একাদশ শ্রেণি দর্শন পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা পর্ব ২

সূচিপত্র

একাদশ শ্রেণি দর্শন পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা পর্ব ২

একাদশ শ্রেণি দর্শন পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা পর্ব ২

ম্যাকেঞ্জি ও মুরহেডের নীতিবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দুটি কী?

নীতিবিজ্ঞানের সংজ্ঞা

নীতিবিজ্ঞান সামাজিক মানুষের আচার-আচরণকে নৈতিকতার নিরিখে বিচারবিশ্লেষণ করলেও, বিভিন্ন নীতিবিজ্ঞানী এর বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।

ম্যাকেঞ্জির সংজ্ঞা: অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জি (JSMackenzie) তাঁর ‘A Manual of Ethics’ নামক গ্রন্থে নীতিবিজ্ঞানকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, তা হল-‘নীতিবিজ্ঞান হল আচরণের ভালো অথবা মঙ্গল সম্পর্কীয় আলোচনা’ (Ethics may be defined as the study of what is right or good in conduct-J. S. Mackenzie: A Manual of Ethics, P-1)। ম্যাকেঞ্জির এই সংজ্ঞাটি থেকে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, নীতিবিজ্ঞানের মূল কাজ হল মানুষের আচরণের নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা করা এবং সেই সমস্ত কাজকে ভালো-মন্দের নিরিখে বিচার করা। অর্থাৎ বলা যায় যে, ভালো-মন্দই হল মানুষের আচরণের নৈতিক বিচারের একমাত্র মানদণ্ড। সেকারণেই নীতিবিজ্ঞানকে মানুষের আচরণের আদর্শ সম্পর্কিত বিজ্ঞান বা আলোচনা বলা হয়।

মুরহেডের সংজ্ঞা: ম্যাকেঞ্জিকে অনুসরণ করে নীতিবিজ্ঞানী মুরহেড (Muirhead) নীতিবিজ্ঞানকে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করেন যে, নীতিবিজ্ঞান হল মানুষের আচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত সর্বোত্তম আদর্শের আলোচনা। এই সর্বোত্তম আদর্শের নিরিখেই মানুষের আচরণের যথাযথ মূল্যায়ন করাই হল নীতিবিজ্ঞানের মূল কাজ। মুরহেডের সংজ্ঞাটিতেও তাই আদর্শের নিরিখে আচরণের মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই দুটি সংজ্ঞার মধ্যে একটা ফাঁক থেকে গেছে। কারণ এখানে কোন্ মানুষের আচরণের কথা বলা হয়েছে এবং কোন্ ধরনের আচরণের কথা বলা হয়েছে, তা পরিষ্কার করে উল্লেখ করা হয়নি।

তা ছাড়াও উল্লেখ করা যায় যে, মুরহেড যে সর্বোত্তম আদর্শের কথা বলেছেন এবং তারই আলোকে মানুষের আচরণের বিচার করার কথা বলেছেন, সে-বিষয়টিও কিন্তু আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ সর্বোত্তম আদর্শটি যে ঠিক, তা মুরহেড স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননি। সেকারণেই বলা যায় যে, ম্যাকেঞ্জি ও মুরহেডের সংজ্ঞাদুটিকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু অসুবিধা দেখা যায়। মাকেঞ্জি ও মুরহেডের সংজ্ঞা দুটির গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্ন দেখা যায়।

নীতিবিজ্ঞান কাকে বলে? এ প্রসঙ্গে লিলির সংজ্ঞাটি উল্লেখ করো।

নীতিবিজ্ঞান

নীতিবিজ্ঞান-এর শব্দগত বিশ্লেষণটিকে এভাবেই উল্লেখ করা যায় যে, নীতি (ঔচিত্য বিষয়ক) + বিজ্ঞান (বিশেষভাবে জ্ঞান) = নীতিবিজ্ঞান। অর্থাৎ বলা যায়, যে বিজ্ঞানে ঔচিত্য তথা নৈতিকতা সম্পর্কিত বিষয়ের আলোচনা করা হয়, তাকেই বলা হয় নীতিবিজ্ঞান। নীতিবিজ্ঞানের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ‘Ethics’। এই ‘Ethics’ শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে গ্রিক ‘Ethica’ শব্দটি থেকে, যা আবার গ্রিক ‘Ethos’ শব্দ থেকে নিঃসৃত। এই Ethos শব্দের অর্থ হল- ‘অভ্যাস’, ‘রীতিনীতি’, ‘আচার-আচরণ’ ইত্যাদি। সুতরাং শব্দতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও ব্যুৎপত্তিগত অর্থে বলা যায় যে, নীতিবিজ্ঞান হল এমনই এক বিজ্ঞান যা মানুষের আচার-আচরণ, রীতিনীতি ও অভ্যাস প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে।

উইলিয়াম লিলির সংজ্ঞা

নীতিবিজ্ঞানের সর্বাপেক্ষা সন্তোষজনক ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন অধ্যাপক উইলিয়াম লিলি (William Lillie)। তিনি তাঁর ‘An Introduction to Ethics’ নামক গ্রন্থে নীতিবিজ্ঞানকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, তা হল-নীতিবিজ্ঞান সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচার-আচরণ সম্বন্ধীয় একপ্রকার আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান, যা মানুষের আচরণকে ঠিক অথবা বেঠিক, ভালো অথবা মন্দ, অথবা অন্য কোনো মাপকাঠির নিরিখে বিচার করে (“We may define Ethics as the Normative science of conduct of human beings living in Societies-which judges their conducts to be right or wrong, to be good or bad, or in some similar ways.” -William Lillie: An Introduction to Ethics, pp.1-2)। উইলিয়াম লিলি প্রদত্ত নীতিবিজ্ঞানের এরূপ সংজ্ঞাটিকেই নীতিবিজ্ঞানের সর্বোৎকৃষ্ট সংজ্ঞারূপে বিবেচনা করা হয়। তাঁর এই সংজ্ঞাটিকে বিশ্লেষণ করলেই নীতিবিজ্ঞানের কতকগুলি স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে।

নীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক কী?

নীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক

নীতিবিজ্ঞান হল সামাজিক মানুষের আচার-আচরণ সম্পর্কিত আলোচনা। অর্থাৎ, সামাজিক মানুষের আচার-আচরণ যেমন হওয়া উচিত সে-সম্পর্কেই আলোচনা করে নীতিবিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞানও (Sociology) মানুষের সামাজিক বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করে। অর্থাৎ সমাজের উৎস, প্রকৃতি, সামাজিক রীতিনীতির উৎপত্তি, সামাজিক বিকাশ, বিভিন্নরকম প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সমাজবিজ্ঞান। আর এই সমস্ত বিষয়ের ঔচিত্যমূলক আলোচনা করে নীতিবিজ্ঞান। সুতরাং, নীতিবিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানের যে একপ্রকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে তা অস্বীকার করা যায় না।

নীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান, উভয়েই সামাজিক বিজ্ঞানরূপে গণ্য। এই দুটি বিষয়ের আলোচনা তাই সমাজ ছাড়া সম্ভব নয়। সমাজ এবং সামাজিক মানুষের ওপর ভিত্তি করেই এই দুটি বিভাগ গড়ে উঠেছে। সামাজিক মানুষের আচরণের বিষয়গুলি তাই এই দুটি বিষয়েই আলোচিত হয়েছে। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, নীতিবিজ্ঞানে মানুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, তার আলোচনা করা হয়। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানে মানুষের আচরণ, সমাজের আচরণ, গোষ্ঠীর আচরণ প্রভৃতিও আলোচনার বিষয়রূপে গণ্য হয়েছে।

আদিম সমাজব্যবস্থা থেকে কীভাবে ধাপে ধাপে মানুষ আজ এই প্রগতিশীল আধুনিক সমাজের দিকে অগ্রসর হয়েছে, সেই সমস্ত ক্রমোন্নয়নের বিষয়গুলি সমাজবিজ্ঞানে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়। আবার ব্যক্তির কল্যাণ, সমাজের কল্যাণ, রাষ্ট্রের কল্যাণ প্রভৃতি নিয়ে নীতিবিজ্ঞান যেমন আলোচনা করে, তেমনই সমাজবিজ্ঞানও এই সমস্ত বিষয়ে আলোচনা করে। অর্থাৎ বলা যায় যে, সমাজের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের আলোচনা নীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান উভয়ের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই উল্লেখ করা যায় যে, এই দুটি সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে একপ্রকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

আরও পড়ুন – একাদশ শ্রেণি দর্শন পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা

উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় ঐচ্ছিক ক্রিয়ার কোন্ স্তরের অন্তর্ভুক্ত?

নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু হিসেবে একমাত্র ঐচ্ছিক কর্মকেই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে নীতিবিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো মতভেদই নেই। কিন্তু এই ঐচ্ছিক তথা স্বেচ্ছাকৃত কর্মের আবার তিনটি স্তর দেখা যায়। এই তিনটি স্তর হল-মানসিক স্তর, দৈহিক স্তর এবং বাহ্য ফলাফল তথা পরিণাম স্তর। এই তিনটি স্তরের মধ্যে মানসিক স্তর এবং বাহ্য ফলাফলের স্তর নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু হতে পারে না। এ বিষয়টিতে নীতিবিজ্ঞানীরা সম্মতি পোষণ করেন। মানসিক স্তরের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নীতিবিজ্ঞানীরা আবার উদ্দেশ্য (Motive) এবং অভিপ্রায় (Intention)-এই দুটি মানসিক বৃত্তির কথা উল্লেখ করেছেন। আর পরিণাম স্তরের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ফলাফল-এর বিষয়টিকেও টেনে এনেছেন। সুতরাং, বলা যায় যে ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মানসিক স্তর এবং পরিণাম স্তরের পরিপ্রেক্ষিতে নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু হিসেবে তিনটি বিষয় উঠে আসে। এই তিনটি বিষয় হল-

[1] নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তুতে ‘উদ্দেশ্য’

[2] নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তুতে ‘অভিপ্রায়’ এবং

[3] নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তুতে ‘ফলাফল।

এখন এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে কোন্টি নৈতিক বিচারের প্রকৃত বিষয়, তা আমাদের জানা উচিত। সেকারণেই এই তিনটি বিষয় তথা উদ্দেশ্য, অভিপ্রায় এবং ফলাফলকে নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন।

উদ্দেশ্য সম্পর্কে ম্যাকেঞ্জি ও লিলি-র সংজ্ঞা দুটি উল্লেখ করো।

ম্যাকেঞ্জির মতে উদ্দেশ্য

অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জি তাঁর ‘A Manual of Ethics’ নামক গ্রন্থে উদ্দেশ্য পদটির দ্বিবিধ অর্থ উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, উদ্দেশ্য হল সেই অনুভূতি যা আমাদেরকে কর্মে প্রেরণা দেয়, অথবা বলা যায় যে, সেই লক্ষ্য যা নির্দিষ্টভাবে আমাদেরকে কর্মে প্রবৃত্ত করে (A motive may be understood to mean either that which emplies or that which induces us to act in a Particular way-P-64)।

ম্যাকেঞ্জির এই সংজ্ঞাটিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা উদ্দেশ্যর দুটি অর্থ পাই। প্রথমত, যে-কোনো ধরনের এক অনুভূতি যা আমাদেরকে কর্মে প্রবৃত্ত করে, তা-ই হল উদ্দেশ্য। দ্বিতীয়ত, লক্ষ্য বা কাম্যবস্তুর ধারণা, যা আমাদেরকে কর্মে নিয়োজিত করে, তা-ই হল উদ্দেশ্য।

লিলির মতে উদ্দেশ্য

নীতিবিজ্ঞানী লিলি মনে করেন যে, উদ্দেশ্য পদটির পরিপূর্ণ অর্থটিকে চয়ন করতে গেলে উদ্দেশ্য-র এই দ্বিবিধ অর্থকেই গ্রহণ করতে হয়। এই দ্বিবিধ অর্থের কোনোটিকেই তাই বর্জন করা যায় না। তিনি তাই বলেন-অনুভূতি এবং কাম্যবস্তুর ধারণা উভয়ই হল উদ্দেশ্যর অর্থ। অধ্যাপক লিলি উদ্দেশ্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তাই বলেছেন-‘উদ্দেশ্য হল একপ্রকারের সচেতন মানসিক প্রক্রিয়া যা ব্যক্তিকে বিশেষ কোনো কর্ম করতে প্রবৃত্ত করে অথবা চালিত করে।’ (A motive may be defined as a conscious mental process which moves a man to act in a particular way “An Introduction to Ethics” William Lillie, P-29)

অভিপ্রায়ের ধারণাটি কী?

অভিপ্রায়ের ধারণা

আমরা সাধারণত উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায়-এই শব্দদুটিকে একই অর্থে প্রয়োগ করে থাকি। কিন্তু নীতিবিজ্ঞানীরা এই দুটি শব্দকে কখনোই একই অর্থে প্রয়োগ করার পক্ষপাতী নন। সেই কারণেই নীতিবিজ্ঞানে এই শব্দদুটির অর্থ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। কারণ, উদ্দেশ্য বলতে যা বোঝানো হয়েছে, অভিপ্রায় বলতে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছুকেই নির্দেশ করা হয়েছে। নীতিবিজ্ঞানে উদ্দেশ্য বলতে শুধু কোনো কাম্যবস্তু বা লক্ষ্যবস্তুর ধারণাকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু অভিপ্রায় বলতে কাম্যবস্তুর ধারণা ছাড়াও আরও কিছুকে বোঝানো হয়েছে। নীতিবিজ্ঞানে অভিপ্রায় বলতে তাই বোঝানো হয়েছে-[1] কোনো কাম্য বা লক্ষ্যবস্তু-র ধারণা, [2] সেই কাম্য বা লক্ষ্যবস্তু লাভের উপায়, এবং [3] কাম্য বা লক্ষ্যবস্তু লাভের ফলাফল। স্বাভাবিকভাবেই তাই দেখা যায় যে, উদ্দেশ্য অপেক্ষা অভিপ্রায়ের অর্থটি অনেক ব্যাপক। অর্থাৎ, উদ্দেশ্য = কাম্যবস্তু বা লক্ষ্যবস্তুর ধারণা

অভিপ্রায় = কাম্যবস্তুর ধারণা + কাম্যবস্তু লাভের উপায় + কাম্যবস্তু লাভের ফলাফল

অভিপ্রায়ের ধারণাটি যে উদ্দেশ্যের ধারণা অপেক্ষা অনেক ব্যাপক, তা একটি সহজ উদাহরণের মাধ্যমে ম্যাকেঞ্জি বোঝাতে চেয়েছেন। ধরা যাক, কোনো সমাজসংস্কারক কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের যখন পরিবর্তন চান, তখন তার মূল উদ্দেশ্য হল আংশিকভাবে সমাজ পরিবর্তন এবং আংশিকভাবে আত্মযশ প্রতিষ্ঠা। তাঁর এই উদ্দেশ্যকে ফলপ্রসূ করার জন্য শান্তির পথ, হিংসার পথ যে- কোনো পথই অনুসরণ করা হতে পারে। যে পথই অনুসরণ করা হোক না কেন, সমাজসংস্কারের কারণে সমাজে একটি ভালো অথবা মন্দের পরিণাম তথা এর ফলাফলের দিক অবশ্যই দেখা যায়। এই সমস্ত বিষয়গুলিই কিন্তু অভিপ্রায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।

আবশ্যিক ক্রিয়া কীভাবে অনৈতিকরূপে গণ্য?

আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে-সমস্ত ক্রিয়া সম্পাদন করি, তাদের মধ্যে কিছু ক্রিয়া হল বাধ্যতামূলক বা আবশ্যিক। এই ধরনের ক্রিয়াগুলিকে আমরা আমাদের ইচ্ছা ব্যতিরেকে করতে বাধ্য হই। অর্থাৎ, এই সমস্ত ক্রিয়াগুলিকে সম্পাদন না করে, আমরা পারি না। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, ক্ষুধার সময় খাদ্যগ্রহণ করা, তৃয়ার সময় জলপান করা, নিশ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াদি সম্পন্ন করা, উদ্দীপকের প্রতি প্রতিক্রিয়া করা, তীব্র আলোয় চোখ বন্ধ করা, উয় স্পর্শে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সরিয়ে নেওয়া প্রভৃতি হল আবশ্যিক বা বাধ্যতামূলক ক্রিয়া।

কারণ, এই ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলি সম্পাদন না করে, আমরা পারি না। ঠিক অথবা বেঠিক, উচিত তথা অনুচিত, যথার্থ অথবা অযথার্থ, ন্যায় অথবা অন্যায়-এরূপ নৈতিক মাপকাঠিগুলির নিরিখে এগুলিকে বিচার করা যায় না। এই ধরনের ক্রিয়াগুলিকে তাই নৈতিক ক্রিয়া (Moral Actions)-রূপে গণ্য না করে, অনৈতিক ক্রিয়া (Nonmoral Actions) রূপেই গণ্য করা হয়।

ঐচ্ছিক ক্রিয়া কীভাবে নৈতিক ক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত?

নৈতিক ক্রিয়ারূপে ঐচ্ছিক ক্রিয়া

বাধ্যতামূলক তথা আবশ্যিক ক্রিয়া ছাড়া মানুষের মধ্যে আর যে ধরনের ক্রিয়া লক্ষ করা যায়, সেগুলিকেই বলা হয় স্বেচ্ছাধীন ক্রিয়া বা ঐচ্ছিক ক্রিয়া (Voluntary Action)। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বেশিরভাগ ক্রিয়াই হল ঐচ্ছিক বা স্বেচ্ছাধীন ক্রিয়া। যে-সমস্ত ক্রিয়াগুলিকে মানুষ তার স্বীয় ও স্বাধীন ইচ্ছায় সম্পাদন করে, সেগুলিকেই বলা হয় ঐচ্ছিক বা স্বেচ্ছাধীন ক্রিয়া। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, লেখাপড়া করা, খেলাধুলা করা, সংগীতচর্চা করা, গুরুজনদের প্রণাম করা, আত্মীয়দের কুশল কামনা করা, ছাত্রছাত্রীদের উপদেশ দেওয়া, মিত্রকে আলিঙ্গন করা, শত্রুকে ছুরি মারা, পরীক্ষার হলে নকল করা-এই ধরনের সমস্ত ক্রিয়াই হল ঐচ্ছিক ক্রিয়া।

কারণ, এই ধরনের ক্রিয়া আমরা আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সম্পাদন করে থাকি। নীতিবিজ্ঞানে একমাত্র এই ধরনের ক্রিয়ারই নৈতিক বিচার করা হয়। কারণ, এই ধরনের ক্রিয়াগুলিকে আমরা ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-বেঠিক, উচিত-অনুচিত প্রভৃতি মাপকাঠিগুলির নিরিখে বিচার করতে পারি। এই ধরনের ক্রিয়াগুলি মানুষ তার নিজের ইচ্ছায় সম্পাদন করে বলেই এগুলির নৈতিক দায়দায়িত্ব তার ওপরই বর্তায়। অর্থাৎ, এই ধরনের ক্রিয়ার জন্য ব্যক্তি নিজেই নৈতিকভাবে দায়ী থাকে। সেকারণেই মানুষের স্বেচ্ছাধীন ক্রিয়াগুলিকে নৈতিক ক্রিয়া (Moral Action)-র অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

নৈতিক ক্রিয়ার দুটি অর্থ কী?

নৈতিক ক্রিয়ার অর্থ

‘নৈতিক’ শব্দটিকে নীতিবিজ্ঞানে দুটি অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। এই দুটি অর্থের একটি হল এর সংকীর্ণ অর্থ এবং অপরটি হল এর ব্যাপকতম অর্থ। সংকীর্ণ অর্থে ‘নৈতিক’ শব্দটি শুধুমাত্র ভালো, ন্যায়, যথার্থ, ঠিক প্রভৃতি বিশেষণের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এদের বিপরীত বিশেষণগুলি যথা-মন্দ, অন্যায়, অযথার্থ, বেঠিক প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত নয়। কিন্তু ব্যাপকতম অর্থে ‘নৈতিক’ শব্দটির অর্থ হল- ভালো বা মন্দ, ন্যায় অথবা অন্যায়, ঠিক অথবা বেঠিক, যথার্থ অথবা অযথার্থ প্রভৃতি বিশেষযুক্ত।

অর্থাৎ বলা যায় যে, কোনো ক্রিয়া ভালো হলেও নৈতিক ক্রিয়ারূপে গণ্য হয়, আবার তা মন্দ হলেও নৈতিক ক্রিয়ারূপে গ্রাহ্য হয়। ভালো অথবা মন্দ যে-কোনো ভাবেই যদি কোনো ক্রিয়াকে বিশেষিত করা যায়, তাহলে সেই ক্রিয়াকেই বলা হয় নৈতিক ক্রিয়া (Moral Actions)। নীতিবিজ্ঞানে এরূপ ব্যাপকতম অর্থেই নৈতিক (Moral) শব্দটিকে গ্রহণ করা হয়েছে। ম্যাকেঞ্জি (Mackenzie), লিলি (Lillie) এবং ফ্রাঙ্কেনা (Frankena) প্রমুখ নীতিবিজ্ঞানীগণ এরূপ ব্যাপকতম অর্থেই ‘নৈতিক’ শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন।

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

2 thoughts on “একাদশ শ্রেণি দর্শন পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা পর্ব ২”

Leave a Comment