আগুন নাটকের প্রেক্ষাপট
উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকেই ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে জাগরণ দেখা দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদ প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। ইটালির মুসোলিনি, জার্মানির হিটলার, জাপান, স্পেন ক্রমশ আঘাত হানতে থাকে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির উপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হতে থাকে।
ইতিমধ্যে ১৯১৭ সালে রাশিয়ার শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচারী জারতন্ত্রের অবসান হয় এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ঘটনা শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মনে আশা জাগায়। বহির্বিশ্বের ফ্যাসিবিরোধী মনোভাবের অভিঘাত এসে পড়ে ভারতের সমাজ-রাজনীতি- সাহিত্যসংস্কৃতিতে। আমরা জানি, জাপান এইসময় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভারত-বর্মা সীমান্তে ছিল বিপুল শস্যভাণ্ডার, তা পাছে জাপানের হাতে চলে যায়-সেই আশঙ্কায় পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে সমস্ত ধান পুড়িয়ে ফেলা হয়। ফলে, অন্নাভাব এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
এই মন্বন্তরের হাত ধরেই আসে মহামারি। এ ছাড়াও ১৯৪২ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা সাইক্লোন এবং জলোচ্ছ্বাস হয়। এরূপ সংকটকালে সুযোগের অপব্যবহার করে কিছু আড়তদার, মজুতদার, চোরাকারবারি গজিয়ে ওঠে। গোটা সমাজ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার রন্দ্রে রন্দ্রে ছড়িয়ে পড়ে দুর্নীতি। কালোবাজারি, মন্বন্তর ও যুদ্ধের ফলে খাদ্যসংকট তৈরি হয়। শ্রমিক-কৃষক- মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রবল দুর্দশার ফলে মানুষের জোটবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়।
এইরকম পরিস্থিতিতে ১৯৪২ সালে গঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ‘ফ্যাসিবিরোধী লেখক-শিল্পী সংঘ’ এবং ‘প্রগতি লেখক সংঘ’। ১৯৪৩ সালে মুম্বাইতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’। কলকাতা- সহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে তার শাখা সংগঠন।
গণনাট্য সংঘের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিজন ভট্টাচার্য প্রথম থেকেই ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর ‘আগুন’ (১৯৪৩) নাটকটির অভিনয়ের মধ্য দিয়েই গণনাট্য সংঘের যাত্রা শুরু হয়। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, সংক্ষেপে আইপিটিএ (IPTA) ১৯৪৩ সালের মে মাসে ‘নাট্যভারতী’ (গ্রেস সিনেমা হল, কলেজ স্ট্রিট) রঙ্গালয়ে ‘আগুন’ নাটকটি মঞ্চস্থ করে।
আরও পড়ুন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা