ল্যাস্কি কীভাবে স্বাধীনতার সংজ্ঞা দিয়েছেন? ল্যাস্কির মতে সাম্য কী? সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করো।
ল্যাস্কি প্রদত্ত স্বাধীনতার সংজ্ঞা
ল্যাস্কি বলেছেন, স্বাধীনতা হল সেই পরিবেশের সযত্ন সংরক্ষণ, যে পরিবেশে মানুষ তার ব্যক্তিসত্তাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারে। তাঁর মতে, কয়েকটি বাহ্যিক সুযোগসুবিধার সংরক্ষণের মাধ্যমে এই পরিবেশ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
ল্যাস্কির মতে সাম্য
অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্যের অর্থ সব বিষয়ে সমতা বা অভিন্নতা নয়। দৈহিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিগত শক্তিসামর্থ্যের নিরিখে সব মানুষ কখনও সমান হতে পারে না। ল্যাস্কির বক্তব্য অনুসারে সাম্য হল- [1] কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বিশেষ সুযোগসুবিধা প্রদান না করা এবং [2] সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা।
সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক
স্বাধীনতা ও সাম্যের আদর্শ সভ্যসমাজ গঠনের অন্যতম অপরিহার্য উপাদান।
[1] অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক: সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। বস্তুত সাম্য ছাড়া যেমন স্বাধীনতা হয় না, তেমনই স্বাধীনতা ছাড়া সাম্যও অসম্পূর্ণ। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সাম্যের জন্য দাবির বহু আগে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি ওঠে। প্রাচীন গ্রিসে এবং রোমে যখন দাসব্যবস্থার প্রচলন ছিল তখন সব মানুষকে সমান ভাবা হত না। সে সময় সাম্যের চেয়ে স্বাধীনতার স্থান ছিল অনেক ওপরে। দাসপ্রথার বিধিবদ্ধতাকে অগ্রাহ্য করে গ্রিসে ইউরিপিডিস, অ্যালসিডামাস প্রমুখ দার্শনিক এবং স্টোয়িক চিন্তাবিদরা স্বাভাবিক সাম্যের ধারণা প্রচার করলেও সমকালীন সমাজে তা গ্রাহ্য হয়নি। খ্রিস্টধর্ম প্রচারকরাও যে সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন তার কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, মধ্যযুগ পর্যন্ত সাম্যের আদর্শ উপেক্ষিত ছিল। পরবর্তীকালে, ইংল্যান্ডের কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা (Utopian Socialist) বৈষম্যহীন সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বললেও সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শের কোনো সমন্বয়ের কথা ভাবেননি। বস্তুতপক্ষে, সর্বপ্রথম আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে (1776 খ্রিস্টাব্দ) এবং পরে ফ্রান্সের মানবাধিকার-সংক্রান্ত ঘোষণায় (1789 খ্রিস্টাব্দ) সাম্য ও স্বাধীনতার সমন্বয়চিন্তা বাস্তব রূপ লাভ করে। ফ্রান্সের জাতীয় সংসদের ঘোষণায় বলা হয়, মানুষ তার জন্ম থেকেই স্বাধীন এবং সমানাধিকারসম্পন্ন।
[2] পরিপূরক সম্পর্ক: ঊনবিংশ শতাব্দীর চিন্তাবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপূরক বলে বর্ণনা করেন। রুশো মনে করতেন, সাম্যের অস্তিত্ব ছাড়া স্বাধীনতা ভোগ করা যায় না। আধুনিককালে বিংশ শতাব্দীর চিন্তাবিদরা সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণাকে একে অপরের পরিপূরক বলে ব্যাখ্যা করেছেন। হবহাউসের মতে, সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার ধারণা বাগাড়ম্বরমাত্র। আর এইচ টনি বলেন, সাম্য কখনও স্বাধীনতার পরিপন্থী হতে পারে না। স্বাধীনতার জন্যই সাম্যের প্রয়োজন। তাঁর মতে, মানবতার নিরবচ্ছিন্ন প্রসার যদি স্বাধীনতা হয়, তাহলে তা সাম্যভিত্তিক সমাজ ছাড়া পাওয়া যাবে না। পোলার্ডের অভিমত হল, স্বাধীনতা-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানসূত্রের নাম সাম্য। বার্কার স্বাধীনতা ও সাম্যের সমন্বয়সাধনের ওপর গুরুত্ব দেন।
[3] অর্থনৈতিক সাম্য এবং স্বাধীনতা: অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কি তাঁর ‘A Grammar of Politics’ গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, অর্থনৈতিক সাম্য না থাকলে রাজনৈতিক সাম্যের কোনো মূল্য নেই। মার্কসবাদীরাও এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, ধনবৈষম্যমূলক সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য না থাকায় রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা নিতান্তই মূল্যহীন হয়ে দাঁড়ায়। মার্কসীয় তত্ত্বে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্তরূপে অর্থনৈতিক সাম্যের কথা বলা হয়।
আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর