বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় সাম্যের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করো
বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় সাম্যের প্রকৃতি
সকল সমাজব্যবস্থায় সাম্যের প্রকৃতি একরকম হতে পারে না। সাম্যের প্রকৃতি সমাজব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যে ধরনের সাম্য পরিলক্ষিত হয়, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেই ধরনের সাম্য পরিলক্ষিত হয় না। বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় সাম্যের প্রকৃতিকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়-
[1] আদিম সাম্যবাদী সমাজে সাম্য: যে-কোনো সমাজে সাম্যের প্রকৃতি সেই সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা দ্বারা নির্ধারিত হয়। আদিম সাম্যবাদী সমাজের সাম্যও সেই সমাজের অর্থনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। আদিম সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। ফলে সমাজে যে সম্পত্তি ছিল তার ওপর ছিল সকলের অধিকার। ওই সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি না থাকায় সকলে মিলে যা সংগ্রহ করত তার ওপর ছিল সকলের সমান অধিকার। অর্জিত বস্তু সকলে মিলে সমানভাবে ভাগ করে নিত। ওই সমাজে নারী পুরুষের মধ্যে কোনোরূপ ভেদাভেদ ছিল না। ওই সমাজে মানুষ অত্যন্ত সহজ সরল জীবনযাপন করত।
[2] দাস সমাজে সাম্য: দাস সমাজে সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। দাস সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব হয়। যাদের হাতে সম্পত্তির মালিকানা কেন্দ্রীভূত হয় তারা দাস মালিক হিসেবে পরিগণিত হয়। ওই সমাজে শাসন করত দাস মালিকগণ। ফলে ওইরূপ সমাজে দাস মালিকদের স্বার্থরক্ষাকারী আইন প্রণীত হত। কাজেই ওই আইন দাস মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করত, দাসদের নয়। একারণে দাসরা সকল প্রকার বৈষম্যের শিকার হত। অর্থাৎ, ওই সমাজে দাসদের কোনোরূপ অধিকার থাকত না।
[3] সামন্ত সমাজে সাম্য: ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর গড়ে ওঠা দাস সমাজে দুটি প্রধান শ্রেণি ছিল সমান্ত প্রভু ও কৃষক সম্প্রদায়। ওই সমাজেও রাষ্ট্র পরিচালনা করত সামন্তপ্রভুরা। ফলে যাবতীয় আইন সামন্তপ্রভুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রণীত হয়। স্বভাবতই কৃষকগণ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হত। কাজেই কৃষকরা চরম বৈষম্যের শিকার হয়।
[4] ধনতান্ত্রিক সমাজে সাম্য: সামন্ত সমাজের পর প্রতিষ্ঠিত হয় ধনতান্ত্রিক সমাজ। ধনতান্ত্রিক সমাজের মূল বক্তব্যই ছিল সাম্য, স্বাধীনতা ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করা। এরূপ সমাজে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-স্ত্রী-পুরুষ ইত্যাদি কারণে কোনোরূপ ভেদাভেদ করা হয় না। আইনের কাছে সকলেই সমান বলে প্রতিপন্ন হয়। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে সকলের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলে। এখানে বিশেষ সুযোগসুবিধা বা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা স্বীকৃত হয় না। এরূপ সমাজে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য স্বীকার করা হয় না, অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক সমাজে সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্যকে স্বীকার করা হয়। কিন্তু এরূপ সমাজে অর্থনৈতিক সাম্যকে স্বীকার করা হয় না। ধনতান্ত্রিক সমাজে মনে করা হয় সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্যই অর্থনৈতিক সাম্যকে প্রতিষ্ঠা করবে।
[5] সমাজতান্ত্রিক সমাজে সাম্য: সমাজতান্ত্রিক সমাজে সাম্যের ধারণা ঠিক ধনতান্ত্রিক সমাজের বিপরীত। এখানে মনে করা হয় যে, অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলেই সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। একারণে এরূপ সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। এরূপ সমাজে মনে করা হয় যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তিই হল যাবতীয় বৈষম্যের মূল কারণ। কাজেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান ঘটিয়ে সম্পত্তির সামাজিক মালিকানা গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানের মাধ্যমে এক শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। ফলে ওই সমাজে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটবে এবং সকলের জন্য সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হবে।
মন্তব্য: সাম্য প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি সম্পর্কে উদারনীতিবাদী ও সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। উদারনীতিবাদীদের বিশ্বাস হল সমাজে সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলেই সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে, সমাজতন্ত্রীদের বিশ্বাস হল অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া অন্যান্য সাম্য অর্থহীন।
আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর