মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান রচনা
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান রচনা
ভূমিকা
মাতৃভাষা মুখের ভাষা, বুকের ভাষা, মনেরভাষা। দীর্ঘকাল বিদেশী ইংরেজরা আমাদের দেশ শাসন করেছে। এতদিন দেশের অগণিত মানুষকে মাতৃভাষা থেকে নির্বাসিত রেখে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞানবিজ্ঞানে, রাজনীতি-সমাজনীতিতে নতুন শিক্ষা-সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে যার সাথে দেশের জল-হাওয়া, মানুষের চিন্তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের সাবলিল সম্পর্কের অভাব ছিল।
ইংরেজি ভাষার প্রয়োজনীয়তা
ব্রিটিশরা আমাদের দেশ শাসন করেছে, শোষণ করেছে। ব্রিটিশরা তাদের প্রয়োজনে এদেশে ইংরেজী ভাষা প্রচলনে সচ্চেষ্ট হয়। একথা ঠিক যে ইংরেজী শিক্ষার ফলে এদেশের মানুষের চোখে ধরা পড়ল সারা পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি। মানুষের মনে জাগ্রত হল আত্ম-সচেতনতা বোধ যা পরবর্তী কালে মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে সাহায্য করেছে। তখন আমাদের জাতীয় জীবনে মধ্যযুগীয় অন্ধকার অপসারণ ও মূঢ়তা -মুক্তির জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রয়োজন ছিল। নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় অচলায়তনকে বিধবংস করল য়ুরোপীয় শিক্ষার আলোকের উজ্জ্বলতা।
ইংরেজি ভাষা-সর্বস্বতার পরিণাম
উনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আমাদের চিত্ত-মুক্তি ঘটলেও এদেশে ইংরেজি ভাষা প্রবর্তনের কারণ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও বাণিজ্য পরিচালনা ও ভারতবাসীর মনে ব্রিটিশ সম্বন্ধে সুমনোভাব সৃষ্টি করা। এর ফলে ভারতবর্ষে এল নবজাগরণ।স্কুল-কলেজে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে যে শিক্ষা আমরা পেয়েছি তা ভাষাসমস্যার জন্য অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত শিক্ষা প্রাপ্তি থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার ফলে আমরা সুদূর বিশ্বকে জানতে সক্ষম হলেও জানতে পারিনি ঘরকে, অবহেলিত হয়েছে নিজস্ব ভাষা মাতৃভাষা, আপন ঐতিহ্য। আমরা ইংরেজি শিক্ষার ফলে প্রকৃত পক্ষে বিদ্যা বলতে যা বুঝায় তা যে পাইনি সে ব্যাপারে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ দুঃখ করে বলেছেন, ‘চারদিকের আবহাওয়া থেকে এ বিদ্যা বিচ্ছিন্ন, আমাদের ঘর আর ইস্কুলের মধ্যে ট্রাম চলে, মনে চলেনা।’
শিক্ষা ও জীবনে মাতৃভাষা
পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন হয়েছে, আমরা এখন স্বাধীন। কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবনে মাতৃভাষার পূর্ণ অভিষেক হল না। ইংরেজি আর্ন্তজাতিক ভাষা। বিশ্বকে জানতে হলে ইংরেজিও জানা প্রয়োজন। কিন্তু জন্মের পরে আমরা যে ভাষায় কথা বলি, মনের ভাব প্রকাশ করি, যে ভাষায় স্বপ্ন দেখি, জীবন শুরুর প্রাতে ও পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার সময় মনের চিন্তা ব্যক্ত করি তা হল মাতৃভাষা। মাতৃদুগ্ধ পান করে যেমন শরীর প্রকৃতি- পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখে তেমনি মাতৃভাষা মানুষের চিন্তা উপলব্ধিকে পূর্ণতা দিতে সাহায্য করে। কারণ প্রত্যেকে তার মাতৃভাষায় প্রথমে চিন্তা করে ও অন্যভাষায় চিন্তার বিষয়কে রূপান্তর করে বলে বা উপলব্ধি করে মাতৃভাষা শিশুর কাছে মাতৃদুগ্ধ যেন, তা তার নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে হৃৎস্পদনের সাথে, শোণিত ধারায় মিশে থাকে।
আমরা অনুসন্ধান করে দেখছি, চীন, রাশিয়া, জাপান বিজ্ঞান সাধনায় যে চরম সাফল্য পেয়েছে তার অন্যতম কারণ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার আয়োজনে। বাংলা ভাষা বাঙালিদের মাতৃভাষা। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতে, আমাদের পার্থিব ভাব-চিন্তা, আশা আকাঙ্খার সঠিক রূপায়ণ বাংলা ভাষার মাধ্যমে সম্ভব। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মাইকেল মধূসুদন প্রমুখ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপহার রেখে গেছেন বাংলা ভাষায় রচনার মাধ্যমে।
মাতৃভাষাও জাতীয় শিক্ষানীতি
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি মনীষীদের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা বাংলা ভাষায় পঠন-পাঠন শুরু হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলাভাষা আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। সরকারি ক্ষেত্রে অফিস প্রভৃতিতে বাংলা ভাষার প্রচলন শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শুভ-সংকেত সূচিত করছে। অপারেশন-ব্লাকবোর্ড, সাক্ষরতা অভিযান প্রভৃতি সরকারি পরিকল্পনা শিক্ষার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন যে আনবে তা শিক্ষাবিদগণ মনে করেন।
উপসংহার
আমরা পা রেখেছি একবিংশ শতাব্দীতে। বিশ্বায়ন ঘটে গেছে। টেলিভিশন, রেডিও প্রভৃতি সংবাদ মাধ্যমের সাহায্যে ঘরে বসে সারা বিশ্বকে জানার সুযোগ এখন এসে গেছে। ইংরেজি বা অন্য ভাষা শিক্ষার প্রয়োজন যে নেই তা নয়। কিন্তু মাতৃভাষা শিশুর জন্ম থেকে বিশ্বের সবকিছুকে চিনতে জানতে এবং সহজে মনের ভাব প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন – ছাত্র সমাজের সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রবন্ধ রচনা