রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি আলোচনা করো
রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি সামাজিক বিজ্ঞান (Social Science) I রাষ্ট্রবিজ্ঞান সময়ের গতির সঙ্গে নিজেকে বদল করে এগিয়ে চলে, তাই একে গতিশীল সামাজিক বিজ্ঞান বলা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি এক জায়গায় নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেনি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয় হল সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনৈতিক জীবন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এই রাজনৈতিক জীবনের নিরন্তর বদল ঘটে চলেছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, সরকার, রাজনৈতিক দল, স্বার্থগোষ্ঠী, ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সবকিছুই যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেকে বদল করে চলেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এই প্রেক্ষাপটে রাজনীতিচর্চাকে নতুন করে তুলে ধরতে চায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্র ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্রাইস (Bryce) বলেছেন-রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি প্রগতিশীল বিজ্ঞান (“Political Science is a progressive Science”)। ১৯৬০-এর দশকে মার্কিন ইতিহাসবিদ থমাস কুন (Thomas kuhn) রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ‘প্রাক্-দৃষ্টান্তমূলক’ (Pre-Paradigmatic) হিসেবে আখ্যা দেন।
প্রাচীন গ্রিসে প্রায় দু’হাজার বছরেরও বহু আগে দুই প্রবাদপ্রতিম দার্শনিক প্লেটো এবং অ্যারিস্টট্ল মানুষের রাজনৈতিক জীবন নিয়ে আলোচনার সূচনা করেন। প্লেটো ‘The Republic’-এ দার্শনিক শাসকের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন রাষ্ট্র পরিচালনার পূর্ণ অধিকার। প্লেটোর সুযোগ্য শিষ্য অ্যারিস্টট্ল তাঁর ‘Politics’ গ্রন্থে ১৫৮টি নগররাষ্ট্রের সাংবিধানিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্রচিন্তায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। প্লেটো ও অ্যারিস্টরে পরবর্তীকালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও তাঁদের আলোচ্য বিষয়কে শুধুমাত্র রাষ্ট্র ও সরকারের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে সীমিত করে রাখেন।
রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনা
অতীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার বাইরে বেরোতে পারেনি। তখন রাষ্ট্র ও সরকারের আলোচনার বাইরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্য কোনো বিষয় থাকতে পারে তা ভাবা হত না। তাই গার্নার-এর বক্তব্য হল, রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূচনা ও সমাপ্তি। গার্নারের এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে গেটেল বলেছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল রাষ্ট্রের বিজ্ঞান। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্যসূচির প্রকৃতি রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় সংগঠন, রাজনৈতিক তত্ত্ব, রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
সরকারকেন্দ্রিক আলোচনা
এই মতাদর্শের তাত্ত্বিকরা মনে করেন যে, ‘রাষ্ট্র’ একটি বিমূর্ত ধারণা, যা সরকারের মধ্য দিয়ে বাস্তব রূপ ধারণ করে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সিলি, লিকক্ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় রাষ্ট্রের পরিবর্তে সরকার নিয়েই আলোচনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সিলি মনে করেন, বিশুদ্ধ বিজ্ঞান যেমন বীজগণিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি, জীববিদ্যা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানও তেমন সরকারের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা নিয়ে আলোচনা করে।
রাষ্ট্র ও সরকারকেন্দ্রিক আলোচনা
অনেকে আবার এই দুই পরস্পরবিরোধী (রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ও সরকারকেন্দ্রিক) মতামতের মধ্যে সমন্বয়সাধন করার চেষ্টা করেছেন, যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন গিলক্রিস্ট, গেটেল, ল্যাস্কি প্রমুখ। গিলক্রিস্ট-এর মতে, রাষ্ট্র ও সরকারের আলোচনাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পল জানে (Paul Janet) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং সরকারের নীতিকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজবিজ্ঞানের সেই শাখা যা রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি ও সরকারের নীতিসমূহ নিয়ে আলোচনা করে। বার্জেস-এর মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিকতার বিজ্ঞান। বার্জেস (Burgess), স্টিফেন লিকক্ (Stephen Leacock), জর্জ ক্যাটলিন (George Catlin), ই সি স্মিথ (EC Smith), জন সিলি (John Seeley), র্যাফেল (Raphael) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্রে শুধুমাত্র রাষ্ট্র ও সরকারকে স্থান দিয়েছেন।
আচরণবাদ
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের হাত ধরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতির এক ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রাহাম ওয়ালাসের (Graham Wallas) ‘হিউম্যান নেচার ইন পলিটিক্স’ (১৯০৮ খ্রি.) এবং আর্থার বেন্টলির (Arthur Bentley) ‘দ্য প্রসেস অফ গভর্নমেন্ট’ (১৯০৮ খ্রি.) এই দুটি বই প্রকাশিত হলে আচরণবাদ নামে যে নতুন বিশ্লেষণধারা গড়ে ওঠে, তার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতির এক ব্যাপক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে। আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকেন্দ্রিক যাবতীয় সাবেকি ধ্যানধারণাকে বাতিল করে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আচার-আচরণ তথা রাজনৈতিক জীবনের কাজকর্মকে তুলে ধরেন। রবার্ট ডাল আচরণবাদী তত্ত্বকে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে একটি প্রতিবাদী আন্দোলন’ (A protest movement within poitical science) বলে অভিহিত করেছেন। আচরণবাদের অন্যতম প্রবক্তা ডেভিড ইস্টন এই তত্ত্বকে ‘একটি তাত্ত্বিক বিপ্লব’ বলে উল্লেখ করেছেন।
ক্ষমতাকেন্দ্রিক ধারণা
রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো বা প্রতিষ্ঠানের বদলে সমগ্র রাজনীতিক ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করে ক্ষমতাকেন্দ্রিক ধারণাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত করেন আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। তাঁরা মনে করতেন রাজনীতি শুধু রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের গণ্ডির মধ্যে সীমিত থাকে না। রাজনীতির অস্তিত্ব সর্বত্র বিরাজমান। যেখানে ক্ষমতা সেখানেই রাজনীতি (Where there is power there is politics)। এই কারণে আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ল্যাসওয়েল ও কাপলান রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ক্ষমতার প্রকৃতি বা ক্ষমতার অংশগ্রহণ সম্পর্কিত গবেষণা বলে অভিহিত করেন। রবার্ট ডাল তাঁর ‘মডার্ন পলিটিক্যাল অ্যানালাইসিস’ (Modern Political Analysis) (১৯৬৩ খ্রি.) গ্রন্থে ক্ষমতা বা কর্তৃত্বকেই রাজনীতি অধ্যয়নের প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে গণ্য করেছেন।
রাজনীতিক বিশ্লেষণ
আচরণবাদীদের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল রাজনৈতিক বিশ্লেষণের এক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতিকে একটি বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের পর্যায়ে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। এই জন্য রাজনীতিক আলোচনার যাবতীয় নৈতিক আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের মতো মূল্যমান নিরপেক্ষ বা Value Free করে গড়ে তুলেছিলেন। নীতিবোধ বা উচিত-অনুচিতের বিষয়কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় স্থান দেননি। পরবর্তীকালে ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে নয়া আচরণবাদ অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষণে মানবিক মূল্যবোধকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। ডেভিড ইস্টন ঘোষণা করেন রাজনীতিতে মূল্যবোধের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, একে উপেক্ষা করা যায় না।
ক্ষমতা ও ক্ষমতা সম্পর্কিত আলোচনা
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেকি আলোচনার মুখ্য বিষয় রাষ্ট্র সরকার, আইন, বিচার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে সমাজজীবনের প্রতিটি স্তরে ক্ষমতা ও ক্ষমতা সম্পর্কিত আলোচনাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। উত্তর-আধুনিক চিন্তাবিদ মিশেল ফুকোর মতে, রোজকার জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে, যেমন পরিবার, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, অফিস, আদালত, খেলার মাঠ প্রতিটি জায়গাতেই সবসময় যে ক্ষমতা বা Power কাজ করে চলেছে তার বিশ্লেষণ করাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান বিচার্য বিষয়। মিশেল ফুকো মনে করেন আমরা সবাই একটা ক্ষমতার জালের ভিতরে রয়েছি (Network of Power)। তাঁর ভাষায়, ‘Power is everywhere and everything।’ এই কারণে ক্ষমতা বিপজ্জনক। ফুকো তাঁর ‘Madness of Civilization’, ‘Discipline and Punish’ ইত্যাদি গ্রন্থে অবশ্য ক্ষমতাকে শেষকথা বলে মানতে চাননি। ক্ষমতা যেমন আছে তেমনি তার প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধও থাকবে বলে মনে করেন।
নয়া উদারনীতিবাদী ধারণা
সাবেকি উদারনীতিবাদীদের উত্তরসূরি হিসেবে ১৯৭০-এর দশকে নয়া উদারনীতিবাদীদের জন্ম হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতিতে এক ভিন্নধর্মী আমূল পরিবর্তন ঘটে। নয়া উদারনীতিবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সাবেকি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় সংগঠনের ভূমিকাকে বাতিল করে দিয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতাকে সবার উপরে তুলে ধরেন। তাঁদের বক্তব্য হল আগে ব্যক্তি পরে রাষ্ট্র।
উত্তর-আধুনিকতাবাদ
বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ও একবিংশ শতাব্দীর আগে উদারনীতিবাদ ও মার্কসবাদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উঠে আসে উত্তর-আধুনিকতাবাদ (Post-modernism)। পরবর্তী সময়ে নারীবাদী তাত্ত্বিকরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি নির্ধারণ করতে গিয়ে রাজনীতির আলোচনার মূলস্রোতকে পুরুষতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে নারীবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এভাবে বিংশ শতাব্দীর শেষলগ্নে ১৯৯০-এর দশকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি নির্ধারণে বিশ্বায়ন (Globalisation) সম্পর্কিত বিতর্ক, সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ জনিত সমস্যা, পরিবেশবাদী আন্দোলন, নাগরিক সমাজের আন্দোলন প্রভৃতি বিষয়গুলি এক নতুন ভূমিকা গ্রহণ করে।
উপসংহার
সবশেষে বলা যায়, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রূপান্তর ঘটে চলেছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতির। তার বিশ্লেষণই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপজীব্য বিষয়।
আরো পড়ুন – জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬ এবং ২০২০ MCQ প্রশ্ন উত্তর
আরো পড়ুন – শিক্ষাক্ষেত্রে সমকালীন বিষয়সমূহের সমস্যা MCQ প্রশ্ন উত্তর
আরো পড়ুন – মহান শিক্ষকগণ ও শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁদের অবদানসমূহ MCQ প্রশ্ন উত্তর