সার্কের সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে আলোচনা করো

সার্কের সাফল্য
‘সার্ক’ আঞ্চলিক সংগঠনের ক্ষেত্রে অন্যতম কনিষ্ঠ সংগঠন। তবে ইতিমধ্যেই সার্ক বেশকিছু সাফল্য অর্জন করেছে। আর্বিভাব লগ্ন থেকেই সার্কের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সদস্যরাষ্ট্রগুলি পারস্পরিক আদানপ্রদান বৃদ্ধি করেছে। এক্ষেত্রে সংগঠনটি কেবলমাত্র সরকারি স্তরে নয়, রাষ্ট্রবহির্ভূত স্তরেও নিয়মিত সংযোগ গড়ে তুলেছে। যা সার্ককে আরও বেশি প্রাণবন্ত ও সম্ভাবনাময় করে তুলেছে। এর উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলি হল-
(i) পারস্পরিক সহযোগিতা:
সার্কের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে আঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিমাণ পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া অভিন্ন নদীগুলির জলবণ্টন, তথ্যপ্রযুক্তির আদানপ্রদান, উপগ্রহভিত্তিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে নানান প্রকার যৌথ কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। বিভিন্ন শীর্ষ সম্মেলনগুলিতে সার্কের রাষ্ট্রপ্রধানগণ গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করেছেন। এরূপ বিষয়গুলির মধ্যে উল্লেখ্য হল-হিমালয়-সহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার সংকটাপন্ন বাস্তুতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংরক্ষণ, উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলির সুরক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সংকটকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা, জ্বালানীর জোগান ও মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
(ii) বাণিজ্যিক প্রসার:
৯০-এর দশক থেকে সার্কের উদ্যোগে সদস্যরাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শুল্ক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা অনেকাংশে হ্রাস পেয়ে আঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিমাণ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে সার্কের উদ্যোগগুলি হল-
- SAPTA স্বাক্ষর: সার্ক ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা, বাংলাদেশে SAPTA অর্থাৎ SAARC Preferential Trading Arrangement চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মাধ্যমে সার্কভুক্ত দেশগুলি পরস্পরকে বহুবিধ বাণিজ্যিক সুবিধা দানের অঙ্গীকার করে। এই সকল সুবিধার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-রফতানি শুল্ক তুলে দেওয়া, নির্দিষ্ট কিছু দ্রব্যে শুল্ক ছাড়, অভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা প্রভৃতি। দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক সহযোগিতা প্রসারে এটি ছিল একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। যা আরও প্রসারিত হয় SAFTA-এর মাধ্যমে।
- SAFTA গঠন: দক্ষিণ এশিয়াকে শুল্ক মুক্ত বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ২০০৪ সালে ৬ জানুয়ারি ইসলামাবাদ সম্মেলনে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (South Asian Free Trade Area) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এই চুক্তি কার্যকর হয়। SAFTA চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হল সার্কের সদস্যরাষ্ট্রগুলির মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পারস্পরিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলিকে সুযোগসুবিধা প্রদান করা। এ ছাড়া এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো South Asian Economic Union বা দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গড়ে তোলাই ছিল SAFTA-এর অন্যতম মূল লক্ষ্য। পাশাপাশি দেশগুলির মধ্যে শুল্কগত বাধা-সহ অন্যান্য বাধা হ্রাস করে বাণিজ্যিক স্বচ্ছতা আনা ও সাফটার উদ্দেশ্যভুক্ত ছিল।
- SAPTA-র নীতিসমূহ: SAFTA চুক্তি অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গড়ে তোলার জন্য সার্কের সদস্যরাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যে কতকগুলি নীতি অনুসরণ করবে। এগুলি হল-
- SAFTA চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলির সম্মতি, প্রবিধান, সিদ্ধান্ত, বোঝাপড়া এবং প্রোটোকল দ্বারা SAFTA সংগঠন পরিচালিত হবে।
- মারাকেশ চুক্তির অধীনে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং অন্যান্য চুক্তি অনুযায়ী SAFTA-এর সদস্যরাষ্ট্রগুলি তাদের অধিকার ও কর্তব্য সুনিশ্চিত করবে।
- সাফ্টা চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলির মধ্যে পারস্পরকিতা ও সুবিধা আদানপ্রদানমূলক নীতি গড়ে তুলতে হবে। যাতে সমস্ত চুক্তিকারী দেশগুলি শিল্প ও আর্থিক উন্নয়ন, বাণিজ্য এবং শুল্ক নীতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে সমানভাবে উপকৃত হয়।
- সাফ্টাভুক্ত দেশগুলি পণ্যের অবাধ চলাচল, উন্মুক্ত বাণিজ্য, শুল্ক অপসারণ-সহ অন্যান্য সমতুল্য ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করবে।
- সাফ্টা চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রগুলি বাণিজ্য সংক্রান্ত ক্ষেত্রগুলিতে আইনের ক্রমান্বয়ে সমন্বয় সাধন করবে।
- স্বল্পোন্নত দেশগুলির (ভুটান, নেপাল, আফগানিস্তান) বিশেষ চাহিদাকে স্বীকৃতি প্রদান করে তাদের অনুকূলে অগ্রাধিকারমূলক চুক্তির ব্যবস্থা করবে।
সাফ্টার উদ্দেশ্যসমূহ: সাফ্টার উদ্দেশ্যগুলি হল-
- আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য সংক্রান্ত সকল বিধিনিষেধ দূর করে পণ্যের অবাধ ও মসৃণ চলাচল সুনিশ্চিত করবে।
- সদস্যরাষ্ট্রগুলি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলে ন্যায়সংগত ও স্বচ্ছ প্রতিযোগিতার পরিবেশ গড়ে তুলবে এবং বাণিজ্য ও শুল্কব্যবস্থা থেকে প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্র যাতে সমান মুনাফা লাভ করতে পারে তা নিশ্চিত করবে।
- ভবিষ্যতে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও পারস্পরিক লাভ বৃদ্ধির জন্য একটি উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলবে।
- SAFTA বাস্তবায়িত করার জন্য মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল পরিকল্পনা ও বিবাদ নিষ্পত্তির উপযোগী কার্যকরী সাংগঠনিক ব্যবস্থা গঠন করবে।
(iii) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব বৃদ্ধি:
সার্ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে তার সাফল্যের নজির রেখেছে। ফলে বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সার্কের গুরুত্ব ও সম্মান যথেষ্ট বৃদ্ধি – পেয়েছে। শিশুকল্যাণ বিষয়ে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনিসেফের (UNICEF) সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি, ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও পরিবেশ বিষয়ে UNDP-এর সঙ্গে চুক্তি, ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে মাদক দ্রব্যের নিষিদ্ধকরণ বিষয়ে UNDCP-এর সঙ্গে চুক্তি, এশিয়া প্যাসিফিক টেলিকমিউনিটির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি প্রভৃতি ছিল এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
(iv) সমমনস্ক অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে চুক্তি:
সার্ক তার উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সমমনস্ক অন্যান্য সংগঠন, যেমন-ASEAN, EU-এর সঙ্গেও চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল।
(v) সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা:
খেলাধুলো ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলি বিশেষ সাফল্য পেয়েছে। বিশেষত সার্ক গেমস যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বর্তমানে। বিশ্বমানের উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক সফর, পর্যটনক্ষেত্র প্রভৃতির মাধ্যমে সার্কের সদস্যরাষ্ট্রগুলিকে একসূত্রে বেঁধে রাখার চেষ্টা চলছে।
(vi) সফল দ্বিপাক্ষিক চুক্তি:
সার্কভুক্ত দেশগুলির মধ্যে বিভিন্ন সময়ে সুসম্পর্কের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বিশেষত জলসম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সার্কের পদক্ষেপ প্রশংসাযোগ্য।যেমন-ভারত-নেপাল মহাকালী নদী চুক্তি, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর জলবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তিগুলি স্বাক্ষরের ফলে দেশগুলির মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধের অবসান হয়েছে এবং উন্নয়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সম্ভব হয়েছে।
সার্কের ব্যর্থতা
বিগত এক দশক ধরে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে সার্কের ভবিষ্যৎ দোদুল্যমান। সার্ক সূচনাকাল থেকেই নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, যা তার বিশেষ কয়েকটি সমস্যা ও দুর্বলতাকে প্রকট করে তুলেছিল। সার্কের ব্যর্থতাগুলি হল-
(i) সহযোগিতার অভাব:
সার্কের ৭টি সদস্যরাষ্ট্র পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এই সংগঠন গড়ে তুললেও এদের মধ্যে পূর্ণ সহযোগিতার মনোভাব কখনোই দেখা যায়নি। কারণ সার্কের সদস্যগুলির মধ্যে সহযোগিতা অপেক্ষা পারস্পরিক প্রতিযোগিতা বেশি থাকায় সার্কের সাফল্যের হার কম এবং এই পারস্পরিক অসহযোগিতার মূল কারণ হিসেবে সার্কভুক্ত দেশগুলির অত্যধিক জাতীয়তাবোধের উন্মেষকে দায়ী করা যায়। অত্যধিক জাতীয়তাবোধের অনুভূতি রাষ্ট্রগুলির মধ্যে আন্তর্জাতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে ব্যর্থ হয়।
(ii) দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনমন: সার্কের জন্মলগ্ন থেকেই সদস্যদেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি, বিশ্বাসের অভাব এই সংগঠনটির সাফল্যের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। যেমন-ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনমন সার্কের সাফল্যের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। শ্রীলঙ্কার জাতিগত সমস্যাকে কেন্দ্র করে তামিল বিদ্রোহ, বাংলাদেশের সঙ্গে উদ্বাস্তু ও জলবণ্টন সমস্যা, পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীর সমস্যা প্রভৃতি সার্কের কার্যকলাপকে দুর্বল করে দিয়েছে। এর ফলে সার্ক দক্ষিণ এশিয়ায় সার্বিক আর্থিক উন্নয়ন এবং যৌথ স্বনির্ভরশীলতকে বাস্তবায়িত করতে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অধিকাংশ সময় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য করে ও দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে বাণিজ্য সম্পাদন করে ফলে SAFTA-এর গুরুত্ব যেমন হ্রাস পাচ্ছে তেমনই সার্কের মাধ্যমে বাণিজ্য না করায় দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলটির সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
(iii) সন্ত্রাসবাদ দমনে ব্যর্থ:
সন্ত্রাসবাদকে দমন করতে ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করতে সার্ক ব্যর্থ হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি ব্যাপকভাবে সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপ দ্বারা আক্রান্ত। বিশেষত পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে ভারতবিরোধী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ পরিচালিত হয়। যেমন-সম্প্রতি চলতি বছরে পহেলগাঁও-এ জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক আরও নিম্নমুখী হয়েছে। পাক হামলার প্রত্যাঘাতে ভারত ক্ষুব্ধ হয়ে পাক জঙ্গিঘাঁটিগুলি ধ্বংস করে। যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হলেও দক্ষিণ এশিয়ার আকাশে ঝড়ের আশঙ্কা এখনও দূর হয়নি। এই ঘটনা SAARC-এর সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
(iv) বিদেশি রাষ্ট্রের কূটনীতি:
সার্কের পার্শ্ববর্তী চিন ও জাপান বা দূরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক কাজকর্ম সার্কের সাফল্যে বাধা দান করে। ক্রমাগত ভারতের বিরুদ্ধাচরণে পাকিস্তানকে মার্কিনি মদত, চিনের ভারত ভূখণ্ড দখলের চেষ্টা প্রভৃতি সার্কের প্রকৃত দায়িত্ব থেকে তাকে বিমুখ করেছিল। উদাহরণ হিসেবে চিনের One Belt One Road (OBOR) কার্যক্রম, কারাকোরাম হাইওয়ে নির্মাণ, বালুচিস্তানে গদর বন্দরের আধুনিকীকরণ, শ্রীলঙ্কায় হাম্বানটোটো বন্দরের আধুনিকীকরণ এবং বাংলাদেশের মঙ্গল বন্দরের আধুনিকীকরণের কর্মসূচির কথা বলা যায়। এগুলি সার্কের সাফল্যে বাধা সৃষ্টি করেছে।
(v) দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা:
সার্কের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির অন্যতম বড়ো সমস্যা ছিল দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা। সার্কভুক্ত দেশগুলির মধ্যে সম্পদের ক্ষেত্রে বাণিজ্য বৈষম্য লক্ষণীয়। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা, সহযোগিতা অনেকটাই কম, পরিবর্তে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই বেশি। সার্কের অধিকাংশ রাষ্ট্রের জনগণই দরিদ্র, সার্ক প্রথম থেকেই এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে এসেছে। সার্ক দারিদ্রতা দূরীকরণে একটি কমিশন গঠন করেছে ঠিকই কিন্তু অঞ্চলটি থেকে দারিদ্রতা দূরীকরণে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। আর নিরক্ষরতা কর্মসূচি এখনও সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত করা যায়নি।
(vi) শিশুশ্রম বন্ধ ও নারীদের সম্মান রক্ষায় ব্যর্থ:
নারী ও শিশু সুরক্ষার জন্য সার্ক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সার্কভুক্ত দেশগুলির অন্যতম সমস্যা হল শিশুশ্রম। আবার এই দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক অত্যন্ত কম হওয়ায় এখানে শ্রমিক শোষণের মাত্রা সর্বাধিক। বিদেশে পতিতাবৃত্তির জন্য পাচার হওয়া মেয়েদের মধ্যে এশীয়দের সংখ্যাই সর্বাধিক। ফলে শিশুশ্রম রোধ ও নারী সম্মান রক্ষায় সার্ক ব্যর্থ হয়েছে।
(vii) নতুন প্রযুক্তিবিদ্যার অভাব:
দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলি মূলত কৃষিনির্ভর। কিন্তু আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি এবং শিল্পক্ষেত্রে প্রযুক্তির অভাব সার্কের স্বনির্ভরতা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করেছে।
(viii) ভারতের ক্ষমতা সম্পর্কে ভীতি:
ভারতের ‘বড়ো ভাই’ সুলভ সদস্যদের তুলনায় ভারত আয়তনের দিক থেকে যেমন বৃহৎ তেমনই আর্থিক-সামরিক ক্ষেত্রে অধিক শক্তিশালী। ভারতের আর্থিক প্রভাবকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না। ফলে সার্কের সদস্যগুলি ভারতকে সম্ভ্রমের চোখে দেখে এবং ভারতের থেকে তারা দূরত্ব বজায় রেখে চলে। রাষ্ট্রগুলি মনে করে সার্ককে ব্যবহার করে ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে সচেষ্ট থাকে। একারণে তারা ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা স্থাপন করতে চায় না, তাদের ধারণা সহযোগিতা পেলে সার্কে ভারতের প্রাধান্য বৃদ্ধি পাবে। তাই বলা যায় ভারতের ভূমিকাও পরোক্ষভাবে সার্কে সহযোগিতা স্থাপনে বাধা সৃষ্টি করেছে।
(ix) দ্বিপাক্ষিক বিরোধ উপেক্ষা:
সার্ক সর্বদা সদস্য রাষ্ট্র গুলির দ্বিপাক্ষিক বিরোধকে সার্কের আলোচনার বাইরে রাখে। সার্কে বর্তমানে যে ৮টি সদস্য রাষ্ট্র রয়েছে তাদের মধ্যে আর্থিক, সামরিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পার্থক্য ও বৈচিত্র্য বিদ্যমান, যা উপেক্ষা করা যায় না। এই পার্থক্য অনেকসময় বিরোধের জন্ম দেয়। দ্বিপাক্ষিক বিরোধ থাকলে কখনোই যৌথ মঞ্চে সহযোগিতা গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। ফলে বলা যায় বিরোধ ও বৈচিত্র্যের কারণে সার্কে সহমতভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব হয় না যা সার্কের কর্মসূচিগুলির বাস্তবায়নে ব্যাঘাত ঘটায় তথা সাফল্যে বাধা সৃষ্টি করে এবং সার্ককে সংগঠন হিসেবে দুর্বল করে তোলে।
(x) মিনি বা বিকল্প সার্ক-এর আতঙ্ক বৃদ্ধি:
সার্কের সদস্যরাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অসহযোগিতা SAARC-এর ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। সদস্যরাষ্ট্রগুলির এই অবিশ্বাস ও স্বার্থদ্বন্দ্বের সুযোগে চিন এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়েছে। সম্প্রতি জানা গেছে যে চিনের উদ্যোগে পাকিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা তথাকথিত ‘মিনি সার্ক’ বা বিকল্প সার্ক গড়ে তুলতে উদ্যোগী। বর্তমানে বাংলাদেশও চিনের অনুসারী। ভারতের আশঙ্কা যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের হাত ধরে চিন সার্কের স্থায়ী সদস্যপদপ্রাপ্তির চেষ্টা করবে। যা ভারতের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা প্রশ্ন উত্তর
আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার দর্শন প্রশ্ন উত্তর
আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টারের ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর
আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টারের ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর