বিশেষ ধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করো
অথবা, স্বধর্ম বলতে কী বোঝো
অথবা, বর্ণাশ্রম ধর্ম সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো
বিশেষ ধর্ম
মানুষের জীবনের পর্যায় ও অবস্থানভেদে বিশেষ ধর্ম নির্দিষ্ট হয়। এককথায় বর্ণধর্ম ও আশ্রমধর্ম-এই দুটিকে একত্রে বর্ণাশ্রম ধর্ম বা বিশেষ ধর্ম বলে গণ্য করা হয়। বিশেষ ধর্মকে স্বধর্মও বলা হয়। বর্ণ অনুযায়ী নির্দিষ্ট ধর্ম বা কর্তব্য হল সেই বর্ণের ব্যক্তির স্বধর্ম। স্বধর্মের ভিত্তি হল সাধারণ ধর্ম, যা স্বধর্মের সীমা নির্দেশ করে দেয়। স্বধর্মের নীতি অসামাজিক কাজকে সমর্থন করে না। এই নীতি মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ করে তোলে, যা সমাজকে উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত করে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় স্বধর্ম প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
“স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।” অর্থাৎ স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও যদি তা উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত হয় তাহলেও তা পরধর্ম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। স্বধর্ম বা বর্ণাশ্রম দুই প্রকার। যথা- বর্ণধর্ম ও আশ্রমধর্ম।
বর্ণধর্ম
বর্ণধর্ম সাধারণ ধর্মের মতো নিঃশর্ত নয়। তা হল শর্তসাপেক্ষ ধর্ম বা কর্তব্যকর্ম। বৈদিক শাস্ত্রে সমাজস্থ মানুষকে চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। যথা- ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র।
ব্রাহ্মণ
সত্ত্বগুণ প্রধান ব্যক্তি হলেন ব্রাহ্মণ। ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’-য় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
"শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ। জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্।।” (১৮/৪২)
অর্থাৎ শম (মনের সংযম), দম (বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সংযম), তপস্যা, শৌচ (দেহ ও মনের শুচিতা), ক্ষান্তি ও আর্জব (ক্ষমা ও সরলতা), জ্ঞান (শাস্ত্রজ্ঞান), বিজ্ঞান (তত্ত্বানুভূতি) এবং আস্তিক্যবুদ্ধি (শাস্ত্র ও ভগবানে বিশ্বাস) -এগুলিই ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত ধর্ম।
তাই ব্রাহ্মণের ধর্ম-যজন, যাজন, অধ্যাপনা প্রভৃতি কর্ম সম্পাদন করা।
ক্ষত্রিয়
সত্ত্বগুণ মিশ্রিত রজোগুণপ্রধান ব্যক্তি হলেন ক্ষত্রিয়। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন
"শৌর্যম্ তেজো ধৃতিদাক্ষ্যং যুদ্ধে চাপ্যপলায়নম্। দানমীশ্বরভাবশ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্।।” (১৮/৪৩)
অর্থাৎ শৌর্য, তেজ, ধৃতি (ধৈর্য্য), দাক্ষ্য (কর্মকুশলতা), যুদ্ধে অপলায়নতা, দানে মুক্তহস্ততা, ঈশ্বরভাব (শাসন ক্ষমতা)- এগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত ধর্ম।
তাই ক্ষত্রিয়ের কর্ম-দেশ শাসন, যুদ্ধে অংশগ্রহণ ইত্যাদি।
বৈশ্য
স্বল্প তমো ও বহুলাংশে রজোগুণপ্রধান ব্যক্তি হলেন বৈশ্য। শ্রীকৃষ্ণ ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’-য় বলেছেন-
“কৃষিগোরক্ষ্য বাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম স্বভাবজম্।” (১৮/৪৪)
অর্থাৎ কৃষি, গো রক্ষা ও বাণিজ্য বৈশ্যের স্বভাবজাত কর্ম। তাই বৈশ্যের ধর্ম- চাষবাস, ব্যাবসা-বাণিজ্য করা।
শূদ্র
স্বল্প রজো কিন্তু তমোগুণপ্রধান ব্যক্তিই শূদ্র। তাই শ্রীকৃষ্ণ ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’য় বলেছেন-
"পরিচর্যাত্মকং কর্ম শূদ্রস্যাপি স্বভাবজম্।” (১৮/৪৪) অর্থাৎ পরিচর্যা (সেবা করা) শূদ্রের স্বভাবজাত ধর্ম।
আশ্রমধর্ম
ভারতীয় বৈদিক শাস্ত্রে মানুষের জীবনযাপনকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য চারটি বিভাগে বিভিক্ত করা হয়েছে। যথা- ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস।
ব্রহ্মচর্য: গুরুগৃহে থেকে বিদ্যাভ্যাস করাই ব্রহ্মচর্য। ব্রহ্মচর্যকাল অতি সংযমের কাল। গুরুসেবা করে ভিক্ষার দ্বারা জীবনযাপন করা হল ব্রহ্মচর্য। ব্রহ্মচর্যে শুচিতা, কর্মপরায়ণতা, সরলতা, তিতিক্ষাভ্যাস ও সংযম করতে হয়।
গার্হস্থ্য: ব্রহ্মচর্যের দ্বারা প্রাপ্ত সতর্ক মন, সুস্থ ও সুঠাম শরীরের দ্বারা গার্হস্থ্য আশ্রমের জন্য ব্যক্তি নিজেকে উপযুক্ত করে তোলে। এই পর্যায়ে মানুষ সাংসারিক দায়দায়িত্ব বহন করে এবং বংশধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখে। গার্হস্থ্য আশ্রমে গৃহীকে বিভিন্ন ধর্ম বা কর্তব্য পালন করতে হয়।
বাণপ্রস্থ: গার্হস্থ্য জীবনকে সসম্মানে বিদায় জানিয়ে বাণপ্রস্থে ব্যক্তি নির্জন অরণ্যে বসবাস করেন। এই পর্যায়ে ব্যক্তি কাঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে ধ্যান, যোগ চর্চা ও আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে আত্মানুসন্ধান করেন। যাতে ব্যক্তি মানুষ নিজেকে আত্মিক স্তরে উন্নীত করতে পারে। সুতরাং এই আশ্রম হল গার্হস্থ্য আশ্রম থেকে সন্ন্যাস আশ্রমে উত্তরণের স্তর ও সবকিছু ত্যাগের প্রস্তুতিকাল।
সন্ন্যাস: মানব জীবনের চতুর্থ তথা শেষ অধ্যায় হল সন্ন্যাস। জাগতিক বস্তুর প্রতি বৈরাগ্যই এই পর্বে প্রবেশের যোগ্যতা। সর্বপ্রকার হিংসা থেকে বিরত, সর্বভূতে দয়া, কামনা-বাসনা থেকে মুক্তি, সুখ-দুঃখে ও লাভ-লোকসানে সমত্ববোধ, শত্রু-মিত্রের প্রতি সম মনোভাব এবং আত্মজ্ঞানে নিমগ্ন থাকাই হল সন্ন্যাস।
উপরের আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়- বর্ণাশ্রমমূলক বিশেষধর্ম হল শর্তসাপেক্ষ কর্তব্যকর্ম। অর্থাৎ এই কর্তব্যকর্মগুলি সমাজস্থ সকল মানুষের প্রতি প্রযোজ্য নয়। বিশেষ বর্ণ বা বিশেষ আশ্রমের মানুষের প্রতি প্রযোজ্য। এই জন্যই এই ধর্ম বিশেষ ধর্ম, সাধারণ ধর্ম নয়।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ