বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ - মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা

"বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি 
দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী 
মানুষের কত কীর্তি, গিরি, সিন্ধু, মরু 
কত-না অজানা জীব কত-না অপরিচিত তরু র
য়ে গেল অগোচরে"-

বিপুলা এ পৃথিবীর বুকে কত গিরি, সিন্ধু, মরু, কত অজানা জীব বিরাজ করছে আপন আপন বৈশিষ্ট্যে তা আমাদের অজানা। সভ্য মানুষের আধুনিক জীবন আর আরণ্যক জীবজন্তুর জীবনযাত্রার মধ্যে রয়েছে বিপুল পার্থক্য কিন্তু তারই মধ্যে আছে এক সুনিবিড় বন্ধন। সভ্যতার ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আঘাত এসেছে জীববৈচিত্র্যের ওপর। নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করে নির্মিত হয়েছে জনপদ, কত শত জীবজন্তু, পশুপাখি আশ্রয়হারা হয়েছে, কেউবা চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে, কখনো বা আধুনিক জীবনের সরণিতে এগিয়ে চলার জন্য, কখনও বা বন্ধাহীন শিকারে উন্মত্ত নেশায় নির্বিচারে হত্যা করা হয় জীবজন্তু ও পশুপাখিদের। আজ যখন একবিংশ শতাব্দীতে প্রকৃতি হয়েছে ধোঁয়ায় বিষাক্ত, প্রকৃতির বুকে বেঁচে থাকাটাই যখন সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তখন সবাই অনুভব করছে যে, নির্বিচারে বন্যপ্রাণী হত্যার ফলে আমরা সত্যিই ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি।

বন্যপ্রাণী হত্যার ভয়াবহ দিক

প্রাকৃতিক ভারসাম্য আজ পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়েছে অচেতন মানুষের বিবেকহীন বন্যপ্রাণী হত্যার কারণে। প্রকৃতির রাজ্যে বাস্তুতন্ত্র বা Ecosystem পুরোপুরি বিপন্ন হয়েছে বনভূমি ধ্বংস ও আরণ্যক প্রাণীদের হত্যার ফলে। কলকারখানা নির্মাণ ও শিল্পপ্রসারের জন্য বিপুল পরিমাণে বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে এবং তার ফলে জীবজগৎ এবং প্রকৃতিজগতের মধ্যে যে একটা জীববৈচিত্র্যের শৃঙ্খল আছে তা পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়েছে। অরণ্যের পশুপাখি ও জীবজন্তু একদিকে যেমন অরণ্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তেমনি অন্যদিকে এরা বাঁচিয়ে রেখেছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। কিন্তু মানুষ তার নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যথেচ্ছ পরিমাণে বন্যপ্রাণী নিধনের ফলে আজ প্রকৃতিরাজ্যে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা হাহাকার জাগায়।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ও তার প্রয়োজনীয়তা

বন্যপ্রাণীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রসংঘ একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও রূপরেখা নির্মাণ করে দিয়েছেন। বিভিন্ন দেশের পরিবেশবিজ্ঞানীরা সমবেতভাবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য এবং অভয়ারণ্য সৃষ্টির জন্য নানাবিধ নিয়মনীতি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। ভারতবর্ষে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে এবং সেই আইনে ৪১টি বৃহৎ প্রাণী, ১৮টি প্রজাতির পাখি এবং কয়েক রকমের উভচর প্রাণীর হত্যা পুরোপুরি নিষিদ্ধ ও আইনবিরোধী বলে ঘোষিত হয়েছে। এ ছাড়া, ১২০টি অভয়ারণ্য, ৫টি জাতীয় উদ্যান, ১৬টি ব্যাঘ্রপ্রকল্প, ২টি সিংহনিবাস নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অভয়ারণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল-পশ্চিমবঙ্গের জলদাপাড়া অভয়ারণ্য, তামিলনাড়ুর মধুমালাই, আসামের কাজিরাঙা, গুজরাটের গির, মণিপুরের ভাসমান অভয়ারণ্য প্রভৃতি। এ ছাড়াও, ভরতপুরের পক্ষীনিবাস, সজনেখালির পাখিরালয়, রায়গঞ্জের ফুলকি পাখিরালয়ে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বন্যপ্রাণী ও চোরাশিকারী

একদল অসাধু চোরাশিকারী আইনকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের হীন স্বার্থসিদ্ধির জন্য পাশবিক নির্মমতায় বন্যপ্রাণী হত্যা করে চলেছে এখনও। অনেকক্ষেত্রেই অনুভব করা যায়, এইসব চোরাশিকারীদের সলো বনদপ্তর কর্মচারীদের একটা গোপন বোঝাপড়া থাকে, সেই যোগ-সংযোগের কারণেই চোরাশিকারীর দল কখনও বন্য জীবজন্তুর মাংসের লোভে, কখনও চামড়া বা শিং-এর লোভে, কখনও দুর্মূল্য পাখির লোভে তারা এই কাজ সংগঠিত করে চলেছে। বনদপ্তর এবং সরকারের যৌথ উদ্যোগে কঠিন ও কঠোরতম শাস্তিবিধানের মাধ্যমেই এই নির্মম হত্যালীলা বন্ধ করা যেতে পারে। তবে একথাও মনে রাখা দরকার, জনগণের গভীর সচেতনতাবোধের জাগরণে বন্যপ্রাণীর যথাযথ সংরক্ষণ সম্ভব।

বন্যপ্রাণী ও পর্যটন

গহন অরণ্যের বুক চিরে ভেসে আসা বাঘের গর্জন বা সিংহের নিনাদের যে গাম্ভীর্য ও আকর্ষণ অথবা হ্রদের বুকে ভাসমান মোটরযানে বসে ডলফিনের জলে ডুব দেওয়া ও ওঠার অপরূপ দৃশ্য কিংবা বিজন অরণ্যের সুড়িপথে দ্রুত ধাবমান বিষধর সাপের এগিয়ে চলার শিহরিত দৃশ্য কী কখনও উপলব্ধি করা যায় চিড়িয়াখানার ভিতরে কিংবা কোনো সংরক্ষিত সর্পোদ্যানে। পশুপ্রেমী মানুষ প্রকৃতির বুকে আরণ্যক জীবজন্তুকে দেখতে ছুটে যায় কত অজানা ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে। পর্যটকদের তথা ভ্রমণপিপাসু মানুষের জন্যই পর্যটনশিল্প থেকে সরকারের আয়বৃদ্ধি অবশ্যই একটা ইতিবাচক দিক। এমনকি বিদেশি পর্যটকরা ভারতে এসে নানা বনাঞ্চলে পরিভ্রমণের ফলে বহু বৈদেশিক মুদ্রা জাতীয়-অর্থভাণ্ডারকে স্ফীত করে।

উপসংহার

“বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে”-

বন্যপ্রাণীর সৌন্দর্য আরণ্যক পরিবেশে। যেমনভাবে শিশু আলোকিত হয় মায়ের কোলে, সেকথা মনে রেখে আমরাও নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করতে পারি যেন বনের পশুপাখি, জীবজন্তুকে আশ্রয়হীন না করা হয়। শুধুমাত্র বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের বলে বন্যপ্রাণী হত্যার নৃশংসতা বন্ধ করা যায় না। মানুষের শুভবোধ এ-বিষয়ে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা নিতে পারে। পরিবেশবিজ্ঞানীদের পরামর্শ যথাযথ গ্রহণ করে, ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যের কথা ভাবলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। বিশ্বপিতার শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ যদি স্বহৃদয়ী ও নির্লোভী হয় তাহলেই বিশ্বপিতার দুনিয়াটা সুন্দর হবে।

আরও পড়ুন –

১। পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

২। পরিবেশ রক্ষায় অরণ্য – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

৩। পরিবেশ বনাম উন্নয়ন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

৪। বিশ্ব উষ্ণায়ন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment