আরোহ অনুমানের স্বরূপ প্রশ্ন উত্তর (তৃতীয় অধ্যায়) | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার দর্শন | HS 4th Semester Philosophy Aroho Onumaner Sworup Question answer 3rd Chapter

১। আরোহ অনুমানের বিশেষ লক্ষণগুলি কী কী? ব্যাখ্যা করো।
আরোহ অনুমানকে অন্যান্য অনুমান থেকে পৃথক করার জন্য যুক্তিবিজ্ঞানীরা কয়েকটি বিশেষ লক্ষণ উল্লেখ করেছেন। এইগুলির মধ্যে তিনটি লক্ষণ প্রধান। এই লক্ষণ তিনটি হল- সামান্যীকরণ, সিদ্ধান্তে হেতুবাক্যকে অতিক্রম করে যাওয়া এবং হেতুবাক্য ও সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রসক্তি সম্বন্ধের অভাব।
সামান্যীকরণ: আরোহ অনুমান হল একটি সামান্যীকরণ প্রক্রিয়া। আরোহ অনুমানে কয়েকটি বিশেষ বিশেষ বস্তু বা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে সেই জাতীয় সকল বস্তু বা ঘটনা সম্বন্ধে একটি সামান্য সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
উদাহরণ:
লোহা গরম করলে প্রসারিত হয়।
তামা গরম করলে প্রসারিত হয়। অ্যালুমিনিয়াম গরম করলে প্রসারিত হয়।
অতএব, সব ধাতু গরম করলে প্রসারিত হয়।
উপরোক্ত উদাহরণে কয়েকটি ধাতুকে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত করা হয়েছে। কেন-না অভিজ্ঞতার দ্বারা সব ধাতুকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। এইভাবে কয়েকটি ধাতুকে গরম করলে প্রসারিত হতে দেখে ‘সব ধাতু গরম করলে প্রসারিত হয়’ এইরূপ সিদ্ধান্ত করাই হল সামান্যীকরণ।
সিদ্ধান্তে হেতুবাকাকে অতিক্রম করে যাওয়া:
আরোহ অনুমানের একটি বিশেষ লক্ষণ হল ‘সিদ্ধান্তে হেতুবাক্যকে অতিক্রম করে যাওয়া।’
উদাহরণ:
রাহুলের পিতা হন স্নেহশীল।
রিমির পিতা হন স্নেহশীল।
অজয়ের পিতা হন স্নেহশীল।
অতএব, সকল পিতা হন স্নেহশীল।
উপরোক্ত উদাহরণে রাহুল, রিমি ও অজয়-এই কয়েকজনের পিতাকে স্নেহশীল দেখে সিদ্ধান্ত করা হল সকল পিতা হন স্নেহশীল। এখানে আশ্রয়বাক্যে কয়েকজন পিতার উল্লেখ থাকলেও সিদ্ধান্তে সকল পিতার উল্লেখ থাকায় সিদ্ধান্তটি আশ্রয়বাক্যকে অতিক্রম করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আরোহ অনুমানে এইভাবে বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্ত পর্যবেক্ষণ করে সার্বিক সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একপ্রকার ঝুঁকি বা অনিশ্চয়তা থাকে। এই ঝুঁকিকে আরোহমূলক লাফ বা ঝুঁকি বলা হয়।
হেতুবাক্য ও সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রসক্তি সম্বন্ধের অভাব:
আরোহ অনুমানের আরও একটি বিশেষ লক্ষণ হল, আরোহ অনুমানের হেতুবাক্য ও সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রসক্তি সম্বন্ধের অভাব থাকে। প্রসক্তি সম্বনধ হল দুটি বিষয়ের মধ্যে অনিবার্য সম্পর্ক। বৈধ অবরোহ যুক্তিতে হেতুবাক্য ও সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রসক্তি সম্বন্ধ থাকে। এইজন্য অবরোহ যুক্তিতে সিদ্ধান্ত হেতুবাক্য থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়। কিন্তু আরোহ অনুমানে হেতুবাক্য ও সিদ্ধান্তের মধ্যে কোনোরূপ প্রসক্তি সম্বন্ধ থাকে না। সিদ্ধান্তটি হেতুবাক্যকে অতিক্রম করে যায় বলে সিদ্ধান্তটি হেতুবাক্য থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয় না।
উদাহরণ:
বনের পাখির ডানা আছে।
খাঁচার পাখির ডানা আছে।
পোষা পাখির ডানা আছে।
অতএব, সব পাখির ডানা আছে।
এক্ষেত্রে হেতুবাক্য সত্য হলে সিদ্ধান্ত মিথ্যা হতে পারে। কারণ হেতুবাক্য ও সিদ্ধান্তের মধ্যে অনেক অপর্যবেক্ষিত দৃষ্টান্ত থেকে যায়। তাই সিদ্ধান্তটি হেতুবাক্য থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হতে পারে না।
২। আরোহ অনুমানের মূল সমস্যা কী? কীভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব?
আরোহ অনুমানের সমস্যা:
আরোহ অনুমানের লক্ষ্য হল বিশেষ বিশেষ বস্তু বা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে একটি সামান্য সংশ্লেষক বচন গঠন করা এবং তার বস্তুগত সত্যতা প্রতিষ্ঠা করা। যেমন-
উদাহরণ:
রাম হয় মরণশীল।
শ্যাম হয় মরণশীল।
অজয় হয় মরণশীল।
অতএব, সকল মানুষ হয় মরণশীল।
উপরোক্ত আরোহ অনুমানে কয়েকজন মানুষের মৃত্যু পর্যবেক্ষণ করে ‘সকল মানুষ হয় মরণশীল’-এইরূপ বচনটির সত্যতা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখন সমস্যা হল আমাদের সীমিত অভিজ্ঞতায় কয়েকজন মানুষের মরণশীলতাকে পর্যবেক্ষণ করতে পারি। কিন্তু অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল মানুষের মরণশীলতাকে পর্যবেক্ষণ করা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। কাজেই এক্ষেত্রে আমাদের দুটি সমস্যা বিশেষভাবে দেখা দেয় যা আরোহ অনুমানের মূল সমস্যা। সেগুলি হল- (a) সীমিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বা বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে কীভাবে সামান্য সংশ্লেষক বচন গঠন করা যাবে? (b) কীভাবে এই সামান্য সংশ্লেষক বচনের বাস্তব সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে?
আরোহ অনুমানের সমস্যার সমাধান:
আরোহ অনুমানের সমস্যার সমাধানের জন্য যুক্তিবিজ্ঞানীগণ আরোহ অনুমানের দুটি মৌলিক নিয়ম বা নীতির উপস্থাপনা করেছেন। এই দুটি নিয়মের উপর ভিত্তি করেই আমরা আরোহ অনুমানে বিশেষ বিশেষ ঘটনা থেকে সামান্যে উপনীত হওয়ার সমস্যা সমাধান করতে পারি। এই নিয়ম দুটি হল-(a) প্রকৃতির একরূপতা নীতি এবং (b) কার্যকারণ নিয়ম।
প্রকৃতির একরূপতা নীতি : প্রকৃতির একরূপতা নীতির মূলকথা হল প্রকৃতি সম অবস্থায় সম আচরণ করে। এই নীতির উপর ভিত্তি করেই আরোহ অনুমানে সামান্যীকরণ সম্ভব হয়। এই নীতি অনুসারে আমরা বিশেষ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু দেখে অনুমান করি যে, ‘সকল মানুষ হয় মরণশীল’। কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটলে প্রকৃতি একইরকমের আচরণ করবে। এই নিয়ম অনুসারে যে যে কারণের জন্য রাম, শ্যাম, অজয় প্রমুখের মৃত্যু অতীতে ঘটেছে, সেইসব কারণের পুনরাবৃত্তি ঘটলে ভবিষ্যতে সকল মানুষ অবশ্যই মারা যাবে।
কার্যকারণ নিয়ম: কার্যকারণ নিয়ম অনুসারে প্রতিটি ঘটনারই কারণ আছে। এই নিয়মের ভিত্তিতেই আরোহ অনুমানে সামান্যীকরণ করা হয়। আরোহ অনুমানের সিদ্ধান্তে দুটি বিষয়ের মধ্যে যে সম্বধ স্বীকার করা হয় তা যদি কার্যকারণ নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় তবে সেটি সার্বিক ও আবশ্যিক হয়ে থাকে। একইভাবে ‘সকল মানুষ হয় মরণশীল’-এক্ষেত্রে মানুষ ও মরণশীলতার মধ্যে কার্যকারণ সম্বধ বর্তমান রয়েছে। এই কার্যকারণ নিয়মের উপর ভিত্তি করেই আমরা বিশেষ ক্ষেত্রে কয়েকজন মানুষের মৃত্যু পর্যবেক্ষণ করে ‘সকল মানুষ হয় মরণশীল’- এই সামান্য সংশ্লেষক বচনটি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হই।
৩। আরোহ অনুমমানের আকারগত ভিত্তি কী কী? আলোচনা করো।
আরোহ অনুমানের আকারগত ভিত্তি বলতে এমন মৌলিক নিয়মকে বোঝায় যেগুলির উপর নির্ভর করে আরোহ অনুমানের সিদ্ধান্ত স্থাপন করা হয়। আরোহ অনুমানের আকারগত ভিত্তি দুটি। যথা- প্রকৃতির একরূপতা নীতি এবং কার্যকারণ নিয়ম।
প্রকৃতির একরূপতা নীতি: প্রকৃতি নিয়মের রাজত্বের অধীনে। প্রকৃতি রাজ্যে আকস্মিকভাবে কোনো ঘটনা ঘটতে পারে না। প্রকৃতির সকল ঘটনাই একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে ঘটে। প্রকৃতির একরূপতা নীতির মূলকথা হল-প্রকৃতি সম অবস্থায় সম আচরণ করে। যে পরিস্থিতিতে প্রকৃতিতে কোনো ঘটনা একবার ঘটে, অনুরূপ পরিস্থিতিতে আবারও সেই ঘটনা একইরকমভাবে ঘটবে। যে অবস্থায় বা পরিস্থিতিতে কোথাও ভূমিকম্প হয়েছিল, সেই একই অবস্থা বা পরিস্থিতির যদি পুনরাবৃত্তি হয় তবে ভবিষ্যতেও ভূমিকম্প ঘটবে। এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না-এটিই হল প্রকৃতির একৰূপতা নীতির মূল বৈশিষ্ট্য। এই নীতির উপর আস্থা রেখে আরোহ অনুমানের গঠন বা সামান্য আকার প্রতিষ্ঠিত হয় বলে প্রকৃতির একরূপতা নীতিকে আরোহ অনুমানের আকারগত ভিত্তি বলা হয়।
কার্যকারণ নিয়ম: কার্যকারণ নিয়ম অনুসারে মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধ আছে বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে পূর্ববর্তী ঘটনাটিকে কারণ এবং পরবর্তী জগতের প্রত্যেকটি কার্যের একটি সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। বৈচিত্র্যময় জগতে শূন্য থেকে কোনো কিছুর সৃষ্টি হতে পারে না। প্রত্যেকটি ঘটনার কোনো-না-কোনো কারণ আছে। অভিজ্ঞতায় বারবার দুটি ঘটনাকে একসঙ্গে ঘটতে দেখে ওই দুটি ঘটনার ঘটনাটিকে কার্য বলে। যেমন-আগুন হল দহন ক্রিয়ার কারণ। এখানে আগুন হল কারণ এবং দহন ক্রিয়া হল কার্য। কার্যকারণ নিয়ম অনুসারে এক্ষেত্রে ‘আগুন’ এবং ‘দহন ক্রিয়া’-র মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধ আছে বলে মনে করা হয়। এই কার্যকারণ নিয়মের ভিত্তিতেই আরোহ অনুমানের সামান্যীকরণ করা হয় বলে কার্যকারণ নিয়মকে আরোহ অনুমানের আকারগত ভিত্তি বলা হয়।
৪। বৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমান বলতে কী বোঝো? এই অনুমানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দাও।
এর বৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমান : যে আরোহ অনুমানে বিশেষ বিশেষ বস্তু বা ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের দ্বারা প্রকৃতির একরূপতা নীতি ও কার্যকারণ নিয়মের ভিত্তিতে একটি সামান্য সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করা হয় তাকে বৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমান বলে।
উদাহরণ:
রহিম হয় বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন।
অজয় হয় বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন।
রাকেশ হয় বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন।
সুমনা হয় বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন।
এতএব, সব মানুষ হয় বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন।
বৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমানের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য
বৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল-
সামান্য সংশ্লেষক বচনের প্রতিষ্ঠা: বৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এই অনুমানে যে সামান্য বচনটি প্রতিষ্ঠা করা হয় তা সংশ্লেষক, বিশ্লেষক নয়। যে বচনের বিধেয়টি কেবলমাত্র উদ্দেশ্য পদের জাত্যর্থ কিংবা জাত্যর্থের অংশ বিশেষকে বিশ্লেষণ করে, তাকে বলা হয় বিশ্লেষক বচন। এই জাতীয় বচন হল সংজ্ঞার্থজ্ঞাপক। কাজেই এক্ষেত্রে বিধেয় পদটি উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কোনো নতুন তথ্য দেয় না। যেমন- ‘সকল মানুষ হয় বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব।’ অপরপক্ষে যে বচনের বিধেয়টি উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নতুন কোনো তথ্য দেয় তাকে বলা হয় সংশ্লেষক বচন। যেমন- ‘সকল মানুষ হয় হাস্যপ্রিয় জীব।’ এই জাতীয় বচনের বিধেয় পদ যে নতুন জ্ঞান দেয় তা উদ্দেশ্যকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় না। তাই বলা যায় যে আরোহ অনুমান সর্বদাই সামান্য সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করে।
পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ: বৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমানের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এই অনুমান বিশেষ বস্তু বা ঘটনার পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের উপর নির্ভর করে। আরোহ অনুমানে আমরা কয়েকটি বিশেষ বস্তু বা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে একটি সামান্য সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করি। যেমন-রাম, শ্যাম, যদু, মধু প্রমুখ কয়েকজনের মৃত্যু পর্যবেক্ষণ করে আমরা অনুমান করি যে ‘সকল মানুষ হয় মরণশীল জীব’। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরীক্ষণের সাহায্যে কয়েকটি বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করে সামান্য সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করতে হয়। যেমন- কয়েকটি বিশেষ দৃষ্টান্ত পরীক্ষণ করে আমরা অনুমান করি যে- ‘সকল ক্ষেত্রে তাপ দিলে বস্তু আয়তনে বাড়ে।’ এইজন্যই পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণকে আরোহ অনুমানের বস্তুগত ভিত্তি বলা হয়।
প্রকৃতির একরূপতা নীতি ও কার্যকারণ নিয়ম: বৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমান দুটি মূল নিয়মের উপর নির্ভর করে- একটি হল প্রকৃতির একরূপতা নীতি এবং অপরটি হল কার্যকারণ নিয়ম। এই দুটি নিয়মের জন্যই ‘আরোহ অনুমান সংক্রান্ত লাফ’ দেওয়া সম্ভব হয়। এই দুটি নিয়ম হল আরোহ অনুমানের স্বীকার্য সত্য। প্রমাণ ছাড়াই এই নিয়ম দুটিকে গ্রহণ করা হয়। প্রকৃতির একরূপতার অর্থ হল ‘প্রকৃতি সম অবস্থায় সম আচরণ করে’। অথবা একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটলে ‘প্রকৃতি একই রকম আচরণ করে’।
আর কার্যকারণ নিয়মের অর্থ হল ‘প্রতিটি ঘটনারই কারণ আছে’। এই দুটি নিয়মের উপর নির্ভর করেই ‘সকল মানুষ হয় মরণশীল জীব’-এই সামান্য সংশ্লেষক বচনটি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। বস্তুত আরোহ অনুমানের সামান্যীকরণ প্রক্রিয়ার মূলে আছে প্রকৃতির একৰূপতা নীতি এবং কার্যকারণ নিয়ম। এই দুটি নিয়মের সাহায্যেই আমরা জ্ঞাত সত্য থেকে অজ্ঞাত সত্যে বিশেষ সত্য থেকে সামান্য সত্যে উপনীত হতে পারি। এই জন্যই এই দুটি নিয়মকে আরোহ অনুমানের আকারগত ভিত্তি বলা হয়।
৫। উপমাযুক্তির মূল্যায়নের মানদণ্ডগুলি আলোচনা করো।
উপমাযুক্তির ভিত্তি হল অসম্পূর্ণ সাদৃশ্য। তাই এই যুক্তির সিদ্ধান্তটি সম্ভাব্য হয়। তবে এই সম্ভাব্যতার মাত্রাভেদ আছে। অর্থাৎ কোনো ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের সম্ভাব্যতা বেশি হতে পারে। আবার কোনো ক্ষেত্রে কম হতে পারে। যেসব মানদণ্ডের উপর উপমাযুক্তির সিদ্ধান্তের সম্ভাব্যতা নির্ভর করে সেগুলি হল-
দৃষ্টান্তের সংখ্যা: হেতুবাক্যে উল্লিখিত দৃষ্টান্তের সংখ্যা যত বেশি হবে, উপমাযুক্তির সিদ্ধান্তের সম্ভাব্যতাও তত বেশি হবে।
জ্ঞাত সাদৃশ্য: হেতুবাক্যে উল্লিখিত দৃষ্টান্তের মধ্যে জ্ঞাত সাদৃশ্যের সংখ্যা যত বেশি হবে, উপমাযুক্তির সিদ্ধান্তের সম্ভাব্যতাও তত বেশি হবে।
ব্যক্তিগত বৈসাদৃশ্য : হেতুবাক্যে উল্লিখিত দৃষ্টান্তসমূহের মধ্যে ব্যক্তিগত বৈসাদৃশ্য যত বেশি হবে সিদ্ধান্তের সম্ভাব্যতাও তত বেশি হবে।
সাদৃশ্যের প্রাসঙ্গিকতা: উপমাযুক্তির মূল্যায়নের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হল-সাদৃশ্যের প্রাসঙ্গিকতা। হেতুবাক্যে উল্লিখিত দৃষ্টান্তের সঙ্গে সিদ্ধান্তের দৃষ্টান্তের সাদৃশ্য প্রাসঙ্গিক হলে যুক্তির সিদ্ধান্ত অনেক বেশি সম্ভাব্য ও গ্রহণযোগ্য হবে। অপরদিকে সাদৃশ্যের বিষয় অপ্রাসঙ্গিক হলে যুক্তির সিদ্ধান্তের সম্ভাব্যতা কম হবে।
উদাহরণ:
রামের রক্ত পরীক্ষায় দেখা গেছে সে যক্ষ্মা রোগী।
শ্যামেরও রক্ত পরীক্ষায় দেখা গেছে সে যক্ষ্মা রোগী।
অতএব, যে ওষুধ খেয়ে রাম ভালো হয়েছে, শ্যামও সেই ওষুধ খেয়ে ভালো হবে।
রাম ও শ্যামের গায়ের রং কালো, দেহের ওজন এক, উচ্চতাও এক, বয়সও এক এবং উভয়ে একই গ্রামে বাস করে।
অসুস্থ রাম কুইনাইন খেয়ে ভালো হয়েছে। অতএব, অসুস্থ শ্যামও কুইনাইন খেয়ে ভালো হবে।
এক্ষেত্রে দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে সিদ্ধান্তের সম্ভাব্যতা অনেক কম, আর প্রথম দৃষ্টান্তে সিদ্ধান্তের সম্ভাব্যতা অনেক বেশি। কারণ প্রথমটিতে সাদৃশ্যের সংখ্যা কম থাকলেও তা প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ।
অজ্ঞাত গুণাবলি: হেতুবাক্যে উল্লিখিত দৃষ্টান্তের মধ্যে জ্ঞাত গুণাবলির তুলনায় যদি অজ্ঞাত গুণাবলির সংখ্যা ও গুরুত্ব বেশি হয়, তাহলে উপমাযুক্তির সিদ্ধান্ত কম সম্ভাব্য হবে।
উপমাযুক্তির ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্য ও অজ্ঞাত গুণাবলির সংখ্যা যত বেশি হবে সিদ্ধান্তের সম্ভাব্যতা তত কম হবে। অপরপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সাদৃশ্যের সংখ্যা যত বেশি হবে সিদ্ধান্তের সম্ভাব্যতাও তত বেশি হবে।