নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর Class 11 Second Semester WBCHSE

নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর

নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর
নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর

১। নীতিবিদ্যায় ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’ বলতে কী বোঝায়?

ভালো ও মন্দ

ভালো ও মন্দ হল এক-একটি নৈতিক বিশেষণ, যেগুলি আমরা নীতিবিজ্ঞানে মানুষের আচরণ সম্বন্ধে ব্যবহার করে থাকি। নীতিবিদ ম্যাকেঞ্জি নীতিবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে এই পদগুলি ব্যবহার করেছেন এবং নীতিবিজ্ঞানের মৌলিক প্রত্যয়রূপে এগুলির বিশ্লেষণ করেছেন।

ইংরেজি ‘Good’ শব্দটি জার্মান শব্দ ‘Gut’ থেকে এসেছে। কোনো কিছুকে তখনই ভালো বলা হয় যখন সেটি কোনো লক্ষ্য পূরণের পক্ষে প্রয়োজনীয় বা মূল্যবান হয়। যেমন- একটি ওষুধকে আমরা তখনই ভালো বলি, যখন সেটি কোনো রোগ নিরাময়ে সমর্থ হয়। একইভাবে আমরা সেই আচরণকে ভালো বলি, যে আচরণ আমাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে । পৌঁছাতে সাহায্য করে। অপরদিকে কোনো কাজ যদি কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য পূরণের পক্ষে সহায়ক বা উপযোগী না হয় তবে সেই কাজকে বলা হয় মন্দ কাজ। অন্যভাবেও বলা যায় যা কাম্য বিষয় নয়, সেগুলি প্রত্যাশাজনক নয় বলেই সেগুলিকেই আমরা এড়িয়ে চলতে চাই। যেমন- দারিদ্র, অশিক্ষা, ভীরুতা, রোগ ইত্যাদি।

এ প্রসঙ্গে ম্যাকেঞ্জিও বলেছেন, ভালো শব্দটি অধিকাংশ সময়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপায় বোঝাতে ব্যবহৃত হয় এ কথা ঠিক নয়। লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য বোঝাতেও ‘ভালো’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এই ‘ভালো’ হল মানুষের জীবনের পরম ভালো (Summum Bonum or Supreme Good) আর এই পরম ভালো হল মানুষের জীবনের পরম আদর্শ বা পরম কাম্য। এই প্রসঙ্গে পরমকল্যাণ এবং আপেক্ষিক কল্যাণের মধ্যে পার্থক্য করতে হয়। যে কল্যাণ পরম এবং চরম, যে কল্যাণকে আমরা সেই কল্যাণ লাভ করার উদ্দেশ্যেই আদর্শরূপে মনে করি অর্থাৎ যার স্বতঃমূল্য আছে, সেটি পরমকল্যাণ আর যে কল্যাণকে আমরা অপর কোনো কল্যাণ লাভ করার উপায়রূপে ব্যবহার করি, সেগুলি হল আপেক্ষিক কল্যাণ। যেমন- অর্থ, বুদ্ধি, জ্ঞান, স্বাস্থ্য, শক্তি এগুলির কেবল সহায়ক মূল্য আছে বা পরত মূল্য আছে।

ভালোর শ্রেণিবিভাগ

উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ভালো-কে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা- 

(1) সর্বোচ্চ ভালো (Supreme good বা Absolute good): কোনো বিষয় যখন নিজ গুণে ভালো হয় তখন তাকে সর্বোচ্চ ভালো বলা হয়।

(2) আপেক্ষিক ভালো (Relative good বা Instrumental good): যার মাধ্যমে আমাদের কোনো উদ্দেশ্য পূরণ হয় তাকে বলা হয় আপেক্ষিক ভালো। এই আপেক্ষিক ভালোকে চার ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা-

  • দৈহিক ভালো (Bodily Good): স্বাস্থ্য, শারীরিক সুস্থতা এবং ভালো থাকা প্রভৃতি দৈহিক ভালোর অন্তর্গত।
  • অর্থনৈতিক ভালো (Economic Good): যেসব ভালো আমাদের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করে, যেমন- সম্পত্তি, ধন-সম্পদ, অর্থ ইত্যাদি হল অর্থনৈতিক ভালো।
  • সামাজিক ভালো (Social Good): যেসব মঙ্গল আমাদের সামাজিক চাহিদা পূরণ করে বা যেসব ভালো আমাদের সমাজের কল্যাণ সাধিত করে। যেমন- সমাজকল্যাণ বা সমাজসেবা। সাধারণত বিভিন্ন সমিতির মাধ্যমে এধরনের কল্যাণ বা ভালো সাধিত হয়।
  • সত্য, শিব ও সুন্দর (Truth, Good and Beauty): এই তিনটি ভালো যথাক্রমে বৌদ্ধিক, নৈতিক এবং নান্দনিক চাহিদা পূরণ করে।

২। নৈতিক বিচারের স্বরূপ বিশ্লেষণ করো।

নৈতিক বিচারের স্বরূপ

কল্যাণের আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে আচরণের মূল্যায়নকে নৈতিক বিচার বলে। এই বিচার মূল্যনিরূপক বিচার ঔচিত্যমূলক বিচার। ভালো-মন্দ, যথোচিত-অনুচিত প্রভৃতি শব্দ দ্বারা এই বিচারকে বাক্যে প্রকাশ করা হয়। যেমন- আমরা বলি চুরি করা অনুচিত, সত্য কথা বলা উচিত, তার এই কাজ যথোচিত নয় ইত্যাদি।

(1) সার্বিকতা: এক অর্থে নৈতিক বিচার সার্বিক। কারণ এই বিচার কোনো সার্বিক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে করা হয়। কল্যাণের আদর্শ সার্বিক। এই আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কোনো কাজকে বিচার করে বলি কাজটি ভালো বা মন্দ কাজ। আবার যখন বলি কাজটি ভালো কাজ তখন ওই কাজ করা সকলের কর্তব্য, এ কথাও আমরা মনে করি।

(2) অব্বারণ তথ্যভিত্তিক: নৈতিক অবধারণ তথ্যাবধারণ থেকে ভিন্ন। তথ্যাবধারণ বর্ণনামূলক। যখন বলি ‘টেবিলটি বাদামি’ তখন টেবিল সম্বন্ধে একটি বর্ণনা পাই। নৈতিক বিচার কোনো বস্তুর প্রকৃতির বর্ণনা করে না। এই বিচার আদর্শের সঙ্গে আচরণের তুলনা করে। এই ক্ষেত্রে আমরা মূলত বিষয়ের মূল্যায়ন করি। এটি Judgement upon a fact অপরদিকে তথ্যাবধারণ হল Judgement of a fact। ম্যুরহেড বলেন নৈতিক বিচার আইনের বিচারের মত। নৈতিক বিচার তর্কবিজ্ঞানের বিচার থেকে ভিন্ন।

(3) বাধ্যতাবোধ: নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রে একটা বাধ্যতাবোধ জড়িত থাকে। যে কাজকে উচিত বলে বিচার করি, সেই কাজ করা কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। আমরা যখন বলি “কাজটি অশুভ” তখন এ কথাও স্বীকার করি যে ওই কাজ করা থেকে বিরত থাকা আমাদের কর্তব্য। এইভাবে কোনো কাজকে শুভ বা অশুভ, যথোচিত বা অনুচিত বলে বিচার করে। নৈতিক বিচার পরোক্ষভাবে আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করে। এই অর্থে নৈতিক বিচার নিয়ন্ত্রণমূলক।

(4) চারটি দিক: নৈতিক বিচারের চারটি দিক আছে। যথা-

বিচারকর্তা, বিষয়বস্তু, বিচারের আদর্শ ও নৈতিক বিচারের বৃত্তি। বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি নৈতিক বিচারের কর্তা ঐচ্ছিক ক্রিয়া হল বিষয়বস্তু, কল্যাণ হল আদর্শ এবং মানুষের বিবেক হল নৈতিক বৃত্তি।

(5) চারটি তাৎপর্য: লিলি বলেন, যখন কোনো ঐচ্ছিক ক্রিয়াকে যথোচিত বলি তখন তার চারটি তাৎপর্য থাকে:কাজটি আদর্শ  অনুযায়ী করা হয়েছে, কাজটি করা অবশ্য কর্তব্য, কাজটি ঐ নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে যথোচিত বা যুক্তিযুক্ত, কাজটিকে যে মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করা হচ্ছে, সেই মূল্য কাল্পনিক বা ব্যক্তিগত নয়, এটি সর্বজনগ্রাহ্য। সুতরাং নীতিগতভাবে কোনো ভালো কাজ অবশ্যই আদর্শনানুগ, করণীয়, নীতিগতভাবে যুক্তিযুক্ত (right) এবং যে আদর্শ অনুসারে কাজটিকে ন্যায় বলছি, সেই আদর্শটি এক অর্থে বাস্তব, কাল্পনিক নয় এবং ব্যক্তি নিরপেক্ষ।

পরিশেষে বলা যায় যে নৈতিক বিচার হল বুদ্ধি সম্পর্কীয় বিচার। নৈতিক বিচারের নিজের কোনো নৈতিক গুণ নেই।

৩। নৈতিক বিচার বলতে কী বোঝায়? নৈতিক বিচারের ধর্ম বা বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করো।

নৈতিক বিচার

নৈতিক বিচার বলতে বোঝায় মানুষের স্বেচ্ছাকৃত কর্মকে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি নৈতিক বিশেষণে বিশেষিত করা।

নৈতিক বিচারের ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য

যখন কোনো কাজের ভলো-মন্দ বিচার করা হয় অর্থাৎ নৈতিক বিচার করা হয় তখন তার কতকগুলি বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করা হয়। অধ্যাপক লিলি (Lillie) তাঁর ‘An Introduction to Ethics’ গ্রন্থে নৈতিক বিচারের এরূপ চারটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল-মূল্য নির্ধারণ, কর্তব্যমূলক, পরিস্থিতি নির্ভর এবং বিষয়গত বৈধতা।

(1) মূল্য নির্ধারণ: নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য একটি বৈশিষ্ট্য হল মূল্য নির্ধারণ। যে কাজের নৈতিক বিচার করা হয় সেই কাজের মূল্য আছে। নৈতিক বিচারে কোনো কাজের মূল্য নিরূপণ করা হয় এবং ভালো- মন্দ, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি মূল্য নিরূপক শব্দের দ্বারা ভাষায় প্রকাশ করা হয়। এজন্য নৈতিক বিচার মূল্যায়ননির্ভর।

(2) কর্তব্যমূলক: কোনো কাজের ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষেত্রে উচিত- অনুচিতের বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। কোনো কাজকে ভালো বলার অর্থ হল কাজটি আমাদের করা উচিত। আর নৈতিক বিচারে কোনো কাজ উচিত বলে গণ্য হলে তা আমাদের কাছে অবশ্য করণীয় বা কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। যখন বলা হয় কাজটি ভালো তখন প্রকৃতপক্ষে এটাই বোঝানো হয় যে, এই কাজটি অথবা এই জাতীয় কাজ করা আমাদের সকলের কর্তব্য বা এই জাতীয় কাজ করতে আমরা দায়বদ্ধ।

(3) পরিস্থিতি নির্ভর:  নৈতিক বিচারের উপযুক্ততা প্রায়শই কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিবিধানের উপর নির্ভর করে। কোনো কাজ যদি নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় তবেই কাজটিকে ভালো বলা হবে অন্যথায় কাজটিকে মন্দ বলা হবে।

(4) বিষয়গত বৈধতা: নৈতিক বিচারের মাধ্যমে কোনো কাজের বৈধতা নির্ণয় করা হয়। কোনো ব্যক্তি কোনো কাজকে ভালো মনে করছে বলেই যে কাজটি ভালো, বা মন্দ মনে করছে বলেই যে কাজটি মন্দ তা নয়। কাজটি স্বরূপতই ভালো বা স্বরূপতই মন্দ। যেমন-পরোপকার করা কাজটি ভালো। এখন এই পরোপকার করা কাজটি অধিকাংশ লোক ভালো বলে মনে করে বলেই যে কাজটি ভালো তা নয়, পরোপকার করা কাজটির মধ্যেই এমন এক ধর্ম আছে যা কাজটিকে স্বরূপত ভালোরূপে প্রতিপন্ন করে। এটিই নৈতিক বিচারের বিষয়গত বৈধতা।

৪। নৈতিক বিচারের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করো।

নৈতিক বিচারের প্রকৃতি

নৈতিক বিচারের মাধ্যমে আমরা আমাদের ক্রিয়া বা আচরণের নৈতিক মূল্য অর্থাৎ ভালো-মন্দ, ন্যায়- অন্যায় ইত্যাদি বিচার করে থাকি। নৈতিক বিচারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে আমরা নৈতিক বিচারের বৈশিষ্ট্য ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত হই। এগুলি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল-

(1) নৈতিক বিচারের বৈশিষ্ট্য: নৈতিক বিচারের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

  • নৈতিক বিচার হল একটি মানসিক ক্রিয়া, যার সাহায্যে কোনো কাজের নৈতিক গুণাগুণ বিচার করা হয়।
  • নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধিশীল ও বিচারে সামর্থ্য বা মানসিক ক্ষমতা আছে এরূপ একজন বিচারকর্তা অবশ্যই থাকবে।
  • নৈতিক বিচারের বিষয় হিসেবে আমাদের কোনো-না-কোনো ঐচ্ছিক ক্রিয়া থাকে।
  • নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রে কোনো-না-কোনো আদর্শ থাকে, যার ভিত্তিতে নৈতিক বিচার করা হয়ে থাকে।

(2) উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়: যে নির্বাচিত লক্ষ্য মানুষকে কর্মে প্রবৃত্ত করে তা হল উদ্দেশ্য এবং উদ্দেশ্য লাভের উপায় ও প্রত্যাশিত পরিণামের সমন্বয়কে অভিপ্রায় বলা হয়।

(3) উদ্দেশ্যের উপর গুরুত্ব: মার্টিন্যু প্রমুখ স্বজ্ঞাবাদী নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু হিসেবে উদ্দেশ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর মতে, যে উদ্দেশ্য দ্বারা আমরা ক্রিয়া করতে প্রণোদিত হই তার দ্বারা আমাদের কাজের ভালো-মন্দ বিচার করা উচিত। স্বজ্ঞাবাদীরা উদ্দেশ্যের একটি বিশদ তালিকা দিয়েছেন, যার সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে ভক্তি এবং সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে দ্বেষদর্শিতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা।

(4) উদ্দেশ্য ভালো, উপায় খারাপ: শুধু উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে নৈতিক বিচার আরোপ করা যায় না। কেন-না অনেক সময় উদ্দেশ্য ভালো হলেও উদ্দেশ্য লাভের উপায় অসৎ হয়ে থাকে। যেমন- একজন ব্যবসায়ীর উদ্দেশ্য হল অর্থ উপার্জন করা। কিন্তু সে চোরাবাজার, ভেজাল ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করল। এক্ষেত্রে তার কাজের উদ্দেশ্য ভালো হলেও উপায় খারাপ হওয়ায় তার কাজকে আমরা নৈতিক দিক থেকে সমর্থন করতে পারি না।

(5) অভিপ্রায়ের উপর গুরুত্ব: উপযোগবাদীগণ নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রে অভিপ্রায়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। কিন্তু শুধু অভিপ্রায়ের উপর নির্ভর করে নৈতিক বিচার আরোপ করা যায় না। কেন-না অনেক সময় উদ্দেশ্য ভালো হলেও অভিপ্রায় খারাপ হতে পারে। যেমন-কোনো ব্যক্তি সৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে পরিবার প্রতিপালনের পরিবর্তে দুরাচারী জীবনযাপন করে। এক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ভালো হলেও অভিপ্রায় খারাপ হয়ে পড়ে। তাই শুধু অভিপ্রায়ের উপর নির্ভর করে নৈতিক বিচার আরোপ করা যায় না।

(6) আত্মচেতনার উপর গুরুত্ব:  কর্তার অভিপ্রায় তার চরিত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তাই ম্যাকেঞ্জি বলেন, ব্যক্তির চরিত্র তথা ব্যক্তি স্বয়ং নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু। অর্থাৎ ক্রিয়াকে বিচার না করে স্বয়ং কর্মকর্তাকে বিচার করা উচিত। কিন্তু অভিপ্রায় সবসময় কর্তাকে প্রকাশ করতে পারে না। তাই আমরা আত্মবিচারের মাধ্যমে নিজের কাজের নৈতিক গুণাগুণ উপলব্ধি করি। তাঁর সঙ্গে তুলনা করে অপরের মনোভাব অনুমান করি এবং তদনুযায়ী তার কাজের নৈতিক মূল্য বিচার করি। অর্থাৎ আমরা আত্মচেতনার মাধ্যমে নিজেদের কাজ বিচার করার পর অপর ব্যক্তির কাজ বিচার করে থাকি।

৫। নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু আলোচনা করো।

নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু

নৈতিক বিচারের বিষয়গুলি নিম্নে আলোচনা করা হল-

(1) ঐচ্ছিক ক্রিয়া: নীতিবিদগণ বলে থাকেন আমাদের যে-সমস্ত ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকে, সেইসব ঐচ্ছিক ক্রিয়াগুলির নৈতিক বিচার করা হয়। অর্থাৎ ঐচ্ছিক ক্রিয়াগুলিই নৈতিক বিচারের বিষয়।

(2) ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ধারণা: যখন আমরা পূর্ব থেকে কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উক্ত উদ্দেশ্য সিদ্ধির কামনায় উপযুক্ত উপায় নির্বাচনপূর্বক ক্রিয়া সম্পাদন করি, তখন তাকে বলা হয় ঐচ্ছিক ক্রিয়া। ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমরা স্বাধীনভাবে উদ্দেশ্য স্থির ও উপায় নির্বাচন করে থাকি। এই ক্রিয়া সম্পাদনের ব্যাপারে ব্যক্তির ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং তৎসহ দায়িত্ববোধ থাকে বলে ওই ক্রিয়াগুলি ভালো না মন্দ, ন্যায় না অন্যায় এরূপ বিচার করা যায়। এখন বিচার্য হল, ঐচ্ছিক ক্রিয়া সামগ্রিকভাবে, না এর কোনো বিশেষ স্তর নৈতিক বিচারের বিষয় অর্থাৎ ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মানসিক স্তর নৈতিক বিচারের বিষয় নাকি দৈহিক স্তর বা বাহ্যিক পরিণাম?

(3) সুখবাদ: নীতিবিদ্যায় পরস্পরবিরোধী দুটি মতবাদ গড়ে উঠেছে। যথা- সুখবাদীদের মত এবং বুদ্ধিবাদীদের মত। সুখবাদীগণ মনে করেন ঐচ্ছিক ক্রিয়ার বাহ্যিক পরিণাম বা ফলাফলের স্তরই নৈতিক বিচারের উপাদান হয়। অর্থাৎ তাদের মতে, যে ক্রিয়ার ফলাফল সুখকর তৃপ্তিদায়ক, তা হল ভালো বা ন্যায়। অপরপক্ষে, বুদ্ধিবাদীদের মতে, যে ক্রিয়ার ফলাফল দুঃখজনক বা বেদনাদায়ক তা মন্দ বা অন্যায়রূপে বিবেচিত হয়।

(4) বুদ্ধিবাদ: বুদ্ধিবাদীদের মতে, কাজের ফলাফল বা বাহ্যিক পরিণাম নৈতিক বিচারের যথার্থ বিষয়বস্তু হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে উদ্দেশ্য, অভিপ্রায় ইত্যাদি যে-সমস্ত মানসিক অবস্থা ক্রিয়া-সম্পাদনের মূল উৎস বা প্রেরণাস্বরূপ কাজ করে থাকে সেগুলি নৈতিক বিচরের বিষয়। অর্থাৎ একমাত্র মানসিক দিক বিবেচনা করে কাজের নৈতিক গুণাগুণ নির্ধারণ করা উচিত।

(5) কাল্টের মত: দার্শনিক কান্টের মতে, একমাত্র সৎ ইচ্ছাই হল সৎ। তা ছাড়া সবকিছুই শর্তসাপেক্ষে সৎ। একমাত্র সৎ ইচ্ছা আপন আলোকে দীপ্তমান এবং এক দৃঢ় প্রচেষ্টা বা নিয়ত সুফল বা কল্যাণ দান করে। তাই সৎ ইচ্ছা ছাড়া কোনো সৎ ক্রিয়া হতে পারে না। এখন প্রশ্ন হল, মানসিক দিকের মধ্যে যে-সমস্ত বিভিন্ন স্তর রয়েছে, সেগুলির মধ্যে কোন্টি নৈতিক বিচারের বিষয় হবে।

(6) উদ্দেশ্য বিচারের বিষয়: মার্টিন্যু প্রমুখ স্বজ্ঞাবাদী নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু হিসেবে উদ্দেশ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর মতে, যে উদ্দেশ্য দ্বারা আমরা ক্রিয়া করতে প্রণোদিত হই, তার দ্বারা আমাদের কাজের ভালো-মন্দ বিচার করা উচিত।

৬। “সব ভালো যার শেষ ভালো”-এই নীতিবাক্যটি কি সমর্থনযোগ্য?

শেষ শব্দের অর্থ

‘শেষ’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘End’ যার দুটি অর্থ হতে পারে। প্রথম অর্থ হল ‘ফল’ (Consequence বা Result) । এটি হল শব্দটির লৌকিক অর্থ। শব্দটির দ্বিতীয় অর্থ হল উদ্দেশ্য (Motive) বা কাজের লক্ষ্য। দুটি অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নটির বিচার করা প্রয়োজন।

(1) প্রথম অর্থ: সুখবাদীরা ‘শেষ’ (End) শব্দটিকে প্রথম অর্থে গ্রহণ করে বলেন কর্মের ফল দেখে ঐচ্ছিক ক্রিয়ার নৈতিক বিচার করতে হবে। কর্মের ফল যদি সুখদায়ক হয় তবে কর্মটি শুভ বলে বিবেচিত হবে, ফল সুখদায়ক না হলে, অর্থাৎ দুঃখদায়ক হলে কর্ম নীতিগতভাবে মন্দ বলে বিবেচিত হবে। মিল বলেন, নৈতিকতার সঙ্গে উদ্দেশ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর মতে কোনো দস্যু যদি লুণ্ঠিত অর্থে শিশুদের জন্য হাসপাতাল করে এবং এর দ্বারা যদি শিশুরা প্রকৃতভাবে উপকৃত হয় তবে তার কাজের ফল ভালো হওয়ায় নীতিগতভাবে কাজটি সৎ বলে বিবেচিত হবে। সুতরাং এই মতে “সব ভালো যার শেষ ভালো”- এই নীতিবাক্যটি সমর্থনযোগ্য।

সুখবাদীদের এই অভিমত গ্রহণ করা যায় না। ফলাফল দেখে কর্মের নৈতিক বিচার করা সংগত নয়। অনেকেক্ষেত্রেই কর্মের ফলাফলের সঙ্গে ব্যক্তির উদ্দেশ্যের সংগতি থাকে না। ড: জনসন একটি ভিক্ষুকের প্রতি বিরক্ত হয়ে তার মাথায় আঘাত করার উদ্দেশ্যে একটি মুদ্রা ছুঁড়ে মারলেন। মুদ্রাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মাটিতে পড়ল ও ভিক্ষুক মুদ্রাটি কুড়িয়ে নিয়ে খাবার কিনে খেল। এই ক্ষেত্রে কর্মের বাহ্যফল ভালো হলেও উদ্দেশ্য মন্দ হওয়ায় তার কাজটি নীতিগতভাবে মন্দ কাজ।

আবার, ফলাফলের উপর ব্যক্তির সব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলাফল অপ্রত্যাশিত হতে পারে। একজন দক্ষ শল্যচিকিৎসক রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে রোগীর দেহে সততার সঙ্গে অস্ত্রোপচার করলেন। কিন্তু রোগীটি মারা গেল। এইক্ষেত্রে উদ্দেশ্য সৎ হওয়ায় আমরা ফলাফল উপেক্ষা করে বলতে পারি চিকিৎসকের কাজ নীতিগতভাবে মন্দ নয়। সুতরাং “সব ভালো যার শেষ ভালো”-এই নীতিবাক্যটি যদি প্রথম অর্থে গ্রহণ করা হয়, তবে তা সমর্থন করা যায় না।

(2) দ্বিতীয় অর্থ : ‘শেষ’ (End) শব্দটিকে দ্বিতীয় অর্থে গ্রহণ করলেও একে সমর্থন করা যায় না। দ্বিতীয় অর্থে ‘শেষ’ শব্দের অর্থ কর্মের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য (Motive)। অবশ্য কোনো কোনো বুদ্ধিবাদী দার্শনিক ‘শেষ’ শব্দটিকে এই অর্থে গ্রহণ করে নীতিবাক্যটিকে সমর্থন করে থাকেন। তাঁরা বলেন কোনো কাজের উদ্দেশ্য ভালো হলে কাজটিকে অবশ্যই ভালো বলতে হবে।

প্রতিটি ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মূলে থাকে কোনো অভাববোধ থেকে আসা কাম্যবস্তুর ধারণা, যা ঐ অভাববোধকে দূর করতে পারে বলে ব্যক্তি মনে করে। ঐ কাম্যবস্তু হল লক্ষ্য, যাকে লাভ করার জন্য ব্যক্তি কর্মে প্রবৃত্ত হয়। বাটলার প্রমুখ স্বজ্ঞাবাদীরা দাবি করেন যে নৈতিক বিচারের প্রকৃত বিষয় হল উদ্দেশ্য। কাজের ফল যাই হোক না কেন, কোনো কাজের উদ্দেশ্য সৎ হলে কাজটিকে শুভ বলতে হয়।

Also Read – The Garden Party questions and answers

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment