বৌদ্ধদের অষ্টাঙ্গিক মার্গের ধারণা প্রশ্ন উত্তর Class 11 Second Semester WBCHSE

সূচিপত্র

বৌদ্ধদের অষ্টাঙ্গিক মার্গের ধারণা প্রশ্ন উত্তর

বৌদ্ধদের অষ্টাঙ্গিক মার্গের ধারণা প্রশ্ন উত্তর
বৌদ্ধদের অষ্টাঙ্গিক মার্গের ধারণা প্রশ্ন উত্তর

১। কর্মবাদ কী? বৌদ্ধ কর্মবাদ সম্পর্কে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো

কর্মবাদ

বৌদ্ধ অধিবিদ্যক তত্ত্বসমূহের মধ্যে কর্মবাদ হল অন্যতম। কর্মবাদ অনুসারে প্রত্যেক জীবকে তার কৃতকর্মের জন্য ফলভোগ করতেই হবে। জীব তার কর্ম অনুযায়ী ফলভোগ করে থাকে। সৎকর্মের ফলে সুখ লাভ করা যায় আর অসৎ কর্মের ফলে দুঃখ ভোগ করতে হয়। এইভাবে পূর্বজীবনের কর্মফলের দ্বারা বর্তমান জীবন এবং বর্তমান জীবনের কর্মফলের দ্বারা ভবিষ্যৎ বা পরবর্তী জীবন নির্ধারিত হয়। মনুষ্যকৃত প্রতিটি কর্মের ফলই কার্যকারণ পরম্পরায় পূর্ববর্তী জীবন, বর্তমান জীবন ও তার পরবর্তী জীবনের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে।

(1) কর্মের প্রকারভেদ: বৌদ্ধ দর্শনে তিন প্রকার কর্মের কথা বলা হয়েছে। যথা-কায়িক, বাচিক ও মানসিক। উদাহরণের সাহায্যে এই কর্মগুলিকে ব্যাখ্যা করা হল। ধরা যাক, কোনো ব্যক্তি প্রাণী হত্যার সংকল্প নিয়ে অরণ্যে গেল এবং প্রাণী হত্যা করল। এই প্রাণী হত্যা করা হল ব্যক্তিটির কায়িক কর্ম। কিন্তু যদি অনেক অনুসন্ধানের পরও সে বধযোগ্য কোনো প্রাণীর সন্ধান না পায়, সেক্ষেত্রে ব্যক্তিটি শারীরিকভাবে প্রাণী হিংসা না করলেও তার মানসিক কর্মে হিংসা যুক্ত থাকে।

আবার যদি কোনো ব্যক্তি নিজে হত্যা না করে অন্যকে প্রাণী হত্যা করার জন্য আদেশ দেয় তবে তার এই কর্মটিকে বলা হবে বাচিক কর্ম এবং এক্ষেত্রে এই বাচিক কর্মটি হল হিংসাযুক্ত। এক্ষেত্রে, সমস্ত কায়িক কর্ম ও বাচিক কর্মের মূলে রয়েছে মানসিক কর্ম। কারণ মন্দ চিন্তা বা মন্দ ইচ্ছা, তা কার্যে রূপায়িত হোক বা না হোক, সেটি মানসিক কর্ম বলে অভিহিত হবে। মানসিক কর্ম না থাকলে কায়িক বা বাচিক কর্ম থাকতে পারে না।

কর্মফলের দিক থেকে কর্মকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

  • অশুভ বা অসৎ কর্ম যা অবিশুদ্ধ বা অশুচিমূলক কর্মফল উৎপন্ন করে।
  • শুভ বা সৎ কর্ম যা বিশুদ্ধ কর্মফল উৎপন্ন করে।
  • আংশিকভাবে শুভ বা সৎ ও আংশিকভাবে অশুভ বা অসৎ কর্ম যা শুভ ও অশুভ উভয়প্রকার কর্মফল উৎপন্ন করে। এই তিন প্রকার কর্ম হল সকাম কর্ম।
  • যে কর্ম শুভ বা অশুভ (সৎ বা অসৎ) কর্ম নয় তা শুভ বা অশুভ কোনোপ্রকার কর্মফলই উৎপন্ন করে না। এরূপ কর্মই কর্মের বিনাশে সহায়ক হয়। এই প্রকার কর্ম হল নিষ্কাম কর্ম।

(2) কর্মবাদের ব্যাখ্যা: কর্মবাদ অনুসারে, মানুষ মাত্রই তার কৃতকর্মজনিত ফল ভোগ করতে হয়। যদিও কর্মমাত্রই তাৎক্ষণিক ফল উৎপন্ন করে এমনটা নয়। কর্ম অনেককাল পরেও তার ফল উৎপন্ন করতে পারে এবং যতক্ষণ না সেই ফল উৎপাদিত হচ্ছে ততক্ষণ তা দীর্ঘস্থায়ী এবং শক্তিরূপে বিদ্যমান থাকতে পারে যাকে ‘অদৃষ্ট’ বা ‘ধর্ম’ বলা হয়। এই অদৃষ্ট শক্তির কারণেই অনুষ্ঠিত কর্ম তাৎক্ষণিক ফল উৎপাদন না করে অনেকদিন পরে জীবনের শেষ দিকে বা পরবর্তী জীবনে কর্মফল প্রদান করে। মনুষ্যজীবনে এই কর্মনিয়ম অলঙ্ঘনীয়।

(3) সমালোচনা : বৌদ্ধ কর্মবাদ প্রসঙ্গে সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে যে, কর্মবাদকে স্বীকার করলে নির্বাণ লাভ করা কীভাবে সম্ভব? কেন-না, কর্মবাদ অনুসারে, কর্মনিয়ম অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবীরূপে ব্যক্তিকে ফলভোগ করায়। যার ফলস্বরূপ জন্ম-জন্মান্তরের ভবচক্রে মানুষকে আবর্তিত হতে হয় এবং নির্বাণ লাভ অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর তাই কর্মবাদ নির্বাণলাভের বিরোধী। উপরোক্ত আপত্তির উত্তরে বৌদ্ধরা বলেন যে, কর্মবাদ যেসব কর্মকে ফলপ্রসূ বলে স্বীকার করেছে তার সবই সকাম। নিষ্কাম কর্ম কোনো ফলপ্রসব করে না। কর্মকর্তা যদি ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন করে, স্বার্থ-বুদ্ধি পরিত্যাগ করে নিরাসক্তভাবে কর্ম সম্পাদন করেন তবে সেই কর্ম বন্ধনের কারণ হয় না। আসক্তিযুক্ত সকাম কর্মই বন্ধন তথা জন্ম-জন্মান্তরের কারণ হয়। কাজেই নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে নির্বাণের কোনো অসংগতি বা বিরোধ নেই বরং নিষ্কাম কর্ম নির্বাণ লাভের পথকে আরও প্রশস্ত করে।

২। আর্যসত্য কী? বৌদ্ধ দর্শনে চারটি আর্যসত্য কী কী? চারটি আর্যসত্য সম্বন্ধে আলোচনা করো। অথবা, বৌদ্ধ নীতিতত্ত্বে চারটি আর্যসত্য বিশ্লেষণ করো

আর্যসত্য

বুদ্ধদেব ছিলেন সত্যদ্রষ্টা সাধক ও নীতিতত্ত্বের প্রচারক। নিছক ও নিরর্থক তত্ত্ব আলোচনাকে তিনি মূর্খতা বলে মনে করতেন। বুদ্ধদেব উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষ যেমন বাস্তব, মানুষের দুঃখও তেমনি বাস্তব। জগতের সবকিছুই ক্ষণিক হওয়ায় তা নিত্যসুখ দিতে অসমর্থ্য। ইন্দ্রিয়সুখমাত্রই ক্ষণিক হওয়ায় তা দুঃখময়। জীবমাত্রই সীমাহীন দুঃখে জর্জরিত। আর মানুষের এই দুঃখ-কষ্টের মূল কারণ হল অবিদ্যা (তত্ত্ব জ্ঞানের অভাব) বা অজ্ঞানতা। এই অবিদ্যার বিলোপসাধন করতে পারলেই মানুষ দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। বুদ্ধদেব মানুষকে দুঃখ, তার উৎপত্তি, নিবৃত্তি ও নিবৃত্তির উপায় সম্বন্ধে সচেতন করেছেন। এই চারটি বিষয় সম্পর্কে বুদ্ধদেবের মতই হল বৌদ্ধ দর্শনের নৈতিকতার মূলতত্ত্ব। এগুলিকে বলা হয় আর্যসত্য।

চারটি আর্যসত্য

দীর্ঘ সাধনার পর বোধিলাভের মধ্যে দিয়ে বুদ্ধদেবের মনে যেসব সত্যের জ্ঞান জাগরিত হয়েছিল তা আর্যসত্য চতুষ্টয় বা ‘চত্বারি আর্যসত্যানি’ নামে পরিচিত।

আর্যসত্য চতুষ্টয়ের এই চারটি মহান আর্যসত্য হল-

  1. দুঃখ আছে (সর্বং দুঃখম্)।
  2. দুঃখের কারণ আছে (দুঃখ সমুদয়)।
  3. দুঃখ নিবৃত্তি সম্ভব (দুঃখ নিরোধ)।
  4. দুঃখ নিবৃত্তির উপায় আছে (দুঃখ নিরোধ মার্গ)।

(1) দুঃখ আছে: বুদ্ধদেবের প্রথম আর্যসত্যটি হল ‘সর্বং দুঃখম্’ অর্থাৎ সব কিছুই দুঃখময়। মানুষের জীবনে জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, রোগ, শোক, প্রিয় বিয়োগ, অপ্রিয় সংযোগ প্রভৃতি দুঃখ অবশ্যম্ভাবী। তাই জীবন দুঃখময়। জীব মাত্রই অন্তহীন দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত। সুতরাং দুঃখ সত্য অর্থাৎ দুঃখ আছে- এই হল বৌদ্ধ দর্শনের প্রথম আর্যসত্য।

(2) দুঃখের কারণ আছে: বুদ্ধদেবের দ্বিতীয় আর্যসত্যটি হল দুঃখের কারণ আছে। বুদ্ধদেব অবিদ্যাকে দুঃখের মূল কারণ বলেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি একটি কার্যকারণ শৃঙ্খলের সন্ধান দিয়েছেন। এই শৃঙ্খলের দ্বাদশটি অঙ্গ থাকায় একে দ্বাদশ নিদান বলে। এই কার্যকারণ শৃঙ্খল চক্রাকারে সংযুক্ত হয়ে মানুষকে জন্ম-মৃত্যু-জন্মান্তর প্রবাহে আবর্তিত করে বলে একে ‘ভবচক্র’ বলা হয়। অবিদ্যা থেকে ক্রমান্বয়ে দুঃখের অন্যান্য কারণগুলির সৃষ্টি হয় বলে অবিদ্যাকে দুঃখের মূল কারণ বলা হয়েছে।

(3) দুঃখ নিবৃত্তি সম্ভব: বুদ্ধদেব তৃতীয় আর্যসত্যে বলেছেন দুঃখের মূল কারণ অবিদ্যা দূরীভূত হলে দুঃখ নিরোধ সম্ভব। কার্যকারণ নিয়ম অনুসারে, কারণ বিনাশপ্রাপ্ত হলে কার্যটিও বিনাশপ্রাপ্ত হয়। তাই দুঃখের মূল কারণ অবিদ্যা দূর হলে কার্যকারণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ অন্যান্য কারণগুলিও বিনাশপ্রাপ্ত হয়। বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিকে বলা হয় নির্বাণ। এই নির্বাণের অর্থ হল কামনা-বাসনার চির বিলুপ্তি।

(4) দুঃখ নিবৃত্তির উপায় আছে: বুদ্ধদেবের মতে নির্বাণ হল দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশ বা নিবৃত্তি। বুদ্ধদেব দুঃখ নিবৃত্তির উপায় হিসেবে আটটি মার্গের সন্ধান দিয়েছেন, যা অষ্টাঙ্গিক মার্গ নামে পরিচিত। এই অষ্টাঙ্গিক মার্গগুলি হল- সম্যক দৃষ্টি,  সম্যক সংকল্প,  সম্যক বাক্, সম্যক কর্মান্ত, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম,  সম্যক স্মৃতি, এবং সম্যক সমাধি।

বুদ্ধদেবের মতে চারটি আর্যসত্যের সম্যক জ্ঞান লাভ হলে মানুষ দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ করতে পারে।

৩। বৌদ্ধদের প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা করো

‘প্রতীত্যসমুৎপাদ’ তত্ত্ব 

বৌদ্ধ দর্শনে কার্যকারণবাদ ‘প্রতীত্যসমুৎপাদ’ নামে পরিচিত। ‘প্রতীত্যসমুৎপাদ’ শব্দের অন্তর্গত ‘প্রতীত্য’ শব্দের অর্থ কোনো কিছুর শর্তাধীন থাকা আর ‘সমুৎপাদ’ শব্দের অর্থ উৎপন্ন হওয়া। কাজেই ব্যুৎপত্তিগত অর্থে প্রতীত্যসমুৎপাদ বলতে বোঝায় ‘শর্তাধীন ভাবে কোনোকিছু উৎপন্ন হওয়া’। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী স্বীকৃত এই দার্শনিক তত্ত্বের সারকথা হল এই জগতের সব কিছুই কোনো-না-কোনো শর্তের অধীন।

(1) কার্যকারণ তত্ত্ব: বৌদ্ধ দার্শনিকদের কার্যকারণতত্ত্ব আসলে অসৎকার্যবাদকেই নির্দেশ করে। কেন-না উৎপত্তির পূর্বে কার্য কারণে থাকে না। আবার কার্যোৎপত্তির পরে কারণ কার্যে বিদ্যমান থাকে না। কারণ ও কার্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। বৌদ্ধ মতে প্রতিটি বস্তু স্বলক্ষণযুক্ত এবং ক্ষণমাত্র স্থায়ী। একটি স্বলক্ষণ অন্য একটি স্বলক্ষণকে উৎপন্ন করে বিনষ্ট হয়। কারণ ও কার্যের সম্বন্ধ অনুলোমতা। এই সম্বন্ধ আপেক্ষিক। অর্থাৎ যে কার্যটি উৎপন্ন হল তা আবার তার পরবর্তী কার্যের কারণ। কার্যকারণ সম্বন্ধের শৃঙ্খল একটি প্রবাহ বিশেষ, যার গতি সর্বদা একদিকে। এই কার্যকারণ সম্বন্ধের স্রোতকে বোঝাতে বৌদ্ধ দার্শনিকরা ‘অনুলোমতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

  • কার্যকারণ তত্ত্বরূপে প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব ব্যাখ্যা: বুদ্ধদেবের মতে, এই পৃথিবীতে অকারণে বা বিনা কারণে কোনো কিছু ঘটতে পারে না। এ জগতে যা কিছু ঘটে, তা কোনো-না-কোনো কারণের উপর নির্ভর করেই ঘটে। বৌদ্ধ দর্শনে এই কার্যকারণ তত্ত্বকেই ‘প্রতীত্যসমুৎপাদবাদ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। সার্বভৌম হলেও এই নিয়ম একই সঙ্গে আবশ্যিক এবং আপতিক বা শর্তাধীন। প্রতীত্যসম্যুৎপাদবাদ আপতিক কেন-না শর্তের উপস্থিতিতেই কার্য উৎপন্ন হয়। আবার কার্য উৎপন্ন হওয়া মানেই হল শর্ত উপস্থিত থাকা, যা আবশ্যিক শর্তকে নির্দেশ করে। কাজেই বৌদ্ধ প্রতীত্যসমুৎপাদতত্ত্ব একদিকে যেমন সার্বভৌম কার্যকারণবাদ আবার অন্যদিকে তেমনি শর্তসাপেক্ষ কার্যকারণবাদ। বুদ্ধদেব এর অর্থ পরিস্ফুট করতে গিয়ে শিষ্যদের বলেন যে “ওটা আছে বলেই এটাও আছে, ওটা না থাকলে এটাও আর থাকবে না।” এই জগতের সমুদয় বস্তু এবং ঘটনা বাহ্য ও মনোজগতের সবকিছুই জন্ম-মৃত্যুর অধীন হওয়ায় অনিত্য।

(2) অন্যান্য মতবাদের ভিত্তি: প্রতীত্যসমুৎপাদতত্ত্ব বৌদ্ধ দর্শনে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কেন-না বৌদ্ধ দর্শনের অপরাপর দার্শনিক তত্ত্বগুলি এই তত্ত্ব থেকেই নিঃসৃত হয়েছে। বুদ্ধদেব স্বয়ং এই তত্ত্বকে ‘ধর্ম’ বা ‘নীতি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। বুদ্ধদেব তাঁর শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বলেছেন যে প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্বকে উপলব্ধি করা মানেই হল ধর্মকে জানা। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী স্বীকৃত কর্মবাদ, অনিত্যবাদ বা ক্ষণিকত্ববাদী ও নৈরাত্মবাদ এমনকি বুদ্ধদেব উপলব্ধ আর্যসত্য চতুষ্টয় এই মূলতত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে আছে।

(3) মধ্যমপন্থী মতবাদ: প্রতীত্যসমুৎপাদবাদ এক মধ্যমপন্থী মতবাদ। এই প্রতীত্যসমুৎপাদ হল নিত্যতাবাদ এবং নাস্তিত্ববাদ বা উচ্ছেদবাদ-এর মধ্যবর্তী মতবাদ। নিত্যতাবাদ অনুসারে, কোনো কোনো সত্তা নিত্য এবং শর্ত নিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বশীল; আর নাস্তিত্ববাদ অনুযায়ী সত্তা বলে কোনো কিছু নেই, সবই অ-সত্তা। কিন্তু প্রতীত্যসমুৎপাদ অনুযায়ী সকল বস্তু উৎপত্তি ও বিনাশশীল; কোনো বস্তুই নিত্য নয়। প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব অনুসারে বস্তু আছে, তবে তা আপেক্ষিক ও শর্তনির্ভর।

(4) স্ববিরোধী মতবাদ: বৌদ্ধ স্বীকৃত প্রতীত্যসমুৎপাদবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান অধিকার করে আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অন্যান্য সব তত্ত্বের মতো এটিও সমালোচিত হয়েছে। প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্বের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো যে আপত্তিটি ওঠে তা হল, বুদ্ধদেব দুঃখের মূল কারণরূপে অবিদ্যাকে নির্দেশ করলেও অবিদ্যার আর কোনো কারণ নির্দেশ করেননি। কোনো ঐশ্বরিক সত্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করেননি। কাজেই মনে হয় যেন কার্যকারণ শৃঙ্খলটি হঠাৎ অবিদ্যাতে গিয়ে থেমে গেছে। আর তাই প্রতীত্যসমুৎপাদবাদ তত্ত্বটি স্ববিরোধিতা দোষে দুষ্ট।

৪। দ্বাদশ নিদান বা ভবচক্র কী? সংক্ষেপে লেখো।

বৌদ্ধ দর্শনে মানুষের দুঃখের কথা স্বীকার করা হয়েছে এবং দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে চারটি সত্যের কথা বলা হয়েছে। যা আর্যসত্য নামে পরিচিত। এর মধ্যে দ্বিতীয় আর্যসত্যে বলা হয়েছে, আমরা দুঃখ ভোগ করি কেন। এর উত্তরে বুদ্ধদেব বলেছেন বিনা কারণে বা অকস্মাৎ দুঃখ হয় না। তাঁর মতে কার্য মাত্রই কারণ থেকে উৎপন্ন। সুতরাং দুঃখ যেহেতু একটি কার্য সেহেতু এরও একটি কারণ অবশ্যই থাকবে।

দ্বাদশ নিদান

বুদ্ধদেব দুঃখের কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে একটি কার্যকারণ শৃঙ্খলের উল্লেখ করেছেন। এই শৃঙ্খলের দ্বাদশটি অঙ্গ থাকায় একে দ্বাদশ নিদান বলা হয়। নিম্নে এই দ্বাদশ নিদান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল-

(1) জরা-মরণ: মানবজীবনে দুঃখ বা জরা-মরণ আছে।

(2) জাতি বা পুনর্জন্ম: জরা-মরণ বা দুঃখের কারণ হল জাতি বা পুনর্জন্ম। জন্ম হয় বলেই আমরা দুঃখ ভোগ করি।

(3) ভব: পুনর্জন্মের কারণ হল ভব। ‘ভব’ কথার অর্থ হল পুনরায় জন্মগ্রহণ করার জন্য ব্যাকুলতা।

(4) উপাদান: ভব বা জন্মগ্রহণের জন্য ব্যাকুলতার কারণ হল উপাদান বা বিষয়ের প্রতি আসক্তি।

(5) তৃষ্ণা: বিষয়ের প্রতি আসক্তির কারণ হল তৃয়া বা ভোগ্যবস্তুকে ভোগ করার বাসনা।

(6) বেদনা: তৃয়া বা ভোগ-বাসনার কারণ হল আমাদের বেদনা বা অতীতের ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা। পূর্বের বিষয় ভোগ যে আপাত সুখকর অনুভূতি সৃষ্টি করে সেই অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের মধ্যে এই ভোগস্পৃহা জাগে।

(7) স্পর্শ: বেদনার কারণ হল স্পর্শ। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগ হল স্পর্শ। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগ না হলে বেদনা বা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা হত না।

(8) ষড়ায়তন: স্পর্শ বা ইন্দ্রিয়-বিষয় সংযোগের কারণ হল ষড়ায়তন। ষড়ায়তন হল ছয়টি ইন্দ্রিয়-চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও মন।

(9) নামরূপ: ষড়ায়তনের কারণ হল নামরূপ বা দেহ-মনের সংগঠন।

(10) চেতনা বা বিজ্ঞান: নামরূপের কারণ হল চেতনা। চেতনা থাকে বলেই জীবদেহ মাতৃগর্ভে দিন দিন বাড়তে থাকে।

(11) সংস্কার: চেতনার কারণ হল সংস্কার বা অতীত জীবনের অভিজ্ঞতার ছাপ।

(12) অবিদ্যা: সংস্কারের কারণ হল অবিদ্যা। এই অবিদ্যাই হল সকল দুঃখের মূল কারণ। অবিদ্যার অর্থ ‘সম্যক জ্ঞানের অভাব’। অবিদ্যাবশত জীব দুঃখের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই অবিদ্যা থেকেই অন্য নিদানগুলি উদ্ভূত হয়ে ভবচক্র অর্থাৎ অস্তিত্বের বৃত্ত বারবার আবর্তন করছে।

উল্লিখিত বারোটি কার্যকারণ শৃঙ্খলে মানুষের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ জীবন আবদ্ধ। বৌদ্ধ মতে মানুষের পূর্বজীবন বর্তমান জীবনের কারণ, তেমনি আবার বর্তমান জীবন পুনর্জন্মের কারণ। ঘূর্ণমান চক্রের মতো মানুষের জীবন, পূর্বজীবন থেকে বর্তমান জীবন, বর্তমান জীবন থেকে পরজন্মের প্রতি অগ্রসর হয়। এই বারোটি নিদান কার্যকারণ শৃঙ্খলে চক্রের আকারে সংযুক্ত হয়ে মানুষকে জন্ম- মৃত্যু-জন্মান্তরে আবর্তিত করে। তাই একে ভবচক্র (Wheel of Life) বলে।

এই দ্বাদশ কার্যকারণ শৃঙ্খলের প্রতিটি অঙ্গ একদিকে যা কারণ, অন্যদিকে তা কার্য। যেমন অবিদ্যা একদিকে সংস্কারের কারণ অন্যদিকে জরা-মরণের কার্য। বৌদ্ধ পরিভাষায় একে বলা হয় প্রতীত্যসম্যুৎপাদ তত্ত্ব (Theory of Dependent Origination) I

৫। নির্বাণ কী? নির্বাণের স্বরূপ বা প্রকৃতি সম্বন্ধে আলোচনা করো। অথবা, টীকা লেখো: নির্বাণ। অথবা, বৌদ্ধসম্মত তৃতীয় আর্যসত্যটি ব্যাখ্যা করো

নির্বাণ

বৌদ্ধ মতে নির্বাণ হল পরমপুরুষার্থ। দুঃখের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক নিবৃত্তি হল নির্বাণ। বুদ্ধদেব তাঁর নিজ সাধনা জ্ঞানে যে চারটি আর্যসত্য লাভ করেছিলেন তার মধ্যে তৃতীয় আর্যসত্যটি হল ‘দুঃখ নিরোধ অর্থাৎ দুঃখ নিবৃত্তি সম্ভব’। এই দুঃখ নিরোধকেই বৌদ্ধ দর্শনে নির্বাণ বলা হয়েছে।

(1) ‘নির্বাণ’ শাব্দর অর্থ: ‘নির্বাণ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘নিভে যাওয়া’ বা ‘নির্বাপিত হওয়া’। এই দিক থেকে ‘নির্বাণ’ বলতে অস্তিত্বের সম্পূর্ণ বিলুপ্তিকে বোঝায়। কিন্তু বুদ্ধদেবের নিজের জীবনই এ কথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। কেন-না তিনি নিজে জীবিত অবস্থায় বোধি লাভ করেছিলেন।

আবার ‘বাণ’ শব্দের অর্থ ‘তৃয়া’। তাই এই দিক থেকে ‘নির্বাণ’ শব্দের অর্থ হয় ‘তৃয়ার ক্ষয়’। বুদ্ধদেবের মতে নির্বাণ প্রাপ্তি ব্যক্তি কাম, ক্রোধ ইত্যাদি সমস্ত রিপুকে জয় করে সর্বদর্শী হন। সকল বিষয়ে তার অনাসক্তি উৎপন্ন হওয়ায় তার তৃয়ার ক্ষয় হয় এবং তিনি সর্বত্যাগী হন।

বুদ্ধদেবের মতে ‘নির্বাণ’-এর অর্থ ‘জীবন্মুক্তি’ বা ‘জীবিত অবস্থায় মুক্তিলাভ’। কোনো ব্যক্তি তৃয়াজনিত কামনা-বাসনাকে সম্পূন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সত্যের নিয়ত ধ্যানের দ্বারা সমাধির চারটি স্তরের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ প্রজ্ঞা স্তরে উন্নীত হতে পারেন। তিনি সমস্ত আসক্তি থেকে মুক্ত হন। তার তৃয়ার ক্ষয় হয় এবং দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি ঘটে। এই অবস্থাই হল ‘নির্বাণ’।

নির্বাণের স্বরূপ

নির্বাণের স্বরূপ সম্পর্কে বুদ্ধদেব সুস্পষ্টভাবে কিছু বলেননি তাই বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর নির্বাণকে কেন্দ্র করে তার শিষ্যদের মধ্যে চারটি ভিন্ন ভিন্ন মত লক্ষ করা যায় – নির্বাণ হল চির অবলুপ্তি, নির্বাণ হল শাশ্বত ও আনন্দময় অবস্থা,  নির্বাণ হল শাশ্বত অপরিবর্তনীয় অবস্থা, নির্বাণ হল অবর্ণনীয় অবস্থা।

(1) নির্বাণ হল চির অবলুপ্তি: ‘নির্বাণ’ শব্দের অর্থ ‘নির্বাপিত হওয়া’ বা ‘নিভে যাওয়া’। এই অর্থ অনুযায়ী ‘নির্বাণ’ শব্দের অর্থ সত্তার পূর্ণ বিলুপ্তি। জীবন কামনা-বাসনাময়, নির্বাণে যেহেতু কামনা-বাসনার আত্যন্তিক বিনাশ ঘটে কাজেই জীবের সত্তারও পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে বলে মনে করা হয়। তেলের অভাবে প্রদীপ শিখা যেমন নিভে যায় তেমনই কামনা-বাসনা নির্বাপিত হলে জীবের পুনর্জন্ম আর হয় না। ফলত অস্তিত্বের বিলোপ ঘটে।

(2) নির্বাণ হল শাশ্বত ও আনন্দময় অবস্থা: ‘নির্বাণ’ শব্দের অর্থ ‘শীতল হওয়া’ বা ‘ঠান্ডা হয়ে যাওয়া’। ‘নির্বাণ’ শব্দের এই অর্থ অনুযায়ী নির্বাণ হল এক শাশ্বত আনন্দময় অবস্থা। নির্বাণের অর্থ ‘সত্তার বিলোপ’ নয়। ধর্মপদে নির্বাণকে আসক্তিশূন্য ও ভয়শূন্য এক আনন্দময় অবস্থা বলা হয়েছে। বৌদ্ধ আচার্য নাগসেন নির্বাণ সম্পর্কে এই অভিমত পোষণ করেন যে, নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তির আত্যন্তিক দুঃখ নিবৃত্তি ঘটে। ফলত জাগতিক ও পার্থিব বন্ধনে তিনি আর আবদ্ধ হন না। তার ফলে শাশ্বত আনন্দপূর্ণ এবং শান্তিময় অবস্থায় তিনি উন্নীত হন।

(3) নির্বাণ হল শাশ্বত অপরিবর্তনীয় অবস্থা: বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হীনযান সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বৈভাষিকগণ নির্বাণকে এক শাশ্বত অপরিবর্তনীয় অবস্থা বলেছেন। নির্বাণের কারণ নেই তাই তার উৎপত্তি বা বিনাশ নেই। এই মত অনুযায়ী আত্মা স্বরূপত অচেতন। আত্মার সত্তা থাকলেও এই পর্যায়ে আত্মার কোনোপ্রকার সুখ-দুঃখের অনুভূতি থাকে না। কাজেই নির্বাণ এক শাশ্বত অপরিবর্তনীয় অবস্থা হলেও তা আনন্দময় হতে পারে না। পঞ্চস্কন্ধের বিনাশ হওয়ায় সুখ-দুঃখ ইত্যাদি কোনোপ্রকার বোধ থাকে না। তাই এই মতানুযায়ী নির্বাণ এক নির্বিকার অচেতন অবস্থা।

(4) নির্বাণ হল অবর্ণনীয় অবস্থা: নির্বাণের স্বরূপ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধদেব নীরব থাকায় কেউ কেউ নির্বাণকে এক অবর্ণনীয় অবস্থারূপে বর্ণনা করেন। নির্বাণ ভাবাত্মক বা অভাবাত্মক যাই হোক না কেন তাকে লৌকিক ভাষা বা বাক্যের দ্বারা বর্ণনা করা যায় না। বৌদ্ধ মহাযান সম্প্রদায়ের অন্তর্গত শূন্যবাদী নাগার্জুন নির্বাণ সম্পর্কে এই অভিমত পোষণ করেন। তিনি অভিজ্ঞতা বহির্ভূত এক পরমসত্তার উপলব্ধিকে ‘নির্বাণ’ আখ্যা দেন। যে সত্তা অভিজ্ঞতাগ্রাহ্যও নয় আবার বুদ্ধিগ্রাহ্যও নয় যা কেবলমাত্র স্বজ্ঞার দ্বারা উপলব্ধি করা যায়। নির্বাণ সত্তার বিলোপ নয়, কামনা-বাসনার পূর্ণ বিনষ্টই হল নির্বাণ। নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বৌদ্ধ পরিভাষায় ‘অর্হৎ’ বা ‘জ্ঞানী’ বলা হয়।

বৌদ্ধ মতে, নির্বাণ হল সর্বপ্রকার দুঃখ থেকে মুক্তি। এই কারণেই নির্বাণ বলতে দুঃখের আত্যন্তিক মুক্তিকে বোঝানো হয়েছে। বৌদ্ধসম্মত চারটি আর্যসত্য সম্পর্কে জ্ঞানলাভের দ্বারা এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গের নিরন্তন অনুশীলনের মাধ্যমেই ব্যক্তি পূর্ণ প্রজ্ঞার স্তরে উন্নীত হতে পারে।

৬। অষ্টাঙ্গিক মার্গ কী? তা আলোচনা করো। অথবা, চতুর্থ আর্যসত্যটি সংক্ষেপে আলোচনা করো

অষ্টাঙ্গিক মার্গ

বৌদ্ধ দর্শনে ‘দুঃখ নিরোধ’ বা ‘নির্বাণ’ লাভের উপায় বর্ণনা করা হয়েছে চতুর্থ আর্যসত্যে। দুঃখ নিবৃত্তির এই উপায় বা মার্গ অষ্টাঙ্গিক মার্গ নামে পরিচিত। দুঃখ নিবৃত্তির উপায়ের কথা অষ্টাঙ্গিক মার্গে বর্ণনা করা হয়েছে বলে একে দুঃখ নিরোধ মার্গও বলা হয়। বৌদ্ধ নীতিতত্ত্বে যে অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণের কথা বলা হয়েছে, সেগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল-

(1) সম্যক দৃষ্টি: ‘সম্যক’ শব্দটির অর্থ হল ‘যথার্থ’। সুতরাং ‘সম্যক দৃষ্টি’ শব্দের অর্থ হল ‘যথার্থ দৃষ্টি’ বা ‘যথার্থ জ্ঞান’। দুঃখের কারণ হল অবিদ্যা বা মিথ্যাজ্ঞান। এই অবিদ্যা দূর করতে হলে প্রথমে তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন। চারটি আর্যসত্য সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞানই হল তত্ত্বজ্ঞান। প্রকৃতপক্ষে সম্যক দৃষ্টি হল জাগতিক সবকিছুই পরিবর্তনশীল, ক্ষণকাল স্থায়ী, অনাত্ম ও অনিত্য-এই বোধ বা উপলব্ধি। সুতরাং চারটি আর্যসত্যের মধ্যে সম্যক দৃষ্টি বা যথার্থ জ্ঞানই হল নির্বাণ লাভের প্রথম সোপান। সম্যক দৃষ্টির তিনটি দিক রয়েছে। সেগুলি হল-

  • কর্মের স্বকীয়তা বিষয়ক সম্যক দৃষ্টি: বৌদ্ধ দর্শনে বলা হয় ব্যক্তি ভালো কর্ম বা মন্দ কর্ম যাই করুক না কেন সেই কর্ম অনুসারে ফলভোগ তাকেই করতে হয়।
  • চারটি আর্যসত্য বিষয়ক সম্যক দৃষ্টি: চারটি আর্যসত্য সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানই হল সম্যক দৃষ্টি। এই সম্যক দৃষ্টি ব্যক্তির মানসচক্ষুর উন্মীলন ঘটায় যার ফলে ব্যক্তি কামনা-বাসনাকে চিহ্নিত করতে পারে।
  • দশবস্তু বিষয়ক সম্যক দৃষ্টি: বুদ্ধদেব দশ প্রকার কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। সেগুলি হল- প্রাণী হত্যা, চুরি করা, ব্যভিচার, মিথ্যা কথা বলা, ভেদ-বাক্য বলা, রূপ বাক্য বলা, সম্প্রলাপ, পরধনে লোভ করা, হিংসা করা ও মিথ্যা দৃষ্টি।

(2) সম্যক সংকল্প: সম্যক দৃষ্টির আলোকে জীবন নিয়ন্ত্রিত করার দৃঢ় সংকল্প হল ‘সম্যক সংকল্প’। সম্যক সংকল্প বলতে বোঝানো হয়েছে সত্য জ্ঞানানুযায়ী কর্ম করা ও জীবনযাপন করার দৃঢ় ইচ্ছা বা সংকল্পকে। এই সম্যক সংকল্প অনুযায়ী অহিংসা, অনাসক্তি ও অ-বিদ্বেষের সংকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। বুদ্ধদেব তিন প্রকার সংকল্পের উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল-

  • নৈষ্কম্য সংকল্প: দুঃখ সৃষ্টিকারী কামনা-বাসনার প্রতি অনাসক্তি হল নৈষ্কম্য সংকল্প।
  • অব্যাপদ সংকল্প: সকল জীব ও বস্তুর প্রতি সদিচ্ছা পোষণ করা হল অব্যাপদ সংকল্প।
  • অহিংসা সংকল্প: ব্যক্তিকে সর্বদা কুশল বা ভালো কর্মে নিয়োজিত রাখার দৃঢ় ইচ্ছা হল অহিংসা সংকল্প।

(3) সম্যক বাক্: সম্যক বাক্ কথার অর্থ বাক্ সংযম। মিথ্যাভাষণ, বিদ্বেষপরায়ণ বাক্য, কটুভাষণ এবং অসারভাষণ ও পরনিন্দা থেকে বিরত থাকাকে বলা হয় বাক্ সংযম। বুদ্ধদেব এই চার প্রকার বাক্য ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।

(4) সম্যক কর্মান্ত: ‘সম্যক কর্মান্ত’ বলতে বোঝায় কর্মসংযম বা সংযত আচরণকে। বুদ্ধদেব সম্যক কর্মান্তে তিন প্রকার কর্ম সম্পাদন করা থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন। সেগুলি হল- অপহরণ বা চুরি করা, প্রাণী হত্যা না করা এবং মাদক দ্রব্য বর্জন ও ব্যভিচার থেকে নিজেকে বিরত রাখা।

(5) সম্যক আজীন: সৎ পথে জীবিকা নির্বাহ করা হল ‘সম্যক আজীব’। সম্যক আজীবের মাধ্যমে দেহ নির্মল ও চিত্ত শুদ্ধি হয়। ফলে নির্বাণ লাভের পথ সুগম হয়। বুদ্ধদেব সম্যক আজীবের জন্য পাঁচ প্রকার পেশাকে সরাসরি নিষিদ্ধ বলেছেন। সেগুলি হল- অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয়, নেশাজাতীয় যে-কোনো বস্তু ক্রয়-বিক্রয়, পশুপাখির মাংস ক্রয়-বিক্রয়, বিষ বিক্রয়, মানুষকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে যে-কোনো পেশা থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে।

(6) সম্যক ব্যায়াম: মন থেকে সকল কুচিন্তার বিনাশ ও সুচিন্তার উদয়ের অনুশীলন করাই হল সম্যক ব্যায়াম। সম্যক ব্যায়ামের ফলে চিত্ত শুদ্ধি হয়। সম্যক ব্যায়ামের চারটি দিক রয়েছে। সেগুলি হল-

  • অশুভ চিন্তার দূরীকরণ: নির্বাণকামী ব্যক্তির মনে অকল্যাণকর চিন্তা দূর করে মনকে পরিশুদ্ধ ও শান্ত রাখতে হবে।
  • অশুভ চিন্তার পুনরাগমন রোধ: নির্বাণকামী ব্যক্তির মনে পুনরায় যাতে কোনো অকল্যাণকর চিন্তার উদ্ভব না হতে পারে তার জন্য ব্যক্তিকে সচেতন রাখা।
  • শুভ চিন্তার উৎপাদন: ব্যক্তির মনে যাতে শুভ চিন্তার উদ্ভব হয় তার জন্য তাকে সচেষ্ট হতে হবে।
  • শুভ চিন্তার অনুশীলন: ব্যক্তির মনে উপস্থিত শুভ চিন্তাগুলির সংরক্ষণ করতে হবে।

(7) সম্যক স্মৃতি: সম্যক স্মৃতি অনাসক্তি সৃষ্টি করে নির্বাণের পথে চালিত করে। সম্যক স্মৃতিতে ব্যক্তি যে চারটি দিকের প্রতি সচেতন থাকে সুেগলি হল-

  • কায়ানুস্মৃতি: ইন্দ্রিয়সুখ সম্পর্কে সচেতন থাকা হল কায়ানুস্মৃতি।
  • বেদানুস্মৃতি: সুখ, দুঃখ অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন থাকা হল বেদানুস্মৃতি।
  • চিত্তানুস্মৃতি: মনের অবস্থান, চিন্তা এবং আবেগের প্রতি সচেতন থাকা হল চিত্তানুস্মৃতি।
  • ধর্মানুস্মৃতি: বুদ্ধদেবের শিক্ষাকে গভীরভাবে অনুশীলন করা হল ধর্মানুস্মৃতি।

(8) সম্যক সমাধি: নির্বাণলাভের শেষ মার্গ হল সম্যক সমাধি। যে ব্যক্তি পূর্বোক্ত সাতটি কর্মবিধি অনুসরণ করে সকল প্রকার অসৎ চিন্তা থেকে মনকে মুক্ত করতে পেরেছেন, ইন্দ্রিয়কে বশীভূত করেছেন, তিনি সমাধির মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করতে পারেন। সম্যক সমাধিতে চারটি স্তর লক্ষ করা যায়-

  • প্রথম স্তর: সমাধির এই স্তরে নির্বাণকামী ব্যক্তি চারটি আর্যসত্য সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করেন এবং মনকে সত্য সংক্রান্ত বিতর্ক ও বিচারে নিযুক্ত রেখে আসক্তি মুক্ত হয়ে আনন্দ অনুভব করেন।
  • দ্বিতীয় স্তর: দ্বিতীয় স্তরের সমাধিতে নির্বাণকামী ব্যক্তি অচঞ্চল ও স্থির ধ্যানের ফলে তার মনে সহজ শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে।
  • তৃতীয় স্তর: সমাধির তৃতীয় স্তরে নির্বাণকামী ব্যক্তি ধ্যানে মগ্ন হন। এর ফলে তার মনে এক নিস্পৃহতা বা উদাসীনতার ভাব জাগে।

চতুর্থ স্তর: সমাধির শেষ স্তরে নির্বাণকামী ব্যক্তি সর্বপ্রকার আসক্তি থেকে মুক্ত হয়ে যথার্থ প্রজ্ঞা লাভ করেন। প্রজ্ঞার মাধ্যমেই নির্বাণ লাভ হয়। তখন তিনি ‘অর্হৎ’ রূপে বিবেচিত হন।

Also Read – The Garden Party questions and answers

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment