স্বামী বিবেকানন্দের সামাজিক সংস্কার আলোচনা করো

স্বামী বিবেকানন্দের সামাজিক সংস্কার আলোচনা করো

স্বামী বিবেকানন্দের সামাজিক সংস্কার আলোচনা করো
স্বামী বিবেকানন্দের সামাজিক সংস্কার আলোচনা করো

স্বামী বিবেকানন্দের সামাজিক সংস্কার

উনিশ শতকের শেষের দিক এবং বিশ শতকের শুরুর সময়ে ভারতের সামাজিক সংস্কারের জন্য এক আলোচিত এবং উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন স্বামী বিবেকানন্দ।

প্রচলিত অর্থে সমাজ সংস্কারক বলতে যা বোঝায় স্বামীজি তা ছিলেন না। স্বামীজি শুধু সমাজের বাইয়ের সংস্কার চাননি, চেয়েছিলেন সমাজের ভিতরের এক আমূল পরিবর্তন।

কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী এই বিশাল ভারতভূমি দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে (1887-1892) কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও ট্রেনে পরিব্রাজক রূপে ভ্রমণ করে স্বামীজি বিপুল বৈচিত্র্যের এ দেশে সমাজের নানা প্রান্তের নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করেছেন। মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে একাত্ম হয়ে দেশের নানান সমস্যা জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছেন। পরবর্তীতে সেই সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতে গিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের কথা ভেবেছেন।

বিবেকানন্দের সামাজিক সংস্কার সব দিক থেকেই ব্যতিক্রমী ও ভিন্নধর্মী। এতদিন যাঁরা সামাজিক সংস্কারের কথা ভেবেছেন তাঁরা সমাজের নীচের সারির প্রান্তিক মানুষদের দিকে লক্ষ করেননি, তাঁরা সংস্কার করতে চেয়েছেন সমাজের উপর সারির দিক থেকে। অর্থাৎ হতদরিদ্র মানুষ অপেক্ষা ধনী ও সচ্ছল মধ্যবিত্তদের সামাজিক সমস্যাকেই তাঁরা সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। স্বামীজি ছিলেন এর ব্যতিক্রম।

স্বামীজির সামাজিক সংস্কারের প্রধান দিকগুলির মধ্যে যেগুলি উল্লেখযোগ্য, সেগুলি হল-

[1] দারিদ্র্যমুক্ত ভারত: স্বামীজির সামাজিক সংস্কারের কেন্দ্রে ছিল দারিদ্র্যমুক্ত ভারত। তিনি মনে করতেন, ভারতের জাতীয় জীবন দরিদ্রের কুটিরেই বাস করে। এই কারণে জাতীয় উন্নয়ন বলতে স্বামীজি দারিদ্র্যমুক্তির প্রকৃত উন্নয়নকেই বুঝিয়েছেন। তাঁর স্পষ্ট অভিমত ছিল, ‘খালি পেটে ধর্ম হয় না’। তিনি বিশ্বাস করতেন, নিরন্ন মানুষকে ধর্মের নীতিকথা শোনানো বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। যে ভগবান শুধুই স্বর্গসুখের কথা বলে, খাদ্য জোগাতে পারে না, সে ভগবানের প্রতি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ছিল না স্বামীজির। বহুকাল আগে তিনি চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন, দারিদ্র্যই হল ভারতের প্রধান সমস্যা এবং দারিদ্র্যই হল ভারতের প্রধান শত্রু।

[2] শিক্ষার প্রসার: স্বামীজির সামাজিক সংস্কারের ভাবনায় গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হল শিক্ষার প্রসার। স্বামীজি দেখেছিলেন নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের অন্ধকারে ভারতবর্ষের এক বিশাল অংশের মানুষ ডুবে রয়েছে। তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষার আলোয় তাদের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে। স্বামীজি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য নিছক জ্ঞানচর্চা নয়, শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মানুষের মনে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা। পরাধীন ভারতের জনগণকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য তাঁর অভিমত ছিল-“যদি পর্বত মহম্মদের কাছে না-ই আসে, তবে মহম্মদকেই পর্বতের কাছে যেতে হবে। দরিদ্র মানুষ যদি শিক্ষার কাছে না পৌঁছাতে পারে (অর্থাৎ নিজেরা শিক্ষালাভে উৎসাহী না হয়) তবে শিক্ষাকেই চাষির লাঙলের কাছে, মজুরের কারখানায় এবং অন্যত্র সব স্থানে যেতে হবে।”

[3] নারীর ক্ষমতায়ন: স্বামীজির সমাজ সংস্কারের ভাবনায় নারী মুক্তি, নারী ক্ষমতায়ন এবং নারী শিক্ষার একটা বড়ো জায়গা ছিল। তৎকালীন ভারতীয় সমাজে নারীকে যেভাবে পায়ে বেড়ি পরিয়ে নানান সংস্কারের বেড়াজালে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, স্বামীজি তার তীব্র বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে, ভারতবর্ষের দুই মহাপাপের একটি হল ‘মেয়েদের পায়ে দলানো’। অর্থাৎ মেয়েদের পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখা। স্বামীজি চেয়েছিলেন “মেয়েদের আগে তুলতে হবে, ‘mass’-কে জাগাতে হবে, তবে তো দেশের কল্যাণ, ভারতের কল্যাণ।” মেয়েরা প্রত্যেকে এমন কিছু শিখুক যাতে প্রয়োজন হলে তাদের জীবিকা তারা নিজেরাই অর্জন করতে পারে। করে দেখতে গিয়ে স্বামীজি উপলব্ধি করেছিলেন, বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা গুণগত না

[4] সামাজিক সমতা: ভারতীয় সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথার পর্যালোচনা হয়ে বংশগত হওয়াতেই উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে সমাজ ব্যবস্থাকে করায়ত্ত করে রেখেছে। এভাবে ভারতীয় সমাজকে ব্রাহ্মণরা, ব্রাহ্মণের পরে ক্ষত্রিয়রা, তারপরে বৈশ্যরা শাসন করছে। একদিন শূদ্ররাও শাসন করবে। সমাজের সর্বনিম্নে অবস্থানকারী শূদ্রদের শাসনকে স্বাগত জানিয়ে স্বামীজি বলেছেন, “শূদ্রযুগ আসবেই আসবে, কেউ তার প্রতিরোধ করতে পারবে না।” স্বামীজি অবশ্য ভারতীয় সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি চাননি। তিনি চেয়েছিলেন গুণের ভিত্তিতে বর্ণাশ্রম প্রথার সংস্কার করতে।

[5] অস্পৃশ্যতা বিরোধিতা: স্বামীজি সেযুগের হিন্দু সমাজের ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার বা অস্পৃশ্যতার তীব্র নিন্দা করতেন। তিনি এই অস্পৃশ্যতাকে নির্বোধের আচরণ আখ্যা দিয়েছিলেন। সমাজের তথাকথিত নীচু জাতিতে জন্ম নিয়েছে বলে তাদের অচ্ছ্যুত করে রেখে দেওয়া হবে এই অন্যায় ও অমানবিক রীতিনীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন স্বামীজি। এ জন্য শূদ্রের গলায় ব্রাহ্মণের পইতা ঝুলিয়ে, ভাঙ্গির (মেথরের) হাতে অন্নগ্রহণ করে স্বামীজি সমগ্র দেশবাসীর সামনে অস্পৃশ্যতা ও জাতপাত বিরোধী এক বর্ণহীন সাম্যবাদী আদর্শের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment