পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও বিকল্প জ্বালানি প্রবন্ধ রচনা – আজকের পর্বে পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও বিকল্প জ্বালানি প্রবন্ধ রচনা আলোচনা করা হল।
পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও বিকল্প জ্বালানি প্রবন্ধ রচনা
পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও বিকল্প জ্বালানি
ভূমিকা
যেদিন থেকে মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখেছে সেদিন থেকে জ্বালানি হয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এক অপরিহার্য বস্তু। প্রথমে মানুষ কাঠ প্রভৃতি জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করত। পরে আবিষ্কার হয় ভূগর্ভস্থ কয়লা, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি। মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ, সমুন্নতি তথা সভ্যতার অগ্রগতিতে জ্বালানি শক্তির গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। এখন মানব সভ্যতার অস্তিত্ব অনেকাংশে নির্ভর করছে প্রকৃতি প্রদত্ত-জ্বালানি শক্তির ওপর। এই জ্বালানির ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে প্রকৃতি প্রদত্ত ভান্ডার সংকুচিত হচ্ছে এবং সমস্ত দেশের দুশ্চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে। যেহেতু শক্তির উৎস জ্বালানি তাই যেসব দেশ শক্তিধর তারা জ্বালানি সমৃদ্ধ দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে, যদিও সৌরশক্তি, পারমাণবিক শক্তি প্রভৃতি আবিষ্কার হয়েছে। গাড়ি, প্লেন, যন্ত্রপাতি, কলকারখানা তথা বিভিন্ন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে পেট্রোলিয়াম্ খুবই প্রয়োজন হওয়ায় পেট্রোলিয়ামের ভান্ডার যত কমছে দাম তত বাড়ছে।
জ্বালানির উৎস ও সংকটের কারণ
আগের তুলনায় কয়লার ব্যবহার কমেনি। প্রাকৃতিক গ্যাস, সোলার শক্তি, বিদ্যুৎ, পারমাণবিক শক্তি কয়লার স্থান পূরণ করছে এবং সুখস্বাচ্ছন্দও বেশি দিচ্ছে। কিন্তু গাড়ি, ট্রেন, প্লেন, জাহাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্পে পেট্রোলের আকাশ ছোঁয়া চাহিদা থাকায় প্রতিনিয়ত দাম বেড়ে চলেছে। এজন্য বিকল্প জ্বালানির কথা ভাবিয়ে তুলছে দেশকে। পরিবহন, বিভিন্ন শিল্প, রান্নার কাজ প্রভৃতির জন্য এত বেশি কয়লা ব্যবহার করা হচ্ছে যে এইভাবে চললে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে কয়লার ভান্ডার নিঃশেষ হয়ে যাবে। প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা সেভাবে বৃদ্ধি হওয়ায় তার ভান্ডারও ফুরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। প্রকৃতি প্রদত্ত এইসব শক্তিকে সৃষ্টি করা যায় না, কেবল ঘটানো যায় রূপান্তর।
বিকল্প শক্তির উৎস সন্ধান
জ্বালানি সংকটের জন্য মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে পেট্রোপণ্যের। এই সংকট থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য বিশ্বজুড়ে চলছে বিকল্প শক্তির উৎসের অনুসন্ধান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই সমস্যা সমাধানের জন্য বিশ্বের বিজ্ঞানীরা যে চৌদ্দটি শক্তির উৎসের সন্ধান দিয়েছেন সেগুলি হল সৌরশক্তি, পারমাণবিকশক্তি, বায়ুশক্তি, জোয়ার-ভাটা থেকে প্রাপ্ত শক্তি, ভূ-তাপীয় শক্তি, সাগরের তাপীয় শক্তি, গোবর গ্যাস, বিদ্যুৎ শক্তি প্রভৃতি। তৈলবীজ থেকেও জ্বালানি পাওয়া যায় এবং আমাদের দেশে এই প্রকল্পের সূচনা হয়েছে। তৈলবীজ পাওয়া যায় এরূপ নতুন নতুন গাছপালা উদ্ভিদের অনুসন্ধানও চলছে।
সৌরশক্তি
কর্কটক্রান্তি রেখা আমাদের দেশের মাঝখান দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। এখানে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেশি বৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু বছরের অবশিষ্ট মাস থাকে রোদ-ঝলমল। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে সূর্যালোককে কাজে লাগিয়ে সোলার সেল বা সৌরকোষের মাধ্যমে তড়িৎশক্তি উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে এবং এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ এখন খুব সহজ হয়েছে। সোলার, সেলের সাহায্যে আলো, রান্নার জন্য সোলার কুকার ব্যবহার করে জ্বালানির অভাব পূরণ সম্ভব।
বায়ুশক্তি
বায়ু ও অন্যতম এক শক্তি। আকাশের বিদ্যুৎকে করায়ত্ত করে মানুষ যেমন প্রয়োজন মেটাচ্ছে তেমনি যে বায়ু বা ঝড় মানুষের কাছে ভয়ের কারণ ছিল তাকেও বাতাসের মুখোমুখি ঘূর্ণায়ন পাখার সাহায্যে বিশেষ কৌশলে বায়ুকলের সহায়তায় খাল-বিল-কুয়ো প্রভৃতি থেকে জল তুলে সহজে জলের সমস্যা মিটিয়ে চাষবাসের ব্যবস্থা হচ্ছে। এমন কি আখ মাড়াই, ধান-গম ঝাড়াই প্রভৃতি যন্ত্র চালিত হচ্ছে বায়ুকলের সহায়তায়। বায়ুকল বা উইন্ডমিলের সাহায্যে বিভিন্ন দেশে রাইসমিল বা ধানভাঙার কাজও সম্ভব হচ্ছে।
অন্যান্য শক্তি
যেখানে জলের স্রোত আছে সেখানে জলশক্তিকে কাজে লাগিয়ে টারবাইনের সাহায্যে বিদ্যুৎ উপাদান সম্ভব হয়েছে এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে এই প্রকল্প শুরু হয়েছে। পরমাণুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ প্রভৃতি উৎপাদন এখন বিশেষ শক্তির উৎস। আমাদের দেশে রয়েছে অফুরন্ত জল। তাই জল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সহজেই সম্ভব। যদিও পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ব্যয় বহুল তবুও অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশও যথেষ্ট অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করছে। গোবর গ্যাস, জৈব গ্যাস ও বিশেষ একটি শক্তি যার সাহায্যে আলো ও রান্না প্রভৃতি সম্ভব হয়। প্রস্রবণের জলে থাকে উত্তপ্ত ম্যাগমা। পৃথিবীর অভ্যন্তর উত্তপ্ত থাকায় প্রস্রবণে জল ও উত্তপ্ত হয়। এই জল থেকে পাওয়া যায় ভূতাপীয় শক্তি। ভূতাপীয় শক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কয়লার প্রয়োজন হয়। তাই পেট্রোপণ্যের বিকল্প হিসাবে এইসব শক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ বা সৌরশক্তি চালিত যানবাহন ও আবিষ্কার হয়েছে। পৃথিবীতে যে বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহৃত হয় তার ষাট ভাগ তাপ বিদ্যুৎ ও চল্লিশ ভাগ সৌরশক্তি বায়ুশক্তি প্রভৃতি থেকে পাওয়া যায়। তাপবিদ্যুতের জন্য প্রয়োজন হয় কয়লাখনির তেল, প্রকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি। ভারতের ‘সালার মেশিন’ ২০২০ সালের মধ্যে ২১,০০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আগামী তিন বছরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হল ১,৩০০ মেগাওয়াট। এছাড়া এক কেজি ডয়টোরিয়াম থেকে ত্রিশ লক্ষ কেজি কয়লার সমান শক্তি পাওয়া সম্ভব।
পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ
পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধ করার জন্য বিকল্প শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। তাপবিদ্যুৎ, পারমাণবিক প্রকল্প প্রভৃতি বড়ো বড়ো প্রকল্পের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন। সরকারী, বেসরকারী বিভিন্ন উদ্যোগে নানা প্রকল্পের সূচনা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আরও নতুন বিকল্প শক্তির উৎস সন্ধানে। জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির ফলে পেট্রোপণ্যের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে, যোগান কমে যাওয়ায় পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ছে, বিকল্প শক্তি ব্যবহার করে ও প্রয়োজন বেশি হওয়ায় পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি স্বাভাবিক কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পেট্রোলিয়ামের মূল্য বৃদ্ধি হলে তার থেকে উৎপাদিত পণ্যের দাম বৃদ্ধি হওয়া স্বাভাবিক। পেট্রোলিয়ামের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে অপেক্ (অয়েল এন্ড পেট্রোলিয়াম এক্সপোটিং কান্ট্রিজ বা OPEC) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
উপসংহার
পেট্রোপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ তখনই সম্ভব হবে যখন বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাড়বে, ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন অফুরন্ত বিকল্প শক্তি।
আরও পড়ুন – বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম ও সংবাদপত্র প্রবন্ধ রচনা