গণতন্ত্রের সুবিধা ও অসুবিধাগুলি ব্যাখ্যা করো
গণতন্ত্রের সুবিধা
আধুনিক যুগ হল গণতন্ত্রের যুগ। নিম্নে কোন্ কোন্ যুক্তিতে গণতন্ত্রকে শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা বলা হয় তা আলোচনা করা হল-
[1] সাম্য ও স্বাধীনতা: গণতন্ত্রের প্রধান ও প্রথম গুণ হচ্ছে এই শাসনব্যবস্থা সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত। গণতন্ত্রে প্রত্যেক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সমমর্যাদাসম্পন্ন। সমমর্যাদার আদর্শ থেকেই সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার গণতন্ত্রের স্বীকৃত নীতি। গণতন্ত্র ব্যক্তির মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বের উপর গুরুত্ব দেয়। তাই ব্যক্তিস্বাধীনতা গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র।
[2] দায়িত্বশীলতা : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম সুবিধা হল শাসিতের কাছে শাসকের দায়িত্বশীলতা। সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রীপরিষদ জনপ্রতিনিধিদের কাছে তাদের কাজের জন্য দায়িত্বশীল থাকে এবং জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে।
[3] বিপ্লবের সম্ভাবনা কম: গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন করা যায়। কোনো বিশেষ দলীয় শাসন জনগণের পছন্দ না হলে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলীয় সরকার পরিবর্তন করা যায়, এর জন্য কোনো বিপ্লবের প্রয়োজন হয় না।
[4] রাজনৈতিক চেতনা ও দেশপ্রেম: নাগরিকদের রাজনৈতিক চেতনা উন্মেষের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের অবদান সর্বাপেক্ষা বেশি। সাধারণ নির্বাচন, উপনির্বাচন, রাজনৈতিক দলগুলির সভাসমিতি, সমাবেশ, পত্রপত্রিকায় জাতীয় সমস্যা সম্বন্ধে আলোচনা ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনসাধারণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করে।
[5] স্থায়িত্ব : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এই শাসনব্যবস্থার স্থায়িত্ব। জনগণের সম্মতি ও সহযোগিতার ভিত্তিতে এরূপ শাসনব্যবস্থায় সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়ভার গ্রহণ করে এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনই রাষ্ট্রের সরকারের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। ফলে জনগণের স্বার্থরক্ষা করতে পারলেই শাসনব্যবস্থার স্থায়িত্ব বজায় থাকে।
[6] জ্ঞানের প্রসার ঘটে: গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের জ্ঞান প্রসারিত হয়। প্রত্যেকের জ্ঞানের বিকশিত হওয়ার প্রক্রিয়াকেই গণতন্ত্র বলা যায়। ফ্যাগুয়ে বলেছেন, জনগণ কীভাবে, কী অনুভব করে, কী দুর্ভোগ ভোগ করে, কী আকাঙ্ক্ষা করে-এসবই জানার দরকার এবং জনগণের কাছ থেকেই তা জানতে হবে।
[7] ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা ও আত্মশক্তি অর্জনের সহায়ক: গণতন্ত্রকে সমর্থন করার কারণ হল এই শাসনব্যবস্থাতেই ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা ও আত্মশক্তিতে আস্থা গড়ে তোলা হয়।
[৪] রাজনৈতিক সার্বাভৗমত্বের বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব: জনগণই যে সমস্ত ক্ষমতার উৎস তা একমাত্র গণতন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তব রূপ পেতে পারে। কেন-না, জনগণ তাদের ইচ্ছামতো সরকার গঠন করতে পারে, ইচ্ছামতো ফ্যাগুয়ে সরকারের পরিবর্তন ঘটাতে পারে এবং সরকারকে তার কাজের জন্য দায়িত্বশীল রাখতে পারে অর্থাৎ রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব গণতন্ত্রেই বাস্তবায়িত হতে পারে।
গণতন্ত্রের অসুবিধা
তত্ত্বগতভাবে গণতন্ত্রের সপক্ষে যতই যুক্তি থাক-না-কেন, বাস্তবে তার প্রয়োগের মধ্যে, বিশেষ করে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে অনেক ত্রুটি দেখা যায়-
[1] গণতন্ত্র হল মুষ্টিমেয়র শাসন: গণতন্ত্রে ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে কয়েকজন মুষ্টিমেয় বাক্যবাগীশ নেতার হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। তাছাড়া শিক্ষিত জনগণ বা ভোটদাতারা যে বাক্যবাগীশ নেতাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে আত্মস্বার্থে ভুল নেতাদের নির্বাচন করবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
[2] অজ্ঞ ও অযোগ্যদের শাসন: আধুনিক পরোক্ষ গণতন্ত্রে জনসাধারণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে শাসনের দায়িত্বভার প্রতিনিধিদের উপর অর্পণ করে। কিন্তু যেহেতু তারা নিজেরাই অজ্ঞ ও মূর্খ, সেহেতু তারা তাদের মতো অযোগ্য ব্যক্তিদেরই প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করে। এ প্রসঙ্গে কার্লাইল ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, গণতন্ত্র হচ্ছে মূর্খদের জন্য, মূর্খদের দ্বারা, মূর্খদের শাসন।
[3] দলীয় ব্যবস্থার কুফল: আধুনিক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য। দলীয় স্বার্থেই শাসনকার্য পরিচালিত হয়। ক্ষমতা বজায় রাখা বা দখল করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঘুষ নেওয়া, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ বা গোষ্ঠীস্বার্থকে উৎসাহিত করে। এইভাবে দলীয় ব্যবস্থার কুফল গণতন্ত্রকে বিকৃত করে তোলে।
[4] জরুরি অবস্থায় অকার্যকর: অনেকে মনে করেন যে, জাতীয় জরুরি অবস্থায় সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কিন্তু গণতন্ত্রে সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত ও বিলম্বিত হয়।
[5] আদলাতন্ত্রের প্রাধান্য: শাসনক্ষমতা থাকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হাতে, যারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন। ফলে এদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা বিশেষ থাকে না। তাই তারা তাদের বিভাগীয় কাজকর্মের জন্য আমলাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
[6] অস্থায়ী ও রক্ষণশীল : গণতন্ত্রের ত্রুটি হচ্ছে এর স্থায়িত্বের অভাব ও রক্ষণশীলতা। গণতন্ত্র প্রধানত জনমতের উপর নির্ভরশীল। অতএব জনমতের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরকারেরও পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে সরকারের পক্ষে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কোনো দীর্ঘকালীন কর্মসূচি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের প্রাধান্য থাকায় গণতান্ত্রিক সরকার রক্ষণশীল হয়, কেন-না সাধারণ মানুষ কোনো বৈপ্লবিক প্রগতিশীল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চায় না।
[7] স্বৈরাচারিতা দেখা দিতে পারে: গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন করার ক্ষমতা স্বীকৃত। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার যে, সকলেরই স্বার্থে কাজ করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং ক্ষমতা লাভ করে, সংখ্যালঘিষ্ঠের স্বার্থ বা মতামতকে উপেক্ষা করাই তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন সুনিশ্চিত সেই কারণে শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে স্বৈরাচারী মনোভাব গড়ে উঠতে পারে। জন স্টুয়ার্ট মিলও সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারিতা (Majority tyranny) সম্বন্ধে আতঙ্কিত ছিলেন। বিশেষ করে যে দেশে জনসাধারণের একটা বড়ো অংশ অশিক্ষিত ও রাজনৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ নয়, সেই দেশে শাসকদল স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে।
[৪] সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশের অন্তরায় : সমালোচকরা মনে করেন যে, গণতন্ত্রে শিল্প, কলা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিশেষ বিকাশ লাভ হয় না। কারণ সাধারণ বিদ্যা-বুদ্ধিসম্পন্ন শাসকদের কাছে সংখ্যাই বড়ো, গুণ বড়ো নয়। যেহেতু তারা নিজেরা সাধারণ মানের, সেহেতু তারা অপরের গুণ বা প্রতিভাকে মর্যাদা দিতে পারে না ফলে গণতন্ত্র সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশের গতিকে মন্থর করে তোলে।
মূল্যায়ন: গণতন্ত্রের উপরোক্ত সুবিধা-অসুবিধা বা গুণ-ত্রুটি বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, কিছু ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্র অন্যান্য সাসনব্যবস্থার তুলনায় শ্রেষ্ঠতর শাসনব্যবস্থা। রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা উপেক্ষিত, তার মানসিক বিকাশের দ্বার রুদ্ধ। কিন্তু গণতন্ত্রে ব্যক্তি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত, স্বাধীন পরিবেশ সৃষ্টি করে তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথকে উন্মুক্ত করা হয়। এখানেই গণতন্ত্রের অবদান।
১। ব্যাপক ও সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? গণতন্ত্রের সর্বাধুনিক সংজ্ঞাগুলি আলোচনা করো
২। গণতন্ত্রের উদ্ভবের কারণগুলি ব্যাখ্যা করো
৩। গণতন্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো
৪। গণতন্ত্রের প্রকৃতি আলোচনা করো
৫। গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
৬। গণতন্ত্র কাকে বলে? এর বিভিন্ন রূপগুলি আলোচনা করো
৭। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝো? এইরূপ গণতন্ত্রের গুণ বা সুবিধাগুলি আলোচনা করো
৮। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের দোষ বা অসুবিধাগুলি আলোচনা করো
৯। প্রতিনিধিত্বমূলক বা পরোক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? এইরূপ গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
১০। পরোক্ষ গণতন্ত্রের সপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো
১১। পরোক্ষ গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো
১২। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
১৩। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র কাকে বলে? সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো