গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তগুলি কী কী
আধুনিক যুগে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হল এক আদর্শ শাসনব্যবস্থা। তবে গণতন্ত্র সর্বশ্রেষ্ঠ উদারনৈতিক রাষ্ট্রদর্শন বা রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও সকল সমাজব্যবস্থাতে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা সহজ ব্যাপার নয়। গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য একটি নির্দিষ্ট গণতান্ত্রিক পরিবেশের প্রয়োজন।
গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্ত
[1] সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা: রাষ্ট্রীয় কার্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনগণকে অংশগ্রহণ করতে হয়। এই দায়িত্ব পালন করতে হলে জনগণকে শিক্ষিত হতে হবে। অতএব অধিকার ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতনতা থাকা দরকার এবং তা সম্ভব একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমে। জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছেন, সর্বজনীন ভোটাধিকারের পূর্বে সর্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছেন যে, জনগণ শিক্ষিত না হলে সুচতুর রাজনীতিবিদরা তাদের ভ্রান্ত পথে চালিত করতে সক্ষম হবে। অতএব গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হচ্ছে সর্বজনীন শিক্ষার প্রবর্তন।
[2] পরমত সহিষ্ণুতা ও সংবাদপত্রের ভূমিকা: পরমত-সহিমুতাকে গণতন্ত্রের সাফল্যের একটি অপরিহার্য শর্ত বলে মনে করা হয়। গণতন্ত্রে সকলেরই নিজস্ব মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। এক্ষেত্রে সংবাদপত্রের একটা বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। সংবাদপত্র যদি বিত্তশালী শ্রেণির কুক্ষিগত হয় এবং সাধারণ মানুষের বা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মতামত নিরপেক্ষভাবে প্রকাশ না করে, তাহলে আইনগতভাবে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও বাস্তবে সেই স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।
[3] স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ: বিচার বিভাগ যদি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ না হয় তাহলেও গণতন্ত্রে জনগণ সঠিক বিচার পাবে না। তাই গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ থাকাটা জরুরি বলে মনে করা হয়।
[4] লিখিত সংবিধান: কিছু কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন যে, গণতন্ত্রকে সফল করতে হলে একটি লিখিত সংবিধান থাকা উচিত, কেন-না সংবিধানে লিখিতভাবে সরকারের ক্ষমতা নির্দিষ্ট থাকলে সরকার স্বেচ্ছামূলকভাবে কোনো কাজ করতে পারে না।
[5] ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ: ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ গণতন্ত্রের অন্তরায়স্বরূপ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাই মনে করেন যে, গণতন্ত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। কেন্দ্র থেকে শুরু করে স্থানীয় অঞ্চল পর্যন্ত ক্ষমতা বণ্টন করলে জনসাধারণ রাজনৈতিক কাজে ব্যাপকভাবে লিপ্ত হতে পারে এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে জনগণের রাজনৈতিক চেতনাও বৃদ্ধি পেতে পারে।
[6] অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা: অধ্যাপক ল্যাস্কি-র মতে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলি স্বীকৃত হলে গণতন্ত্রের সাফল্য আসে না, তার জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র মূল্যহীন। যে সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য বিদ্যমান, যেখানে দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির নিয়ন্ত্রণাধীন সেখানে জনগণ কখনও সুষ্ঠুভাবে গণতান্ত্রিক জীবনযাপন করতে পারে না।
[7] দক্ষ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব: গণতন্ত্রের সাফল্যের ব্যাপারে নেতৃত্বের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। জনসাধারণ নানাভাবে সরকারি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাদের পরিচালনার দায়িত্ব থাকে নেতৃত্বের হাতে। অতএব নেতৃত্ব যদি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরিচালিত হয় অথবা তার নিজের বা পরিবারের বা দলের স্বার্থে শাসন পরিচালনা করে, তাহলে গণতন্ত্র সফল হতে পারবে না।
[৪] সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব: গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। এর ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করা কষ্টসাধ্য হয়। প্রতিনিধিত্ব না থাকার অর্থ ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হওয়া। এইজন্য মিল বলেছেন যে, গণতন্ত্রকে সার্থক করতে হলে সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করতে হবে।
[9] আমলাতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি: গণতন্ত্রে জাতীয় নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব জনপ্রতিনিধিদের হাতে, কিন্তু নীতি প্রয়োগ যদি যথার্থভাবে না হয়, তাহলে ন্যায্য নীতিও অর্থশূন্য হয়ে পড়বে। এই নীতি প্রয়োগের দায়িত্ব থাকে আমলাদের হাতে। অতএব আমলারা যদি সৎ, দক্ষ ও গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন না হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক সরকার জনস্বার্থে শাসন পরিচালনা করতে পারবে না। এই কারণেই আমলাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা ও জনমুখিতার উপর গণতন্ত্রের সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করে।
[10] জনমতের প্রাধান্য: গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে জনমত। সুষ্ঠু জনমত গড়ে তুলতে না পারলে এই শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। গণতন্ত্র যে সর্বসাধারণের মঙ্গলের জন্য পরিচালিত শাসন, এই মানসিকতা গড়ে তোলার প্রয়োজন। বেতার, চলচ্চিত্র, দূরদর্শন, শিক্ষায়তন ও আইনসভার মাধ্যমে নিরন্তর জনগণকে রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি সম্বন্ধে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার দরকার। কেন-না রাজনৈতিকভাবে সচেতন মানুষই সঠিক জনমত গড়ে তুলে গণতান্ত্রিক শাসনকে কায়েম রাখতে পারে।
[11] বিরোধী দলের অস্তিত্ব: গণতন্ত্রে বিরোধী দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে সরকার সতর্ক থাকে যে, তার ত্রুটিবিচ্যুতি জনসমক্ষে তুলে ধরে জনমানসে তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা সম্ভব হবে। কোনো সরকারি দলই চাইবে না এমন কিছু করতে যাতে তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু বিরোধী দলের অবর্তমানে বা বিরোধী দল দুর্বল হলে সরকারি দলের মধ্যে স্বৈরাচারী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ছাড়া গণতন্ত্রকে সফল করা যায় না। গণতান্ত্রিক সমাজ বলতে এমন একটি সমাজকে বোঝায়, যেখানে পারস্পরিক আলোচনা, স্বাধীনভাবে মতামত বিনিময়, বৈষম্যের অনুপস্থিতি ও দায়িত্বশীলতার উপাদান উপস্থিত থাকে।
আরও পড়ুন –
১। ব্যাপক ও সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? গণতন্ত্রের সর্বাধুনিক সংজ্ঞাগুলি আলোচনা করো
২। গণতন্ত্রের উদ্ভবের কারণগুলি ব্যাখ্যা করো
৩। গণতন্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো
৪। গণতন্ত্রের প্রকৃতি আলোচনা করো
৫। গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
৬। গণতন্ত্র কাকে বলে? এর বিভিন্ন রূপগুলি আলোচনা করো
৭। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝো? এইরূপ গণতন্ত্রের গুণ বা সুবিধাগুলি আলোচনা করো
৮। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের দোষ বা অসুবিধাগুলি আলোচনা করো
৯। প্রতিনিধিত্বমূলক বা পরোক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? এইরূপ গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
১০। পরোক্ষ গণতন্ত্রের সপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো
১১। পরোক্ষ গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো
১২। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
১৩। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র কাকে বলে? সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
১৪। গণতন্ত্রের সুবিধা ও অসুবিধাগুলি ব্যাখ্যা করো