নারী শিক্ষা প্রবন্ধ রচনা
প্রাচীন ও মধ্যযুগে নারী শিক্ষা
প্রাচীনকাল থেকে আমাদের দেশে নারী শিক্ষার প্রচলন আছে। বৈদিক যুগ থেকে বর্তমানেও শিক্ষার এই ধারাটি প্রবহমান। প্রাচীন ভারতের নারীর বিশেষ স্থান ছিল সমাজে। পুরুষদের মতো নারীরা পেয়েছে সম্মান, জ্ঞানবিকাশের ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী হয়েছে পরস্পরের সহায়ক। সামাজিক ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটল মনুর যুগে, তাঁর রচিত নতুন বিধি প্রচলিত হওয়ার ফলে। সমাজে নারীর স্থানের গুরুত্ব কমে গেল, বিদ্যাচর্চার সুযোগ থেকে তাঁরা অনেক সময় বঞ্চিত হলেন। বৌদ্ধযুগে নারীশিক্ষার ধারা সংকীর্ণ গণ্ডী থেকে কিছুটা মুক্ত হতে দেখা যায়। মঠে শাস্ত্রজ্ঞ ভিক্ষুর পাশে বিদুষী ভিক্ষুণী নানা শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করে পাণ্ডিত্যের খ্যাতি অর্জন করেছেন। ঘনঘটা। নারী বঞ্চিত হয় পুরুষের সাথে সমান তালে অগ্রসর হওয়ার অধিকার থেকে, প্রাচীনকালে গার্গী, মৈত্রী, খনা, লোপামুদ্রা প্রভৃতি নারীগণ যে শ্রদ্ধার
মধ্যযুগে নারী শিক্ষা
মধ্যযুগে নারীর জীবনে নেমে আসে দুর্যোগের আসনে উপবিষ্ট হয়েছিলেন নিজ প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্যের জন্য, মধ্যযুগে তাঁদের। শিক্ষার পথ হল রুদ্ধ, বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা, কৌলীন্যপ্রথা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা নারীসমাজকে নিক্ষেপ করল অন্ধকারময় একযুগে। সমাজ কাঠামোর মূল স্তম্ভ নারী ও পুরুষ। নারীসমাজকে দুর্বল রাখায় সমাজের ভীত হয়ে গেল নড়বড়ে। পিছিয়ে পড়ল সমাজের অগ্রগতি।
ইংরেজ শাসনকালে নারী শিক্ষা
নারী শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হল আমাদের দেশে বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষা প্রচলিত হওয়ার ফলে। নারীর জীবনধারায় এল পরিবর্তন। যার ফলে নারীসমাজকে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আর আটকে রাখতে পারল না সমাজপতিরা। বিশেষ করে রাজা রামমোহন রায়ের নারীমুক্তি আন্দোলনে কুলীনপ্রথা, বহুবিবাহ, সতীদাহ প্রথার মতো কুসংস্কারের অন্ধকারযুগের অচলায়তন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তিনি নারীসমাজকে প্রতিষ্ঠিত করলেন সামাজিক মর্যাদার মুক্তাঙ্গনে। এগিয়ে এলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধানাথ শিকদার প্রমুখ সমাজ সংস্কারকগণ এবং ডিরোজিও এবং তাঁর সমর্থকগণ নারীশিক্ষা প্রসারে উদ্যোগী হলেন।
নারীশিক্ষা বিস্তারে আর একজনের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে, তিনি হলেন ড্রিঙ্কওয়াটার বীটন বা বেথুন। বেথুনের অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের জমি ও অর্থদানে গড়ে ওঠে বিথুনের নামে বিদ্যালয়। তিনি ছিলেন ডিরোজিওর ছাত্র। এছাড়া নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে মিস কুক, ভগিনী নিবেদিতা ও স্বামী বিবেকানন্দের অবদানের কথা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এইভাবে বিংশ শতাব্দীতে খুলে গেল নারী শিক্ষার দ্বার, শুরু হল নারীশিক্ষার স্বর্ণযুগ।
নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
পুরুষের মতো নারীরও যে শিক্ষালাভের অধিকার আছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য নারী পুরুষের সমান অধিকার থাকা প্রয়োজন। এই সত্যটি সম্বন্ধে আমরা তেমন সচেতন ছিলাম না বলে আমাদের দেশের নারীরা দীর্ঘকাল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাই দেশের বেশীরভাগ নারী কুসংস্কার ও অজ্ঞানতাকে পাথেয় করে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তার ফলে দেশের কল্যানসাধিত তো হয়নি বরঞ্চ নারীর অজ্ঞতা আমাদের সমাজকে অগ্রসরে বাধার সৃষ্টি করেছে। পুরুষের কর্মক্ষেত্র বহিবিশ্বে, নারীর কর্মকেন্দ্র সীমাবদ্ধ ছিল ঘরের মধ্যে। পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু যদি ভারসাম্য হারায় তাহলে মানুষের জীবনে অশান্তি অনিবার্য। তাই নারীশিক্ষার প্রচার ও প্রসার খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ-সাধন যা শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তা একচেটিয়া বিশেষ কোন শ্রেণি বা ব্যক্তির হতে পারে না। পুরুষ ও স্ত্রী সমান শিক্ষা পাওয়ার অধিকারী। শিশু জন্মের পরে তার রক্ষণাবেক্ষণ ও মানসিকতা গঠনে মায়ের ভূমিকা বেশি। উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে যেমন গাছের ছোট্ট চারা ঠিকমত বেড়ে উঠতে পারে না তেমনি সঠিকভাবে শিশুকে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে না পারলে ভবিষ্যতে সে দিভ্রষ্ট হবে-এই সত্য সর্বজন স্বীকৃত। এজন্য প্রয়োজন পাঠক্রম, পরীক্ষা পদ্ধতির রূপান্তর সাধন, গৃহকেন্দ্রিক বৃত্তি শিক্ষার প্রসার। সূচীশিল্প, রন্ধনশিল্প, গার্হস্থ্য-স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান, সাধারণ গণিত, ইংরেজি ভাষা, বাংলা, সাহিত্য, ভূগোল, ইতিহাস এবং সংগীত শিক্ষাকে নারীদের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমানে সরকারী ও বেসরকারী ক্ষেত্রে যে প্রচেষ্টা চলছে তার শুভযাত্রা নতুন প্রভাতের পূর্বাভাষ।
উপসংহার
রাষ্ট্রের এখন প্রধান লক্ষ্য উপযুক্ত কন্যা, উপযুক্ত পত্নী, উপযুক্ত মাতার সৃষ্টি করা। আদর্শহীন, লক্ষ্যহীন পথে চলে জাতীয় জীবনকে পঙ্গু করার দিন এখন শেষ হয়ে গেছে। এখন নারীরা গৃহাভ্যন্তরের সমস্ত দায়িত্ব পালন করেও সমাজের সর্বক্ষেত্রে পুরুষের সাথে সমান তালে পা মিলিয়ে চলতে শিখেছে। সমাজ থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে নিরক্ষরতার অভিশাপ। পুরুষকে হতে হবে আরও মানবিক। মনে রাখতে হবে বিধাতার অমর সৃষ্টি অর্ধেক পুরুষ ও অর্ধেক নারী। দুই অর্ধেকের শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতিই পূর্ণতার প্রতীক।
আরও পড়ুন – নেলসন ম্যান্ডেলা প্রবন্ধ রচনা