ভাব সম্মিলন কবিতার উৎস, কবি পরিচিতি ও বিষয়বস্তু

ভাব সম্মিলন কবিতার উৎস, কবি পরিচিতি ও বিষয়বস্তু

ভাব সম্মিলন কবিতার কবি-পরিচিতি

প্রাক্‌চৈতন্য যুগের অন্যতম বৈষ্ণব পদকর্তা হলেন বিদ্যাপতি। সংস্কৃত কবি জয়দেবের ভাবাদর্শ ও রাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনির প্রভাবে বিদ্যাপতি পদ রচনা করেন। তিনি ছিলেন মিথিলার কবি। মৈথিলি ভাষাতেই তিনি তাঁর পদ রচনা করেন। কিন্তু বাংলাদেশেই তিনি অধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। বাংলা ভাষাতে কোনো পদ না লিখেও তিনি বাঙালির হৃদয়াসনে স্থান করেছিলেন। বস্তুত বাংলায় প্রচলিত তাঁর পদগুলি লেখা হয়েছিল ব্রজবুলি ভাষায়।

বিদ্যাপতি দ্বারভাঙ্গা জেলার মধুবনী মহকুমার অন্তর্গত বিসফী গ্রামে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর তিরোধান ঘটে বলে অনুমান করা হয়। মিথিলার রাজা শিবসিংহ ছিলের তাঁর পরম সুহৃদ। মিথিলারাজ কীর্তিসিংহের কীর্তি-কাহিনি নিয়ে অবহট্ঠ ভাষায় লেখেন ‘কীর্তিলতা’। কীর্তিসিংহের রাজত্বকাল ছিল ১৪০২-১৪০৪ মাত্র দু’বছর। এই সময় কবি কিশোর ছিলেন। কারণ এই কাব্যে তিনি নিজেকে ‘খেলন কবি’ বলে উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ নিজেকে কিশোর বলেছেন। রাজা দেবীসিংহের আদেশে রচনা করেন ‘ভূপরিক্রমা’ (আনু ১৪০০ খ্রি.)। এছাড়া ‘পুরুষপরীক্ষা’ (১৪১০ খ্রি.), ‘কীর্তিলতা’ (১৪১০ খ্রি.), ‘লিখনাবলী’ (১৪৮১ খ্রি.) রচনা করেন। ‘শৈবসর্বস্বহার’ ও ‘গঙ্গাবাক্যাবলী’ রচনা করেন ১৪৩০-৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। ‘বিভাসাগর’, ‘দানবাক্যাবলী’, ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’ কাব্যগুলি রচনা করেন ১৪৪০-৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। এরপর তাঁর রচিত আর কোনো গ্রন্থ পাওয়া যায়নি।

বিদ্যাপতি ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এবং মৈথিলি ভাষার কবি। তাঁর অসামান্য কবিপ্রতিভার জন্য তিনি ‘কবি সার্বভৌম’ হিসেবে পরিচিত হন। জয়দেবের ভাবধারাকেও তিনি গ্রহণ করেছিলেন বলে সুহৃদ শিবসিংহ তাঁকে ‘অভিনব জয়দেব’ উপাধি দেন। এছাড়া তিনি ‘মৈথিল কোকিল’ নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি প্রায় আটশো পদ লিখেছিলেন। কিন্তু বাংলা ভাষায় তিনি কোনো পদ লেখেননি। বাংলা ও মৈথিলি ভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্ট হয়েছে ব্রজবুলি ভাষা। বিদ্যাপতির পদগুলি বাংলায় প্রবেশ করে বাংলা ভাষার সংমিশ্রণে একটি সুমিষ্ট ভাষায় পরিণত হয়। এই ব্রজবুলি ভাষাতেই বিদ্যাপতির পদগুলি প্রচলিত হয় এবং তা পাঠক ও শ্রোতার মন জয় করে নেয়।

রাধাকৃষ্ণ পদাবলী রচনার মধ্য দিয়েই বিদ্যাপতি কাব্যপ্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে যান। তিনি রাধাকৃর লীলার বিভিন্ন পর্যায় নিয়েই পদ রচনা করেছেন। যেমন-পূর্বরাগ, অনুরাগ, বাসকসজ্জা, অভিসার, বিপ্রলম্বা, খন্ডিতা, কলহান্তরিতা, মান, বিরহ ও মিলনলীলার বর্ণনা করেছেন। তবে মাথুর এবং ভাবোল্লাস ও মিলন পর্যায়ের পদে তাঁর প্রতিভার জৌলুষ ধরা পড়েছে। বিদ্যাপতি যেহেতু রাজসভার কবি ছিলেন, তাই তাঁর কাব্যে লিরিকের মূর্ছনা, বাগগ্বৈদস্থ্য, প্রেমের চাতুর্য, আদি রসাত্মক দেহজ প্রেম, ধ্বনিঝংকার, অলঙ্কার সমাবেশের প্রাথর্য ধরা পড়েছে। চৈতন্যপরবর্তী পদকর্তা গোবিন্দদাসকে ‘বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য’ বলা হয়। তাই তিনি ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ নামে পরিচিত।

ভাব সম্মিলন কবিতার উৎস

পাঠ্য ‘ভাবসম্মিলন’ পদটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত শ্যামাপদ চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘বৈয়ব পদাবলী’ গ্রন্থের ‘ভাবোল্লাস ও মিলন’ পর্যায় থেকে নেওয়া হয়েছে। ‘ভাবোল্লাস ও মিলন’ পর্যায়ের এটি ৫ সংখ্যক পদ। এই পর্যায়ের পদে বিদ্যাপতি অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

ভাব সম্মিলন কবিতার বিষয়বস্তু

‘বৈষ্ণব পদাবলী’ গ্রন্থের অন্তর্গত আমাদের পাঠ্য বিদ্যাপতির ‘ভাবসম্মিলন’ পদটিতে আমরা দেখি রাধা তাঁর প্রিয়তম কৃষ্ণের সঙ্গে কল্পনায় মিলিত হয়েছেন। তাঁর এই ভাবসম্মিলনের মধ্য দিয়ে তিনি সমস্ত দুঃখ-যন্ত্রণা ভুলে গেছেন। তাঁর আনন্দানুভূতির সীমা নেই। এতদিন তিনি কৃষ্ণের বিরহে যত দুঃখ পেয়েছেন, এই মিলনের সুখ তার থেকে অনেক বেশি, অন্তহীন। তাই তিনি বলেছেন, তিনি যদি আঁচল ভরে মহামূল্যবান রত্ন, ধনসম্পদও পান, তাহলেও প্রিয়কে আর দূরদেশে পাঠাবেন না। কারণ পার্থিব সম্পদ যে সুখ দিতে পারে তা কখনোই প্রিয়া-মিলনের আনন্দের পরিপূরক হতে পারে না। প্রিয়তম, রাধিকার কাছে শীতের ওড়না (চাদর), গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছাতা আর নদীর বুকে বয়ে চলা নৌকা। তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষণে জড়িয়ে রয়েছেন মাধব। ভালোবাসার কুমকুম-রাগে কৃয় তাঁকে ভরিয়ে রেখেছেন। তাই বিরহবেলার অবসানে রাধিকা কৃষ্ণের সঙ্গে কাল্পনিকভাবে মিলিত হয়েছেন এবং ভাবোল্লাসে আনন্দানুভূতিতে বিভোর হয়েছেন। তাই পদের শেষে পদকার বিদ্যাপতি রাধাকে উদ্দেশ করে বলেছেন যে, শ্রেষ্ঠা নারী, যিনি ভালো মানুষ, সুজন তাঁর জীবনে দুঃখ চিরকাল থাকে না। তাই রাধিকা মিলিত হয়েছেন তাঁর পরম প্রিয়ের সঙ্গে এবং সমস্ত অতৃপ্তি ও নৈরাশ্যের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন।

ভাব সম্মিলন কবিতার চরণের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য

১. “কি কহব রে সখি আনন্দ ওর। চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।”

-এখানে রাধার কল্পনায় কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর মিলন ঘটেছে। তাই তিনি সখীদের উদ্দেশ করে বলেছেন যে, তাঁর সুখের কোনো সীমা নেই। কারণ অনেকদিন পর মাধব অর্থাৎ কুষ্ণ তাঁর কাছে আবার ফিরে এসেছেন। এই কাল্পনিক মিলনে তাঁর মধ্যে ভাবোল্লাস সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বিরহের বেদনা ভুলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছেন। তাঁর সমগ্র দেহমন কৃষ্ণমিলনে অভিভূত হয়ে পড়েছে।

২. “পাপ সুধাকর যত দুখ দেল। পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।”

-কৃষ্ণের মথুরাগমনের পর থেকে রাধা কৃষ্ণের বিরহে শোকসন্তপ্তা। পাপিষ্ঠ চন্দ্রকিরণ তার জ্যোৎস্নার আলোয় রাধাকে চরম যন্ত্রণায় বিদ্ধ করেছে। তাঁর দেহমন বিরহ যন্ত্রণায় কাতর হয়েছে। কারণ চন্দ্রের মধ্যেই তিনি তাঁর প্রিয়মুখ সর্বদা নিরীক্ষণ করেন। কিন্তু মাধব যখন সত্যসত্যই তাঁর কাছে ফিরে এসেছেন তখন তাঁর আনন্দ সীমাহীন হয়েছে। যে দুঃখ এতদিন রাধা পেয়েছেন তাঁর থেকেও বহুগুণ এই আনন্দানুভূতি। প্রিয় কৃষ্ণের সঙ্গে ভাবসম্মিলনের ফলে রাধিকার মনের সমস্ত জ্বালা জুড়িয়ে গেছে।

৩. “ভণয়ে বিদ্যাপতি শুন বরনারি। সুজনক দুখ দিবস দুই-চারি।।”

-‘ভাবসম্মিলন’ পদটির শেষে বিদ্যাপতি রাধাকে উদ্দেশ করে বলেছেন যে, শোনো শ্রেষ্ঠা নারী, যে সুজন অর্থাৎ ভালো মানুষ তাঁর দুঃখ বেশিদিন থাকে না। তা মাত্র দু-চারদিন স্থায়ী হয়। কৃষ্ণের বিরহে রাধার জীবনে যে দুঃখ ও চিরযন্ত্রণা নেমে এসেছিল তার উপশম ঘটবে প্রিয়ের সঙ্গে ভাবমিলনে। প্রিয়জনের সান্নিধ্যে রাধার হৃদয় অপার আনন্দ ও সুখ ভোগ করবে।

প্রসঙ্গ: পদাবলী ও বিদ্যাপতি

ভাবসম্মিলন

বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে রাধাকৃষ্ণের লীলার কয়েকটি পর্যায় আছে। তার মধ্যে ‘ভাবোল্লাস ও মিলন’ বা ‘ভাবসম্মিলন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। ভাবোল্লাস বা ভাবসম্মিলন হল একটি নিরবচ্ছিন্ন মিলনের স্তর। এই স্তরে রাধিকার মনে এক আনন্দানুভূতির জন্ম নেয়। সেখানে বিচ্ছেদের কোনো আশঙ্কা নেই। বলা যায়, দেবতার প্রতি ভত্ত্বের এক নিঃশর্ত আত্মনিবেদন।

কংসবধের জন্য কৃষ্ণ মথুরায় চলে যান। তিনি আর কোনোদিন বৃন্দাবনে ফিরবেন না। তখন সমগ্র বৃন্দাবনবাসীই তাঁর জন্য শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। শ্রীরাধিকার অবস্থা ভীষণ খারাপ। প্রিয় বিরহে তিনি উদ্‌ভ্রান্ত। তাই কখনো মেঘকে কৃষ্ণ ভেবে আলিঙ্গন করেন, কখনোবা চন্দ্রের মুখদর্শনে প্রিয়মুখ মনে পড়ে। রাধিকার এই বিরহব্যথার অবসান ঘটে ভাবসম্মিলনে। ‘ভাবসম্মিলন’ কথাটির অর্থ হল ভাবে অর্থাৎ কল্পনায় মিলন। আর মিলনজাত আনন্দ বা উল্লাসকে বলা হয় ভাবোল্লাস। রাধিকাও ভাবের দ্বারা অর্থাৎ কল্পনায় মিলিত হয়েছেন মাধবের সঙ্গে। এই মিলনের সুখানুভূতি বা আনন্দোল্লাসই হল ভাবোল্লাস বা ভাবসম্মিলন। দুটি হৃদয়ের প্রেমানুভূতি ও নিঃশর্ত আত্মনিবেদনই হল ভাবসম্মিলন। ভাবসম্মিলনের পদে বিদ্যাপতি উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। যেমন-

“প্রিয়া জব আওব এ মধু গেহে। মঙ্গল জতেওঁ করব নিজ দেহে।।”

ব্রজবুলি ভাষা

বিদ্যাপতি কোন্ ভাষাতে পদ লিখেছিলেন, এ নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। প্রকৃত অর্থে বিদ্যাপতি তাঁর মাতৃভাষা মৈথিলিতেই পদ রচনা করেন। মিথিলা এবং তার চারিপাশ থেকে বিদ্যাপতির যেসকল পদ পাওয়া গেছে, সেগুলি যে মৈথিলি ভাষাতেই লেখা তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সমস্যা দেখা গিয়েছে বাংলাদেশে প্রাপ্ত পদগুলির ক্ষেত্রে। সেই সময় বাংলাদেশ থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী মিথিলাতে পড়াশোনা করতে যেতেন। তাঁরা যখন ফিরে আসতেন তখন বিদ্যাপতির পদ বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাঁদের কণ্ঠে কণ্ঠে পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং তৈরি হয় ব্রজবুলি ভাষা।

বাংলা ও মৈথিলি ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছিল একপ্রকার সুমিষ্ট ভাষা, যাকে ব্রজবুলি বলা হয়। বিদ্যাপতির পদগুলি বাংলায় অনুপ্রবেশের পরেই পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং তাঁর রাধাকুয়লীলা বিষয়ক পদগুলিই ব্রজবুলির উৎপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন-বিদ্যাপতির একটি ব্রজবুলির পদ-

"আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লু
পেখলু পিয়া-মুখ-চন্দা।"

এই ব্রজবুলিতেই বাংলাদেশে পরবর্তীকালে পদ রচিত হয়েছে। এমনকি আধুনিক যুগেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ রচিত হয় ব্রজবুলির আদলে। শুধু বাংলা নয়, অসম, ওড়িশা, নেপাল প্রভৃতি স্থানেও মৈথিলির সঙ্গে স্থানীয় ভাষা যুক্ত হয়ে মিশ্রভাষা বা ব্রজবুলি তৈরি হয়।

ব্রজবুলি ভাষার বৈশিষ্ট্য

1. ব্রজবুলি একপ্রকার মিশ্র ও কৃত্রিম ভাষা।

2. ব্রজবুলি শ্রুতিমধুর ভাষা।

3. ব্রজবুলি মুখের ভাষা নয়, এটি লেখ্য ভাষা।

4. বাংলা, অসম, ওড়িশা, নেপাল প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচলিত ভাষা।

5. মৈথিল ও স্থানীয় ভাষা সহযোগে তৈরি হয় ব্রজবুলি ভাষা।

বিদ্যাপতিকে বাংলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্তির কারণ:

বিদ্যাপতি ছিলেন মিথিলার কবি। এমনকি তিনি বাঙালিও ছিলেন না। তবুও তাঁকে বাংলা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলার বৈষুব পদাবলী সাহিত্যে প্রাক্-চৈতন্যযুগের কবি হিসেবে বিদ্যাপতি অনন্য।

বিদ্যাপতিকে বাংলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্তির কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে মিথিলা ছিল ন্যায়শাস্ত্রের পীঠস্থান। তাই বাংলার বহু ছাত্র সেখানে ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে যেতেন। সেখানে তাঁরা বিদ্যাপতির পদ শুনতে খুবই ভালোবাসতেন। তাঁরা যখন ফিরে আসতেন তখন তাঁদের কণ্ঠে নিয়ে আসতেন বিদ্যাপতির পদ। মৈথিলি ভাষার সেই পদ বাংলায় এসে বাংলা ও মৈথিলির মিশ্রণে সুমধুর ব্রজবুলি ভাষার সৃষ্টি করেছে। ব্রজবুলির সেই সকল বিদ্যাপতির পদগুলি বাংলার মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয়ত, শ্রীচৈতন্যদেব নিজে দিনরাত বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের পদ শুনতেন এবং সমাদর করতেন। তাই বিদ্যাপতির রচিত বৈঘ্নব পদগুলি বাংলা ও বাঙালির জীবনে স্থান পেয়েছে। তৃতীয়ত, বিদ্যাপতির শিল্পকলা বাঙালিকে আকৃষ্ট করে এবং বৈল্পব পদকর্তারা বিদ্যাপতির অনুসরণে পদ রচনা করেন। যেমন-চৈতন্যপরবর্তী কবি গোবিন্দদাসকে ‘বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য’ বলা হয়।

এছাড়া, সুমধুর রাধাকৃষ্ণ লীলাকে বাঙালি আপন হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বৈস্তুব সমাজের বাইরেও ভক্তিরসাত্মক গান হিসেবে বিদ্যাপতির পদবিশিষ্ট স্থান লাভ করেছে।

এইসকল কারণেই বিদ্যাপতিকে বাংলা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

অভিনব জয়দেব

মিথিলার কবি বিদ্যাপতি রাধাকৃত্বের পদ রচনায় সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সংস্কৃত কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ দ্বারা। বিদ্যাপতি সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন। তাই সংস্কৃত শাস্ত্রের পূর্বরাগ, মিলন, অভিসার, মান, বিরহ পুনর্মিলন ইত্যাদির প্রভাব বিদ্যাপতির কাব্যে পড়েছে। জয়দেবের রাধার সঙ্গে বিদ্যাপতির রাধার চারিত্রিক সাদৃশ্য রয়েছে। বিদ্যাপতির রাধার মধ্যে মর্তবাসী নায়িকার প্রেম, কামনাবাসনা ও উজ্জ্বলতা যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনি মিলনে তিনি অপরূপা এবং বিরহে বেদনাবিধুর। জয়দেবের কাব্যে যেমন আদিরস ভক্তিরসে পরিণত হয়েছে, তেমন বিদ্যাপতির পদেও আদিরসকে ভিত্তি করে ভক্তিরসেই রাধার প্রেম পরিণতি লাভ করেছে। এই কারণেই বিদ্যাপতিকে ‘অভিনব জয়দেব’ আখ্যা দেওয়া হয়।

বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের তুলনা

বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাস দুজনেই হলেন চৈতন্যপূর্ববর্তী যুগের কবি। বৈয়ব পদাবলী রচনায় দুজনেরই কৃতিত্ব অনবদ্য। তাঁদের কাব্যের মূল বিষয় ছিল রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা। তাই সাহিত্য সমালোচকেরা এই দুই পদকারের মধ্যে তুলনা করে থাকেন। এখানে আমরা সে বিষয়েই আলোচনা করব।

বিদ্যাপতি ছিলেন রাজসভার কবি এবং চন্ডীদাস ছিলেন সাধারণ গ্রাম্য গৃহস্থ পরিবারের সদস্য। বিদ্যাপতি তাঁর পদাবলী সাহিত্য রচনা ছাড়াও অন্যান্য বই রচনা করেছেন। তিনি ছিলেন সংস্কৃত শাস্ত্রানুরাগী। তাই তাঁর রচনায় সংস্কৃত সাহিত্যের প্রভাব পড়েছে। কিন্তু পদাবলীর রাধাকৃয়লীলা ছাড়া চন্ডীদাসের আর কোনো রচনা পাওয়া যায়নি। চৈতন্যদেব, বিদ্যাপতি এবং চন্ডীদাস উভয়ের পদই আস্বাদন করতেন।

বিদ্যাপতি কিন্তু বাঙালি কবি ছিলেন না। বাংলাতেও তিনি কোনো পদ রচনা করেননি। তিনি মিথিলার কবি এবং মৈথিলি ও ব্রজবুলি ভাষায় পদ লিখেও পাঠকচিত্তে উজ্জ্বল স্থান করে নিয়েছেন। আর চন্ডীদাস বাংলা ও বাঙালির কবি। তিনি তাঁর সহজসরল ভাব-ভাষা ও মাধুর্য দিয়ে বাঙালির আপনজনে পরিণত হয়েছেন।

শ্রীরাধার চরিত্র অঙ্কনেও বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাস উভয়েই নিজস্ব কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। বিদ্যাপতি ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত। তাই তাঁর কাব্যে রাধিকার ক্রমবিকাশ ঘটেছে। রাধার প্রেম শুরু হয়েছে মর্ত্যজীবনের ভোগবাসনাকে অবলম্বন করে। ক্রমশ তা সুখ-দুঃখ বিরহমিলনের মধ্য দিয়ে এক অপরূপ ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। ভরা ভাদ্রের বর্ষার রাতে রাধিকার অন্তর বিপুল বিলাপে ভেঙে পড়েছে-

সখি, হামারি দুখক নাহি ওর।

এ ভরা বাদর          মাহ ভাদর 

শূন্য মন্দির মোর।। 

কিন্তু চন্ডীদাসের রাধার কোনো ক্রমবিকাশ নেই বললেই চলে। পূর্বরাগ থেকে শুরু করে মাথুর বা ভাবসম্মিলন প্রতিটি পর্যায়েই রাধার সাধিকা মূর্তি প্রকাশিত হয়েছে। তাই তিনি বলতে পারেন-

কলঙ্কী বলিয়া ডাকে সব লোক

তাহাতে নাহিক দুখ।

তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার

গলায় পরিতে সুখ।

পদাবলী রচনায় বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের কাব্যশৈলী স্বতন্ত্র মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। বিদ্যাপতি ছিলেন রাজসভার কবি। তাই তাঁর কবিতা যেন স্বর্ণহার; আর চন্ডীদাসের রয়েছে সহজসরল সুরের ব্যঞ্জনা। তাই তাঁর কবিতা যেন রুদ্রাক্ষের মালা। বাবৈদ্য, ছন্দের ঝংকার বা অলংকারের কারুকার্য বিদ্যাপতির কাব্যকে রূপ-রস-রঙে অতুলনীয় করে তুলেছে। কিন্তু চন্ডীদাসের ভাষাভঙ্গিমা, ছন্দ, অলংকার, বাক্রীতি সহজসরল, যেন নীরব পদক্ষেপ। আসলে বিদ্যাপতি হলেন সমুদ্রের উচ্চকিত তরঙ্গভঙ্গ আর চন্ডীদাস সমুদ্রের অতল প্রশান্তি।

রবীন্দ্রনাথও বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের সম্পর্কে বলেছেন, বিদ্যাপতি হলেন সুখের কবি, আর চন্ডীদাস দুঃখের কবি। বিদ্যাপতির রাধা জগতে প্রেমকে সর্বস্ব মনে করেছেন কিন্তু চন্ডীদাসের রাধা প্রেমই জগৎসংসার মনে করেন। বিদ্যাপতির রাধা বিরহে কাতর হয়েছেন কিন্তু চন্ডীদাসের রাধার মিলনেও সুখ নেই।

তাই বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের তুলনা আলোচনার শেষে একথা বলা যায়, দুজনেই প্রেমের পূজারি এবং কাব্যপ্রতিভায় অনন্য। কেউ বিদ্যাপতির পদে অবলম্বন খোঁজেন, আবার কেউ চন্ডীদাসের পদে আশ্রয় খুঁজে পান। কাব্যপ্রতিভায় দুজনেই শ্রেষ্ঠ।

গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য বা দ্বিতীয় বিদ্যাপতি

চৈতন্যোত্তর কবি গোবিন্দদাসকে বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য বা ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ বলা হয়। গোবিন্দদাস প্রায় দু-শতাব্দী পরে বিদ্যাপতির ভাব ও ভাষাকে আত্মস্থ করে তার সঙ্গে চৈতন্যদেবের ভাবাদর্শ মিলিয়ে এক অভিনব গীতধারা বা রাধাকৃষ্ণের পদ সৃষ্টি করেছেন। এই অভিনবত্বই তাঁদের মনোজগতের পার্থক্যকে স্পষ্ট করে। তবে, ছন্দনির্মাণ, সুরচেতনা, অলঙ্কারসজ্জা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উভয়ই তুল্যমূল্য দক্ষ ছিলেন। তাঁরা দুজনেই ব্রজবুলি ভাষায় দক্ষতার সঙ্গে পদ লিখেছেন। মনোধর্ম ও শিল্পচেতনার আপাতসাদৃশ্য লক্ষ করেই বাঙালি গোবিন্দদাসকে ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ বা ‘বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য’ বলেছেন।

আরও পড়ুন – শিক্ষামনোবিজ্ঞান প্রশ্ন ও উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment