মোক্ষকে কেন শ্রেষ্ঠ পুরুষার্থ বলা হয়
মোক্ষ
চার্বাক ব্যতীত অন্যান্য আস্তিক ও নাস্তিক সকল সম্প্রদায়ের ভারতীয় দার্শনিকেরাই পরম বা শ্রেষ্ঠ পুরুষার্থ হিসেবে মোক্ষকে স্বীকার করেছেন।
‘মোক্ষ’ শব্দের অর্থ
‘মোক্ষ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘মুক্তি’। সাধারণ মানুষের কাছে মুক্তির গুরুত্ব ও আকর্ষণ অপরিসীম। এই মোক্ষ শব্দের অর্থ কী তা নিয়ে সাধুগণ ও দার্শনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কারোর মতে আত্মজ্ঞানের অভাব হল অবিদ্যা। আর এই অবিদ্যার নাশই হল মোক্ষ। আবার কারোর মতে, অনিত্য সংসার মাত্রই সুখ-দুঃখের সমন্বয় এবং বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি দয়ামায়ার বন্ধন। এই সুখ-দুঃখময় সংসারের মায়ার বাঁধন ছিন্ন করাই হল মোক্ষ। কেউ কেউ বলেছেন মোক্ষ হল এক পরম আনন্দময় ও পরম শান্তির অবস্থা।
মোক্ষের পর্যায়বাচক নাম
মোক্ষ বা মুক্তির ধারণা ভারতীয় দর্শনের অনবদ্য অবদান, যা এই দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সম্প্রদায়ভেদে ‘মুক্তি’, কখনও ‘মোক্ষ’ কখনও ‘অপবর্গ’ কখনও ‘নির্বাণ’ বা কখনও ‘কৈবল্য’ -এই ধরনের বিভিন্ন সমপর্যায়ের বাচকপদ দ্বারা অভিহিত হয়েছে।
মোক্ষ কেন শ্রেষ্ঠ পুরুষার্থ
মোক্ষকে শ্রেষ্ঠ পুরুষার্থ বলার কারণগুলি হল-
- মোক্ষ লাভের মধ্যে ধর্ম, অর্থ ও কাম পরিপূর্ণতা ও সার্থকতা লাভ করে। এই দিক থেকে বিচার করে শাস্ত্রকাররা মোক্ষকে পরমপুরুষার্থ বলেছেন। মোক্ষই একমাত্র পুরুষার্থ যা নিজস্ব মূল্যে মূল্যবান।
- মোক্ষকে পরমপুরুষার্থ বলার অপর একটি কারণও বিদ্যমান। প্রতিটি পুরুষার্থই সুখপ্রাপ্তির সঙ্গে যুক্ত। ধর্ম, অর্থ ও কাম সাক্ষাৎ সুখ নয়, সুখের হেতু। কিন্তু মোক্ষ সাক্ষাৎ সুখস্বরূপ। এইজন্য মোক্ষকে পরমপুরুষার্থ বলা হয়।
- গীতায় বলা হয়েছে- জন্ম, মৃত্যু, জরা প্রভৃতি থেকে অব্যাহতির উপায় নেই। সংসার সুখের নয়, অর্থ ও কাম অস্থায়ী এবং সাংসারিক সুখ দুঃখযুক্ত। জ্ঞানী ব্যক্তি এইসব চিন্তা করেই মোক্ষলাভের চিন্তা করেন।
- ভারতীয় চিন্তাধারায় মোক্ষলাভের উপায় হিসেবে তিনটি পথ বা মার্গের কথা বলা হয়েছে- জ্ঞানমার্গ, কর্মমার্গ ও ভক্তিমার্গ। জ্ঞানযোগের সার কথা হল, ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা জীব এই জন্মেই মোক্ষ লাভ করতে পারে। কর্ম বর্জন করে মোক্ষলাভ করা যায় না। নিষ্কাম কর্ম মোক্ষ প্রাপ্তিতে সহায়ক হয়। আর ভক্তিযোগ বলতে বোঝায় ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি- ঈশ্বর প্রাপ্তিই মোক্ষ।
- মোক্ষ যে মানুষকে দুঃখ থেকে মুক্তিদান করে এ বিষয়ে ভারতীয় দার্শনিকরা একমত। সমাজ রক্ষার প্রতি দৃষ্টি রেখে ধর্ম মানুষের কাম ও অর্থলিপ্সাকে সংযত করে। এই সংযম মানুষকে মোক্ষের পথে নিয়ে যায়।
- আমাদের দৈনন্দিন ও ঐহিক জীবন হল অধ্যাত্মপথের সোপান মাত্র, যার মাধ্যমে আমরা মোক্ষ নামক পরমপুরুষার্থকে লাভ করতে পারি। প্রায় সমস্ত ভারতীয় দার্শনিকদের মতে, মোক্ষ হল মানুষের অবিদ্যাজনিত দুঃখ থেকে পরিত্রাণের উপায়।
পরিশেষে বলা যায় যে, মোক্ষের আদর্শ জীবমুক্তি, জীবন থেকে মুক্তি নয়, বরং মোক্ষই জীবনের এমন এক অবস্থার সূত্রপাত করে যা নিরাসক্ত ও নির্মোহ। তাই মোক্ষই শ্রেষ্ঠ পুরুষার্থ।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ