রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষায় মোট বারোটি উপন্যাস রচনা করেছেন (‘করুণা’ উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস হলেও এটি সমাপ্ত হয়নি বলে সম্পূর্ণ উপন্যাসের মর্যাদা পায়নি)। তাঁর লেখা উপন্যাসগুলি হল-‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘রাজর্ষি’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘চোখের বালি’, ‘যোগাযোগ’, ‘নৌকাডুবি’, ‘শেষের কবিতা’, ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’, ‘দুইবোন’, ‘মালঞ্চ’, ‘গোরা’, ‘চার অধ্যায়’।
ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ ও সমকাল প্রশ্ন উত্তর
১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষায় মোট কতগুলি উপন্যাস লিখেছিলেন, শ্রেণিবিভাগ-সহ উপন্যাসগুলির নাম লেখো।
উপন্যাসের নাম: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষায় মোট বারোটি উপন্যাস রচনা করেছেন (‘করুণা’ উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস হলেও এটি সমাপ্ত হয়নি বলে সম্পূর্ণ উপন্যাসের মর্যাদা পায়নি)। তাঁর লেখা উপন্যাসগুলি হল-‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘রাজর্ষি’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘চোখের বালি’, ‘যোগাযোগ’, ‘নৌকাডুবি’, ‘শেষের কবিতা’, ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’, ‘দুইবোন’, ‘মালঞ্চ’, ‘গোরা’, ‘চার অধ্যায়’।
উপন্যাসের শ্রেণিবিভাগ: তাঁর উপন্যাসগুলিকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। সেগুলি হল-
ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাস: তাঁর রচিত ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাসগুলি হল-‘বৌ- ঠাকুরাণীর হাট’ ও ‘রাজর্ষি’।
মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বমূলক উপন্যাস: তাঁর রচিত মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বমূলক উপন্যাসগুলি হল-‘চোখের বালি’, ‘নৌকাডুবি’, ‘যোগাযোগ’।
সমস্যামূলক উপন্যাস: তাঁর রচিত সমস্যামূলক উপন্যাসগুলি হল- ‘গোরা’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘চার অধ্যায়’।
মিস্টিক ও রোমান্টিক উপন্যাস: তাঁর রচিত রোমান্টিক উপন্যাসগুলি হল- ‘চতুরঙ্গ’, ‘শেষের কবিতা’, ‘দুইবোন, ‘মালঞ্চ’।
২। ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে যা জানো লেখো।
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই সঙ্গে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক এবং প্রাবন্ধিক। মাত্র বারোটি উপন্যাস লিখলেও যুগজীবন, পরাধীন দেশ ও জাতীয়তাবোধ, জীবনের জটিলতা ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে তাঁর উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ ধারাবাহিকভাবে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতে পরিণত ভাবনার প্রকাশ না থাকলেও এর ঐতিহাসিক মূল্য অনস্বীকার্য।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট, রাজর্ষি, ‘নৌকাডুবি: ঐতিহাসিক তথ্য অবলম্বনে রচিত ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ (১৮৮৩) ও ‘রাজর্ষি’ (১৮৮৭) উপন্যাস দুটিতে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব লক্ষণীয়। প্রথমটিতে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের সংসারের কথা এবং দ্বিতীয়টিতে ত্রিপুরার রাজবংশের ইতিহাস নিপুণভাবে আঁকা। তাঁর বিশিষ্ট উপন্যাস ‘চোখের বালি’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। সামাজিক সংস্কারের সঙ্গে জৈবনিক প্রবৃত্তির দ্বন্দ্বে মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন এই উপন্যাসের মূল বিষয়। ‘নৌকাডুবি’-তে চরিত্র অপেক্ষা ঘটনার প্রাধান্য মেলে।
গোরা, ঘরে-বাইরে, চতুরঙা, শেষের কবিতা: স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘গোরা’ তাঁর মহাকাব্যিক রচনা। এর মধ্যে আছে রাজনীতি, সমাজনীতি ও স্বদেশি ভাবনা। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে রাজনীতিগত ও সমাজনীতিকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব চোখে পড়ে। এখানে স্বদেশি আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে দাম্পত্যজীবন অস্থির হয়ে ওঠার চিত্র রয়েছে। ‘চতুরঙ্গ’ মতবাদসর্বস্ব রচনা এবং শচীশ ও দামিনীর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কের বিরোধ তুলে ধরা হয়েছে। ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে বাস্তববোধ ও আবেগসর্বস্বতার মিশ্রণ ঘটায় কিছু পরিমাণে কাব্যময়তা প্রাধান্য পেয়েছে।
যোগাযোগ, দুই বোন, মালঞ্চ, চার অধ্যায়: ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি লেখকের রচনাকর্মের বিশেষ পরিচয়বাহী। দাম্পত্য সম্পর্কের জটিলতা ও ইগো৭ সমস্যা এই উপন্যাসের উপজীব্য। ‘দুই বোন’ ও ‘মাল্য’ উপন্যাস দুটির প্রথমটিতে দুই নারীসত্তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে এবং পরেরটিতে স্বামীর বান্ধবীর প্রতি বিদ্বেষ-মনোবিকার স্বল্প আয়তনে তুলে ধরা হয়েছে। এগুলি উপন্যাসিকার আদলে লেখা হয়েছে। ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে সন্ত্রাসবাদীদের কুচক্রী প্রবৃত্তি এবং দেশসেবার নামে নীচতার পরিচয় আছে। তাঁর উপন্যাস ভাবনার পথ ধরেই উত্তরকালের উপন্যাস শিল্পের পথ চলা।
৩। ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাসগুলি সম্পর্কে লেখো।
ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাস: বঙ্কিমচন্দ্রের সার্থক উত্তরসূরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট বারোটি উপন্যাস রচনা করেছেন, যথা-‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’, ‘রাজর্ষি’, ‘চোখের বালি’, ‘নৌকাডুবি’, ‘গোরা’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘যোগাযোগ’, ‘শেষের কবিতা’, ‘দুই বোন’, ‘মালঞ্চ’, ‘চার অধ্যায়’। উপন্যাস রচনার প্রাথমিক পর্বে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের মতোই ইতিহাসের রোমান্টিক কাহিনির দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, যার ফলশ্রুতি ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’, ‘রাজর্ষি’।
বৌ ঠাকুরাণীর হাট: ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাসটিতে বাংলাদেশের রাজা প্রতাপাদিত্যের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। সমকালীন ঐতিহাসিক ও { লেখকেরা প্রতাপাদিত্যকে যেখানে জাতীয় বীরের মর্যাদায় ভূষিত করেছিলেন সেইখানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপন্যাসে প্রতাপাদিত্য চরিত্রটিকে নির্মম নিষ্ঠুররূপে চিত্রিত করে দেখিয়েছেন-তাঁর কারণেই অন্তঃপুরের শান্তি বিঘ্নিত হল, পুত্রকন্যার জীবন বিষময় হল, পিতৃব্য প্রাণ হারালেন এবং সদ্যবিবাহিতা কন্যা বিভার দাম্পত্যজীবন ব্যর্থ হল।
রাজর্ষি: ত্রিপুরার রাজবংশের কাহিনি অবলম্বনে রচিত ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসটি যথাযথ ঐতিহাসিক উপন্যাস হয়ে উঠেছে। রাজা গোবিন্দমাণিক্য ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের বলিদানের ঘোর বিরোধী ছিলেন কিন্তু মন্দিরের পূজারি রঘুপতি বলির পক্ষে-উভয়ের নিদারুণ দ্বন্দ্বের পটভূমিকায় উপন্যাসকাহিনি রচিত। ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসটিতেও রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন আচারসর্বস্বতার ঊর্ধ্বে মানবতার জয়। মানবিক মূল্য ও স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসার যে সাধনা রবীন্দ্রনাথ সমগ্র জীবন দিয়ে অন্বেষণ করেছেন, উপন্যাসটিতে সেই সাধনারই জয় সূচিত হয়েছে। পরবর্তীকালে এই উপন্যাসের কাহিনিধারা থেকে তিনি ‘বিসর্জন’ নাটকটি রচনা করেন।
৪। রবীন্দ্রনাথের দ্বন্দ্বমূলক উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করো।
চোখের বালি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত দ্বন্দ্বমূলক উপন্যাসগুলি হল- ‘চোখের বালি’, ‘নৌকাডুবি’ ও ‘যোগাযোগ’। বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা যখন রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে পুনঃপ্রকাশিত হয় তখন ‘নবপর্যায় বঙ্গদর্শন’-এর পাতায় আত্মপ্রকাশ করে বাংলার যুগান্তকারী উপন্যাস ‘চোখের বালি’। বাল্যবিধবা বিনোদিনীর হৃদয়ে পুরুষের প্রতি দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষার জাগরণ এবং তার মানসিক পরিবর্তনের টানাপোড়েন এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু। মহেন্দ্র, আশা, বিহারী ও বিনোদিনী-এদের জীবনের প্রেমঘটিত সমস্যা এবং তার গ্রন্থিমোচন রবীন্দ্রনাথের এই উপন্যাসে পাওয়া যায়। বঙ্কিমচন্দ্র যেখানে সমাজস্বীকৃত নয় এমন প্রেমের ক্ষেত্রে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সমাজসংস্কারের জয় ঘোষণা করেছেন, সেখানে রবীন্দ্রনাথ বাল্যবিধবার প্রেমকে অস্বীকার করতে পারেননি, আবার তাকে সমাজ-সংসারের স্বাভাবিক জীবনের মধ্যেও প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজন বোধ করেননি। উপন্যাসের ক্ষেত্রে মনোবিশ্লেষণমূলক রীতি রবীন্দ্রনাথের হাতে সম্পূর্ণতা লাভ করেছে এ কথা বলা যায়।
নৌকাডুবি ও যোগাযোগ: রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী দ্বন্দ্বমূলক উপন্যাস ‘নৌকাডুবি’ রোমান্টিক, সহজসরল বিষয়-আশ্রয়ী। তবে রমেশ-হেমনলিনী- নলিনাক্ষ-কমলা এই চরিত্রগুলির টানাপোড়েন যতটা পরিণত দক্ষতার সঙ্গে রূপলাভ করত ততখানি দক্ষতা ঔপন্যাসিকের কলম থেকে পাওয়া যায়নি। ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ‘তিন পুরুষ’ নামে প্রকাশিত ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে মধুসূদন ও কুমুদিনীর বিড়ম্বিত দাম্পত্যজীবনের অশান্তি ও পরিণাম ঔপন্যাসিক যথেষ্ট মুনশিয়ানার সঙ্গেই এঁকেছেন।
৫। সমাজসমস্যামূলক উপন্যাসের স্রষ্টা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের অবদান আলোচনা করো।
গোরা: বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে উত্তাল সামাজিক পরিবেশ ও বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক চেতনার অভিঘাত রবীন্দ্রনাথের যে-সমস্ত উপন্যাসগুলিতে প্রকাশিত সেগুলি হল-‘গোরা’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘চার অধ্যায়’। ‘গোরা’ উপন্যাস ইউরোপের ‘Epic Novel’-এর আদর্শে রচিত মহাকাব্যোপম উপন্যাস। সমগ্র জাতির মানসিক সংকটের কাহিনিই ‘গোরা’ উপন্যাসের প্রধান বক্তব্য বিষয়। গোরা, গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণ হিসেবে সর্বত্রই সোচ্চারে ঘোষণা করেছিল, হিন্দুপ্রধান ভারতে নিষ্ঠাভরে আচারধর্ম পালনের মধ্যেই প্রকৃত দেশহিতৈষিতা। কিন্তু উপন্যাসের পরিণামে গোরার জন্মবৃত্তান্ত উদ্ঘাটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছেড়ে তার মানবিকতায় উত্তরণ ঘটে।
ঘরে-বাইরে: বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসটিতে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন শুভচেতনাহীন দাম্ভিক দেশপ্রেমের ক্ষতিকর দিক। স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বিমলা, নিখিলেশ ও সন্দীপ- এই তিন জনকে ঘিরে মনস্তাত্ত্বিক আকর্ষণ-বিকর্ষণের কাহিনি আবর্তিত হয়। নিখিলেশের শান্ত, সংযত জীবনদর্শন ও বিমলার পতিপ্রেমের মাঝে উদ্ধত, অবিনয়ী, নারীলোলুপ সন্দীপ যেন মূর্তিমান ছন্দপতন। সন্দীপের চটকদার ইমেজে বিমলার স্খলন হলেও নিখিলেশের ধৈর্য ও মহানুভবতায় বিমলা আবার স্বাভাবিক-সংযত জীবনে প্রত্যাবর্তন করে। উপন্যাসের কাহিনিতে চরিত্রদ্বন্দ্ব, উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিণাম এবং নারীর সামাজিক অধিকার – সমস্ত দিকগুলি সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে।
চার অধ্যায়: রবীন্দ্রনাথের অপর একটি উপন্যাস ‘চার অধ্যায়’-এ আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ সামাজিক জীবনকে কতখানি বিপথে চালিত করেছিল তা বর্ণিত হয়েছে। অতীন্দ্র ও এলার ব্যর্থতার কথা উপন্যাসে মাত্র চারটি অধ্যায়ে বলা হয়েছে।
এই উপন্যাস তিনটির মধ্য দিয়ে দেশ, জাতীয়তাবাদ, স্বদেশপ্রেম ও সামাজিক কর্তব্যবোধ সম্বন্ধে রবীন্দ্রদর্শন প্রতিভাত হয়।
৬। রোমান্টিক উপন্যাস রচনার ধারায় রবীন্দ্রনাথের অবদান আলোচনা করো।
রোমান্টিক উপন্যাস রচনায় রবীন্দ্রনাথ: রবীন্দ্রনাথ তাঁর দু-একটি উপন্যাসে অসাধারণ কল্পনা ও রোমান্সকে প্রকাশ করেছেন। সেগুলি হল -‘চতুরঙ্গ’, ‘শেষের কবিতা’।
চতুরঙ্গ: ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে শচীশ-দামিনী-শ্রীবিলাস-এর যে বিচিত্র মানসিক দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কের টানাপোড়েনের ছবি প্রকাশিত, তাকে শুধুমাত্র মনোবিজ্ঞানতত্ত্বের সাহায্যে বিশ্লেষণ করা যায় না। চেতন মনের অন্তরালে যে রসধারা ফল্গুস্রোতের মতো প্রবহমান, এ যেন তারই ইঙ্গিত দেয়।
শেষের কবিতা: রবীন্দ্রনাথের শেষজীবনে রচিত রোমান্স-আশ্রয়ী উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’ যেন এক বিচিত্র বিস্ময়। অমিত ও লাবণ্যের প্রেমের আখ্যান এই কাহিনির প্রধান উপাদান হলেও এর মধ্যে কবি একটি গভীর তাৎপর্য সংযোজন করেছেন। দৈনন্দিন বিবাহিত জীবনের – কর্তব্যপীড়িত গতানুগতিকতা ও অপার্থিব রোমান্টিক প্রেমের স্বপ্নাভিসার এই দুয়ের মধ্যে মিল অসম্ভব। সেজন্য পরস্পরের প্রেমকে প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে রেখে অমিত-কেটি মিত্র এবং লাবণ্য-শোভনলাল সামাজিক বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়। উপন্যাসটির কাব্যময়তা, প্রেম ও সৌন্দর্যের স্বর্গলোক রচনা সমকালীন সমাজকে তো বটেই এমনকি, তার পরবর্তী সময়কেও আচ্ছন্ন করে রাখে। ‘শেষের কবিতা’ কবি-ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী সৃষ্টির অন্যতম।
দুই বোন ও মালঞ্চ: এগুলি ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ‘দুই বোন’ ও ‘মালঞ্চ’ নামে দুটি উপন্যাস রচনা করেন। মূলত ছোটোগল্পের আখ্যানকে দীর্ঘায়িত করে উপন্যাস দুটি রচিত। নারীর প্রিয়ারূপ আর জননীরূপের তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ‘দুই বোন’ উপন্যাসটি রচিত। ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসে একই তত্ত্ব কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে নীরজা-সরলা-আদিত্যের জীবনের মধ্য দিয়ে অঙ্কিত হয়েছে।
৭। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক কালে বাংলা উপন্যাসের গতিপ্রকৃতি আলোচনা করো।
রবীন্দ্র সমসাময়িক কালে বাংলা উপন্যাসের গতিপ্রকৃতি: উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রবীন্দ্রপ্রতিভার বিচ্ছুরণের পাশাপাশি অন্যান্য যেসব ঔপন্যাসিকরা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ছিলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, তাঁর চরিত ‘নবীন সন্ন্যাসী’, ‘রত্নদীপ’, ‘মনের মানুষ’, ‘আরতি’ ইত্যাদি উপন্যাস বহুলসমাদৃত। এরপর সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, মণীন্দ্রনাথ বসু, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁদের উপন্যাসগুলির মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রদর্শিত পথের অক্ষম অনুকরণের প্রচেষ্টা চালালেন। যদিও এই ধারার একমাত্র মৌলিক ও ব্যতিক্রমী উপন্যাস হল পরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের লেখা ‘অভয়ের বিয়ে’ ও ‘শুভ্রা’। এই সময়পর্বে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের হাতে বাংলা উপন্যাসে এক নতুন সামাজিক অভিঘাত সৃষ্টি হল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারতীয় মেয়েরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল এবং সমাজ তাদের মূলত গৃহকর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখত। এই সময়ে পুরুষতন্ত্রের শৃঙ্খল ভেঙে নিজেকে ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ে এগিয়ে আসেন স্বর্ণকুমারী দেবী, অনুরূপা দেবী, নিরুপমা দেবীর মতো সাহিত্যিকরা। স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘দীপ নির্বাণ’। তাঁর লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘মিবাররাজ’, ‘বিদ্রোহ’। তাঁর সামাজিক ও পারিবারিক উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘স্নেহলতা’, ‘কাহাকে’। অনুরূপা দেবীর লেখা কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘মহানিশা’, ‘মা’-এই উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে তিনি সমাজের আদর্শ ও প্রেরণাকে গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। নিরুপমা দেবীর লেখা উপন্যাস ‘উচ্ছৃঙ্খল’-এ রয়েছে প্রেম ও দাম্পত্যজীবনের অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা। এ ছাড়া নিরুপমা দেবী ও অনুরূপা দেবী হিন্দু সমাজের আদর্শ ও প্রেরণাকে গভীরভাবে উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
আরও পড়ুন | Link |
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
তেলেনাপোতা আবিষ্কার বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
আগুন নাটকের বড়ো প্রশ্ন উত্তর | Click Here |