গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো

গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো

গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো
গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো

গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তিসমূহ

অন্যদিকে, ফ্যাগুয়ে, লেকি, নিৎসে, হল, কার্লাইল, হেনরি মেইন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে গণতন্ত্রকে তীব্র সমালোচনা করেছেন। গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তিসমূহ নিম্নরূপ-

[1] নৈতিকতার অবনতি ঘটায়: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নৈতিকতার অবনতি ঘটায় বলে সমালোচকরা মনে করেন। তাঁদের মতে, গণতন্ত্রে যেহেতু জনগণ অজ্ঞ ও অশিক্ষিত থাকে, তাই ধূর্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এর সুযোগ নিয়ে শাসনক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে নিজেদের কাজে লাগায়। এর ফলে নির্বাচনের সময় বলপূর্বক বুথ দখল, উৎকোচ গ্রহণ ও প্রদান, কারচুপি ইত্যাদি দেখা যায়। এতে গণতন্ত্র নেহাতই তত্ত্বকথায় পরিণত হয় এবং নৈতিকতার দিক থেকে রাষ্ট্রের মান হ্রাস পেতে শুরু করে।

[2] গুণের তুলনায় সংখ্যার উপর গুরুত্ব: গণতন্ত্র মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ এর শাসন। সমালোচকরা বলেন, এখানে গুণের তুলনায় সংখ্যার প্রাধান্য স্বীকৃত হয়। উৎকর্ষতার কোনো মূল্য গণতন্ত্রে পাওয়া যায় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ অজ্ঞ জনগণ নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলির কূটকৌশলে পড়ে গুণী ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে অযোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচিত করতে বাধ্য হয়।

[3] ব্যয়বহুল: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমালোচকরা একটি ব্যয়বহুল ব্যবস্থা বলে অভিহিত করেন। গণতন্ত্রে দেশের সাধারণ নির্বাচনগুলিতে সরকারকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থের ব্যবস্থা করতে হয়, তা অনেকসময় অপচয়ের নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া জনমত গঠন ও নির্বাচনের প্রাক্কালে দলীয় প্রচারের কাজে রাজনৈতিক দলগুলি প্রচুর অর্থের অপচয় করে।

[4] সংখ্যালঘু শ্রেণির স্বার্থ উপেক্ষিত: গণতন্ত্র মানেই সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, তাই সংখ্যালঘুরা এখানে উপেক্ষিত হন। আইনসভায় সংখ্যালঘুরা তাঁদের প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রতিনিধি পাঠাতে পারেন না, এর ফলে সংখ্যালঘু শ্রেণি নিজেদের স্বার্থরক্ষা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। সংখ্যালঘু শ্রেণির সমস্যা, অভিযোগ সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য কোনো প্রতিনিধি না থাকায় তারা তাদের স্বার্থের অনুকূলে সরকারি নীতি নির্ধারণ বা সিদ্ধান্তগ্রহণকে পরিচালনা করতে সক্ষম হন না।

[5] জীববিজ্ঞানীদের সমালোচনা: জীববিজ্ঞানীরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করেন। প্রেস্কট হল এবং অ্যালেন আয়ার্ল্যান্ড-এর মতো জীববিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রে ‘সব মানুষ সমান’ এই তত্ত্বকে সত্যের অপলাপ বলে আখ্যা দেন। তাঁদের মতে, জন্মগতভাবে মানুষে মানুষে গুণগত পার্থক্য রয়েছে, যা গণতান্ত্রিক মতাদর্শে স্বীকৃত হয় না।

[6] সততা ও যোগ্যতার স্থান নেই: গণতন্ত্রে সততা ও যোগ্যতার কোনো মূল্য দেওয়া হয় না বলে অনেক সমালোচকরা মনে করেন। বস্তুতপক্ষে, দলীয় রাজনীতির স্বার্থসিদ্ধ সংকীর্ণ চেহারা দেখে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা নির্বাচনের রাজনৈতিক আসরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান না। অনেকসময় আবার দলীয় প্রথার কুফলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীরা নির্বাচনে নেমেও পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হন। ফলে সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

[7] নিম্নস্তরের নেতৃত্ব: গণতন্ত্রে অযোগ্য নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করায়, গণতন্ত্রের মানও নিম্ন হয়ে যায় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন। নির্বাচনের মধ্য দিয়েই এঁনারা নির্বাচিত হন বলে সমালোচকরা দাবি করেছেন। তাই তারা গণতান্ত্রিক নেতৃত্বকে অতীতের তুলনায় অনেক বেশি নিম্নমানের বলে প্রতিপন্ন করতে ইচ্ছুক।

[8] মনোস্তাত্ত্বিক মতবাদ : মনোস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাক্সি জনসাধারণকে পশুর মতো মানসিকতাসম্পন্ন বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, মানুষ ক্ষমতালোভী, স্বার্থপর, ন্যায়নীতিহীন নিকৃষ্ট মানসিকতাবিশিষ্ট, আবার অনেক ক্ষেত্রে আবেগতাড়িত। মানুষ উত্তেজনা, আবেগের বশবর্তী হয়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তাই জনগণের শাসন এই গণতন্ত্র একসময় দায়িত্বজ্ঞানহীন, আবেগতাড়িত, যুক্তিহীন শাসনে পরিণত হয়, যা কখনই আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য কাম্য নয়।

[9] পুঁজিবাদের সমর্থক: অনেকে মনে করেন, পুঁজিবাদ গণতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেয়। কারণ তারা মনে করেন, গণতন্ত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্যকে কিছু ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বীকৃতি প্রদান করা হলেও, অর্থনৈতিক সাম্যকে কখনোই স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। কিন্তু একথা সত্য যে, অর্থনৈতিক সাম্য সমাজে প্রতিষ্ঠা করা না গেলে অপর দুই সাম্যের উপস্থিতি অর্থহীন হয়ে পড়ে। বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে পুঁজি কুক্ষিগত থাকায় তারা নিজেদের স্বার্থে শাসনতন্ত্রকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। অনেকসময় নেতৃবর্গ জনগণের পরিবর্তে ধনীশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য নিজেদের প্রশাসনিক ক্ষমতাকে কাজে লাগায়। ফলে গণতন্ত্র ‘ধনিক- বণিকতন্ত্রে’-র শাসনে পরিণত হয়।

উপসংহার: বহু বিরুদ্ধ সমালোচনা সত্ত্বেও এটা বলা যায় যে, আজও গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্র মূর্খের শাসন নয়। বিচ্যুতি সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজও বিশ্বের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা। আবার, লর্ড ব্রাইস-এর মতানুসারে, গণতন্ত্র বিশ্বসমাজে সৌভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করতে, শিক্ষিত জনসমাজকে সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপে অন্তর্ভুক্ত করতে, কিংবা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করতে না পারলেও গণতন্ত্র নিজেকে অতীতের শাসনতন্ত্রগুলির তুলনায় যথেষ্ট ভিত্তিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্নস-ও অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন। তথাপি উপরোক্ত ভুল-ত্রুটিগুলিকে সংশোধন করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে সাদরে গ্রহণ করে নেওয়াই শ্রেয় বলে রাষ্ট্রবিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন।

আরও পড়ুন –

১। ব্যাপক ও সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? গণতন্ত্রের সর্বাধুনিক সংজ্ঞাগুলি আলোচনা করো

২। গণতন্ত্রের উদ্ভবের কারণগুলি ব্যাখ্যা করো

৩। গণতন্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো

৪। গণতন্ত্রের প্রকৃতি আলোচনা করো

৫। গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো

৬। গণতন্ত্র কাকে বলে? এর বিভিন্ন রূপগুলি আলোচনা করো

৭। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝো? এইরূপ গণতন্ত্রের গুণ বা সুবিধাগুলি আলোচনা করো

৮। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের দোষ বা অসুবিধাগুলি আলোচনা করো

৯। প্রতিনিধিত্বমূলক বা পরোক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? এইরূপ গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো

১০। পরোক্ষ গণতন্ত্রের সপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো

১১। পরোক্ষ গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো

১২। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো

১৩। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র কাকে বলে? সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো

১৪। গণতন্ত্রের সুবিধা ও অসুবিধাগুলি ব্যাখ্যা করো

১৫। গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করো

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment