সমকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তা : অগ্রণী চিন্তাবিদ প্রশ্ন উত্তর Class 11 Second Semester WBCHSE
১। গান্ধিজির রাজনৈতিক দর্শনের মূল সূত্রগুলি আলোচনা করো।
২। গান্ধিজির মতাদর্শের উৎস আলোচনা করো।
৩। গান্ধিজির মতাদর্শের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
৪। গান্ধিজির সত্যাগ্রহ সম্পর্কিত ধারণাটির উপর একটি টীকা লেখো।
৫। গান্ধিজির সত্যাগ্রহ আন্দোলনের বিভিন্ন রূপগুলি আলোচনা করো।
৬। সত্যাগ্রহীদের আচরণ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করো।
৭। সত্যাগ্রহের অর্থ লেখো। সত্যাগ্রহের প্রধান উপাদানসমূহ আলোচনা করো।
৮। সত্যাগ্রহের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
৯। গান্ধিজির সত্যাগ্রহ সম্পর্কিত ধারণাটির সমালোচনাগুলি আলোচনা করো
১০। গান্ধিবাদের মূলনীতি অহিংসার অর্থ আলোচনা করো.
১১। অহিংসা সম্পর্কে গান্ধিজির ধারণা বিশ্লেষণ করো।
১২। গান্ধিজির অহিংসা তত্ত্বটির মূল্যায়ন করো।
১৩। গান্ধিজির অহিংস নীতিটি সম্পর্কে টীকা লেখো।
১৪। গান্ধিজির অছিবাদের মূল বক্তব্য কী? তাঁর অছিবাদের মূল উদ্দেশ্যগুলি আলোচনা করো।
১৫। অছিবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো।
১৬। অছিবাদের উৎস সম্পর্কে আলোচনা করো।
১৭। অছিবাদী তত্ত্বের বিরুদ্ধে সমালোচনাগুলি আলোচনা করো।
১৮। রাষ্ট্র সম্পর্কে গান্ধিজির ধারণা ব্যাখা করো।
১৯। স্বামী বিবেকানন্দের রাষ্ট্রচিন্তার প্রকৃতি আলোচনা করো।
২০। স্বামী বিবেকানন্দের সামাজিক সংস্কারগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।
২১। স্বামী বিবেকানন্দের রাজনৈতিক সংস্কার সমূহ আলোচনা করো।
২২। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্বাধীনতা এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ধারণার উৎস লেখো।
২৩। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্বাধীনতার ধারণাটি ব্যাখ্যা করো।
২৪। সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক স্বাধীনতা সম্পর্কে বর্ণনা করো।
২৫। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ধারণাটি ব্যাখ্যা করো।
২৬। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর চিন্তাধারা ব্যক্ত করো।
২৭। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সামাজিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার ধারণাটি ব্যাখ্যা করো।
২৮। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান আলোচনা করো।
২৯। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ-এর স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণার অনুপ্রেরণাসমূহ আলোচনা করো।
৩০। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রদত্ত বৌদ্ধিক স্বাধীনতার ধারণাটি ব্যাখ্যা করো।
৩১। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ অঙ্কিত রাজনৈতিক স্বাধীনতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দাও।
৩২। মৌলানা আজাদের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা আলোচনা করো।
৩৩। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ-এর শিক্ষাব্যবস্থার মূল্যায়ন করো।
৩৪। মৌলানা আজাদ-এর শিক্ষার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো।
৩৫। নেতাজির পূর্ণস্বরাজ সম্পর্কিত ধারণাটি সংক্ষেপে লেখো। আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠনের পশ্চাতে তার মূল কারণ কী ছিল
পূর্ণ স্বরাজ প্রতিষ্ঠা
সুভাষচন্দ্রের আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল Militant Nationalism। অহিংসার পরিবর্তে তিনি সশস্ত্র বৈপ্লবিক প্রতিরোধ গড়ে তুলে পূর্ণ স্বাধীনতা (পূর্ণস্বরাজ) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্থানে দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর পূর্ণ স্বরাজ ধারণাটি যেই সমস্ত দিকগুলির উপর গুরুত্ব আরোপ করে সেগুলি হল-
- সম্পূর্ণ সার্বাভৌমত্ব: নেতাজি চেয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করতে এবং সম্পূর্ণ ও নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা প্রদান করতে।
- সহিংস পদ্ধতি: তিনি ভারতকে স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের ধারণাটিকে সমর্থন করেছিলেন। যেই উদ্দেশ্যে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ (INA) এবং আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করেছিলেন।
- একতা: তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আজাদ হিন্দ বাহিনী (INA) গঠনের কারণ
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কর্তৃক ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ (INA)-এর গঠন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে INA প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আজাদ হিন্দ বাহিনী বা INA গঠনের মূল কারণগুলি হল-
[1] ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে অসন্তোষ: জাতীয় কংগ্রেসে যুক্ত থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধিজির ভূমিকা নিয়ে ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি বিশ্বাস করতেন, গান্ধিজির অহিংস পদ্ধতি ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। এই দলগত অসন্তোষের কারণে সুভাষচন্দ্র বসু দলত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন এবং সশস্ত্র বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।
[2] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট: সুভাষচন্দ্র বসু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা করেছিলেন। ব্রিটিশদের সঙ্গে অক্ষশক্তির সংগ্রামের সময়কালে তিনি উপলব্ধি করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজয় ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে। এই উদ্দেশ্যে তিনি জাপান সহ অক্ষশক্তির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। জাপান সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে ভারতকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিল, যা আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
[3] বিদ্যমান INA এর সঙ্গে সহযোগিতা: প্রাথমিকভাবে ক্যাপ্টেন মোহন সিং এবং প্রবাসী বিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপানের হাতে বন্দি ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে INA প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাসবিহারী বসু ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নেতৃত্ব দানের জন্য সুভাষচন্দ্র বসুকে আহবান জানান। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে সুভাষচন্দ্র এই বাহিনীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং এর নাম দেন আজাদ হিন্দ ফৌজ।
[4] সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাস: নেতাজি ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ সৈন্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীতা অনুভব করেছিলেন। ফলস্বরূপ তিনি INA কে ভারতীয় প্রতিরোধের একটি প্রতীক হিসেবে দেখেছিলেন।
পরিশেষে বলা যায়, সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যদিও INA- এর সামরিক অভিযান ভারতকে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত করতে সফল হয়নি, তবুও তাদের আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল।
৩৬। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ-এর সামাজিক স্বাধীনতা এবং আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনা করো
সামাজিক স্বাধীনতা
আজাদ-এর স্বাধীনতার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সমতার ধারণা অন্তর্ভুক্ত। তিনি প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের সপক্ষে কথা বলেন এবং বিভিন্ন সামাজিক স্তরের মধ্যে ব্যবধান দূরীকরণের প্রচেষ্টা করেন। তিনি এমন এক সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন, যেখানে প্রত্যেকের সমান সুযোগ ও অধিকার থাকবে। সামাজিক স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তাঁর অবদানগুলি হল-
- বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ: আজাদ জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন আন্দোলন যেমন-অসহযোগ, আইন অমান্য, ভারত ছাড়ো (Quit India) প্রভৃতিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সমাজমুক্তির কথা বলেছিলেন।
- ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গঠন: আজাদ মনে করতেন, ঐক্যবদ্ধ সমাজই ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে উচ্ছেদ করতে সক্ষম, যা বাস্তবিক অর্থেই ভারতের সামাজিক মুক্তি ঘটাবে। এ কারণেই তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সকল সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
- শিক্ষার সংস্কার: সামাজিক স্বাধীনতা লাভের প্রধানতম শর্ত হিসেবে আজাদ শিক্ষার বিস্তারের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক শিক্ষা, উচ্চশিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন।
- অর্থনৈতিক সমতা : আজাদ সামাজিক স্বাধীনতা অর্জনে অর্থনৈতিক সমতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। এজন্য তিনি সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস এবং সকলের জন্য সমান সুযোগের নীতিগুলিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।
আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা
স্বাধীনতা সম্পর্কে আজাদের উপলব্ধি তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, তিনি ইসলামকে এমন একটি ধর্ম হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যা ন্যায়বিচার, সহানুভূতি এবং স্বাধীনতার ধারণাকে সমর্থন করে। আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা সম্পর্কে তাঁর মূল দিকগুলি হল-
- আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার একত্রীকরণ: আজাদ-এর মতে, প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিকাশ ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মৌলানা-র মতে, আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে অজ্ঞতা এবং কুসংস্কারের মতো অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খল থেকে ব্যক্তি নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে।
- বিশ্বজনীন ভাতৃত্ববোধ: আজাদ কেবল ভারতের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের কথা বলেননি, তিনি বিশ্বজনীন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বোঝাপড়া, পারস্পরিক সহযোগিতা স্থাপনের মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ববোধ অর্জনের দ্বারা আধ্যাত্মিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি সুফিবাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রেম, সমবেদনা ইত্যাদির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
- ধর্মীয় সহিষ্ণুতা : তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার মধ্যে কোনোরূপ বিরোধ দেখেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ধর্মীয় সহনশীলতা ও সহানুভূতি ধর্মীয় নিপীড়নের পরিবর্তে স্বাধীনতার পথকে প্রসারিত করে।
- মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠা : আজাদের মতে, আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা প্রত্যেক ব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করে। আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার পছন্দমতো পথ অনুসরণ করার স্বাধীনতা প্রদান করা আবশ্যক বলে তিনি মনে করতেন।
- অহিংসা এবং শান্তি: ইসলামীয় শিক্ষা এবং গান্ধিবাদী নীতি দ্বারা প্রভাবিত আজাদ ছিলেন অহিংসার প্রবক্তা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রাম অহিংস পদ্ধতিতে পরিচালনা করা উচিত। তাঁর মতে, প্রকৃত আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার জন্য স্থায়ী শান্তি অপরিহার্য।
উক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, মৌলানার সামাজিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার ধারণার মধ্যে কোনোরূপ সংকীর্ণতা ছিল না, বরং সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তির মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতার পথকে প্রশস্ত করেছিলেন।
৩৭। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ-এর স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণার সমালোচনামূলক আলোচনা করো
সমালোচনামূলক আলোচনা
স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদে মৌলানা আজাদের অবিস্মরণীয় অবদান থাকা সত্ত্বেও, তাঁর স্বাধীনতার ধারণা বিভিন্ন কারণে সমালোচনার শিকার হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনাগুলি হল-
- ভারত বিভাজন প্রতিরোধে ব্যর্থতা: আজাদ সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত ভাগের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তিনি হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ও সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন এবং অখন্ড ভারতের কল্পনা করেছিলেন। কিন্তু সমালোচকদের মতে, তাঁর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মুসলিম লিগের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং জিন্নাহ-র পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবিকে প্রতিহত করতে তিনি ব্যর্থ হন। সম্ভবত সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে ঐক্যের গভীর বিশ্বাসের কারণেই হিন্দু-মুসলমান বিরোধের তীব্রতাকে তিনি আঁচ করতে পারেননি, যার ফলে শেষপর্যন্ত দেশভাগকে আটকানো যায়নি।
- অতিমাত্রায় নেহরুর প্রভাব: জওহরলাল নেহরু-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার কারণে আজাদ ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। যদিও নেহরু ও আজাদ উভয়ই অখণ্ড গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমালোচকদের যুক্তি ছিল, নেহরু এবং কংগ্রেস দলের প্রতি আজাদের আনুগত্য কখনোই তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেয়নি। ফলে নিজের মতামত দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করার বা তাঁর মতকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ তিনি পাননি।
- ধর্মের প্রভাব: আজাদ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বপ্ন দেখলেও তিনি নিজে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন। অনেক সমালোচক আজাদের এই রূপকে পরস্পরবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ প্রচারের সময়ও ইসলামীয় ঐতিহ্যের উপর জোর দেন। সমালোচকরা যুক্তি দেন যে, এই দ্বৈতরূপের কারণে উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই তিনি সম্পূর্ণরূপে আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পারেননি।
- আন্দোলালর নেতৃত্বে ভূমিকা: খিলাফৎ আন্দোলন থেকে শুরু করে ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্যন্ত আজাদ বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেও তাঁর নেতৃত্ব সন্তোষজনক ছিল না বলে সমালোচকরা অভিযোগ করেছেন। সমালোচকরা মনে করেন, জাতীয় আন্দোলনে আজাদের নেতৃত্ব ততটা কার্যকর ছিল না, যতটা হতে পারত। বরং, আজাদ আন্দোলনের ক্ষেত্রে কৌশলগত পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন।
- অহিংসা এবং সত্যাগ্রহ: আজাদ গান্ধিজির অহিংস পদ্ধতিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু সমালোচকরা যুক্তি দেন যে, এই কৌশলগুলি সর্বদা ব্রিটিশ শক্তিকে দমন করা এবং স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে কার্যকর ছিল না। তারা পরামর্শ দেন, ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ত্বরান্বিত করার জন্য অহিংস পদ্ধতির পরিবর্তে বৈপ্লবিক পদ্ধতির প্রয়োজন অধিক ছিল।
- আদর্শবাদ: সমালোচকরা আজাদের আদর্শবাদ বিশেষ করে শিক্ষা, এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি তাঁর বিশ্বাসকে অবাস্তব বলে সমালোচনা করেছেন। সমালোচকদের মতে, তাঁর আদর্শবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাস্তববাদী ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধা দিয়েছিল।
মূল্যায়ন
উক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও বলা যায়, মৌলানা আজাদ কোনো তাত্ত্বিক ছিলেন না, ফলে স্বাধীনতা সম্পর্কে তিনি কোনো তত্ত্বগত ধারণা দেননি। তিনি ছিলেন একজন আপোসহীন জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী। একই সঙ্গে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে ভারতবর্ষে সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় মিলেমিশে সহাবস্থান করতে পারবে। তিনি স্বাধীনতা বলতে কেবল বিদেশি শাসনের অবসানকে বোঝান নি, বরং তাঁর কাছে যে সমাজ সকল ব্যক্তির অধিকারকে (মতামত প্রকাশ, ধর্মীয় স্বাধীনতা) সুরক্ষিত করতে পারে সেই সমাজই প্রকৃতঅর্থে স্বাধীন। ভারতের স্বাধীনতার প্রতি আজাদের অটল প্রতিশ্রুতি, ধর্মনিরপেক্ষ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই আজও তাঁকে স্মরণ করা হয়।
৩৮। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ-এর শিক্ষার উদ্দেশ্য আলোচনা করো
অথবা, স্বাধীন ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলানার ভূমিকা কী ছিল
আজাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য
আজাদ ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী। তাঁর মন্ত্রীত্বের সময়কালে তিনি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনয়নের চেষ্টা করেন। আজাদের শিক্ষাগত সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গি চারটি মৌলিক লক্ষ্যের উপর ভিত্তিশীল ছিল। এগুলি হল-
[1] শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণ: মৌলানা আজাদ ভারতীয় সমাজে শ্রেণি ও বর্ণবৈষম্য, জাতপাতভিত্তিক কুসংস্কার ইত্যাদির অস্তিত্ব দেখে উপলব্ধি করেছিলেন যে, সামাজিক বৈষম্যের শিকড় অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, কেবলমাত্র শিক্ষাই এই বৈষম্যকে সমূলে উৎপাটিত করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম। এজন্যই তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে সকলের প্রবেশাধিকার সুনিশ্চিত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন এবং শিক্ষার সর্বজনীনতা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে অর্পণ করেছিলেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন যে, মৌলিক শিক্ষা লাভ করা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্মগত অধিকার।
[2] শিক্ষাগত মান বজায় রাখা: আজাদ শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণ এর পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়ন করার জন্যও সমানভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, গণতন্ত্রকে সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে শিক্ষার প্রসার ঘটানো আবশ্যক। তিনি সর্বদা উচ্চমানের শিক্ষাদানের পক্ষপাতী – ছিলেন। উৎকর্ষ শিক্ষার সঙ্গে তিনি কখনোই আপোস করতে রাজি ছিলেন না।
তবে তিনি উচ্চশিক্ষাকে সর্বজনীন করে তোলার পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে কেবল শিক্ষানুরাগী এবং যাদের জ্ঞান অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, তাদের মধ্যেই সীমিত রাখতে চেয়েছিলেন। এভাবে তিনি সমাজের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাগত সুবিধাগুলির সামঞ্জস্যবিধানের চেষ্টা করেছিলেন।
[3] শিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গির সম্প্রসারণ: আজাদ শিক্ষাকে সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি বহুমাত্রিক হাতিয়ার হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। তিনি প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্তরেই শিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি সম্প্রসারণের উপর জোর দিয়েছিলেন। আজাদ ভারতে প্রাথমিক শিক্ষার কার্যকরী ব্যবস্থা হিসেবে একটি মৌলিক ধরন গ্রহণের উপর গুরুত্ব দেন, যা বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
[4] পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধি: আজাদ মানবতার ঐক্যসাধনে বিশ্বাসী ছিলেন। এ কারণেই তাঁর বিশ্বদর্শন জাতীয় সীমানা, ধর্ম, সংস্কৃতি ইত্যাদিকে অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক ঐক্য স্থাপনের উপর গুরুত্ব দিয়েছিল। তিনি মনে করতেন, শিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমেই পারস্পরিক বোঝাপড়া গড়ে তোলা সম্ভব। কারণ প্রকৃত শিক্ষার দ্বারা ব্যক্তির মানবতাবোধের বিকাশ ঘটে যা ধর্মীয় উন্মাদনা রোধ, আর্থিক সমৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক মুক্তির পথকে প্রশস্ত করে।
[5] জাতীয় উন্নয়ন: আজাদ শিক্ষাকে জাতীয় অগ্রগতির মাধ্যম হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভারতের স্বাধীনতা এবং আধুনিকীকরণের সংগ্রামের প্রেক্ষাপট একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তথা একটি জাতির উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
[6] আধুনিকীকরণ: তিনি সমসাময়িক চাহিদা এবং বৈশ্বিক মানদণ্ডের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার জন্য ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ করতে চেয়েছিলেন। এতে ঐতিহ্যগত শিক্ষার পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রসার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
[7] ক্ষমতায়ন ও সমতা: আজাদ নারীর ক্ষমতায়নের জন্য গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তিনি লিঙ্গ সমতা অর্জনের জন্য শিক্ষাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, নারীদের শিক্ষিত করার বিষয়টি সমাজে আরও গুণগত পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে।
৩৯। শিক্ষার পাঠক্রম সম্পর্কে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ-এর মতামত আলোচনা করো
পাঠক্রম সম্পর্কে আজাদের মত
আজাদ মনে করতেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং পাঠক্রমের পরিবর্তন প্রয়োজন। তিনি স্বাধীন ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব মুক্ত একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। যেখানে ঐতিহ্যগত ও আধুনিক উভয় বিষয় একীভূত হবে।
- প্রাথমিক শিক্ষা: আজাদ প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বজনীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি ‘Learning by doing’ বা ‘কাজের মাধ্যমে শেখা’ কৌশলটির উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবে বলে তিনি মনে করেছিলেন, যা তাদের সামগ্রিক বিকাশের পক্ষে সহায়ক হবে। শুধু তাই নয়, তিনি বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলেন। মাধ্যমিক শিক্ষা : তৎকালীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতম অংশ হিসেবে মাধ্যমিক শিক্ষাকে আজাদ ঢেলে সাজানোর উদ্দেশ্যে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে লক্ষণস্বামী মুদলিয়র-এর নেতৃত্বে গঠিত মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন- এর পরামর্শ অনুযায়ী পাঠক্রমকে পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পাঠক্রম প্রস্তুতের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা এবং যোগ্যতার প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়।
- উচ্চশিক্ষা: আজাদ বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শিক্ষাগত মানোন্নয়ন করার উদ্দেশ্যে উচ্চশিক্ষার পাঠক্রমকে আরও সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত করার কথা বলেছিলেন, যা শিক্ষার্থীদের আরও জটিল ও পঠন-পাঠনের বিশেষীকরণ (Specialized field of study)-এর ক্ষেত্রগুলি প্রস্তুত করবে।
- প্রাযুক্তিক শিক্ষা: মৌলানা আজাদ শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর কল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার চরিত্র ছিল বৈজ্ঞানিক প্রকৃতির। তিনি মনে করতেন, দেশের অগ্রগতির প্রয়োজনে পর্যাপ্ত পরিমাণ কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষার প্রসার সাধন করা দরকার। যার দ্বারা যুবসম্প্রদায়ের জীবন সমৃদ্ধ হবে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (IITs) স্থাপনের উপর জোর দিয়েছিলেন এবং ভারতে খড়গপুরে প্রথম আই আই টি স্থাপন করেছিলেন।
- প্রাপ্তবয়স্ক সাক্ষরতা এবং সামাজিক শিক্ষা: প্রাপ্তবয়স্কের স্বাক্ষরতা এবং সামাজিক শিক্ষা কর্মসূচি মূলত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সচেতনতা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে গৃহীত হবে, যার ফলে সামাজিক উন্নয়ন বৃদ্ধি পাবে বলে মৌলানা আজাদ বিশ্বাস করতেন।
- গ্রামীন শিক্ষা: গ্রামীন শিক্ষার ক্ষেত্রে আজাদ বৃত্তিমূলক (Vocational) ও ব্যবহাররিক (Practical) দক্ষতার তাৎপর্যকে স্বীকার করে কৃষি ও কারুশিল্পের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সামাজিক সংস্কার ও সাম্যের হাতিয়ার হিসেবে গ্রামীণ শিক্ষার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক।
- শারীরবৃত্তীয় শিক্ষা: শারীরিক শিক্ষা তথা (শরীর চর্চা) খেলাধূলা, বিনোদন (recreation) ইত্যাদিকে সকল স্তরের শিক্ষা কার্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছিল, যা শিক্ষার্থীদের শারীরিক স্বাস্থ্য বিকাশে অবদান রাখে।
পরিশেষে বলা যায়, জ্ঞানকে তিনি নিছক শিক্ষার পাঠক্রম অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তার মধ্যে বৈচিত্রের প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করেন। এমনকি তিনি শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে বিস্তৃত পরিসরে সজ্জিত করার জন্য শাস্ত্রীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যাকে অন্তর্ভুক্ত করার উপর জোর দেন।
৪০। নারীশিক্ষায় আজাদ-এর ভূমিকা উল্লেখ করো। শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে আজাদের অভিমত ব্যক্ত করো
শিক্ষার ক্ষেত্রে আজাদের ভূমিকা
আজাদ মনে প্রাণে নারীশিক্ষার গুরুত্বকে উপলব্ধি করেছিলেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় আইনসভায় ভাষণ প্রদানকালে তিনি নারীদের আধুনিক বিজ্ঞান ও জ্ঞান চর্চার উপর জোর দেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, জাতীয় শিক্ষার কোনো কর্মসূচিই সফল হতে পারে না, যদি সেটা সমাজের নারীদের শিক্ষা ও অগ্রগতির কথা বিবেচনা না করে। নারীশিক্ষা সম্পর্কে তিনি বলেন, স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে শিক্ষা নারীর মৌলিক অধিকার। তিনি আরও বলেন যে, নারীশিক্ষা তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত করার কাজকে আরও সহজ করে দেয়। তাই তিনি শিক্ষাকে সম্প্রসারিত করে নারীদের অন্তর্ভুক্তির কথা বলেন।
প্রথাগত সামাজিক মনোভাব এবং কু-আচারগুলি মহিলাদের অগ্রগতির সুযোগসুবিধাগুলিকে সীমাবদ্ধ করে। নারীদের উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে আজাদ এই বাধাগুলিকে দূর করার চেষ্টা করেছেন। তিনি শিক্ষাকে সমাজে নারীর মর্যাদা উন্নত করার মাধ্যম হিসেবে দেখেছেন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর কার্যকরী ভূমিকা আশা করেছিলেন।
আজাদ আরও সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে বলেন, পরিবারে মা শিক্ষিত হলে তার শিশুও শিক্ষিত হবে। তাই বলা যায়, নারীশিক্ষার বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র প্রগতিশীল ছিল না, বরং তিনি মনে করতেন নারীশিক্ষার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন সুনিশ্চিত হবে, যা সমাজ বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা নেবে।
শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে আজাদের অভিমত
ভারতের সদ্য স্বাধীনতা লাভের পরই শিক্ষার মাধ্যম কী হবে এই নিয়ে শিক্ষা দফতর এক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। এ বিষয়ে মৌলানার অবস্থান ছিল স্পষ্ট। তিনি মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের কথা বলেন। তিনি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন যে, প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কারণ, শিশুরা মাতৃভাষায় সহজে শিখতে পারবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেছিলেন। তবে উচ্চশিক্ষায় ধীরে ধীরে আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষাদানের কথা বলা হয়।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ত্রিভাষা সূত্র (Three Language Formula) প্রস্তাব করেছিলেন। সেটি হল-
- শিক্ষার প্রাথমিক মাধ্যম আঞ্চলিক ভাষা হওয়া উচিত।
- উচ্চশিক্ষায় সকল শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ বা ব্যবহার করতে হলে ৫ বছরের সময়সীমা প্রদান করা উচিত।
- বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য ইংরেজি ভাষার উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
তবে অপর এক বক্তৃতায় আজাদ স্পষ্টভাবে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ভবিষ্যতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার কোনো স্থান ভারতে নেই। এ ছাড়া তিনি বলেন যে, বিশেষত উচ্চশিক্ষায় কোনো পরিবর্তন ধীরগতিতে হওয়া উচিত। এই কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ৫ বছরের জন্য ভাষাগত মাধ্যমে স্থিতাবস্থা রক্ষার কথা বলা হয়। তবে, ধীরে ধীরে উচ্চপর্যায়ে ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিস্থাপন (Replacement)- এর কথাও বলা হয়েছিল। যদিও আঞ্চলিক ভাষাকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সমর্থন করা হয়েছিল।
৪১। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রদত্ত শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা আলোচনা করো
শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা
মৌলানা আজাদ শিক্ষা সম্পর্কিত প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের ভূমিকা সম্পর্কে গভীর ও দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষকেরা কেবলমাত্র জ্ঞানের প্রসারক নন বরং, তারা শিক্ষার্থীদের চরিত্র এবং বৌদ্ধিকতা গঠনেরও সহায়ক। শিক্ষকদের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সংক্ষেপে আলোচিত হল—
- আদর্শ বা রোল মডেল: আজাদ শিক্ষকের ভূমিকাকে শিক্ষার্থীদের কাছে রোল মডেল বা আদর্শ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। মৌলানার মতে, শিক্ষকদের উচিত জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে অনুসরণ করা। শিক্ষকদের এই নৈতিক চরিত্রই ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক চরিত্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে। অর্থাৎ, ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক চরিত্র গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা পালনকে তিনি চিহ্নিত করেন।
- উৎকর্ষবিধান ও সমালোচনামূলক চিন্তায় উৎসাহপ্রদান : একজন শিক্ষকের সব থেকে বড় ভূমিকা হল ছাত্রদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং স্বাধীন বিচারের বিকাশ ঘটানো। শিক্ষকদের উচিত ছাত্রদের প্রশ্ন করা, বিশ্লেষণ এবং তথ্যমূলক মূল্যায়নে উৎসাহিত করা, বৌদ্ধিক বিকাশে ও কৌতুহল বৃদ্ধিতে সহায়তা করা।
- জাতীয় ঐক্য লালনকারী: আজাদ বলেন যে, শিক্ষকদের জাতীয় ঐক্য ও সামাজিক সংহতি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। শিক্ষকরাই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দেশপ্রেমবোধ জাগ্রত করতে পারেন বলে আজাদ মনে করতেন।
- ভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষক: আঞ্চলিক ভাষার প্রসার ও সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা শিক্ষকদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। ভারতের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার দায়িত্ব আজাদ তাদের উপরেই অর্পণ করেছিলেন।
- উদ্ভাবনীমূলক শিক্ষায় উৎসাহপ্রদান: শিক্ষকের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনীমূলক পদ্ধতি ব্যবহারের উপর আজাদ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। আজাদের বক্তব্য ছিল, শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য শিক্ষামূলক অনুশীলনের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত বিষয়গুলিকেও শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক।
- নারীর ক্ষমতায়ন: মৌলানা আজাদ নারীশিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের উপর জোর দিয়েছিলেন, তিনি আশা রেখেছিলেন যে, নারীশিক্ষা বিস্তারে শিক্ষকরা অগ্রণী ভূমিকা নেবেন এবং শ্রেণিকক্ষে লিঙ্গ সমতাকে বজায় রাখবেন।
- বৈশ্বিক জ্ঞানের সংযোগরক্ষাকারী: আজাদ বলেন, শিক্ষকদের বৈশ্বিক অগ্রগতি এবং জ্ঞান সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। একজন শিক্ষককে আঞ্চলিক ভাষা এবং বৈশ্বিক জ্ঞানের দূরত্বের মাঝে সেতুবন্ধনকারীর ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে ছাত্ররা তথ্য এবং ধারণার বিস্তৃত জগৎ সম্পর্কে অবগত হতে পারে।
- উন্নয়নে সহায়ক: তিনি শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় বিষয়ের উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে দেখেছেন। সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক গঠনের মাধ্যমে শিক্ষকরা জাতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
উক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মৌলানা আজাদ একজন শিক্ষককে কেবল শিক্ষাবিদ হিসেবে দেখেননি বরং, তাদের নৈতিক পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, যিনি ছাত্রের বিশ্লেষণমূলক চিন্তনকে গড়ে তুলতে, দেশের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করতে এবং দেশের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর