill) | এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘জাতীয় জনসমাজের সীমানা রাষ্ট্রীয় সীমানার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়াই বাঞ্ছনীয়’ (‘It is, in general, a necessary condition of free institution that the boundary of government should coinside in the main with those of Nationalities.’)

১০। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারটি ব্যাখ্যা করো।

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার

সংজ্ঞা: স্বকীয়তা রক্ষার জন্য জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে বলা হয় জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। অর্থাৎ একটি জাতি যখন একটি রাষ্ট্রের মাধ্যমে তার আত্মপ্রতিষ্ঠার বা স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সচেষ্ট হয়, তখন তাকে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার (Right of Self- Determination) বলে। মূলত জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে জাতি তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। এক জাতি এক রাষ্ট্র (One Nation One State) এই তত্ত্বকে কেন্দ্র করেই জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্বটি গড়ে উঠেছে।

বৈশিষ্ট্য: জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হল-

(i) জাতির আত্মপ্রকাশে সহায়ক: আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের মাধ্যমে

জাতির সুষ্ঠু গুণাবলি, চেতনা, ভাবধারা, আদর্শ, নিজস্ব সংগঠন প্রভৃতির আত্মপ্রকাশ ঘটে।

(ⅱ) স্বাভাবিক অধিকারের মর্যাদালাভ: এই অধিকারটি স্বাভাবিক অধিকারের মর্যাদা লাভ করেছে। কারণ জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার না থাকলে জাতিগত বিরোধ, হিংসা, সংঘর্ষ ইত্যাদি অনিবার্য হয়ে উঠত।

(iii) গণতন্ত্রের সহায়ক: গণতন্ত্রের উন্মেষ ও প্রচার এবং সংখ্যালঘু সমস্যার স্থায়ী সমাধান হিসেবেও এই অধিকারটির গুরুত্ব অপরিসীম।

(iv) বৃহত্তর স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা: আন্তর্জাতিকতার লক্ষ্যকে কার্যকর করার বৃহত্তর স্বার্থেও এই অধিকার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে বক্তব্যসমূহ

মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার একটি সত্তা হিসেবে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান। তাঁর এই প্রস্তাবকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের শান্তি সম্মেলনে মেনে নেওয়া হয়।

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিপক্ষে বক্তব্যসমূহ

লর্ড অ্যাক্টন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি ও রূপায়ণকে অবাস্তব বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, সমাজে মানুষের সমবায় যেমন সভ্য জীবনযাপনের শর্ত তেমনি বিভিন্ন জাতির এক রাষ্ট্রে মিলেমিশে থাকার বিষয়টি সভ্যতার অপরিহার্য শর্ত।

মূল্যায়ন

পরিশেষে বলা যায়, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার- সম্পর্কিত ধারণা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বলা যায়, সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা, জাতীয় জনসমাজের দাবির প্রকৃতি ও শক্তি, এই দাবির প্রতি জনসমর্থন, মানবসভ্যতার সার্বিক উন্নতি সবকিছুকে বিচার করেই এই অধিকারের যথার্থতা বিচার করা উচিত।

১১। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সপক্ষে যুক্তি দাও।

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সপক্ষে যুক্তি

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সপক্ষে যুক্তিগুলি হল-

[1] গণতন্ত্রের সহায়ক

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি গণতন্ত্রের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন- একটি রাষ্ট্রে একাধিক জাতি বসবাস করলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল জাতিগুলি সরকার গঠনের সুযোগ পায় না। জন স্টুয়ার্ট মিল-এর মতে, বহুজাতিক রাষ্ট্রে স্বাধীন রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে না। (“Free institutions are next to impossible in a country made up of different nationalities.”)। তাই গণতান্ত্রিক সাফল্যের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিটি স্বীকার করা উচিত।

[2] জাতীয় গুণাবলির বিকাশে সহায়ক

প্রতিটি জাতিরই নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, প্রতিভা বর্তমান। এক জাতি নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রে এইসব জাতীয় গুণাবলির বিকাশ ঘটার সম্ভাবনা থাকে।

[3] বিশ্বশান্তির সহায়ক

মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন মনে করেন যে, প্রতিটি জাতিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করলে যুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণসমূহকে সমূলে উৎপাটিত করা সম্ভব হবে। তাঁর মতে, প্রতিটি জাতীয় জনসমাজের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণের স্বাভাবিক অধিকার বিশ্বজনীনভাবে মেনে নেওয়া প্রয়োজন। তাহলে সংখ্যালঘু শ্রেণির সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে বিশ্ব জুড়ে অশান্তির আবহাওয়ার অবসান ঘটবে। এইভাবে স্থায়ী বিশ্বশান্তির পথ প্রশস্ত হবে এবং সভ্যতার সংকট দূর হবে।

[4] ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা

একটিমাত্র জাতির দ্বারা একটি সরকার যখন নির্বাচিত হয়, তখন সেই সরকার বিপুলভাবে জনগণের সমর্থন লাভ করে। জনসাধারণ সরকারের আইনগুলির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। কারণ, এই আইনগুলি হল জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার প্রহরীস্বরূপ। এই কারণেই এক জাতি সমন্বিত রাষ্ট্রে ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সমন্বয়সাধন করা সম্ভব হয়।

[5] ন্যায়সংগত

কোনো একটি বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের শাসনাধীনে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটি জনসমাজের স্বকীয়তাকে মিশিয়ে দেওয়ার অর্থই হল পরাধীনতা। তাই বলা যায়, স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে জাতীয় জনসমাজের স্বাধীনতার সর্বোচ্চ প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়।

পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বসভ্যতায় বৈচিত্র্যময় মানবজীবন এবং সভ্যতার অগ্রগতির জন্য, বিশ্বসংস্কৃতির সমৃদ্ধির জন্য জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারটি যথেষ্ট প্রয়োজন।

১২। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিপক্ষে মতামতগুলি আলোচনা করো।

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিপক্ষে যুক্তি: জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিপক্ষে যুক্তিগুলি হল—

[1] বাস্তব রূপায়ণ অসম্ভব

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিটি তাত্ত্বিক দিক থেকে স্বীকৃত হলেও বাস্তবে কার্যকর করা কষ্টকর। কারণ, একই ভৌগোলিক পরিবেশে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জাতির মানুষ পাশাপাশি বাস করার ফলে পরস্পরের মধ্যে এমন এক মেলবন্ধন তৈরি হয় যে, তাদের পক্ষে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব হয় না।

[2] অবাস্তব নীতি

তত্ত্বগতভাবে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করা হলেও, এই নীতির বাস্তব প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ‘এক জাতি এক রাষ্ট্র’ গঠন সকল ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে গ্লামপ্লাউজ বলেছেন, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সব সময় সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ সব জাতীয় জনসমাজকে ক্রমাগত স্বাধীনতা প্রদান করা হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাই জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে পৃথিবীর মানচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে।

[3] ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলি বিভিন্ন সমস্যায় জড়িয়ে পড়বে

এক জাতি এক রাষ্ট্র’ নীতি কার্যকর হলে পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য ছোটো ছোটো রাষ্ট্রের উদ্ভব হবে। এর ফলে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির তো কোনো সুবিধা হবেই না, বরং তা হবে শান্তি ও কল্যাণের প্রতিবন্ধক।

[4] গণতান্ত্রিক আদর্শের যুক্তি ভিত্তিহীন

গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য যুক্তি দেওয়া হয় যে, জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এই যুক্তিটি হল ভ্রান্ত একটি যুক্তি, কারণ- গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত নাগরিক এবং তাদের সক্রিয় সহযোগিতা। ‘এক জাতি এক রাষ্ট্রের’ সঙ্গে গণতন্ত্রের সফলতার কোনো সম্পর্ক নেই।

[5] আন্তর্জাতিক শান্তি বিপন্ন হবে

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মেনে নিলেই যে পৃথিবীতে যুদ্ধের সম্ভাবনা থাকবে না, এই ধারণাটি ভুল। কারণ বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য সর্বদা সংগ্রামে লিপ্ত থাকবে। এককথায় স্বার্থের দ্বন্দ্ব যুদ্ধের অভিশাপ বহন করে আনবে।*2

মূল্যায়ন

উপরোক্ত আলোচনার নিরিখে বলা যায়, আদর্শ অবস্থায় বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের সুযোগসুবিধা যে বেশি একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু যেখানে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে একটি জাতিসত্তাকে একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, সেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিকে নীতিগতভাবে সমর্থন না করে উপায় থাকে না। এর থেকে বোঝা যায় যে, আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটির সমস্যা দ্বিবিধ। একে স্বীকার করলেও সমস্যা, আবার না করলেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment