আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যের ধারা প্রশ্ন উত্তর Class 11 Second Semester

সূচিপত্র

আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যের ধারা প্রশ্ন উত্তর

আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যের ধারা প্রশ্ন উত্তর
আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যের ধারা প্রশ্ন উত্তর

১। অমৃতলাল বসুর নাট্যকৃতিত্ব আলোচনা করো।

মঞ্চাধ্যক্ষ: অমৃতলাল বসু (১৭এপ্রিল, ১৮৫৩-২জুলাই, ১৯২৯) ছিলেন একাধারে অভিনেতা, নাট্যপরিচালক, মঞ্চাধ্যক্ষ ও মঞ্চমালিক। গিরিশচন্দ্রের শিষ্য হলেও নাটক রচনার ক্ষেত্রে তিনি ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছিলেন। ন্যাশনাল থিয়েটার, গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার, বেঙ্গল, স্টার, মিনার্ভা প্রভৃতি রঙ্গালয়ের সঙ্গে তিনি নানা সময়ে যুক্ত ছিলেন। গুর্মুখ রায়ের থেকে স্টার থিয়েটারকে কিনে নেওয়ার পর হাতিবাগানে নতুন ‘স্টার’ নির্মাণ করে, তাতেই জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন অমৃতলাল। তিনি নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবদ্ধ কার্যপ্রণালী, থিয়েটারের প্রতিটি অংশের মধ্যে সমন্বয়সাধনের জন্য খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তাঁর পরিচালনায় স্টার থিয়েটার আদর্শ রঙ্গালয়ে পরিণত হয়েছিল। গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার যখন ব্রিটিশবিরোধী নাটক করে ইংরেজ সরকারের কোপে পড়ে, সেই সময় তিনি গ্রেট ন্যাশনালের ম্যানেজার হিসেবে জেলও খাটেন। এরপরই কুখ্যাত নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণীত হয়।

অভিনেতা: শ্লেষযুক্ত কৌতুক অভিনয়ে অমৃতলাল শ্রেষ্ঠ ছিলেন, তাই তাঁকে ‘রসরাজ’ আখ্যা দেওয়া হয়। এদিক থেকে তিনি অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির যোগ্য উত্তরসূরি। তিনি নারীচরিত্র সৈরিন্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করেন।

নাট্যকার: অমৃতলাল বসু নাটক, প্রহসন, নবত্রাও রচনা করেছিলেন। সেগুলির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল- ‘হীরকচূর্ণ’, ‘চাটুজ্জে-বাড়ুজ্জে’, ‘বিবাহ বিভ্রাট’, ‘কৃপণের ধন’, ‘ব্যাপিকা বিদায়’, ‘দ্বন্দ্বে মাতনম্’, ‘যাজ্ঞসেনী’ ইত্যাদি।

২। নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।

ভূমিকা: উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ নাগাদ (১৮৭৩) স্থাপিত ন্যাশনাল থিয়েটার আক্ষরিক অর্থে ঘুম কেড়ে নেয় ব্রিটিশ সরকারের। কারণ এই থিয়েটার কর্তৃক অভিনীত হতে থাকা একের পর এক ব্রিটিশবিরোধী নাটক ব্রিটিশ সরকারকে রঙ্গমঞ্চ শাসনের কথা ভাবাতে থাকে।

বাস্তবায়ন: ব্রিটিশ সরকারের এই ভীতিকে দ্রুত বাস্তবায়িত করে সেই সময়ের একটি ঘটনা। গ্রেট ন্যাশনালের ম্যানেজার, নাট্যকার তখন উপেন্দ্রনাথ দাস। মহারানি ভিক্টোরিয়ার পুত্র প্রিন্স অব ওয়েল্স বা সপ্তম এডোয়ার্ড, ১৮৭৫ সালে হাইকোর্টের তৎকালীন উকিল জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে এলে তাঁর বাড়ির মহিলারা অন্তঃপুর ছেড়ে বেরিয়ে এসে শাঁখ বাজিয়ে এডোয়ার্ডকে অভ্যর্থনা জানান। এই নিয়ে বঙ্গসমাজে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে উপেন্দ্রনাথ দাস ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ প্রহসন মঞ্চস্থ করলে পুলিশের নির্দেশে তার অভিনয় বন্ধ হয়। ফলে, প্রহসনের নাম বদলে নাট্যনির্মাতারা নাম রাখেন ‘হনুমানচরিত’। ক্ষুদ্ধ বড়োলাট লর্ড নর্থ বুক এই বিদ্রূপাত্মক প্রহসনের অভিনয় নিষিদ্ধ করার জন্য একটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন।

নির্মিত বিল পাস: ৪মার্চ, ১৮৭৬ সালে যখন নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সতী কি কলঙ্কিনী?’ গীতিনাট্য অভিনীত হচ্ছিল তখন কলকাতার পুলিশ সদলবলে এসে থিয়েটারের সকলকে একযোগে গ্রেফতার করে। পরে বিচারে থিয়েটারের ডিরেক্টর ও ম্যানেজার যথাক্রমে উপেন্দ্রনাথ দাস ও অমৃতলাল বসু ছাড়া অন্য ধৃতরা বেকসুর খালাস পান। উপেন্দ্রনাথ দাস ও অমৃতলাল বসুর এক মাসের কারাদণ্ড হয়। এরপরই ১৮৭৬ সালের ২০ মার্চ ড্রামাটিক পারফরম্যান্স বিল পেশ করা হয়। এরপর ১৬ ডিসেম্বর ১৮৭৬ সালে বিলটি ‘আইনে পরিণত হয়, তখন তার নাম হয় ড্রামাটিক পারফরম্যান্স অ্যাক্ট বা ‘নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন’।

৩। গণনাট্য আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

সূত্রপাত: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সারা পৃথিবীজুড়ে দেখা দেয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অব্যবস্থা, শুরু হয় অর্থনৈতিক মন্দা। এর ফলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির দুর্বলতা সকলের সামনে চলে আসে। দেশাত্মবোধের মুখোশ পরে ইটালি, জার্মানি, স্পেন, গ্রিস, জাপান ইত্যাদি দেশে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলির উত্থান ঘটে। ফেদেরিকো লোরকা, র‍্যালফ্ ফক্স-সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ফ্যাসিস্ট শক্তির নিন্দা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ রোমা রোলাঁ, আঁদ্রে জিদ, এপকেনস্টাইন প্রমুখ পৃথিবীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীরা গণতন্ত্র ও মানবিকতা হত্যার বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার শপথ নেন। এইসময় সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা উৎসাহ-উদ্দীপনার সঞ্চার ঘটায় এবং একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ তথা ফ্যাসিবাদের প্রতি তীব্র ধিক্কার জানায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবর্ষে গণনাট্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।

আদর্শ কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক মঞ্চ IPTA (Indian Peoples’ Theatre Association) গড়ে ওঠে। এ ছাড়াও গড়ে ওঠে ফ্যাসিবিরোধী লেখক-শিল্পী সংঘ। গণনাট্যের আদর্শগুলি হল-

  • নাটক অথবা যে-কোনো শিল্পে বাস্তব জীবনসমস্যার ছবি ফুটে উঠবে। সেই সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা দেখানো হবে জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই।
  • ব্যক্তিচরিত্রকে বিশিষ্ট শ্রেণির অন্তর্গত করে প্রদর্শিত করতে হবে এবং সেই শ্রেণির মানসিকতাও চিত্রিত হবে।
  • ব্যক্তিমানুষের নয়, প্রধান হয়ে উঠবে ব্যক্তিসমষ্টির কথা।
  • জনতার মনোরঞ্জন এবং শিক্ষাবিধানের উদ্দেশ্যে শিল্প রচিত হবে।
  • লোকসংস্কৃতি ও পরিবেশনের মধ্য দিয়ে লোকহৃদয়কে উপলব্ধি করতে হবে এবং নগরজীবনের মধ্যবিত্ত মানসিকতা পরিত্যাগ করে শ্রমজীবী এবং গ্রামীণ লোকমানসের কাছাকাছি এসে প্রবেশ করতে হবে।

৪। নাট্যকার তুলসী লাহিড়ীর নাট্যপ্রতিভা আলোচনা করো।

সূচনা: বাংলার নাট্যজগৎ ও চিত্রজগতের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন তুলসী লাহিড়ী। চিত্রজগতে তিনি মূলত কৌতুক অভিনেতা হলেও, তাঁর নাটকে সমাজের উপেক্ষিত ও বিপন্ন সব মানুষের বঞ্চনা ও বেদনা বাস্তব সত্যের স্পর্শে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর রচিত বিশিষ্ট নাটকগুলি হল ‘দুঃখীর ইমান’ (১৯৪৭), ‘ছেঁড়া তার’ (১৯৫৩) প্রভৃতি। তাঁর অন্যান্য নাটকগুলি হল- ‘বাংলার মাটি’, ‘মায়াকাজল’, ‘ঠিকাদার’, ‘চোরাবালি’, ‘সর্বহারা’, ‘পথিক’, ‘লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার’, ‘মিলন’ প্রভৃতি।

দুঃখীর ইমান’, ‘পথিক’: তুলসী লাহিড়ী রচিত ‘দুঃখীর ইমান’ নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় শ্রীরঙ্গম নাট্যমঞ্চে, ১৯৪৭ সালে। এই নাটকে হিন্দু ও মুসলিম কৃষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দুঃখীদের কথা বর্ণিত হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে তুলসী লাহিড়ী ‘বহুরূপী’ নাট্যদলে যোগ দেন। ১৯৪৯-এ তাঁর ‘পথিক’ নাটক দিয়ে বহুরূপীর যাত্রা শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে কালোবাজারি ও কয়লাখনির মজুরদের জীবনসংগ্রাম হয়ে ওঠা ‘পথিক’ নাটকের বিষয়বস্তু।

‘ছেঁড়া তার’: পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিতে রংপুর জেলার গ্রাম্য কৃষক সমাজকে নিয়ে কামরূপী উপভাষায় রচিত ‘ছোঁড়া তার’ নাটকটি বিশেষ জনসমাদর লাভ করেছিল। মন্বন্তর, সাধারণ লোকের সুখী জীবনের যে ভয়ানক সর্বনাশ ঘটিয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই নাটকে।

‘লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার’: পরবর্তী সময়ে তুলসী লাহিড়ী বহুরূপী থেকে বেরিয়ে প্রথমে ‘আনন্দম’ ও পরে ‘রূপকার’ নাট্যদলের প্রবর্তন করেন। দারিদ্র্য ও বঞ্চনা মানুষের জীবনকে কীভাবে শোচনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনে, তার এক মর্মান্তিক চিত্র রচনা করেছেন ‘লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার’ নাটকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পশ্চিম বাংলার গণনাট্য সংঘের অন্যতম সমাজসচেতন, বলিষ্ঠ ও বাস্তববাদী নাট্যকার হিসেবে তুলসী লাহিড়ী স্মরণীয়।

৫। বিজন ভট্টাচার্যের নাট্যক্তিত্ব আলোচনা করো।

গণনাট্য আন্দোলনের পুরোধা, নবনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ এবং বিশিষ্ট অভিনেতা, পরিচালক ও সংগঠক হিসেবে বাংলা নাটকের জগতে সমাদৃত হয়ে আছেন বিজন ভট্টাচার্য। গভীর সমাজবোধ, জীবনদর্শন ও মানবিক প্রকরণের মধ্য দিয়ে রচিত ২৬টি নাটক-নাটিকা, গীতিনাট্য তাঁর প্রতিভার পরিচয়বাহী।

নাট্যকৃতিত্ব: বিজন ভট্টাচার্যের বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ নাটকগুলি হল- ‘নবান্ন’, ‘অবরোধ’, ‘গোত্রান্তর’, ‘জতুগৃহ’, ‘দেবীগর্জন’, ‘গর্ভবতী জননী’, ‘আজ বসন্ত’, ‘গুপ্তধন’ ইত্যাদি। বিশিষ্ট একাঙ্ক নাটকগুলি হল-‘আগুন’, ‘জবানবন্দী’, ‘কলঙ্ক’, ‘সাগ্নিক’, ‘হাঁসখালির হাঁস’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও গীতিনাট্য ‘জীয়নকন্যা’ ও রূপক নাট্য ‘স্বর্ণকুম্ভ’ বিখ্যাত।

নাট্যপ্রতিভা: বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটকটিতে ১৯৪৩-এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, সমকালের সমাজ ও শোষণ নিপুণভাবে চিত্রিত। সমকালের নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে ‘নবান্ন’-র প্রভাব অনস্বীকার্য। ‘জীয়নকন্যা’ কমিউনিস্ট ভাবধারার অনুগামী। ‘অবরোধ’ নাটকে শ্রমিক ও মালিক শ্রেণির দ্বন্দ্বের কথা আছে। ‘গোত্রান্তর’ নাটকে বাস্তুহারা এক শিক্ষকের জীবনযন্ত্রণার কথা অঙ্কিত। ‘দেবীগর্জন’ নাটকটি কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত। ‘হাঁসখালির হাঁস’ নামক একাঙ্ক নাটকে কৃষকজীবনের কথা বর্ণিত। কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী মানুষটি কেবল নাট্যকার হিসেবে খ্যাত নন, তিনি প্রকৃত অর্থে নাট্যযোদ্ধা এবং নাট্যগুরু হিসেবে বাঙালিদের কাছে সমাদৃত। চরিত্রনির্মাণের দিক থেকে, সংলাপ রচনায়, কাহিনির অভিনবত্বে, নাট্যদ্বন্দ্ব তৈরিতে, মঞ্চসজ্জায়, আঙ্গিক প্রকরণে তিনি নাট্য আন্দোলনের পুরোধা এবং তাঁর প্রদর্শিত পথেই উত্তরকালের বাংলার নাট্যচর্চার বিকাশ পরিলক্ষিত হয়।

৬। নবনাট্য আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

নবনাট্য আন্দোলন: গণনাট্য আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে নবনাট্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। গঙ্গাপদ বসুর কথায় নবনাট্য আন্দোলনের সংজ্ঞা দেওয়া যায়-“…সৎ মানুষের নতুন জীবনবোধের এবং নতুন সমাজ ও বলিষ্ঠ জীবনগঠনের মহৎ প্রয়াস যে সুলিখিত নাটকে শিল্পসুষমায় প্রতিফলিত, তাকেই বলতে পারি নবনাট্যের নাটক”। গণনাট্য ভেঙে নবনাট্যধারা তৈরি হওয়ার মূলে প্রধান বিতর্কের বিষয় ছিল-শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্ক। রাজনীতি-নিরপেক্ষ শিল্পনির্মাণে নবনাট্য আন্দোলনের সূত্রপাত। নবনাট্য আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য নাট্যকারেরা হলেন শম্ভু মিত্র (‘রাজা অয়দিপাউস’, ‘চাঁদ বণিকের পালা’), তৃপ্তি মিত্র (‘ইঁদুর’, ‘বিদ্রোহিণী’), সুনীল দত্ত (‘জতুগৃহ’, ‘হরিপদ মাস্টার’), উমানাথ ভট্টাচার্য (‘সমান্তরাল’, ‘ছারপোকা’) প্রমুখ।

নবনাট্য আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য:

  • জীবনের জন্য শিল্প-নবনাট্য আন্দোলনকারীরা এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। 
  • ব্রাত্য ও উপেক্ষিত কৃষক-শ্রমিকদের জীবনযন্ত্রণার ইতিহাস ছিল এই ধারার নাটকের মুখ্য বিষয়। 
  • এই ধারার নাটকের মধ্যে উপস্থাপিত হত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।
  • মধ্যবিত্ত সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেত।
  • ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশ পেত।

ধনতন্ত্রবাদের বিকাশ সমাজভাবনার বিরুদ্ধে গিয়ে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান তৈরির হাতছানি দিয়েছিল শিল্পীদের। আর সেই তাগিদেই মধ্যবিত্ত মানসিকতা মুক্তির অবকাশ খুঁজেছিল নবনাট্যধারার ছত্রছায়ায়।

৭। গণনাট্য ও নবনাট্য আন্দোলনের ধারায় শম্ভু মিত্রের অবদান আলোচনা করো।

আন্দোলনের ধারায় শম্ভু মিত্রের অবদান: বিংশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ থেকেই বাংলা নাট্যধারার ইতিহাসে একটি নতুন ভাব বা চেতনার স্রোত সংযোজিত হয়, সেটি হল গণনাট্যের ধারা। গণজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে নয়; মানুষের সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতির ফলে তার বিপন্নতা ও অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রামী সত্তাকে নাটকের অঙ্গীভূত করার তাগিদ এই সময়ের নাট্যব্যক্তিত্বদের মধ্যে ধরা পড়ে। এর নাম দেওয়া হয় গণনাট্য আন্দোলন। এর পরবর্তী স্তরে নতুন জীবনবোধ ও বলিষ্ঠ জীবনরচনার তাগিদে এক ধরনের শিল্পভাবনাময় নাট্যসৃষ্টির চর্চাও দেখা যায়, যাকে বলা যায় নবনাট্য আন্দোলন।

গণনাট্য আন্দোলনের পথ পেরিয়ে নবনাট্য আন্দোলনের সূচনা ও মহত্তর অগ্রগতির ক্ষেত্রে শম্ভু মিত্রের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শম্ভু মিত্রের (১৯২৫-১৯৯৭) কালজয়ী সৃষ্টির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘উলুখাগড়া’ দাঙ্গা-যুদ্ধ-মন্বন্তরবিধ্বস্ত পৃথিবীর ইতিহাসের এক রক্তাক্ত সময়কে অবলম্বন করে রচিত তাঁর এই প্রথম নাটক। এ ছাড়া ‘ঘূর্ণি’, ‘কাঞ্চনরঙ্গ’, গ্রিক নাট্যকার সফোক্লেস এর অনুসরণে ‘রাজা অয়দিপাউস’, ইবসেনের রচনা অবলম্বনে ‘পুতুলখেলা’, ‘গর্ভবতী বর্তমান’, ‘অতুলনীয় সংবাদ’, ‘বিভাব’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া মনসামঙ্গল কাব্যকাহিনির প্রেক্ষাপটে চাঁদ সদাগরের ট্র্যাজিক পরিণতি অবলম্বনে ‘চাঁদ বণিকের পালা’ তাঁর অতুলনীয় কৃতিত্ব। ১৯৪৮ সালে তাঁরই উদ্যোগে বাংলার প্রথম ব্যতিক্রমী নাট্যদল ‘বহুরূপী’-র প্রতিষ্ঠা হয়। শম্ভু মিত্র ‘বহুরূপী’র মাধ্যমে বাংলা নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে আলোকদিশারির ভূমিকা পালন করেছিলেন।

৮। উৎপল দত্তের নাট্যকৃতিত্ব আলোচনা করো।

সূচনা: বিংশ শতকের বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে শ্রদ্ধার আসনে আসীন উৎপল দত্ত। তাঁর লেখা মোট ছোটো-বড়ো নাটকের সংখ্যা ৭০-এর কাছাকাছি এবং ২০টি যাত্রাপালা রচনায় তাঁর নাট্যকৃতিত্ব ধরা পড়ে। তিনি ১৯৪৭ সালে ‘দ্য শেক্সপিরিয়ান’ নামক দল গঠন করেন।

নাট্যসম্ভার: ‘ছায়ানট’ (১৯৫৪) তাঁর পূর্ণাঙ্গ নাটক, এখানে চিত্রতারকাদের জীবনের ওঠা-পড়া, সুখ-দুঃখ নিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। ‘অঙ্গার’ (১৯৫৯) নাটকে কয়লাখনির শ্রমিকদের দুঃসহ জীবন, মুনাফালোভী মালিকের নীচতার কাহিনি অঙ্কিত। ‘ফেরারি ফৌজ’ (১৯৬১) নাটকে ইংরেজ আমলের নির্মমতা ও প্রতিরোধের পরিচয় আছে। ১৯৬৮ সালে রচিত ‘কল্লোল’ নাটকটি নৌবিদ্রোহের পটভূমিকে তুলে ধরেছে।

‘টিনের তলোয়ার’ নাটকটি রঙ্গমঞ্চের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে লেখা এবং এখানে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নাট্যপ্রচেষ্টার পরিচয় মেলে। ‘ব্যারিকেড’ নাটকে হিটলারের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের মরণপণ লড়াই-এর কথা বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া ‘দাঁড়াও পথিকবর’, ‘টোটা’, ‘জনতার আফিম’, ‘তীর’, ‘তিতুমীর’, ‘অজেয় ভিয়েতনাম’, ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’ প্রভৃতি নাটকেও তাঁর নাট্যকৃতিত্বের সম্যক পরিচয় মেলে। সত্তরের দশকে জরুরি অবস্থার প্রতি তীব্র আঘাতের অভিপ্রায়ে তিনি লেখেন ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’। মার্কসীয় দর্শনে আদ্যন্ত বিশ্বাসী উৎপল দত্ত সাধারণ মানুষের মুক্তি, শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখিয়েছেন মানুষকে। তাঁর বিদ্রোহী নাট্যভাবনার মধ্যে যে মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের সহাবস্থান ছিল-তা উত্তরকালের নাট্যচর্চা তথা আন্দোলনের পথ প্রস্তুত করেছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘পিপল্স লিটল থিয়েটার’ (১৯৬৯) বর্তমানে তাঁর প্রদর্শিত পথেই বাংলা নাট্যচিন্তাকে প্রবহমানতা প্রদান করে চলেছে। নাট্য আন্দোলনের যথার্থ শিক্ষকরূপে বাংলার নাট্যসাহিত্যে তাঁর নামটি শাশ্বতকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

৯। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাট্যকৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো।

নাট্যজীবনের সূচনা: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৩- ১৯৮৩) স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা থিয়েটারের এক অসাধারণ প্রতিভাবান অভিনেতা, নাট্যকার ও নাট্য পরিচালক। ছাত্রজীবন থেকেই নাট্যকলায় তাঁর হাতেখড়ি হয়। গণনাট্য সংঘের কর্মী হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন সক্রিয় থাকার পর ১৯৬০ সালের ২৯ জুন ‘নান্দীকার’ নাট্যদলের প্রতিষ্ঠা করেন।

নাট্যরচনা ও প্রযোজনা: নান্দীকার-এ অজিতেশ অনেকগুলি নাটক রচনা ও প্রযোজনা করেছেন, তার মধ্যে মৌলিক নাটক ‘সেতুবন্ধন’, ‘হে সময় উত্তাল সময়’, ‘সওদাগরের নৌকা’। বিদেশি নাটক থেকে বাংলায় রূপান্তরিত নাটকগুলি হল-আন্তন চেকভের নাটক অবলম্বনে ‘পান্থশালা’, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও’, ‘মঞ্জুরী আমের মঞ্জুরী’, ‘নানা রঙের দিন’; লুইজি পিরানদেল্লোর নাটক অবলম্বনে ‘শের আফগান’, ইবসেনের নাটক অবলম্বনে ‘বিদ্রোহী’, ব্রেখট-এর নাটক অনুবাদ করে লেখেন ‘তিন পয়সার পালা’ প্রভৃতি।

তিনি রবীন্দ্রনাথের গল্প ও উপন্যাসের (‘রবিবার’, ‘চার অধ্যায়’, ‘বদনাম’) এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পরিণীতা’-র নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। 

১৯৭৭ সালে সাংগঠনিক কারণে অজিতেশ ‘নান্দীকার’ ত্যাগ করেন। ওই বছরই তিনি ‘নান্দীমুখ’ নাট্যদলের প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে নান্দীকারের নাটকগুলিই অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রযোজিত হয়।

নাট্যকৃতিত্ব: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ করা নাটকগুলির মাধ্যমে বাঙালি পাঠক ও দর্শক বিশ্বের বিখ্যাত নাট্যকারদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি প্রযোজনা, অভিনয় এবং নাট্যরচনার জন্য সংগীত নাটক অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন। এ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সরকার, মস্কো নিউজ ক্লাব, ক্রিটিক সার্কল অফ ইন্ডিয়া-র পক্ষ থেকেও বহু পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন।

শুধু নাট্যমঞ্চে নয়, যাত্রা এবং চলচ্চিত্র শিল্পেও তাঁর খ্যাতি ছিল আকাশছোঁয়া। তিনিই ছিলেন বাংলা নাট্যমঞ্চে উৎপল দত্ত-শম্ভু মিত্র পরবর্তী যুগের আধুনিকতার প্রধান কান্ডারি।

১০। বাদল সরকারের নাট্যকৃতিত্ব আলোচনা করো।

নাট্যচর্চা: বাদল সরকারের প্রকৃত নাম সুধীন্দ্র সরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতেই তাঁর নাট্যভাবনার উদয়। তিনি ১৯৫৩-তে মাইথনে থাকার সময় নাটক লেখা ও অভিনয়ের প্রস্তুতি শুরু করেন। ১৯৫৯-এ কলকাতায় ফিরে নাট্যগোষ্ঠী ‘চক্র’ তৈরি করেন। লন্ডনে থাকার সময় প্রথম মৌলিক নাটক ‘বড়ো পিসীমা’ লেখেন। ১৯৬৭-তে প্রতিষ্ঠিত দল হল ‘শতাব্দী’। ৬০-এর দশকে লেখা ও প্রযোজিত নাটকগুলি বেশিরভাগই হাস্যরসাত্মক, হালকা কমেডি। ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘পাগলা ঘোড়া’ ইত্যাদি নাটকগুলির মধ্য দিয়ে তিনি সভ্যতার সংকট, অস্তিত্বের সংকটকে তুলে ধরেছেন।

প্রসঙ্গ থার্ড থিয়েটার: ১৯৭০-এর দশকের গোড়া থেকেই তিনি বিকল্প থিয়েটারের সন্ধান করেন। তিনি তিনটি বেড়া ভেঙেছিলেন অঙ্গনমঞ্চে- দূরত্বের বেড়া, স্তরের বেড়া, দর্শকের সঙ্গে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বেড়া। যাত্রা হল প্রথম থিয়েটার, প্রসেনিয়াম হল দ্বিতীয় থিয়েটার এবং অঙ্গনমঞ্চ হল থার্ড থিয়েটার। একটি খোলা হলঘরের চারদিকে দর্শক বসে। দর্শকের সঙ্গে একই স্তরে বা একই সমতলে, একই আলোকবৃত্তে নাট্যাভিনয় হল। কোনো মঞ্চব্যবস্থাই রইল না। ‘স্পার্টাকাস’ (২৮ জানুয়ারি, ১৯৭২) নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে নাট্যকুশলীদের সঙ্গে দর্শকদের দূরত্ব ঘুচল। সেট, স্পটলাইটের ব্যবহার মুছে গিয়ে দর্শকের কল্পনাশক্তি এবং অভিনেতার দেহ ও মনকে ব্যবহার করা হল। তবে খোলা জায়গায় অভিনয় মানেই তা মুক্তমঞ্চের নাটক, তা নয়। তাতে অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, সাধারণ মানুষের পাশে থাকা, সর্বোপরি বিপ্লবের বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্য থাকতে হবে। সাগিনা মাহাতো, মিছিল, ভানুমতী কা খেল, সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস, ক-চ-ট-ত-প, পদ্মানদীর মাঝি, দখল-প্রসেনিয়ামের জন্য লেখা নাটকে বাদল সরকার যে খ্যাতি পাননি, বিকল্প থিয়েটার তাঁকে সেই সাফল্য এনে দিল।

প্রসেনিয়াম থেকে শুরু করে গ্রাম পরিক্রমা- দর্শকের জন্য অপেক্ষা না করে নাট্যদলই বেরিয়ে পড়ল দর্শকের সন্ধানে। সমাজের নীচুতলার নিপীড়িত মানুষের কথা শুনতে, তাদের কথা বলতে, তাদের পাশে থাকতে। পরবর্তীকালে তাঁর অনুসারী প্রচুর নাট্যদল তৈরি হয়েছে।

১১। সাম্প্রতিক কালের নাট্যচর্চার বিবর্তন আলোচনা করো।

সূচনা: একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক উপস্থিত। বাংলা নাটকের স্বাধীনভাবে এই সুদীর্ঘ পথ চলায়, সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাঙালির নাট্যচর্চাও আরও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলা নাটক, পরিবর্তনের প্রভাবকে আত্তীকরণ করেই সমাজ ও সামাজিক জীবনের কল্যাণসাধনের হাতিয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলা নাটকের এই গতিকে ত্বরান্বিত করতে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন ও করেন তাঁদের মধ্যে মোহিত চট্টোপাধ্যায় (‘রাক্ষস’, ‘সোনার চাবি’, ‘বর্ণ বিপর্যয়’), দেবাশিস মজুমদার (‘ইমন কল্যাণ’), মনোজ মিত্র (‘গল্প হেকিম সাহেব’, ‘কাকচরিত্র’, ‘দম্পতি’), রমাপ্রসাদ বণিক (‘সহবাস’, ‘মানানসই’, ‘ভ্যাবলাই ভালো’), জোছন দস্তিদার (‘কালোমাটির কান্না’), সরোজ রায় (‘গরুর গাড়ির হেডলাইট’) প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্ব স্মরণীয়। এ ছাড়াও অরুণ মুখোপাধ্যায়ের ‘চেতনা’ নাট্যগোষ্ঠী (দুটি বিখ্যাত নাটক-‘মারীচ সংবাদ’, ‘জগন্নাথ’), বিভাস চক্রবর্তীর ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’, বিপ্লবকেতন চক্রবর্তীর ‘থিয়েটারওয়ালা’ নাট্যদল বাংলার নাট্যমঞ্চকে সমৃদ্ধ করেছে।

উত্তরাধিকার: বাংলা নাট্যচর্চাকে বিশ্বমানের করে তুলতে পিছিয়ে নেই উত্তরসূরিরাও। অরুণ মুখোপাধ্যায়ের দুই সুযোগ্য পুত্র সুমন মুখোপাধ্যায় ও সুজন মুখোপাধ্যায়, বিপ্লবকেতন চক্রবর্তীর দুই কন্যা সুদীপ্তা চক্রবর্তী ও বিদিপ্তা চক্রবর্তী বর্তমানে নাট্যমঞ্চের অন্যতম কুশলী। রুদ্রপ্রসাদ ও স্বাতীলেখার কন্যা সোহিনী সেনগুপ্ত বর্তমানে নান্দীকারের কর্ণধার। শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্রের সুযোগ্যা কন্যা শাঁওলী মিত্র তাঁর ‘পঞ্চম বৈদিক’ (যে দলের কান্ডারি বর্তমানে অর্পিতা ঘোষ) নাট্যদলের প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর ‘নাথবতী অনাথবৎ’, ‘কথা অমৃতসমান’ প্রভৃতি নাটকগুলি নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে চিরভাস্বর।

স্বতন্ত্র অভিনেতা হিসেবে দেবশঙ্কর হালদার, গৌতম হালদার (ন’য়ে নাটুয়া নাট্যগোষ্ঠী); অনির্বাণ ভট্টাচার্য, অর্ণ মুখোপাধ্যায়েরা (নটধা নাট্যগোষ্ঠী) বঙ্গীয় নাট্যমঞ্চের অন্যতম জনপ্রিয় প্রতিভূ। অপরদিকে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় (‘সংস্কৃতি’ নাট্যদল); সৌমিত্র বসু, কৌশিক সেন (‘স্বপ্নসন্ধানী’ নাট্যগোষ্ঠী); ব্রাত্য বসুর (‘কালিন্দী ব্রাত্যজন’ নাট্যগোষ্ঠী) মতো নাট্যব্যক্তিত্বরা নাটককে শুধু দর্শক নয়, পাঠকসমাজের কাছেও সমাদৃত করে চলেছেন। •

ব্যতিক্রমী নাট্যচর্চা: মূলস্রোতের নাট্যচর্চার পাশাপাশি ব্যতিক্রমী নাট্যচর্চার ধারায় প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব হলেন বাংলায় মূকাভিনয়ের পথিকৃৎ যোগেশ দত্ত। তাঁর নিজস্ব মূকাভিনয় সংস্থার নাম ‘পদাবলি’। এ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহায়তায় মূকাভিনয় শিক্ষাকেন্দ্র ‘যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমি’ (১৯৭৫) প্রতিষ্ঠা করেন।

দৃষ্টিহীনদের নিয়ে নাট্যচর্চায় অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেছেন শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর দল ‘অন্য দেশ’-এর পরিবেশনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তাসের দেশ’ নাটকটি বর্তমানে নিয়মিত মঞ্চস্থ হচ্ছে। এ ছাড়াও তাঁদের ‘রক্তকরবী’-র অভিনয় বহুলপ্রশংসিত হয়েছে।

প্রদীপ ভট্টাচার্য-র মতো মহানুভব ব্যক্তিরা জেলের কয়েদিদের থিয়েটারের মাধ্যমে জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনছেন।

উপসংহার: শিল্প হল সেই শুদ্ধতা যা মানুষের মনের অন্ধকারতম কোণেও আলো জ্বালাতে সক্ষম। আর নাটক হল এমন এক শিল্পমাধ্যম যা বহুমুখী ধারায় সময়ের সঙ্গে সংগতি রেখে মানবজাতির বিকাশের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। কাজেই বাংলা নাটকের এই সুদীর্ঘ ইতিহাস নদীর স্রোতের মতোই অবিরাম গতিতে পরবর্তী প্রজন্মেও প্রবাহিত হবে-এ কথা বলাই বাহুল্য।

১২। বাংলা সাহিত্যে যাত্রার উদ্ভব ও নাট্যমঞ্চের ভূমিকা আলোচনা করো।

সপ্তদশ শতকে যাত্রা: বাংলা তথা ভারতীয় যাত্রার ইতিহাস অতি প্রাচীন। সুপ্রাচীন চর্যাপদে কিংবা পালাগানে, কীর্তন কিংবা পাঁচালিতে নাটগীতির বহমানতার পরিচয় পাওয়া যায়। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে বাংলায় প্রচলিত ছিল কৃয়যাত্রা, ছিল রাধাকৃয়ের জীবনকথা নিয়ে উক্তি ও প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে গান ও কথার সমন্বয়।

উনিশ শতকে যাত্রা: কৃয়যাত্রার পর বাংলায় আখড়াই, হাফ-আখড়াই, খেউড়, তরজা, কবিগান ইত্যাদির প্রচলন ছিল। ‘সীতাহরণ’ পালার পুথি থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের যাত্রাপালা সম্পর্কে জানা যায়। যাত্রার সঙ্গে গানের নিকট সম্পর্ক ছিল। পয়ার বন্ধনে সংলাপের মধ্য দিয়ে যাত্রাগানের আসর বসত। সেই সময় কীর্তনের ‘গৌরচন্দ্রিকা’য় গীতিরীতির প্রভাব লক্ষ করা যায় যাত্রায়।

পালাগান: সেই সময় যাত্রার আসরে আয়োজিত অভিনয় বা পালাগানে নারীর ভূমিকায় অভিনয় করতেন পুরুষেরা। একসময় যা ছিল গানের আসরে সীমাবদ্ধ, পরবর্তী সময়ে তা দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে মানুষের মনোরঞ্জনের মাধ্যম হয়ে উঠল। এরই সূত্র ধরে একবিংশ শতকেও গ্রামের মানুষ যাত্রাকে ‘পালাগান’ বলে চিহ্নিত করেন।

পাশ্চাত্য আদর্শের প্রভাব: ১৮৩১ সালে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ‘হিন্দু থিয়েটার’ স্থাপনের মাধ্যমে নাটক বা যাত্রাপালার আয়োজন প্রত্যক্ষ করা যায়। কালীয়দমন, চন্ডীযাত্রা প্রভৃতি পালাগান রাঢ়বাংলায় প্রচলিত ছিল। ভদ্র পরিবারের সন্তানরাও এ ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠে। ১৮৩৫-এর অক্টোবরের শেষে শ্যামবাজারে নবীনচন্দ্র বসু তাঁর বাড়িতে পাশ্চাত্য আদর্শে রঙ্গমঞ্চ তৈরি করিয়ে বাঙালি নটনটীদের নিয়ে ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটক অভিনয়ের ব্যবস্থা করেন।

বাংলা নাটক অভিনয়: এরপর আশুতোষ দেবের বাড়িতে বাংলা নাটক অভিনীত হয় ১৮৫৭ সালের ৩০ জানুয়ারি। পরে রামজয় বসাকের বাড়িতে রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকের অভিনয় হয় ১৮৫৭ সালের মার্চে। ধীরে ধীরে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে বাংলা নাট্যাভিনয়ের ব্যবস্থা হয়। বাংলার প্রথম মৌলিক নাটক রচনার কৃতিত্ব মাইকেল মধুসূদন দত্তের। সমকালের যাত্রাগানের কদর্যতা ও নাটকের দুরবস্থা দেখে মধুসূদন নাটক লেখায় প্রেরণা পেয়েছিলেন।

১৩। মূল্যায়ন যাত্রাপালার ক্রমবিকাশের ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করো।

যাত্রা শব্দের অর্থ: ‘যাত্রা’ শব্দটির সাধারণ অর্থ যাওয়া বা গমন। প্রাচীন কাল থেকে উৎসব বোঝাতে ‘যাত্রা’ শব্দটির বহুল ব্যবহার করা হত। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে নাট্যগীতিমূলক অনুষ্ঠানে দেশীয় প্রচেষ্টার পরিণতিস্বরূপ যাত্রাশিল্পের উদ্ভব হয়। চর্যাপদে ‘বুদ্ধনাটক বিসমা হোই’ পদে যে নাট্যরীতির উল্লেখ রয়েছে তা যাত্রারই প্রায় সমতুল্য। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-ও নাটগীতি হিসেবে খ্যাত। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে বাংলায় দীর্ঘদিনের প্রচলিত কৃয়যাত্রা নতুন রূপ লাভ করে। উনিশ শতকের প্রারম্ভে যাত্রার ‘পুনর্বিকাশ’ ঘটে শিশুরাম অধিকারীর হাতে। এরপর যাত্রাপালায় বাঁক বদল ঘটান গোবিন্দ অধিকারী। পরে কৃষ্ণকমল গোস্বামী ভক্তিরস বিস্তারের উদ্দেশ্যে কৃয়যাত্রাকে নবরূপ প্রদান করেন। উনিশ শতকের সূচনা পর্ব থেকেই বিদ্যাসুন্দর যাত্রাও জনপ্রিয় হয় গোপালচন্দ্র দাসের প্রযোজনায়। এই সময়পর্বে লোকযাত্রার দল গড়ে তোলেন বকু মিঞা ও সাদের মিঞা নামে দুই ভাই। ঝাড়ুদাস অধিকারী, ব্রজমোহন রায়, হরিনাথ মজুমদার (কাঙাল হরিনাথ) প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের চেষ্টায় যাত্রা গ্রাম- গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। মতিলাল রায় ভাঁড়ামি ও অশ্লীলতার দায় থেকে মুক্ত করে যাত্রাকে প্রতিষ্ঠা করেন লোকশিক্ষার বাহন হিসেবে। ১৮৮৮ সালে রসিকলাল চক্রবর্তী প্রতিষ্ঠা করেন ‘বালক সংগীত যাত্রা’ দল।

যাত্রায় পরিবর্তন: স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ব্রিটিশের শোষণনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে চারণকবি মুকুন্দ দাস, মথুর সাহা এবং ভূষণ দাস গ্রামবাংলার যাত্রামঞ্চকে স্বাদেশিকতায় ভরে তোলেন। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে ব্রজেন্দ্রকুমার দে লেখেন ‘আকালের দেশ’। ময়মনসিংহ গীতিকার আখ্যান অবলম্বনে লেখা তাঁর ‘সোনাই দিঘি’ পালায় সোনাই চরিত্রে জ্যোৎস্না দত্তের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে যাত্রাপালায় প্রথম মহিলাশিল্পী অংশগ্রহণ করে। তাঁরই ‘নটী বিনোদিনী’ পালায় বীণা দাশগুপ্ত অভিনয় করে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছোন।

জনপ্রিয়তা: ১৯৬১ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত যাত্রা উৎসবের মধ্য দিয়ে যাত্রায় আসে নাগরিকতার স্পর্শ। বিষয়বস্তু নির্বাচনেও যুগগত চাহিদাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। হিটলার, লেনিন, সুভাষচন্দ্র বসু হয় যাত্রার মুখ্যচরিত্র। নকশালবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিকায় উৎপল দত্ত যাত্রামঞ্চে নিয়ে আসেন ‘রাইফেল’ পালা। ছয়ের দশকে ভৈরবনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (‘একটি পয়সা’, ‘মা-মাটি-মানুষ’) এবং সাতের দশকে শম্ভুনাথ বাগ (‘লেনিন’, ‘রক্তাক্ত তেলেঙ্গানা’) যাত্রাশিল্পে দুই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। শেকসপিয়র, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতার ব্যবহারে যাত্রাপালায় নতুনত্বের ছোঁয়া লাগে।

১৪। প্রহসনের উৎস সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো। বাংলায় কিছু শ্রেষ্ঠ প্রহসনের নামোল্লেখ করো।

পঞ্চদশ শতাব্দীতে বিনোদনের ধরন হিসেবে সং, দৈহিক কসরত, ব্যঙ্গচিত্র ও অশোভন আচরণকে বর্ণনা করতে ফ্রান্সে ‘ফার্স’ (farce) শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। সবথেকে প্রাচীন ও এখনও বিদ্যমান প্রহসন হল ‘ল্য গার্সো এ লাভোগ্ন’ (বালক ও অন্ধ লোক, ১২৬৬ সাল)।

প্রহসন হল এক ধরনের হাস্যরসাত্মক নাটক। এর মাধ্যমে হাস্যকৌতুক এবং অসংগতিপূর্ণ আচরণের দ্বারা দর্শকদের বিনোদন প্রদান করা হয়। এ ছাড়াও সামাজিক বিষয় যেমন অনৈতিকতা, অনাচার, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং প্রাত্যহিক জীবনের ত্রুটিবিচ্যুতি প্রহসনের মাধ্যমে চিত্রিত হয়ে থাকে। প্রহসনের দৈর্ঘ্য স্বল্প হয়।

উল্লেখযোগ্য প্রহসন: বাংলায় সংস্কৃত প্রহসনের আদলে কিছু প্রহসন রচনা করেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। সেগুলি হল- ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’, ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল,’ ‘চক্ষুদান’ ইত্যাদি।

পাশ্চাত্য ধারার প্রহসনের আদলে বাংলা ভাষায় সার্থক প্রহসন রচনা করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর রচিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রহসন-

একেই কি বলে সভ্যতা’, ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’। এই প্রহসনগুলিতে বাস্তববোধ ও কৌতুকের পরিবেশনা ছিল যথাযথ। সমাজের নববাবু সম্প্রদায়ের মুখের ভাষা সংলাপের মাধ্যমে তুলে ধরেন তিনি।

এ ছাড়াও দীনবন্ধু মিত্র লেখেন ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’, ‘সধবার একাদশী’ ইত্যাদি। বাংলার তরুণ সমাজের বিলাসপ্রিয়তা ও অধঃপতনের কাহিনি আমরা পাই এই প্রহসনে। অমৃতলাল বসু লেখেন ‘চাটুজ্যে-বাড়ুজে’, ‘বিবাহ বিভ্রাট’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন ‘গোড়ায় গলদ’, ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’; গিরিশচন্দ্র ঘোষ রচনা করেন ‘ভোটমঙ্গল’, ‘বেল্লিক বাজার’। এ ছাড়াও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘বিরহ’, প্রমথনাথ বিশী ‘ভূতপূর্ব স্বামী’ প্রভৃতি প্রহসন রচনা করে বাংলার নাট্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

১৫। বিদ্যাসুন্দরের কাহিনির বিবর্তন কীভাবে ঘটে?

কাহিনিপ্রসঙ্গ: মধ্যযুগের একটি প্রণয়কাব্য হল ‘বিদ্যাসুন্দর’। বিদ্যা ও সুন্দরের প্রণয়কাহিনি এর প্রধান উপজীব্য। কাব্যটির উৎস এগারো শতকের সংস্কৃত কবি বিলহনের ‘চৌরপঞ্চাশিকা’। রামপ্রসাদ সেন, ভারতচন্দ্র রায় প্রমুখ কবিরা এই ধারায় কাব্য রচনা করে যশস্বী হন। অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, পূর্ব ময়মনসিংহ নিবাসী কবি কঙ্ক এই কাব্যের আদি রচয়িতা। তিনি ছাড়াও শ্রীধর কবিরাজ, চট্টগ্রামের কবি শাহ বারিদ খান ও গোবিন্দ দাস প্রমুখ কবিগণ বিদ্যাসুন্দর-কালিকামঙ্গল ধারার কাব্যরচনার প্রচেষ্টা করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত এই ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য খুবই জনপ্রিয় ছিল। এই নাট্যরসাশ্রয়ী অবৈধ প্রণয়ের গল্প অতি সহজেই যাত্রাগানে রূপান্তরিত হল। উনিশ শতকের প্রথমদিকে বরাহনগরে একাধিক ‘বিদ্যাসুন্দর’ দল তৈরি হয়েছিল। সম্ভবত বরাহনগরের ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায় সর্বপ্রথম সখের বিদ্যাসুন্দর যাত্রার দল করেন। তখনও কলকাতায় মুদ্রণকার্য সেভাবে প্রচলিত নয়, তাই উদ্যোক্তারা বিদ্যাসুন্দর যাত্রার হাতে লেখা পুথি থেকে পাঠ লিখে নিয়েছিলেন। সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় হয়েছিল গোপাল উড়ের বিদ্যাসুন্দর যাত্রা। বিদ্যাসুন্দর যাত্রার বিভিন্ন পালায় গণিকা বা বারাঙ্গনারাও থাকতেন, অর্থাৎ নারীচরিত্রে পুরুষদের পরিবর্তে নারীরাও অনেকক্ষেত্রে অভিনয় করতেন। একটি বিদ্যাসুন্দর যাত্রার পরিচালনা করতেন রাজা বৈদ্যনাথ রায়ের রক্ষিতা, দ্বারকানাথ ঠাকুরও বিদ্যাসুন্দর পালার অনুরাগী ছিলেন। পরবর্তীকালে এই পালাগুলিতে আদিরসাত্মক চটুল সংলাপ, গান এবং খ্যামটা নাচের প্রচলন ঘটে।

১৬। থিয়েটারের ধারণা কীভাবে বাংলা থিয়েটারে আসে?

প্রসেনিয়াম: প্রসেনিয়ামের ধারণাটা গ্রিক থিয়েটার থেকে এসেছে। গ্রিক থিয়েটারে মঞ্চের থেকে দর্শকের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য যে অর্ধচন্দ্রাকৃতি উঁচু অংশ থাকে, তাকেই প্রসেনিয়াম বলা হত। পরবর্তীকালে প্রসেনিয়াম থিয়েটার বলতে তিন দিক ঘেরা, সামনের দিকটা দর্শকদের জন্য খোলা মঞ্চকে বোঝানো হত।

কলকাতার প্রথম প্রসেনিয়াম: বাংলায় আগে চারদিক খোলা মঞ্চে নাটক বা যাত্রা হত। পরবর্তীকালে কলকাতার লালবাজারে ১৭৫৩ সালে চালু হয় কলকাতার প্রথম প্রসেনিয়াম থিয়েটার তথা নাট্যগৃহ-‘দ্য প্লেহাউস’। এটি তিন দিক দেয়ালে ঘেরা আয়তাকার প্রেক্ষাগৃহ, যার চতুর্থ দেয়ালের জায়গায় মঞ্চ, মাঝখানে মঞ্চের দিকে মুখ করে দর্শকদের আসন ছিল। যদিও এই নাট্যমঞ্চের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। ১৭৫৬ সালের জুন মাসে তরুণ নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করলেন ইংরেজদের শিক্ষা দিতে। সম্পূর্ণ শহরকে জ্বালিয়ে দেওয়ার ফলে ধ্বংস হয় ‘দ্য প্লেহাউস’। ইংরেজরা কলকাতায় ফিরে আসার পর পুনর্নির্মিত হয়েছিল সেই বাড়ি, তবে নাট্যমঞ্চ হিসেবে আর নয়, পরিবর্তিত হয়েছিল নিলামঘরে।

প্রসেনিয়ামে বাংলা নাটক: রুশ পণ্ডিত গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফ ২৫ নম্বর ডোমতলা লেন (বর্তমান ৩৭ নম্বর এজরা স্ট্রিট) -এ ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’ নামে ২০০ আসনের একটি নাট্যশালা চালু করে প্রসেনিয়াম থিয়েটারে বাংলা নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেন। ১৭৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ‘কাল্পনিক সংবদল’ বলে বাংলা ভাষায় অনূদিত একটি নাটক সর্বপ্রথম মঞ্চস্থ হয়।

আরও পড়ুন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment