গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো
গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তিসমূহ
গণতন্ত্রের পক্ষে যেসকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাদের যুক্তি দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হল-জন স্টুয়ার্ট মিল, ব্যোম, টভিল, স্পেনসার, ল্যাস্কি, লর্ড ব্রাইস, বার্কার প্রমুখ। এঁনাদের মতে, সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনতন্ত্র হল গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তিগুলি নিম্নরূপ-
[1] গণসার্বভৌমত্বের রূপায়ণ: গণতন্ত্রের প্রধান গুণ হল এখানে গণসার্বভৌমত্বের নীতি বাস্তবে রূপায়িত হয়। জনগণ এখানে সমগ্র রাষ্ট্রক্ষমতার মূল উৎস। কোন্ দলের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবে, সরকারের পররাষ্ট্রনীতি তথা জাতীয় নীতি কী হবে, অযোগ্য ও জনস্বার্থবিরোধী রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করা ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রগুলিতে সিদ্ধান্তগ্রহণের দায়ভার একমাত্র গণতন্ত্রেই জনগণের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকে।
[2] স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের সার্থক রূপায়ণ: গণতন্ত্রে স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের সার্থক রূপায়ণ ঘটে। ‘স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব’ অনুসারে, প্রতিটি ব্যক্তি তার ভাগ্য নির্ধারণ করার অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এই নীতি বাস্তবায়িত হয়, কারণ গণতন্ত্রে প্রতিটি ব্যক্তি সমান সুযোগসুবিধা পাওয়ার অধিকারী। এখানে সাম্যের ভিত্তিতে প্রত্যেকের সমান অধিকারের দাবি স্বীকৃত। ল্যাসওয়েল-এর মতে, একটি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো ব্যক্তিই এই অভিযোগ করতে পারে না যে, তার কথা শোনানোর জন্য তাকে সুযোগ দেওয়া হয়নি।
[3] আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত: অনেকে মনে করেন, গণতন্ত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফাইনার-এর মতে, একমাত্র গণতন্ত্রে আইনের যথাবিহিত পদ্ধতি (Due process of Law) ছাড়া ব্যক্তিজীবনে হস্তক্ষেপ ঘটানো যায় না। গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের যাবতীয় ক্ষেত্রে জনগণই হল চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগ্রহণকারী। নিজেদের সম্পাদিত কার্যাবলির জন্য শাসকবর্গকেও গণতন্ত্রে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়।
[4] স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ: গণতন্ত্রের একটি বড়ো গুণ হল, এখানে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের অস্তিত্ব বজায় থাকে। সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে বিচারকার্য সম্পাদন করে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার শর্তাবলি একমাত্র গণতন্ত্রে পূরণ হয়। সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষা ও নাগরিক অধিকারের সংরক্ষণের বিষয়ে বিচার বিভাগ গণতন্ত্রে এক উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে।
[5] স্বৈরাচারিতা রোধ: গণতন্ত্রে জনগণের মতামতই চূড়ান্ত বলে এখানে শাসকগোষ্ঠী স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে না। কোনো শাসকগোষ্ঠী যদি জনগণের মতামতের বিরুদ্ধাচরণ করে তবে, পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করে। আর, ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী এগুলি সম্পর্কে অবগত বলেই নিজেদের রাজনৈতিক ভাগ্যের উপর বিপর্যয় ডেকে আনতে চান না।
[6] সার্বিক কল্যাণসাধন: সরকারি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সমাজের যে শ্রেণি কায়েম করে সরকার মূলত সেই শ্রেণির স্বার্থই সংরক্ষণ করে। গণতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারী একমাত্র জনগণই। তাই জনগণের সার্বিক কল্যাণসাধনই হল গণতান্ত্রিক সরকারের একমাত্র লক্ষ্য।
[7] স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা: জন স্টুয়ার্ট মিল-এর মতে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, জনগণের মানসিক উন্নতি সাধনের স্বার্থে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করাও সরকারের একটি কর্তব্য। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার অবাধ সুযোগ রয়েছে। শাসনকার্যে অংশগ্রহণের ফলে জনগণ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং তাদের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটে।
[8] আদর্শবাদ এ হিতবাদের সমর্থন : গণতন্ত্রে আদর্শবাদী তত্ত্বের ও হিতবাদী তত্ত্বের সমর্থন দেখতে পাওয়া যায়। আদর্শবাদ অনুসারে গণতান্ত্রিক পরিবেশে ব্যক্তি তার আত্মবিকাশের জন্য সর্বাধিক সুযোগ লাভ করে। জনগণ নিজেরাই সরকার গঠন করে বলে, এখানে আত্মবিকাশের কোনো অন্তরায় সৃষ্টি হয় না। জনগণ নিজ নিজ মতামত প্রকাশের মাধ্যমে নিজেদের স্বাধীনতা সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে, যাতে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভবপর হয়। অন্যদিকে, হিতবাদী তত্ত্বের মূলনীতি ‘সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক কল্যাণ’ (Greatest good of the greatest number of people)-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপায়িত হয়। গণতন্ত্রের সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে বলে যাবতীয় সরকারি সুযোগসুবিধা সবাই ভোগ করতে পারে। এই তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা হলেন বেখাম, জেমস মিল প্রমুখ। এঁনারা গণতন্ত্রকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছেন। ব্যোম মনে করতেন, শাসক ও শাসিতের স্বার্থের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এবং সমাজের সর্বাধিক জনসাধারণের সর্বাধিক কল্যাণসাধনই হল সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রধান সমস্যা। আর এরূপ সমস্যার সমাধান একমাত্র তখনই সম্ভব, যখন শাসিতের হাতে শাসনভার অর্পিত হবে। আর গণতন্ত্রের মাধ্যমেই সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসিতশ্রেণি শাসন ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হবে। এ প্রসঙ্গে জেমস মিল মন্তব্য করেছেন, বর্তমানকালের সর্বোত্তম উদ্ঘাটন (Grand discovery of modern times) হল গণতন্ত্র (Democracy)।
[9] ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্কার-এর অভিমত অনুসারে, গণতন্ত্রে ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও ভাব বিনিময়ের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকায় রাজনৈতিক সত্যের উপলব্ধি করা যায়। তাই গণতন্ত্র হল পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা (“Democracy… is a system of government by discussion.”)। আবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মেয়ো গণতন্ত্রকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপযোগী সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা বলে উল্লেখ করেছেন (Democracy is the system best able to produce justice) I
[10] ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ হয় : গণতন্ত্রে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বেরসর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটে। কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, জনগণের মানসিক উৎকর্ষসাধন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সম্ভব। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের অবারিত সুযোগ থাকায় তাদের ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধিত হয়। এ প্রসঙ্গে জন স্টুয়ার্ট মিল মন্তব্য করেছেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা ছাড়াও সরকারের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল জনসাধারণের মানসিক উৎকর্ষসাধন। জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ তাদের বুদ্ধিদীপ্ত করে তোলার পাশাপাশি আত্মপ্রত্যয়সম্পন্ন করে তুলতেও বিশেষ সাহায্য করে, যার মধ্য দিয়ে জনগণের ব্যক্তিত্বের চরম বিকাশ সাধিত হয়।
১। ব্যাপক ও সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? গণতন্ত্রের সর্বাধুনিক সংজ্ঞাগুলি আলোচনা করো
২। গণতন্ত্রের উদ্ভবের কারণগুলি ব্যাখ্যা করো
৩। গণতন্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো
৪। গণতন্ত্রের প্রকৃতি আলোচনা করো
৫। গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
৬। গণতন্ত্র কাকে বলে? এর বিভিন্ন রূপগুলি আলোচনা করো
৭। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝো? এইরূপ গণতন্ত্রের গুণ বা সুবিধাগুলি আলোচনা করো
৮। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের দোষ বা অসুবিধাগুলি আলোচনা করো
৯। প্রতিনিধিত্বমূলক বা পরোক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? এইরূপ গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
১০। পরোক্ষ গণতন্ত্রের সপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো
১১। পরোক্ষ গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো
১২। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
১৩। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র কাকে বলে? সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো