ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 11 দ্বিতীয় সেমিস্টার

সূচিপত্র

ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 11 দ্বিতীয় সেমিস্টার | Vaab Sommillon kobitar question Answer | Class Eleven 2nd Semester

ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর
ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর

১. “কি কহব রে সখি আনন্দ ওর।”-কে মন্তব্যটি করেছেন, ‘ওর’ শব্দের অর্থ কী? এই আনন্দের কারণ নিজের ভাষায় লেখো। ২+৩

উত্তর: বিদ্যাপতি রচিত ‘ভাব সম্মিলন’ পদে শ্রীরাধা উল্লিখিত মন্তব্যটি করেছেন। ‘ওর’ শব্দের অর্থ সীমা।

‘মাথুর’ বা বিরহ পর্যায়ে কৃষ্ণ-বিচ্ছেদের যন্ত্রণা রাধার মধ্যে তীব্রভাবে বেজেছিল-“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।”

কিন্তু ভাবসম্মিলনের পদে এই বিচ্ছেদ যন্ত্রণাকে অতিক্রম করে রাধা ভাবময় জগতে তাঁর মনের মধ্যেই কৃষ্ণকে উপলব্ধি করেছেন। প্রিয়তমের মুখদর্শনে তিনি সমস্ত দুঃখকে অতিক্রম করে গিয়েছেন এবং বলেছেন যে, যদি কেউ তাঁকে মহামূল্যবান রত্নসামগ্রীও দেয়, তবুও তিনি তাঁর প্রিয়তমকে দূরদেশে পাঠাবেন না। কৃষ্ণ-বিচ্ছেদের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে বিদ্যাপতির রাধার উত্তরণ ঘটেছে এক নবতর আনন্দময় জগতে। সেই সীমাহীন আনন্দের উপলব্ধির কথাই উল্লিখিত অংশে প্রকাশিত হয়েছে।

২. “পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।”-কে এ কথা বলেছেন, বক্তার মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো।

উত্তর: বিদ্যাপতি রচিত ‘ভাব সম্মিলন’ পদে শ্রীরাধা উল্লিখিত মন্তব্যটি করেছেন। ‘মাথুর’ বা প্রবাস পর্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে ছেড়ে মথুরায় গোপিনীদের কাছে চলে গিয়েছিলেন। কৃষ্ণ-বিচ্ছেদের তীব্র যন্ত্রণায় রাধা কাতর হয়ে পড়েন। চাঁদের দিকে তাকিয়ে তিনি কৃষ্ণের সৌন্দর্যকে উপলব্ধির চেষ্টা করেন। কিন্তু চাঁদের আলো তাঁর কষ্টকেই শুধু বাড়িয়ে দেয়। তার মধ্যে কৃয়কে তিনি কোনোভাবেই খুঁজে পান না। এই বিচ্ছেদ-যন্ত্রণার অবসান হয়, যখন ভাবসম্মিলনের পদে ভাবলোকে রাধা কৃষ্ণের সান্নিধ্য পান। ভাবময় জগতে প্রিয়তমের মুখদর্শন করে উচ্ছ্বসিত রাধিকা বিদ্যাপতির অনেক পদে বলে ওঠেন-

"সোই কোকিল অব  লাখ লাখ ডাকউ 
লাখ উদয় করু চন্দা।"

পঠিত পদেও দেখা যায় চাঁদের আলো রাধার মনের মধ্যে কৃষ্ণের বিভ্রম তৈরি করে যে কষ্টের জন্ম দিয়েছিল, ভাবজগতে প্রিয়তমের মুখদর্শন করে শ্রীরাধিকার ততটাই সুখানুভূতি হয়েছিল।

৩. “তব হাম পিয়া দূর দেশে না পাঠাই।” -কাকে দূরদেশে না পাঠানোর কথা বলা হয়েছে? মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো। ১+৪ 

উত্তর: বিদ্যাপতি রচিত ‘ভাব সম্মিলন’ পদে শ্রীরাধা তাঁর প্রিয়তম কৃষ্ণকে দূরদেশে না পাঠানোর কথা বলেছেন।

‘মাথুর’ পর্যায়ে বিচ্ছেদের তীব্র যন্ত্রণাকে অতিক্রম করে ভাবসম্মিলনের পদে রাধা নিজের মনোলোকে কৃষ্ণের উপস্থিতি লক্ষ করেছেন। এই সান্নিধ্য রাধার মধ্যে প্রবল ভাবোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করেছে। বিদ্যাপতির রাধা এই উচ্ছ্বাসে অন্যত্র বলেছেন-

"আজু রজনী হাম  ভাগে পোহায়লু
পেখলু পিয়া-মুখ-চন্দা।
জীবন-যৌবন সফল করি মানলু
দশ দিশ ভেল নিরদন্দা।।"

প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণের মুখদর্শনে যে সুখ রাধা লাভ করেছেন, কোনোভাবেই তিনি তার থেকে বঞ্চিত হতে চাননি। সেই অমূল্য সম্পদকে কোনো পার্থিব প্রলোভনের কারণে হারাতে রাজি নন রাধা।

৪. “আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই।”-প্রসঙ্গ উল্লেখ করো। উক্ত পঙ্ক্তিটিতে ডাবসম্মিলনের প্রকাশ কীভাবে ঘটেছে? ২+৩

উত্তর : বিদ্যাপতির ভাবসম্মিলনের পদে রাধা বিরহের পরে ভাবময় জগতে কৃষ্ণের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়েছেন এবং তাঁর মধ্যে অপরিমেয় উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি বলেছেন যে, কোনো অবস্থাতেই এমনকি মহামূল্যবান রত্নসামগ্রীর বিনিময়েও তিনি তাঁর প্রিয়তম কৃষ্ণকে আর দূরদেশে পাঠাবেন না।

ভাবসম্মিলনের পদে প্রকট লীলায় কৃষ্ণ মথুরায় বিরাজ করলেও অপ্রকট লীলায় বৃন্দাবনে নিত্যবিরাজিত থাকেন বলে বৈয়ব দর্শনে উল্লেখ করা হয়। তাই বিদ্যাপতির রাধা মনে করেন- “চিরদিন মাধব মন্দিরে মোর।” বিদ্যাপতির রাধা নিজের দেহকে মন্দিরের মতো পবিত্র করে রাখেন কৃষ্ণের জন্য।

"পিয়া যব আওব এ মঝু গেহে। 
মঙ্গল যতই করব নিজ দেহে।।"

এবং কোনোভাবেই কৃষ্ণকে তিনি হৃদয়বিচ্ছিন্ন করতে চান না। তাই কোকিল লক্ষবার ডাকলেও, লক্ষ চন্দ্র উদিত হলেও, পঞ্চশর লক্ষশরে পরিণত হলেও, এবং মলয়পবন মন্দ মন্দ প্রবাহিত হলেও তিনি বিরহে কাতর হবেন না। কারণ, কৃষ্ণময় জীবনে পরিপূর্ণ তিনি। সে-কারণেই বিদ্যাপতির রাধা বলেছেন যে আঁচল ভরে মহারত্ন পেলেও তিনি তাঁর প্রিয়তমকে দূরদেশে পাঠাবেন না। ভাবোল্লাসের পদে সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতির বিকল্পে কৃষ্ণকে দেখেছেন রাধা। এখানে সেই ভাবনারই ইঙ্গিত রয়েছে।

৫. “বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।”-কে, কার সম্পর্কে এ কথা বলেছেন? এখানে বক্তার যে মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে তা নিজের ভাষায় লেখো। ২+৩

উত্তর: বিদ্যাপতি রচিত ‘ভাব সম্মিলন’ পদে শ্রীরাধা কৃষ্ণ সম্পর্কে উল্লিখিত মন্তব্যটি করেছেন।

ভাবসম্মিলনের পদে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার ভাবজগতে মিলন ঘটেছে। ‘মাথুর’ পর্যায়ে কৃষ্ণের সঙ্গে বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় কাতর রাধা’ বলেছিলেন-“পিয়া বিনে পাঁজর ঝাঁঝর ভেলা”; তিনিই ভাবসম্মিলনে এসে কৃষ্ণের সান্নিধ্যে পুনরায় মুগ্ধতার ভাষ্য তৈরি করেছেন। মনের মন্দিরে নিত্য বিরাজিত কৃয় রাধার কাছে শীতের ওড়না কিংবা গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছত্র এবং সমুদ্রের নৌকা। অর্থাৎ যে-কোনো পরিস্থিতিতে কৃষ্ণই রাধার একমাত্র অবলম্বন।

৬. “ভণয়ে বিদ্যাপতি….”-ভণিতায় বিদ্যাপতি কী বলেছেন? আলোচ্য পদের মধ্য দিয়ে রাধা তাঁর জীবনে কৃষ্ণের গুরুত্বকে কীভাবে স্মরণ করেছেন? ২+৩

উত্তর: ভাবসম্মিলন পদের ভণিতায় বিদ্যাপতি ‘বরনারি’ অর্থাৎ রাধাকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন যে, সুজন মানুষের দুঃখের দিন সাময়িক অর্থাৎ খুবই অল্প হয়।

ভাবসম্মিলনের পদে রাধা ভাবময় জগতে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। তাই কৃষ্ণময় হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবন। বিদ্যাপতির রাধার মধ্যে সেই কৃয়সর্বস্বতার অসামান্য প্রকাশ দেখা গিয়েছে। কৃষ্ণকে মনের মধ্যে দেখতে পেয়ে রাধার আনন্দ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে, তৈরি হয়েছে এক অলৌকিক সুখানুভূতি। কোনোভাবেই কৃয়বিচ্ছেদ তাঁর কাম্য নয়। তাই বিদ্যাপতির রাধা বলেছেন যে,

"আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই। 
তব হাম পিয়া দূর দেশে না পাঠাই।।"

কৃষ্ণ রাধার কাছে জীবনসর্বস্ব। তিনি রাধার কাছে শীতের ওড়না, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছাতা, সমুদ্রের নৌকা। অর্থাৎ কৃষ্ণ রাধার সংকটের সমাধান, প্রতিকূলতায় আশ্রয়, যাত্রাপথের আনন্দগান।

৭. ‘সুজনক দুখ দিবস দুই-চারি।”-কে, কোন্ প্রসঙ্গে মন্তব্যটি করেছেন?

উত্তর: বিদ্যাপতি রচিত ‘ভাব সম্মিলন’ পদের ভণিতায় পদকার বিদ্যাপতি স্বয়ং উল্লিখিত মন্তব্যটি করেছেন।

মাথুর বা প্রবাস পর্যায়ে কৃষ্ণ রাধাকে একা রেখে মথুরায় চলে যান। রাধার মধ্যে সৃষ্টি হয় তীব্র বিরহ-যন্ত্রণা। কিন্তু শ্রীরাধিকার এই যন্ত্রণার উপশম ঘটেছে ভাবসম্মিলনে। মানস-বৃন্দাবনে তিনি কৃষ্ণের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়েছেন। আর তাতেই রাধার মনের মধ্যে সীমাহীন আনন্দের অনুভূতি তৈরি হয়েছে। সুখানুভূতি এতই তীব্র যে রাধা বলেছেন, তাঁকে যদি কেউ আঁচল ভরে রত্ন দেয় তাহলেও তিনি প্রিয়তমকে দূরদেশে পাঠাবেন না। তীব্র বিরহ-বেদনার সময়ে বিদ্যাপতি তাঁর রাধাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন-‘ধৈরয ধরহ চিতে মিলব মুরারি’। আর ভাবসম্মিলনের আনন্দঘন মুহূর্তে বিদ্যাপতি রাধাকে উদ্দেশ করে বলেছেন যে, সুজন মানুষের দুঃখ চিরস্থায়ী হয় না, তার স্থায়িত্ব খুব বেশি হলে দু-চার দিন।

৮. বিদ্যাপতির পঠিত পদে ভাব সম্মিলন-এর প্রকাশ কীভাবে ঘটেছে?

উত্তর : ভাবসম্মিলনের পদে রাধার মনে ভাবোল্লাসের যে আনন্দময় উচ্ছ্বাস, তা বিদ্যাপতির পঠিত পদটিতেও লক্ষ করা যায়। রাধা বলেছেন-

"কি কহব রে সখি আনন্দ ওর।
চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।"

বিরহের দিনগুলিতে চাঁদের আলোয় প্রিয়তমের মুখ খুঁজে যত কষ্ট পেয়েছিলেন, এখন প্রিয়তমের মুখদর্শন করে শ্রীরাধিকা ততটাই সুখ লাভ করেছেন। রাধা বলেছেন আঁচল ভরে যদি কেউ তাঁকে মহারত্নসামগ্রী দেয়, তাহলেও নিজের প্রিয়তমকে তিনি আর দূরদেশে পাঠাবেন না। এভাবেই উল্লিখিত পদে বিদ্যাপতির রাধা নিত্যমিলনের স্থায়ী সুর যোজনা করেছেন। তাঁর কাছে কৃষ্ণ তখন শীতের ওড়না, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছত্র, দরিয়ার নৌকা। আরামে-বিরামে কৃষ্ণই একমাত্র অবলম্বন, রাধা যেন কৃষ্ণেরই বিকল্প সত্তা।

৯. ‘ভাব সম্মিলন’-এর পদে রাধা চরিত্রকে যেভাবে পাওয়া যায় তা নিজের ভাষায় লেখো।

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতির সম্পর্কে বলেছিলেন- “বিদ্যাপতি জগতের মধ্যে প্রেমকে সার বলিয়া জানিয়াছেন…”। পঠিত ‘ভাব সম্মিলন’-এর পদে বিদ্যাপতির রাধার মধ্যে প্রেমের উচ্ছ্বাস যেমন আছে, সেরকমই রয়েছে ভাব-গভীরতা। প্রিয়তমের বিচ্ছেদে যে রাধা একসময় বলেছিলেন-“পিয়া বিনে পাঁজর ঝাঁঝর ভেলা”, ভাবসম্মিলনে সেই রাধারই ‘জীবন-যৌবন সফল’ হয়ে যায় ‘পিয়া মুখ-চন্দা’ দর্শন করে। প্রিয়তমের মুখ-দর্শনে যে অমৃত সুখ রাধা লাভ করেছেন সেখানে কোনো আসঙ্গ লিঙ্গা নেই, আছে ভাব-গভীরতা।

"পাপ সুধাকর যত দুখ দেল। 
পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।।"

রাধা মূল্যবান রত্নসামগ্রীর বিনিময়েও তাঁর প্রিয়তমের সঙ্গে বিচ্ছেদ চান না। পুনর্মিলনের উল্লাস সেখানে যেমন আছে, তেমনি রয়েছে হৃদয়-অনুভূতির নিবিড়তা। বিদ্যাপতির এই রাধা পরিণত এবং গভীর।

১০. ‘ভাব সম্মিলন’-এর পদে রাধার মধ্যে যে কৃষ্ণ-তন্ময়তা প্রকাশ পেয়েছে তা নিজের ভাষায় লেখো।

উত্তর: বিদ্যাপতির রাধা ভাবসম্মিলনের প্রস্তুতিতে বলেছিলেন-

"পিয়া যব আওব এ মঝু গেহে 
মঙ্গল যতই করব নিজ দেহে।"

পঠিত ‘ভাব সম্মিলন’-এর পদে রাধা যখন ভাবময় জগতে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হলেন, তখন তাঁর মধ্যে যে প্রবল উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রকাশ ঘটেছে। কৃষ্ণকে চিরদিন মনের মধ্যে উপলব্ধি করে রাধার আনন্দ সীমাহীন হয়ে উঠেছে। প্রিয়তমের মুখদর্শনে সমস্ত দুঃখের অবসানে, রাধার মধ্যে সুখানুভূতি তৈরি হয়েছে। কোনো মূল্যবান রত্নসামগ্রীর বিনিময়ে তিনি তাঁর প্রিয়তমকে দূরদেশে না পাঠানোর অঙ্গীকার করেছেন। কৃষ্ণ রাধার কাছে সংকট মুহূর্তের সমাধান, প্রতিকূলতায় আশ্রয়, যাত্রাপথের আনন্দ গান। তিনি রাধার কাছেশীতের ওড়না, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছাতা এবং সমুদ্রের নৌকা। এভাবেই ভাবজগতে শ্রীরাধিকার কৃষ্ণপ্রেমে বিভোরতার প্রকাশ ঘটেছে।

১১. ভাব সম্মিলন কাকে বলে? আলোচ্য পদটিতে রাধার আনন্দের যে চিত্রটি ফুটে উঠেছে তা নিজের ভাষায় বর্ণনা করো। ২+৩

উত্তর: ‘মাথুর’ পর্যায়ের সাজানো কুঞ্জবন, ব্রজপুর আর শ্রীরাধাকে পিছনে ফেলে কৃষ্ণ চলে গিয়েছেন মথুরায়। একলা রাধার ‘ফাটি যাওত ছাতিয়া’। শ্রীরাধার এই বেদনাদীর্ণ অবস্থার অবসানে এল ভাব সম্মিলন। রাধা-কৃষ্ণের মানস-মিলন। বৈয়ব তাত্ত্বিকরা এই মিলনকে বলেন নিত্যমিলন এবং সেই মিলনের আনন্দই ভাবসম্মিলনের পদের প্রধান উপজীব্য।

ভাবসম্মিলনের পদে রাধার মনে ভাবোল্লাসের যে আনন্দময় উচ্ছ্বাস, তা বিদ্যাপতির পঠিত পদটিতেও লক্ষ করা যায়। রাধা বলেছেন-

"কি কহব রে সখি আনন্দ ওর। 
চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।"

বিরহের দিনগুলিতে চাঁদের আলোয় প্রিয়তমের মুখ খুঁজে যত কষ্ট পেয়েছিলেন, এখন প্রিয়তমের মুখদর্শন করে শ্রীরাধিকা ততটাই সুখ লাভ করেছেন। রাধা বলেছেন আঁচল ভরে যদি কেউ তাঁকে মহারত্নসামগ্রী দেয়, তাহলেও নিজের প্রিয়তমকে তিনি আর দূরদেশে পাঠাবেন না। এভাবেই উল্লিখিত পদে বিদ্যাপতির রাধা নিত্যমিলনের স্থায়ী সুর যোজনা করেছেন। তাঁর কাছে কৃয় তখন শীতের ওড়না, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছত্র, দরিয়ার নৌকা। আরামে-বিরামে কৃয়ই একমাত্র অবলম্বন, রাধা যেন কৃয়েরই বিকল্প সত্তা।

১৩. “পাপ সুধাকর যত দুখ দেল।/পিয়া মুখ দরশনে তত সুখ ভেল।।”-কার লেখা কোন্ কবিতার অংশ? মন্তব্যটির তাৎপর্য আলোচনা করো। ২+৩

উত্তর : উদ্ধৃত মন্তব্যটি বিদ্যাপতির লেখা ‘ভাবসম্মিলন’ পদ থেকে গৃহীত হয়েছে।

কৃষ্ণের মথুরাগমনের পরে গোকুলে করুণার রোল উঠেছিল, আর মাথুরের তীব্র বিরহযন্ত্রণায় বিদ্যাপতির রাধা বলে উঠেছিলেন-“শূন ভেল মন্দির শূন ভেল নগরী। শূন ভেল দশ দিশ শূন ভেল সগরি।” সেই রাধাই ভাবসম্মিলনের পদে ভাবময় জগতে কৃয়ের সঙ্গে মিলনের আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছেন। নিজের মনের মন্দিরে কৃয়কে চির-বিরাজিত দেখে সীমাহীন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছেন রাধা। প্রিয়ার মুখচন্দ্র দর্শন করে রাধা বলেছেন-” জীবন-যৌবন সফল করি মানলু / দশদিশ ভেল নিরদন্দা।।”

এ এমন এক প্রেম যা স্বয়ং রাধা বলেছেন-‘তিলে তিলে নূতন হোয়।’ যে রাধা একদিন তীব্র বিরহে গভীর আক্ষেপে বলেছিলেন- “প্রতিপদ চাঁদ উদয় যৈছে যামিনী/সুখ-লব ভৈগেল নৈরাশা।” সেই রাধাই কৃষ্ণসান্নিধ্যে প্রত্যয়ী এবং পূর্ণ হয়েছেন। সে-কারণেই বলেছেন, বিরহের দিনে চাঁদের মধ্যে প্রিয়তমের মুখচ্ছবি কল্পনা করে তিনি যেভাবে প্রবঞ্চিত হয়েছেন এবং তাতে তাঁকে যে দুঃখের মুখোমুখি হতে হয়েছে এখন প্রিয়তমের মুখদর্শনে ঠিক ততটাই তাঁর সুখানুভূতি হয়েছে।

১৪. “সুজনকে সুখ দিবস দুই-চারি”-আলোচ্য অংশে ‘সুজন’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে, তাঁর দুঃখের কারণ কী? সেই দুঃখের অবসান কী প্রকারে সম্ভব?

উত্তর: বিদ্যাপতির ভাবসম্মিলন পদটির উল্লিখিত অংশে ‘সুজনক’ বলতে রাধাকে বোঝানো হয়েছে। উল্লিখিত অংশে রাধার দুঃখের পূর্বস্মৃতির কথা বলা হয়েছে। কৃষ্ণের মথুরাগমনে ‘মাথুর’ পর্যায়ে রাধার মধ্যে যে বিরহযন্ত্রণা সৃষ্টি হয়েছিল এখানে সেই দুঃখের কথাই বলা হয়েছে। ‘ভাবসম্মিলন’-এর পদে রাধা কৃয়ের সঙ্গে ভাবময় জগতে মিলিত হয়েছিলেন। তার ফলে তার আনন্দ সীমাহীন হয়ে ওঠে। পিয়া-মুখ-দরশনে অসীম সুখের উপলব্ধি ঘটে তার মধ্যে। উচ্ছ্বসিত রাধা কোনোভাবেই কৃয়কে কাছ-ছাড়া করতে চান না। রাধা বলেছেন-

"আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই।
তব হাম পিয়া দূর দেশে না পাঠাই।।"

কৃয়কে রাধা তাঁর জীবনের সর্বস্ব করে নিয়েছেন। কৃয় তাঁর কাছে শীতের ওড়না, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছাতা, সমুদ্রের নৌকা। অর্থাৎ তাঁর সংকটের সমাধান, প্রতিকূলতায় আশ্রয়, যাত্রাপথের আনন্দগান। এই সুখানুভুতির তীব্রতার কাছে সমস্ত পূর্ব-দুঃখ অবসিত হয়ে যেতে বাধ্য। তাই অন্যপদে বিদ্যাপতির রাধা বলেছেন-

"জীবন-যৌবন     সফল করি মানলু
দশ দিশ ভেল নিরদন্দা।"

সে-কারণেই পঠিত পদে বিদ্যাপতি বলেছেন যে, যারা সুজন অর্থাৎ ভালোমানুষ হয় তাদের দুঃখের দিন ক্ষণস্থায়ী হয়।

১৫. ভাবসম্মিলনের পদে বিদ্যাপতির কবিপ্রতিভার যে পরিচয় পাওয়া যায় নিজের ভাষায় লেখো।

উত্তর: বিদ্যাপতির ‘ভাবসম্মিলন’-এর পদের রচনারীতির প্রধান বিশেষত্ব তার গীতিকাব্যিক উচ্ছ্বাসে। কৃয়ের সঙ্গে পুনর্মিলনের আনন্দে রাধার মধ্যে যে তীব্র উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে তা গীতিকাব্যিক মাত্রা পেয়েছে। -“কি কহব রে সখি আনন্দ ওর।” এই উচ্ছ্বাস পদকে গীতিকাব্যের মর্যাদা দিয়েছে। বিদ্যাপতির পদ ধ্বনিময়। পঠিত পদে এই ধ্বনিঝংকার যথেষ্ট মাত্রায় লক্ষ করা যায়।

"পাপ সুধাকর যত দুখ দেল।
পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।।"

‘প’, ‘র’, ‘দ’, ‘স’ এবং ‘ল’ ধ্বনির অনুপ্রাসে এখানে ধ্বনিময়তা সৃষ্টি করা হয়েছে। একইভাবে অলংকার সৃষ্টিতেও এখানে বিদ্যাপতির দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। কৃয় সম্পর্কে বিদ্যাপতির রাধা বলেছেন-

"শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষির বা। 
বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।"

রূপক অলংকারের অসামান্য প্রয়োগ দেখা যায় এখানে। এইভাবে বিদ্যাপতির পঠিত পদটি কাব্যসৌন্দর্যে অসামান্য হয়ে উঠেছে।

১৬. “শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষির বা।/ বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।”-কোন্ প্রসঙ্গে বিদ্যাপতি এই উপমাটি ব্যবহার করেছেন? উপমাটির তাৎপর্য উল্লেখ করো। ২+৩

উত্তর: বিদ্যাপতির ‘ভাবসম্মিলন’ পদে রাধা ভাবময় জগতে কৃয়ের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। এই পর্বে তাঁর মধ্যে যে কৃয়বিভোরতা সৃষ্টি হয়েছে তার উল্লেখ প্রসঙ্গেই রাধা উল্লিখিত মন্তব্যটি করেছেন।

নিজের হৃদয়-মন্দিরে কৃষ্ণকে উপলব্ধি করে রাধার মধ্যে তীব্র উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। -“কি কহব রে সখি আনন্দ ওর।/চিরদিন মাধব মন্দিরে মোর।।” ‘পিয়া-মুখ-দরশনে’ রাধার যে সুখানুভুতি হয়েছে সে-কারণে কোনোভাবেই রাধা তাঁকে আর হাতছাড়া করতে চাননি। তাই রাধা বলেছেন যে, আঁচল ভরে কেউ যদি তাঁকে মহামূল্যবান রত্নসামগ্রী দেয় তাহলেও তাঁর প্রিয়তমকে তিনি দূরদেশে পাঠাবেন না। বিদ্যাপতির রাধা প্রিয়তমকে কাছে পেয়ে উচ্ছ্বাসে বলেছেন-

" সোই কোকিল অব লাখ উদয় করু চন্দা।
লাখ লাখ ডাকউ
পাঁচবাণ অব  লাখ বাণ হোউ
মলয় পবন বহু মন্দা।।"

কৃষ্ণময় এই রাধার জীবন। কৃষ্ণ রাধার কাছে তাই শীতের ওড়না, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছাতা, সমুদ্রের নৌকা। অর্থাৎ কৃষ্ণ রাধার সংকটের সমাধান, প্রতিকূলতায় আশ্রয়, যাত্রাপথের আনন্দগান।

আরো পড়ুন : একাদশ শ্রেণি দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment