ডাকঘর নাটকের প্রশ্ন উত্তর (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা | Class 12 dakghor natoker long question answer | WBCHSE

সূচিপত্র

ডাকঘর নাটকের প্রশ্ন উত্তর (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা | Class 12 dakghor natoker long question answer | WBCHSE

ডাকঘর নাটকের প্রশ্ন উত্তর
ডাকঘর নাটকের প্রশ্ন উত্তর

১। রূপক-সাংকেতিক নাটক কাকে বলে? ডাকঘর নাটকটির শ্রেণি বিচার করে, শ্রেণিগত দিক দিয়ে নাটকটির সার্থকতা বিচার করো।

রূপক-সাংকেতিক নাটক: রূপক হল নীতিগর্ভ আখ্যান (allegory)। রূপকধর্মী রচনায় দুটি সমান্তরাল অর্থ বা কাহিনি থাকে- একটি আপাত এবং একটি অন্তর্নিহিত। এর মধ্যে ভিতরের কাহিনি বা অর্থটি পরিবেশন করাই লেখকের মূল উদ্দেশ্য। রূপকের আবেদন জ্ঞান ও বুদ্ধির দ্বারাই বিচার করা সম্ভব হয়।

সাংকেতিক নাটক একটু আলাদা। এখানে ইন্দ্রিয়াতীত শাশ্বত সত্যকে প্রকাশ করা হয়। চিরন্তন সৌন্দর্য এবং অপার্থিব, অতীন্দ্রিয় সত্য আভাসে-ইঙ্গিতে, প্রতীকে-ব্যঞ্জনায় (symbolic art) অনুভবগম্য তথা বোঝার উপযোগী হয়ে ওঠে। সীমার মধ্যে অসীমতা ও মুক্তির স্বাদ এনে দেয় সাংকেতিক নাটক। তাই এখানে কল্পনা-অনুভূতি-ভাবকেই প্রাধান্য পেতে দেখা যায়। ‘ডাকঘর’-ও এই শ্রেণির নাটক।

সাংকেতিক নাটকরূপে সার্থকতা: ‘ডাকঘর’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ সাংকেতিক নাটক। এ নাটকে মানবমনের সুদূরের জন্য আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তির আকুলতা প্রকাশিত হয়েছে। বালক অমল সুদূরের পিয়াসি। কিন্তু কঠিন অসুখে সে গৃহবন্দি। বন্দিত্ব ছিন্ন করে সে বাইরের অসীম জগতে বেরোতে চায়। জানালা দিয়ে সে দইওয়ালা, প্রহরী, মোড়ল, ফকির, সুধা, ছেলের দলের সঙ্গে ভাব জমিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে চায়। বিশ্বপ্রকৃতি অহরহ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। একদিন সে দ্যাখে তার জানালার কাছে রাজার ‘ডাকঘর’ স্থাপিত হয়েছে। সে ভাবে রাজা তাকেও চিঠি পাঠাবেন। এখানে মুমূর্ষু অমল মানবাত্মার প্রতীক আর ‘ডাকঘর’ হল বিশ্বস্রষ্টার অসীমতার প্রতীক। তাই অমলের, রাজার চিঠির প্রত্যাশা যেন বিশ্বাত্মার সঙ্গে মানবাত্মার মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার সংকেতই বহন করে। এরপর অমল যখন চিরনিদ্রায় লীন তখন মালিনীর মেয়ে সুধা এসে বলে যায়, সে অমলকে ভোলেনি। সুধা এখানে মূর্ত জীবনের প্রতীক। অর্থাৎ মৃত্যুর থেকে বড়ো হয়ে প্রকট হয় সুধার স্মৃতিতে অমলের থেকে যাওয়া, স্মৃতি বা মনে থেকে যাওয়া বা না ভোলা তাই মৃত্যুকে অতিক্রম করে জীবনের জয়গান শোনায়। অমলের মৃত্যু তো এ নাটকের আসল কথা নয়, আসল হল তার জীবনাকুতি। মৃত্যুর অমৃতপাত্রে যে নবজীবন ও মুক্তির স্বাদ-অমলের ঘুম তারই সংকেত বহন করে। নানাবিধ সংকেতে ইন্দ্রিয়াতীত অসীমের অনুভব এবং বিশ্বপ্রকৃতির শাশ্বত সৌন্দর্য-মাধুর্য এ নাটকে বিধৃত হয়েছে। অমলের বাইরে যেতে চাওয়া, রাজার চিঠির অপেক্ষা, সময়ের ঘণ্টা শুনতে পাওয়া, চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়া এই সকল আপাত ঘটনা বর্ণনার অন্তর্নিহিত অর্থ তথা ৰূপকাৰ্থ ছিল মুক্তি, যে মুক্তি সূচিত হয়েছিল রাজার ডাকঘর, রাজকবিরাজের আগমন, রাজার শূন্য চিঠিতে অক্ষর ফুটে ওঠা, সুধার ফুল নিয়ে আসা ইত্যাদি সংকেত দ্বারা যা মানবাত্মার সঙ্গে বিশ্বাত্মার মিলনের সৌন্দর্য, শাশ্বত সত্য এবং জীবনের পূর্ণতাকেই নির্দিষ্ট করে। অর্থাৎ ‘ডাকঘর’ নাটকে কোনো কোনো স্থানে রূপকার্থ সংকেতের মাধ্যমে প্রকাশ পেলেও সামগ্রিক বিচারে এই নাটক রূপক-সাংকেতিক নাটক নয়। এখানে সংকেতই হয়ে উঠেছে মুখ্য, তাই সাংকেতিক নাটক হিসেবে ‘ডাকঘর’ বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে।

২। ‘ডাকঘর’ নাটকের সংলাপ নাট্যবিষয়ের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে, তা আলোচনা করো। ৫

সংলাপ হল নাটকের প্রাণ। ‘ডাকঘর’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ সাংকেতিক নাটক। এখানে সংকেত বা প্রতীকের মাধ্যমে জীবনের গূঢ়তত্ত্ব পরিবেশিত হয়েছে। ফলে এ নাটকের অধিকাংশ সংলাপ সংকেতবাহী। উপরন্তু, ‘ডাকঘর’ নাটকের সংলাপে নাট্যধর্মিতা প্রকট হয়ে ওঠেনি। সহজসরল কথ্য রীতির ব্যবহারই সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে মুখ্য হয়ে উঠেছে।

বাস্তবধর্মী: আলোচ্য নাটকে মাধব দত্ত, কবিরাজ, মোড়লের মতো গতানুগতিক চরিত্রগুলির সংলাপে স্বাভাবিক বাস্তবতার প্রকাশ ঘটেছে। গৃহবদ্ধ অমলের দূরের পাহাড় পেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছের কথা শুনে মাধব দত্তকে বলতে শোনা যায়- “পাহাড়টা যখন মস্ত বেড়ার মতো উঁচু হয়ে আছে তখন তো বুঝতে হবে ওটা পেরিয়ে যাওয়া বারণ”। অমলের অসুস্থতা প্রসঙ্গে কবিরাজের মন্তব্য- “ওর ভাগ্যে যদি আয়ু থাকে, তাহলে দীর্ঘকাল বাঁচতেও পারে”। মোড়ল তার স্বভাব অনুযায়ী বলেছে-“মাধব দত্তের বড়ো বাড় হয়েছে দেখছি।” এরা সকলেই পার্থিব পৃথিবীর মায়াবন্ধনজাত বেড়াজাল, আকাঙ্ক্ষা, অহংকার বা আত্মগর্বের প্রতীক তাই অমলের অন্তর্দৃষ্টির অনুধাবন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই মাধব দত্তের সংলাপে বারংবার বিষয়-আশয়ের কথা, কবিরাজের সংলাপে শাস্ত্রের বুলি আর মোড়লের সংলাপে তার স্বভাবোচিত ব্যঙ্গবিদ্রুপের আধিক্য দেখা যায়।

আধ্যাত্মিক-দার্শনিক-কাব্যিক: অমল, ঠাকুরদা, প্রহরী, রাজবৈদ্য, এমনকি দইওয়ালার সংলাপেও পাওয়া যায় অধ্যাত্মচেতনা, জীবনের গূঢ়দর্শন, সংকেতধর্মিতা, কাব্যধর্মিতা- যা ‘ডাকঘর’ নাটকটির নির্যাস। প্রহরীর উক্তিতে আছে গভীর জীবনদর্শন- “ঘণ্টা এই কথা সবাইকে বলে, সময় বসে নেই, সময় কেবলই চলে যাচ্ছে।” অথবা, “সে দেশে সবাইকে যেতে হবে বাবা!” আবার ঠাকুরদার ক্রৌঞ্চদ্বীপের বর্ণনা যেমন কাব্যিক তেমনই তার বহু উক্তি সংকেত আর অধ্যাত্মচেতনায় সমৃদ্ধ-“ভিতরের দিক দিয়ে সে একটা রাস্তা আছে, সে হয়তো খুঁজে পাওয়া শক্ত।” এখানে আপন অন্তরে ঈশ্বরের খোঁজ করার ইঙ্গিত আছে। “অমন নবীন চোখ তো আমার নেই” অথবা “তিনি তোমাকে যা দেবেন অমনিই দিয়ে দেবেন”- এইসব সংলাপে ফকির তথা ঠাকুরদার স্বরূপ ফুটে ওঠে – অমলের শক্তিচেতনাকে আপন কল্পনারসে জারিত করে ফকির। অমল যখন মানসচোখে দ্যাখে হরকরা রাজার চিঠি বয়ে আনছে বা দইওয়ালার গ্রামের দৃশ্য কিংবা পুটুলি কাঁধে কাজ খুঁজতে যাওয়া লোকটির চলে যাওয়া, তখন তার সংলাপ চমৎকার কাব্যরসে পরিসিক্ত হয়ে ওঠে-“রাজার ডাক-হরকরা পাহাড়ের উপর থেকে একলা কেবলই নেমে আসছে”। আবার, “আমি যদি পাখি হতুম তা হলেー” এই কাব্যিক সংলাপ দ্বারা ফুটে ওঠে অমলের কল্পনাপ্রবণতা এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। “আমি রাজাকে বলব, এই অন্ধকার আকাশে ধ্রুবতারাটিকে দেখিয়ে দাও।”- এই সংলাপ দ্বারা বিশ্বাত্মার সহিত অমলের মিলিত হওয়ার উদ্‌গ্রীব অপেক্ষাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সুধা চরিত্রটিও তার কাব্যধর্মী সংলাপ নিয়ে নাটকে বিরাজ করে। অসুস্থ অমলকে দেখে সে বলে, “তোমাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে যেন সকালবেলাকার তারা-“। আলোচ্য নাটকে নাট্যকার দার্শনিকতা, আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ ঘটাতে সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে কাব্যধর্মিতাকে অবলম্বন করেছেন। ফলস্বরূপ, ‘ডাকঘর’ গদ্যলিরিক-এর বিশিষ্টতাপ্রাপ্ত হয়েছে।

ব্যঞ্জনবাহী: রূপক-সাংকেতিক নাটক ‘ডাকঘর’-এর সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ব্যঞ্জনাধর্মী সংলাপ। যেমন প্রহরীর কথায়, “সে দেশে সবাইকে যেতে হবে বাবা!” সংলাপটি সময়ের প্রবহমানতা ও সময় ফুরোলে মৃত্যুই ভবিতব্য অর্থাৎ জীবনের পরপারে অমর্ত্যলোকের সংকেতবাহী। আবার, ফকিরের “হ্যাঁ, আমি খেপেছি। তাই আজ এই সাদা কাগজে অক্ষর দেখতে পাচ্ছি”- এ কথা রাজার আগমনবার্তা শুনতে পাওয়ার বিষয়টিকেই স্পষ্ট করে। অমল যখন বলে, “- সব তারাগুলি দেখতে পাচ্ছি- অন্ধকারের ওপারকার সব তারা।”- বোঝা যায়, অমলের মুক্তি আসন্ন।

এভাবেই ‘ডাকঘর’ নাটকের সংলাপগুলি চরিত্রোপযোগী ও নাট্যবিষয়ের সঙ্গে অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

৩। ডাকঘর নাটক অবলম্বনে অমল চরিত্রটির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

অথবা, ‘ডাকঘর’ নাটকের অমল চরিত্রটি তোমার কীরূপ লাগে তা নিজের ভাষায় বর্ণনা করো।

স্নেহজাগানিয়া: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ডাকঘর’ নাটকের নায়ক তথা প্রধান চরিত্র অমল গুপ্ত। সে এমন এক বালক যে তাকে কেউ ভালো না বেসে পারে না। ব্যতিক্রম কেবল কবিরাজ ও মোড়ল। কবিরাজ পেশাগত দৃষ্টিকোণে অমলকে শুধু রোগী হিসেবেই দেখেছেন। মোড়ল অকারণ পরশ্রীকাতরতায় অমলের প্রতি নির্দয়। নিঃসন্তান মাধব দত্তের স্ত্রীর গ্রাম সম্পর্কিত ভাইপো অমল। তার খুব ছোটোবেলায় মা মারা গিয়েছে, বাবাও সম্প্রতি গত হয়েছে। পালিত পুত্ররূপে মাধব তাকে ঘরে এনেছে। সার্থকনামা সে, তার মনটি অমলিন। তার পবিত্র প্রাণের স্পর্শে মাধব দত্তের মতো বিষয়ী লোকের বিষয় চিন্তারও খানিক বিস্মরণ ঘটে। তার সান্নিধ্যে দইওয়ালা আপন কাজের মানে খুঁজে পায়। প্রহরী রাজার কাজ ভুলে অমলের মনের নিরন্তর জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে আগ্রহী হয়। ফকির তার কল্পনার পালে হাওয়া দিতে ঠায় বসে দেশ-বিদেশের গল্প শোনায়। এমনকি অমলের সঙ্গে মিলিত হয়ে স্বয়ং রাজারূপী ঈশ্বর মাটির কাছাকাছি নেমে আসেন।

বদ্ধতনু-মুক্তমনা কল্পনাপ্রবণ বালক: অমল খুবই রুগ্‌ণ। কবিরাজ বলেছেন, তার ওইটুকু শরীরে একসঙ্গে বাত-পিত্ত-শ্লেষ্মা যেভাবে প্রকুপিত হয়ে উঠেছে, তাতে তার আর বেঁচে থাকার বড়ো আশা নেই। তাই কবিরাজ তাকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। ঘরে বসে পুথি পড়ে অমল পণ্ডিত হতে চায় না। জানালা দিয়ে সে বাইরের জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। উন্মুক্ত প্রকৃতি তাকে হাতছানি দেয়। বিশ্বলোকের সাড়া জাগে তার অন্তরে। বাইরে বেরোনোর জন্য অমল ব্যাকুল, তাই পথচারীদের সঙ্গে গল্প করে সে বহির্জগতের আস্বাদ নিতে চায়। দইওয়ালার গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-মাধুর্য তার মানসপটে ভেসে ওঠে। প্রহরীর ঘণ্টাধ্বনি তাকে উদাস করে দেয়। ফকির, ছিদাম, ছেলের দল আর সুধার সঙ্গে তার সখ্য। রাজার ডাকঘর অমলের মনে রাজপত্র প্রাপ্তির প্রত্যাশা জাগায়। মোড়লের মিথ্যে চিঠির পরিহাসকেও অমল সত্যরূপে গ্রহণ করে। ছিদামের অন্ধত্বকেও বিশ্বাস করে অমল। আসলে যার অন্তর্দৃষ্টি জাগরিত হয়ে গিয়েছে তাকে পার্থিব জগতের এসব তুচ্ছ ঘটনা প্রভাবিত করে না অমলকে তাই মুগ্ধ করে প্রহরীর সময় বয়ে যাওয়ার ঘণ্টা, ফকিরের ক্রৌঞ্চদ্বীপের বর্ণনা আর রাজার আগমনী চিঠি।

মুক্তিকামী মানবাত্মা : পার্থিব ব্যক্তি পরিচয়ের ঊর্ধ্বে অমল আসলে মুক্তিকামী মানবাত্মার প্রতীক। তার চিরঘুম মৃত্যু নয়, নবজীবনলাভ। রাজারূপী ঈশ্বর তাকে তুচ্ছ মায়াবন্ধন থেকে চিরমুক্তির অতীন্দ্রিয় জগতে নিয়ে যান। গভীর ঘুমের মধ্যে সীমা ছেড়ে অসীমের পথে পাড়ি দেয় অমল। যে দর্শন, যে তত্ত্ব আলোচ্য নাটকে সাংকেতিকতায় উপস্থাপিত, তার প্রধান ধারক-বাহক হল অমল চরিত্রটি।

৪। ডাকঘর’ নাটকে ঠাকুরদা চরিত্রটির ভূমিকা আলোচনা করো।
অথবা, ‘ডাকঘর’ নাটক অবলম্বনে ফকিরের পরিচয় দাও। ৫

ঠাকুরদা চরিত্রের ব্যাপ্তি: রবীন্দ্রসাহিত্যে, বিশেষত নাটকে এক নিরাসক্ত, জ্ঞানবৃদ্ধ, অধ্যাত্মচেতনায় ঋদ্ধ চরিত্র ফিরে ফিরে এসেছে। ৪ ‘শারদোৎসব’-এ (১৯০৮) ঠাকুরদাদা, ‘রাজা’-তে (১৯১০) ঠাকুরদা, ‘অচলায়তন’-এ (১৯১২) দাদাঠাকুর, ‘ডাকঘর’-এ ঠাকুরদা একই সত্তা এবং রবীন্দ্র ভাবাদর্শের বাহক। ঠাকুরদা রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শময় উন্মুক্ত প্রকৃতির প্রতিভূ, বিশ্বসৃষ্টির অন্তরালোক ও বহির্লোকের বার্তাবাহক।

ছেলে খেপানোর সর্দার: ‘ডাকঘর’ নাটকে মাধব ঠাকুরদাকে ‘ছেলে খ্যাপাবার সদ্দার’ বলে অভিহিত করেছে। উদার প্রকৃতির মাঝে শিশুদের টেনে এনে খেলাধুলায়, আনন্দে মাতিয়ে রাখে ঠাকুরদা। ছেলেগুলোকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসাই তার বুড়ো বয়সের খেলা। মাধবের পালিত পুত্র বালক অমল অসুস্থ। কবিরাজের নির্দেশে তার বাইরে যাওয়া বারণ। মাধবের ভয় ঠাকুরদা যদি অমলকে বাইরে বেরোনোর জন্য খেপিয়ে তোলে। তবে ‘ঘরে ধরে রাখবার খেলাও আমি কিছু জানি’ বলে ঠাকুরদা মাধবকে আশ্বস্ত করে আদতে অমলকে ঘরের চারদেয়ালের ভিতরেই বাহিরের গল্প শুনিয়ে মত্ত করে তোলে।

ফকিরবেশে অমলের সঙ্গে সখ্য: ফকিরের ছদ্মবেশে ঠাকুরদা অমলের বদ্ধ জীবনে এনে দেয় মুক্তির স্বাদ। তাকে প্রকৃতির পাঠ দেয়। বিশ্বপ্রকৃতির মাধুর্য বালকের কাছে পৌঁছে দিয়ে তার মুক্তিপিয়াসি অন্তরকে শুশ্রুষা দেয়। ঠাকুরদার ক্রৌঞ্চদ্বীপের গল্প, হালকা দেশের গল্প অমলের মনে প্রশান্তি এনে দেয়। অমলকে চিঠি পাঠানোর জন্য তার বাড়ির সামনে ডাকঘর খুলেছেন রাজা। বালকের মনে আশা জাগিয়ে তুলতে ঠাকুরদা জানায়, সে চিঠি রওনা হয়ে এখন পথে আছে। মোড়লের দেওয়া অক্ষরশূন্য কাগজটিই যে রাজার চিঠি তা অমলকে বিশ্বাস করায় ঠাকুরদাই। ঠাকুরদাই সেই সর্বজ্ঞানী যে মানবাত্মার স্বরূপ অমলের সঙ্গে বিশ্বাত্মার মিলিত হওয়ার কথা জানত। তাই ফকিরবেশে এসে অমলকে সেই বাহিরের স্বপ্ন, মুক্তির মুগ্ধতা অনুভব করতে শিখিয়েছিল ঠাকুরদাই। অমলের মুক্তিচেতনাকে উসকে দিয়ে তার মুক্তির পথকে প্রশস্ত করেছিল ফকির। রাজার আগমনের বার্তাকে ভাষা দিয়েছিল ফকির। অমলের মধ্যে চলা সীমা-অসীমের দ্বন্দ্বের মধ্যস্থতাকারীরূপেই নাটকে ফকিরবেশী ঠাকুরদার অবস্থান।

আধ্যাত্মিকতা: ঠাকুরদা সব নিষেধের ঊর্ধ্বে বিরাজমান বন্ধনমুক্ত নিরাসক্ত এক অধ্যাত্মপুরুষ। ঠাকুরদা জানে ঈশ্বরই নিখিলবিশ্বের রাজা। তিনি অদৃশ্য বার্তা পাঠান। অলক্ষ্যে থেকেই অমলকে তিনি নিয়ে যাবেন সসীম থেকে অসীমে। চিরনিদ্রা বা তথাকথিত মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঈশ্বর মানবাত্মাকে নবজীবন দান করেন। ঘুমের ভিতর দিয়ে অমলকে অমর্ত্যলোকে নিয়ে যেতে রাজারূপী ঈশ্বর আসছেন। এ কথা উপলব্ধি করেই অবিশ্বাসীদের চুপ করিয়ে ঠাকুরদাকে স্তব্ধ হতে দেখা গিয়েছে। অমলের চিরনিদ্রায় তাকে বিচলিত হতে দেখা যায়নি, কারণ জীবনের বৃহত্তর লক্ষ্য, জীবনের ওপারের তত্ত্ব তার জানা। অমলের মুক্তির পথে তার আনন্দযাত্রার দোসর তাই ঠাকুরদা। মুক্তির আঙিনায় দাঁড়ানো অমলের নেপথ্যে জীবনের জয়গান গেয়েছে অমলের এই ফকির।

৫। ডাকঘর’ নাটক অবলম্বনে সুধা চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো। ৫

পার্থিব জগতের মায়ার স্বরূপ: রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের লেখা ‘ডাকঘর’ নাটকে একমাত্র নারীচরিত্র সুধা। সে শশী মালিনীর মেয়ে। সকালে মল ঝমঝমিয়ে ফুল তুলতে যাচ্ছিল। অমল তাকে ডেকে আলাপ জমায়। অসুস্থ অমলের ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে বালিকা সুধার মনে হয় যেন ‘সকালবেলাকার তারা’। অমল যদি ফুল তুলতে যেতে পারত তবে উঁচু ডাল থেকে ফুল পেড়ে দিত, শুনে সুধা বলে- “ফুলের খবর আমার চেয়ে তুমি নাকি বেশি জান।” সুধা খুব ব্যস্ত। তার অনেক কাজ। সে যদি অমলের মতো বসে থাকতে পারত কত ভালো হত! যাওয়ার সময় সুধা বলে যায়- “আমি ফুল তুলে ফেরবার পথে তোমার সঙ্গে গল্প করে যাব।” অমলের আবদারে সুধা বলে সে তাকে ভুলে যাবে না। ফিরতি পথে একটি ফুল দিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় সুধা, বদলে সেই ফুলের দামও চেয়ে নেয় সে। অর্থাৎ পার্থিব জগতের বিষয়ী ভাবনা থেকে মুক্ত নয় সুধা। তবু সে এক বালিকা, অপরিণত মনের মায়ায় জড়িয়ে, সমবয়সি সখীটির প্রতিশ্রুতিতে নিজেকে ভুলিয়ে ঘরের ভিতর তার ফুল নিয়ে ফিরে আসার অপেক্ষা করতে চায় অমল। সুধা যেন অমলের মুক্তির জন্য অধীর অপেক্ষাকে খানিক প্রশমিত করে, তার অপেক্ষার যন্ত্রণায় সাময়িক আনন্দের প্রলেপ লাগিয়ে দেয়।

ক্ষণিকের অমর্ত্য প্রেমানুভূতি: সুধা হল মর্ত্যসুধা। সুধা শব্দের অর্থ অমৃত। মর্ত্যজীবনে অমলকে সুধা দিয়েছে ক্ষণিকের অমর্ত্য প্রেম। রবীন্দ্রসাহিত্য বিশেষজ্ঞ উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছেন- “মানবী সুধা সাধারণ মানুষের প্রেমের স্বরূপটিই জানাইয়া গেল তাহার প্রেমকে সে জীবনের মধ্যে, স্মৃতির ভাণ্ডারে অক্ষয় করিবে, অমলকে সে ভোলে নাই, ভুলিবে না।” অর্থাৎ সুধার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টির জাগরণ না ঘটলেও, অমলের মুক্তিচেতনাকে তার ‘দুরন্তপনা’ বলে মনে হলেও, সুধা অমলের আধখোলা মুক্তির জানালাখানি অবুঝের মতো বন্ধ করে দিতে চাইলেও- অমলের, সুধাকে তার পারুলদিদি করার ইচ্ছার মধ্য দিয়েই বোঝা যায় অমলের মুক্তিকামী মনকে বদ্ধাবস্থায় ক্ষণিকের শান্তি দিতে পেরেছিল সুধা। জাগতিক জীবনে নৈসর্গের অনুভূতি এনে দেয় নিখাদ প্রেম সুধার সঙ্গে ক্ষণিকের সান্নিধ্যেই অমল সেই অমর্ত্য প্রেমের সুধা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তাই অমলের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল সুধার তাকে না-ভোলা।

প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপনকারী: অমলকে, সুধা একটি ফুল দিয়ে যাওয়ার কথা দিয়েছিল এবং সুধা তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেনি। সুধা নাটকের একেবারে অন্তিমে যখন ফুল হাতে উপস্থিত হয় তখন অমল চিরনিদ্রায়। তাই সুধা যে তাকে ভোলেনি সে-কথা অমলের জানা হয় না, কারণ সে তখন সমস্ত মর্ত্যপ্রেম ছাড়িয়ে অনন্ত প্রেমের পথের যাত্রী। বাস্তবের সসীম কর্মজগতের প্রতীক সুধা কথা রেখেছে। অমল পারেনি। কারণ আরও বৃহৎ অনন্ত অধ্যাত্মজগতের ঈশ্বরপ্রেম তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছে। আর একমাত্র সুধার স্মৃতিতেই সত্যি হয়ে থেকেছে অমলের জাগতিক অস্তিত্ব।

৬। ডাকঘর’ নাটক অবলম্বনে মাধব দত্ত চরিত্রটির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। ৫

বিষয়সচেতনতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ডাকঘর’ নাটকে নিঃসন্তান মাধব দত্ত বিষয়ী লোক। প্ররিশ্রমলব্ধ অর্থ সঞ্চয়ে সে সজাগ। স্ত্রীর অনুরোধে বালক অমলকে দত্তক নেওয়ার পর মাধব অর্থ উপার্জনের প্রকৃত আনন্দ উপলব্ধি করে। ঠাকুরদাকে বলে, আগে টাকা রোজগার তার নেশা ছিল কিন্তু এখন ‘সবই ঐ ছেলে পাবে জেনে উপার্জনে’ তার ভারী আনন্দ। অর্থাৎ তার উপার্জিত অর্থের একজন উত্তরসূরি রয়েছে এ কথা মাধব দত্তের বিষয়ী মনকে প্রবোধ দিয়েছে।

পিতৃত্ব ও বাৎসল্য: আলোচ্য নাটকে অমল এসে মাধবের ঘর ও মন জুড়ে বসে। ছেলেটিকে ঘিরে মাধবের বঞ্চিত পিতৃত্ব জেগে ওঠে। কিন্তু অমল অসুস্থ, কবিরাজ তাকে বাইরে যেতে মানা করেছেন। তার রোগে শয্যাগত অবস্থা মাধব দত্তকে ব্যথিত করে। অমলের কড়া ও তেতো ওষুধ খাওয়া দেখে মাধব দত্ত কবিরাজকে বলে- “আপনার ওষুধ খাবার সময় ওর কষ্ট দেখে আমার বুক ফেটে যায়।” নাটকের শেষ দিকে যখন অমল চিরঘুমের দেশে চলে যাচ্ছে তখন রাজবৈদ্য সমস্ত আলো নিভিয়ে দিতে বললে আর্তনাদ করে ওঠে- “এরা আমার ঘর অন্ধকার করে দিচ্ছে কেন! তারার আলোতে আমার কী হবে।” রুগ্ম অমলকে কতদিন পৃথিবীতে ধরে রাখতে পারবে তা নিয়ে সর্বদা ভয়ে ও ভাবনায় জর্জরিত ছিল মাধব।

বাস্তববাদী: অমলের প্রকৃতিকে ভালোবাসা, বাইরে বেরোনার আকাঙ্ক্ষাকে আমল দেয়নি মাধব। সে মনে করেছে, এসব বালকের খ্যাপামি। মাধব চায় ঘরে বসে অমল অনেক বই পড়ে ভবিষ্যতে পণ্ডিত হোক। এই ব্যতিকর্মী বালকের সংবেদনশীল মন ও কল্পনাপ্রবণতাকে বোঝার বোধ বাস্তববাদী মাধবের ছিল না। রাজা বলতে সে জাগতিক ক্ষমতাধর বিত্তমান শাসককেই বুঝেছে। তাই অমলকে রাজার কাছে প্রকারান্তরে অর্থসম্পদ প্রার্থনা করতে বলেছে সে। উল্লেখ্য অমল রাজার কাছে তার ডাকঘরের ডাকহরকরা হওয়ার ‘তুচ্ছ’ ইচ্ছা জানাবে- এ কথা শুনে মাধব দত্তকে কপাল চাপড়ে হা-হুতাশ করতে দেখা গিয়েছে।

প্রতীকী চরিত্র: মাধব দত্ত ‘ডাকঘর’ নাটকের বেদনাহত এক ট্র্যাজিক চরিত্র। সন্তানহীনতার কষ্ট দূর করতে যাকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছে, সেই অমলকেও ধরে রাখতে পারেনি সে। গতানুগতিক চিন্তাধারার এক সাধারণ সংসারী হিসেবে তার চরিত্রটি সৃষ্ট। অর্থাৎ সে এই সীমাবদ্ধ মায়াময় জগতের প্রতীক, যে নিজের পার্থিব চাহিদাগুলিকে ত্যাগ করে বিশ্বাত্মার স্বরূপ জানতে ব্যর্থ হয়েছে।

৭। ‘ডাকঘর’ নাটকে মোেড়ল চরিত্রটির গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো।

স্বঘোষিত মোড়ল: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ডাকঘর’ নাটকে পঞ্চানন মোড়ল চরিত্রটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। রাজা তাকে মোড়ল করেননি, সে স্বঘোষিত মোড়ল। স্বেচ্ছায় মাতব্বরি করা তার স্বভাব। সকলের সঙ্গে তার শত্রুতা- “যে ওকে না মানতে চায় ও তার সঙ্গে দিনরাত এমনি লাগে যে ওকে সকলেই ভয় করে।” এমনকি রাজার প্রহরীও তাকে ভয় করে। অন্যায় চোখরাঙানিতে সকলকে ভয় দেখিয়ে, ক্ষমতার আস্ফালন দ্বারাই পরিতৃপ্ত হয় মোড়ল- এতেই সে নিজেকে মহৎ ভাবে।

কঠোর ও হৃদয়হীন: মোড়ল অমলের সঙ্গে উগ্রভাবে কথা বলে। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কখনও ‘তুই’ সম্বোধন করে। কখনও ‘ছোঁড়া’, কখনও ‘বাঁদড়’ বলে। অমলের পিসেমশায় মাধব দত্ত অর্থবান বলে তাকে ব্যঙ্গ করে মোড়ল। অসুস্থ বালক অমলের প্রতি কোনো স্নেহ, সমমর্মিতা তার নেই। মোড়লের সংকীর্ণ মন অকারণ হিংসায় পূর্ণ। অমলের মুক্তিচেতনা বোঝার ক্ষমতা মোড়লের নেই, তবে নিজের বোঝার পরিধির বাইরের সব ঘটনাকে সে বিদ্রুপ করে। তাই রাজার আগমনের বিষয়টিকে সে মাধব দত্তের ছল বলে মনে করে। অসুস্থ বালক অমলকে বিদ্রুপ করতেও তার বাধে না।

অসংবেদনশীল: মোড়লকে, অমল শুধু বলেছিল রাজা তাকে চিঠি লিখবেন আর সেই চিঠির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে মোড়ল যেন ডাক -হরকরাকে বলে দেয় যে তারই নাম অমল। কিন্তু বালকের কল্পনাপ্রবণ সংবেদনশীল মনস্তত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ মোড়ল এসব অমলের আস্পর্ধা ভেবে ব্যঙ্গ করে। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে অমলের পরিবারের উপর-“ওহে মাধব দত্ত, আজকাল তোমাদের যে খুব বড়ো বড়ো লোকের সঙ্গে সম্বন্ধ।” বালকের ছেলেমানুষিকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো সংবেদনশীলতাটুকুও মোড়লের মধ্যে নেই।

ছলচাতুরী: গুরুতর অসুস্থতায় অমল যখন অন্তিম শয্যায় শায়িত তখন তাকে নিয়ে পরিহাস করার অভিপ্রায়ে মোড়ল রাজার চিঠি বলে অক্ষরশূন্য একটি কাগজ অমলকে দেখায়। বালকের মন রাখতে এবং আধ্যাত্মিক ভাবনা থেকে এই পরিহাসকে সত্য বলে মান্যতা দেয় ঠাকুরদা। রাজা অর্থাৎ ঈশ্বরের বার্তা এমনই লিপিহীন অদৃশ্যমান মাধ্যমে মুক্তিকামী মানবাত্মার কাছে পৌঁছোয়। এ কথা মাধব বা মোড়ল না জানলেও ঠাকুরদা জানে। অজ্ঞ মোড়ল রাজার চিঠির মর্মার্থ না বুঝেই সাদা কাগজ দেখিয়ে বালক অমলের সঙ্গে ছল করে যা তার হীনম্মন্যতা ও নীচ প্রবৃত্তির পরিচায়ক।

শ্রেণিচরিত্র: মোড়ল বাস্তব সমাজের এক বিশেষ শ্রেণিচরিত্র। আলোচ্য নাটকের মূল সুরের বিপরীতে মোড়ল একটি প্রতিচরিত্র এবং নাট্যদ্বন্দ্বের সহায়ক। একাধারে সে অজ্ঞ, রাজার আগমন নিয়ে অবিশ্বাসী আবার সত্যিই রাজার আগমনের সময় হলে তাকেই শশব্যস্ত হয়ে রাজার জন্য ভোগের আয়োজন করতে দেখা যায়। মোড়লের মতো শ্রেণিচরিত্রদের জীবন তোষামোদের মাধ্যমেই অতিবাহিত হয়। নিজস্বতাহীন এমনই এক খলচরিত্ররূপে মোড়ল আলোচ্য নাটকে স্থান পেয়েছে।

৮। ডাকঘর নাটকে প্রহরী চরিত্রটির ভূমিকা আলোচনা করো।

ছদ্ম-গাম্ভীর্য: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ডাকঘর’ নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে প্রহরীর প্রবেশ। সে রাস্তায় পায়চারি করছিল, অমল তাকে ডাকে। ছদ্ম-গাম্ভীর্যে সে বালক অমলকে রাজার কাছে ধরে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখায়। পরক্ষণেই যখন জানতে পারে বালকটি অসুস্থ, কবিরাজ তাকে বাইরে যেতে বারণ করেছেন তখনই প্রহরীর গাম্ভীর্য খসে গিয়ে আসল মানুষটির প্রকাশ ঘটে। সমবেদনার সুরে বলে- “তোমার মুখ যেন সাদা হয়ে গেছে। চোখের কোলে কালি পড়েছে।”

দার্শনিক চরিত্র: রাজার প্রহরী প্রহরে প্রহরে ঘণ্টা বাজায়। সেই ঘণ্টাধ্বনি অমলকে উদাস করে দেয়। ‘ঘণ্টা কেন বাজে’- অমলের এই প্রশ্নে প্রহরী বলে- “ঘণ্টা এই কথা সবাইকে বলে, সময় বসে নেই, সময় কেবলই চলে যাচ্ছে।” সময় চলে যাচ্ছে সেই অজানা দেশে যেখানে সবাইকে যেতে হবে। প্রহরীর এসব কথায় তার দার্শনিক সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। অমলেরও যে পার্থিব সময় ফুরিয়ে আসছে তারই আভাস যেন প্রহরীর উক্তিতে নিহিত। উল্লেখ্য, এই প্রহরী রাজার প্রহরী তাই সে সময়ের হিসেব রাখলেও সময়কে বেঁধে রাখার প্রবণতা তার মধ্যে দেখা যায় না। অমল যখন সহজ মনে বলে যে, প্রহরী ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেই সময় হয়ে যাবে তখন সে স্পষ্টতই জানায়, সময়কে বেঁধে রাখার সাধ্য কারও নেই। এমনকি ডাকঘর, রাজার চিঠি ও ডাকহরকরাদের খবর দিয়ে অমলের মনে আশা জাগিয়েছিল এই প্রহরীই।

বালকের প্রতি স্নেহ: রাস্তার ওপারের বড়ো বাড়িতে ডাকঘর স্থাপিত হয়েছে-এ খবর প্রহরীর কাছেই পায় অমল। প্রহরী জানায়-“ছেলেমানুষকে রাজা এতটুকু-টুকু ছোট্ট ছোট্ট চিঠি লেখেন।” অমলকে চিঠি লিখবেন বলেই রাজা তার জানালার সামনে অত বড়ো ডাকঘর খুলেছেন। অমলের সঙ্গে কথা বলে প্রহরীর মনে হয়- “এ ছেলেটি ভারি মজার।” ছেলেটিকে তার বেশ লাগে। রাজার প্রহরী শুনলে যে চিরাচরিত ভয় পাঠকের মনে জেগে উঠতে পারত, আলোচ্য নাটকে তা হতে দেখা যায়নি। এক স্নেহপরায়ণ, আশাজাগানিয়া, কোমল হৃদয়ের চরিত্ররূপেই প্রহরী চরিত্রটির প্রকাশ ঘটেছে।

কালের ধারক: প্রহরী আসলে অখন্ড কালপ্রবাহের প্রতিনিধি, বহমান সময়ের সূচক তার ঢং ঢং ঘণ্টাধ্বনি সময়প্রবাহকে খণ্ড খণ্ড করে মানুষের চেতনা জাগিয়ে তোলে এবং কালের বহমানতার স্বরূপ ও মূল্য বোঝাতে চায়। আলোচ্য নাটকের অন্যতম উপজীব্য হল সময়প্রবাহ। তারই সংকেত প্রহরী চরিত্রে নিহিত।

৯। ডাকঘর’ নাটক অবলম্বনে দইওয়ালা চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো। ৫

অমলের সহমর্মী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ডাকঘর’ নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যটি শুরু হয়েছে দইওয়ালার সুরেলা হাঁক দিয়ে- “দই-দই-ভালো দই!” অসুস্থতার কারণে ঘরে বন্দি অমল জানালা দিয়ে দইওয়ালাকে ডেকে ভাব জমায়। অমলের কাছে পয়সা নেই, সে দই কিনবে না জেনে দইওয়ালা অসন্তুষ্ট হয়। কিন্তু যখন জানতে পারে বালকটি ব্যাধিগ্রস্ত, তার বাইরে বেরোনোয় কবিরাজের বারণ আছে তখন দইওয়ালার হৃদয় বিগলিত হয়। সে তখন আর তার লাভক্ষতি, সময় বয়ে যাওয়ার পরোয়া করে না। অমলের বন্দিদশা দেখে সমব্যথী হয় সে।

স্নেহপ্ৰবণ: পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায়, শামলী নদীর ধারে দইওয়ালার গ্রাম। বড়ো বড়ো প্রাচীন গাছের ছায়ায় রাঙা রাস্তার ধারের সেই গ্রামের ছবি ভেসে ওঠে বালক অমলের কল্পনায়। অমলের কল্পনাশক্তির জোর দেখে এবং শিশুমনে খানিক প্রবোধ দিতে অমলের ব্যাখ্যায় দইওয়ালা অত্যন্ত বিস্মিত হয়। কবিরাজ অমলের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিলে দইওয়ালা তাকে নিজেদের গ্রামে নিয়ে যাবে বলে কথা দেয়।

জীবনের গূঢ়তত্ত্ব বুঝতে অক্ষম: দইওয়ালা অমলের সঙ্গে একাত্মতা উপলব্ধি করলেও তার সরল মনের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়ার মতো বোধ তার ছিল না। দইওয়ালার কাছে তার নিজের পেশাটি কষ্টসাধ্য বলে মনে হয়। তাই অমল তার মতো সুর করে, ঘুরে ঘুরে দই বেচতে চায় শুনে দইওয়ালা আঁতকে ওঠে। সেও চায় অমল অনেক বই পড়ে পণ্ডিত হোক। অমলের বন্দিমনের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে সে অনুধাবন করতে পারে না, বরং তাকে সে এক ভাঁড় দই দেয় এবং অমলের সঙ্গে তার ছোটো বোনঝির বিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয়। কার্যত অমলের মন ভোলাতেই দইওয়ালা চরিত্রটির আগমন। যদিও অমলের সঙ্গে এই স্বল্প সাক্ষাতেই দইওয়ালার লাভক্ষতির হিসাবনিকাশ গুলিয়ে গিয়েছিল।

স্বাধীনতার উপলব্ধি: অমলের সঙ্গে গল্প করতে করতে বেলা বয়ে গেলেও দইওয়ালা লাভলোকসানের হিসাব কষেনি। বরং অমলকে সে বলেছে- “দই বেচতে যে কত সুখ সে তোমার কাছে শিখে নিলুম।” দইওয়ালা স্বাধীনভাবে ঘুরে ঘুরে প্রতিদিনই দই বিক্রি করে। কিন্তু সেই স্বাধীনতার স্বাদ এর আগে কখনও সে অনুভব করেনি। কিন্তু গৃহবন্দি বালকের সঙ্গে গল্প করে সে উপলব্ধি করে তার স্বাধীনতার মর্ম। অমলও যেন দইওয়ালার সান্নিধ্যে বাইরের মুক্ত পৃথিবীর স্বাধীনতার আভাস পায়। অসমবয়সি হলেও দইওয়ালা অমলের মতোই সরল। প্রকৃতির মাঝে যে মুক্তির জন্য অমল ব্যাকুল, তারই ক্ষণিকের দোসর হয়ে এসেছে দইওয়ালা।

১০। ‘ডাকঘর নাটক অবলম্বনে কবিরাজ চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। ৫

পুথিনির্ভরতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ডাকঘর’ নাটকে কবিরাজ হলেন অমলের চিকিৎসক। নাটকের প্রথম ও তৃতীয় দৃশ্যে তাঁর ক্ষণিকের উপস্থিতি। তিনি আয়ুর্বেদশাস্ত্রমতে চিকিৎসা করেন। অমলের শারীরিক অবস্থা ও চিকিৎসা প্রসঙ্গে পুথি থেকে উদ্ধৃতি দেন-“পৈত্তিকান্ সন্নিপাতজান্ কফবাতসমুদ্ভবান্-“। এসব সংস্কৃত উক্তি সাধারণ গৃহস্থ মাধব দত্তের মনে ভীতির সঞ্চার করে। কথায় কথায় কবিরাজ আয়ুর্বেদশাস্ত্রের দোহাই দেওয়ায় মাধব বিরক্তি বোধ করে। তাঁর চিকিৎসায় অমলের প্রাণও ওষ্ঠাগত। আসলে স্বাধীন মনকে পুথিশাস্ত্রের বেড়াজালে বন্ধ করে রাখাকেই কবিরাজ রোগনিরাময় বলে মনে করে।

চিকিৎসাবিধির কঠোরতা: কবিরাজ বলেছেন অমলের এটুকু শরীরে একসঙ্গে বাত-পিত্ত-শ্লেষ্মা যেরকম প্রকুপ্রিত হয়ে উঠেছে, তাতে তার আর বড়ো আশা নেই। পুথিগত জ্ঞানের বাইরে কবিরাজের আর কোনো বোধ নেই। বালকের মনস্তত্ব বোঝার ক্ষমতা তাঁর নেই। অতএব, অমলকে ঘরে আটকে রাখার বিধান দেন তিনি। তাঁর মতে- “এই শরৎকালের রৌদ্র আর বায়ু দুই-ই ওই বালকের পক্ষে বিষবৎ।” কবিরাজের চিকিৎসাবিধি বড়ো নির্মম। নির্বিকারভাবে তিনি রোগীকে কড়া ও তেতো বড়ি খাওয়ান। এসব অমলের উপর অত্যাচারের শামিল বলেই মনে হয় মাধবের। তবে মনে রাখতে হবে, কবিরাজের চিকিৎসাবিধির বাঁধন যত শক্ত হয় ততই তা ভাঙনের মুখে পতিত হতে থাকে।

নেতিবাচক মানসিকতা: অমলের সুস্থ হয়ে ওঠার ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক কথা কবিরাজ বলেননি। বরং তিনি আশা ছেড়ে দিয়েছেন-“বোধ হচ্ছে, আর ধরে রাখা যাবে না।” পরবর্তীকালে একটি চিঠিতে নাট্যকার স্বয়ং বলেছেন- “কবিরাজটা ওকে মারতে বসেছিল বটে।” অর্থাৎ অমলের মানসিক মুক্তিকে রোধ করে তার বৌদ্ধিক মৃত্যু প্রায় ঘটিয়েই ফেলেছিল কবিরাজ, অবশেষে রাজবৈদ্যের আগমনে তাকে নিরস্ত করা সম্ভব হয়। অমলের মৃত্যু হয়েছে বলে অবিশ্বাসীরা সন্দেহ করলেও রাজবৈদ্যের হাতে কেউ মরে না।

স্থূল পার্থিব সীমাবদ্ধতা: প্রাচীন সংস্কার, শাস্ত্র ও পুথিনির্ভরতার প্রতিভূরূপে কবিরাজ চরিত্রটি পরিকল্পিত। প্রচলিত সংস্কারে আচ্ছন্ন, পুথিগত বিদ্যায় আবদ্ধ, সংকীর্ণ পার্থিব সীমায় আটকে থাকা কবিরাজের পক্ষে মানবাত্মার প্রকৃত মুক্তির মন্ত্র জানা তাই সম্ভব ছিল না।

১১। ডাকঘর’ নাটক অবলম্বনে রাজদূত এবং রাজকবিরাজ চরিত্র দুটির ভূমিকা আলোচনা করো। ৫

রাজদূতের ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ডাকঘর’ নাটকে অসুস্থ অমল যখন শয্যাশায়ী তখন রাজদূতের প্রবেশ। সে বার্তা নিয়ে এসেছে যে, আজ দুই প্রহর রাত্রে মহারাজ আসবেন। রাজদূত অমলকে জানিয়েছে- “রাজা তাঁর বালক-বন্ধুটিকে দেখবার জন্যে তাঁর সকলের চেয়ে বড়ো কবিরাজকে পাঠিয়েছেন।” এ নাটকে রাজদূতের ভূমিকা এতটুকুই। সে রাজার আগমনবার্তার বাহক মাত্র। এরপরই রাজকবিরাজের প্রবেশ।

রাজকবিরাজের ভূমিকা: কবিরাজের নির্দেশানুযায়ী অমল ছিল গৃহবন্দি কিন্তু রাজকবিরাজ এসে ঘরের সমস্ত জানালা-দরজা খুলে দেয়। রাজকবিরাজের উপস্থিতিতে রাতের তারারা অমলের চোখের সামনে ফুটে ওঠে অর্থাৎ অমলের মুক্তির পথ প্রশস্ত করে দেয় রাজকবিরাজ-অমলের যন্ত্রণামুক্তি ঘটে। রাজার আগমনহেতু মুড়িমুড়কির ভোগ আর ফুলের সজ্জার নির্দেশ করে রাজবৈদ্য, কারণ সাধারণের মধ্যে সাধারণরূপে ধরা দিতেই রাজা নেমে আসছেন তাঁর রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে। তাই রাজবৈদ্যের দ্বারাই মুক্তির প্রথম অনুভূতি সঞ্চারিত হয় অমলের মধ্যে। এরপর রাজবৈদ্য সবাইকে স্থির হতে বলেন। কারণ অমলের ঘুম আসছে তাই প্রদীপের আলো নিভিয়ে দিতে বলেন তিনি- “এখন আকাশের তারাটি থেকে আলো আসুক, ওর ঘুম এসেছে।” অমল চিরঘুমের মধ্য দিয়ে অমৃতলোকে যাত্রা করেছে। বিশ্বস্রষ্টা সসীম জগৎ থেকে নিয়ে যাচ্ছেন অসীম-অনন্ত-অরূপলোকে। আর তারই ব্যবস্থাপনা ছিল রাজকবিরাজের দায়িত্বে। রাজারূপী ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়ে রাজকবিরাজ এসেছেন অমলকে চির-আরোগ্যময় অমর্ত্যলোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সমস্ত বন্ধন থেকে বালককে মুক্ত করে পার্থিব মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নবজীবন লাভের সহায়করূপে রাজকবিরাজ চরিত্রটির আগমন।

১২। ডাকঘর নাটকে পথের ভূমিকা আলোচনা করো। ৫

পথের ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ডাকঘর’ নাটকে অমানবীয় উপাদানগুলির মধ্যে পথ গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে। বালক অমল মা-বাবাকে হারিয়ে দূর সম্পর্কের পিসেমশায় মাধব দত্তের বাড়িতে আশ্রয় পায়। সেই বাড়ির সামনেই রয়েছে মানুষের আসা-যাওয়ার প্রশস্ত এক পথ। অসুস্থতার কারণে ঘরবন্দি অমল বাইরে বেরোনোর জন্য ব্যাকুল হয়। জানালা দিয়ে সে দূরের পাহাড় দ্যাখে আর তার খুব ইচ্ছে করে পাহাড়টা পেরিয়ে চলে যেতে। কাজ খুঁজতে বেরোনো এক পথিককে সেই পাহাড়ের দিকে কাজ খুঁজতে যেতে দেখে অমলেরও কাজ খুঁজতে যেতে ইচ্ছে হয়। খোঁজার মধ্যে মুক্তির আভাস অমল পথের থেকেই ধার করে নেয়। জানালার ধারে বসে পথচারীদের সঙ্গে ভাব জমায় অমল। এভাবেই একে একে দইওয়ালা, প্রহরী, মোড়ল, ফকির, ছিদাম, সুধা, ছেলের দলের সঙ্গে অমলের ভাবনার আদানপ্রদান হয়। তার কল্পনায় ভেসে ওঠে দইওয়ালার গ্রামের রাঙামাটির পথ। পথে পথে ভিক্ষে করে জীবনকে উপভোগ করে খঞ্জ, দৃষ্টিহীন ছিদাম। অমলেরও মন চায় ভিক্ষার ছলে পথে নামতে। ফকির যে হালকা দেশের গল্প শোনায় সেখানে যাওয়ার ‘ভিতরের দিক দিয়ে সে একটা রাস্তা আছে’- সেই রাস্তার মোহে পড়ে অমল।

অমলের অনুরোধে ছেলের দল পথেই কিছুক্ষণ খেলা করে যায়। এ পথেই সুধা ফুল নিয়ে আসে অমলের জন্য। পথের ওপারেই রাজা ডাকঘর খুলে বসেন। অমলের নামে রাজার চিঠি আসবে এ পথেই, তা অমল জানে। রাজার ডাকহরকরা কত দূর থেকে সেই চিঠি বয়ে নিয়ে আসবে। পাহাড়ের পাদদেশে ঝরনার পথ ফুরোলে বাঁকা নদীর পথ ধরে হরকরা কেবলই চলে আসছে অমলের দিকে, তা যেন অমল দেখতে পায়।

পথ কি শুধু বাইরে! অন্তরেও থাকে অনন্ত পথের আহ্বান। দৃশ্যমানতার বাইরেও আছে অলক্ষ্য পথ। ‘পথের শেষ কোথায়, কী আছে শেষে’-মানুষ জানে না। পথ তাই অনন্তের প্রতীক। মানবাত্মা কেবল জীবনপথটুকু চেনে, ভাবে মৃত্যুতেই বুঝি সে পথের সমাপ্তি। কিন্তু তারও পরে আছে অমৃতলোকের পথ। সে পথেই অমলকে নিয়ে যাবেন রাজারূপী ঈশ্বর। অন্য অর্থে, পথ হল মাধ্যম বা উপায়। ঈশ্বরসান্নিধ্যে পৌঁছোনোর উপায়। সমগ্র রবীন্দ্রসৃষ্টিতে পথের ভূমিকা তাই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আলোচ্য নাটকেও ঘর ও পথের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই পথ যেন এক জীবন্ত সত্তা হয়ে উঠেছে। ঘর যেমন সীমার, পথ তেমনই অসীমের প্রতীক।

১৩। “যখন ও ছিল না, তখন ছিলই না-কোনো ভাবনাই ছিল না। এখন ও কোথা থেকে এসে আমার ঘর জুড়ে বসল; ও চলে গেলে আমার এ ঘর যেন আর ঘরই থাকবে না।”- এই উক্তিতে বক্তার কোন্ মানসিক অবস্থার প্রকাশ ঘটেছে?

অথবা, “মুশকিলে পড়ে গেছি।”- বক্তার মুশকিলের বর্ণনা দাও। ৫

পোষ্যপুত্রের প্রতি হৃদ্যতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ডাকঘর’ নাটকে মাধব দত্ত তার মানসিক অবস্থা বোঝাতে গিয়ে কবিরাজকে উক্ত কথাগুলি বলেছে। মাধব দত্ত নিঃসন্তান, বিষয়ী ও হিসেবি এক মানুষ। সংসারে সে ও তার স্ত্রী ব্যতীত আর কেউ ছিল না। সন্তানের অভাববোধ থেকে তার স্ত্রী পোষ্যপুত্র নেওয়ার জন্য স্বামীকে বরাবর অনুরোধ করে এসেছে। কিন্তু মাধব তাতে কর্ণপাত করেনি কারণ তাঁর আশঙ্কা ছিল তার কষ্টার্জিত ধনসম্পদ অন্যের ছেলে এসে নয়ছয় করবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সে তার স্ত্রীর গ্রাম সম্পর্কের এই ভাইপোকে দত্তক হিসেবে ঘরে নিয়ে আসে। ছেলেটি ছোটোবেলা থেকেই মাতৃহীন। সম্প্রতি তার বাবাও মারা গিয়েছে। বালকটির নাম অমল। তাকে পোষ্যপুত্ররূপে গ্রহণ করার পর থেকেই মাধক তার মায়ায় জড়িয়ে পড়ে। উত্তরাধিকারের প্রয়োজন অপত্যস্নেহে পরিণত হয়। ‘পরের ছেলে’টিকে আপন করে নিয়ে, ভালোবাসায় জড়িয়ে যেন মুশকিলে পড়ে মাধব দত্ত। সন্তানসম অমলকে হারানোর ভয় সন্তানহীনতার বেদনাকে ছাপিয়ে যায়।

অমলকে হারানোর আশঙ্কা: মাধব দত্তের পোষ্যপুত্র অমলের কঠিন অসুখ। কবিরাজ তাকে গৃহে আবদ্ধ রাখতে বলেছেন। ছেলেটির বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই পরিস্থিতিতে মাধবের মনে হয়েছে অমল যখন তার জীবনে আসেনি, তার ঘর ও হৃদয় ‘অধিকার’ করে বসেনি তখন তার কোনো ভাবনা ছিল না। এলই যখন, তখন এত কম আয়ু নিয়ে এল কেন? এই প্রশ্নই তার মাথায় ঘোরে সর্বদা। অমল চলে গেলে মাধবের ঘর শূন্য হয়ে যাবে। সন্তানহীন স্বামী-স্ত্রীর সংসারে যে শূন্যতা ছিল তা পূর্ণতা পেয়েছে অমলের আগমন ও উপস্থিতিতে। এখানে ও চলে গেলে যে শূন্যতা তৈরি হবে তা পূর্বের শূন্যতার থেকেও ভয়ঙ্কর। আর অমলের হৃদয় উদ্বেলকারী ‘পিসেমশায়’ ডাকখানি মাধব দত্তের অবদমিত পিতৃসত্তাকে জাগিয়ে তোলে। সেই অকৃত্রিম অপত্যস্নেহের কারণেই অমলকে হারানোর আশঙ্কায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মাধবের বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থার প্রকাশ ঘটেছে আলোচ্য উক্তিতে।

১৪। ওতে আরও আমার ভয় বেড়ে যায়।”- কীসে বক্তার ভয় বেড়ে যায়? ভয় বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? ২+৩

ভয়ের উৎস: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ডাকঘর’ নাটকে মাধব দত্ত একজন বিষয়ী গৃহস্থ। তার কোনো সন্তান ছিল না। স্ত্রীর গ্রাম সম্পর্কে – ভাইপো অনাথ বালক অমলকে সে পোষ্যপুত্র হিসেবে ঘরে আনে। অমল – কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত, সে বেশিদিন বাঁচবে কি না তা নিয়ে কবিরাজের সংশয় আছে। তিনি আয়ুর্বেদশাস্ত্র আওড়ে মাধবকে তাঁর আশঙ্কার কথা শোনান। শাস্ত্র থেকে শ্লোক উদ্ধৃত করে বলেন- “পৈত্তিকান্ সন্নিপাতজান্ কফবাতসমুদ্ভবান্” অর্থাৎ পিত্ত সংক্রান্ত জ্বর-কফ-বায়ু থেকে উদ্ভূত রোগে অমল আক্রান্ত। রোগব্যাধির এইসব শ্লোক আওড়ানোর ফলে মাধবের ভয় আরও বেড়ে যায়।

ভয় বাড়ার কারণ: মাধব ও তার স্ত্রীর ঘর যখন শূন্য ছিল তখন বিষয়- আশয় নিয়ে ব্যস্ত মাধব দত্ত সন্তানের শূন্যতা সেভাবে অনুভব করতে পারেনি বরং পোষ্যপুত্র গ্রহণের কথায় সে বরাবরই তার উপার্জিত অর্থ নয়ছয় হওয়ার আশঙ্কা করেছে। কিন্তু অমলকে পেয়ে তার এই মানসিকতার আমূল পরিবর্তন ঘটে। নিঃসন্তান মাধবের সংসার ভরিয়ে তোলে অমলের উপস্থিতি। স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে অমলকে ঘরে আনলেও অসুস্থ, নিষ্পাপ বালকটির সঙ্গে জড়িয়ে যায় মাধব দত্ত। তার শূন্য ঘর ভরে ওঠে। বালকের প্রতি অকৃত্রিম বাৎসল্যে মাধবের এতদিনের না পাওয়া পিতৃত্ব তৃপ্ত হয়। কিন্তু অমলের অসুস্থতা নিয়ে তার দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। কবিরাজের নিদান মেনে অমলকে বাইরে যেতে বারণ করতেও মাধবের কষ্ট হয়। ছোটো ছেলে, ঘরের বাইরে বেরিয়ে একটু খেলাধুলো করবে- তার উপায় নেই। যদি কবিরাজের আশঙ্কা সত্যি হয়, যদি অমল অকালে তার ঘর শূন্য করে চিরতরে চলে যায়-এই ভয় মাধবকে তিলেতিলে দগ্ধ করে। তাই কবিরাজের নেতিবাচক, নিরাশাব্যঞ্জক, ভয়ংকর শ্লোক আওড়ানোয় মাধবের অমলকে হারানোর ভয় আরও বেড়ে যায়।

আরো পড়ুন : হলুদ পোড়া গল্পের প্রশ্ন উত্তর

আরো পড়ুন : হারুন সালেমের মাসি গল্পের প্রশ্ন উত্তর

আরো পড়ুন : তিমির হননের গান কবিতার প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment