নানা রঙের দিন নাটকের প্রশ্ন উত্তর (অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়) | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা | Nana ronger din natoker question answer | class 12 bengali 4th semester
১। “শিল্পকে যে-মানুষ ভালবেসেছে-তার বার্ধক্য মন্তব্যটির তাৎপর্য লেখো।
অথবা, শিল্পকে যে-মানুষ ভালোবেসেছে-তার বার্ধক্য নেই কালীনাথ, একাকীত্ব নেই”-বলতে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় কী বুঝিয়েছেন আলোচনা করো।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ-নাটক ‘নানা রঙের দিন’-এ দেখা যায়, বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় আটষট্টি বছর বয়সে এসে তাঁর অভিনয় জীবনের স্বর্ণযুগকে স্মরণ করে জীবনের উত্তাপ খুঁজেছেন। বয়সের কারণে বর্তমানে ‘দিলদার’-এর মতো গৌণ চরিত্র ছাড়া তাঁর অভিনয়ের সুযোগ মেলে না। কিন্তু তাঁর মনে এখনও উজ্জ্বল ঔরঙ্গজেব, সুজা, বক্তিয়ার ইত্যাদি চরিত্রে তাঁর অভিনয়ের স্মৃতি। শূন্য ও অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে মঞ্চের উপরে দাঁড়িয়ে প্রম্পটার কালীনাথকে সামনে রেখে এইসব চরিত্রের সংলাপ করতে থাকেন তিনি। এর মাধ্যমেই যেন তিনি খুঁজে পান প্রতিভার পুরোনো বিচ্ছুরণ-“প্রতিভা যার আছে, বয়েসে তার কী আসে যায়!”
এই নাট্যশিল্পকেই ভালোবাসতে গিয়ে একদিন তাঁর সংসার করা হয়নি, ভালোবাসার মানুষ দূরে সরে গিয়েছে, জীবনের শেষপর্বে এসেও নিঃসঙ্গ সেই মানুষটি অভিনয়কে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চেয়েছেন। মঞ্চের উপরে দাঁড়িয়ে জীবনের শেষ যুদ্ধযাত্রার আগে পিয়ারাবানুকে বলা সুজার সংলাপ উচ্চারণ করেছেন তিনি। আবেগবিহ্বল রজনীকান্ত বয়সকে মেনে নিয়েও শিল্পকেই চূড়ান্ত সত্য বলে ঘোষণা করেছেন-যার কাছে বার্ধক্য নেই, একাকিত্ব নেই, রোগ নেই, এমনকি মৃত্যুভয়কেও যা তুচ্ছ করতে পারে। এভাবেই শিল্পের কাছে দায়বদ্ধ একজন অভিনেতা হিসেবে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন।
২। “আমাদের দিন ফুরিয়েছে!”-কে, কোন্ প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছেন? বক্তার এই উপলব্ধির কারণ ব্যাখ্যা করো। ২+৩
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ-নাটক ‘নানা রঙের দিন’-এ প্রশ্নোদ্ভূত অংশটির বক্তা বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে অভিনয় জীবনের খ্যাতি এবং অভিনয়ের দক্ষতা ক্রমশই বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে বলে উপলব্ধি করেন রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। নায়ক চরিত্র থেকে তিনি এখন পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা মাত্র, এই নেতিবাচক অনুভূতি থেকে তাঁর মনে তীব্র হতাশার জন্ম নেয়। আর এই প্রসঙ্গেই প্রম্পটার কালীনাথ সেনকে উদ্দেশ্য করে তিনি মন্তব্যটি করেন।
মধ্যরাতে শূন্য প্রেক্ষাগৃহে মঞ্চের উপরে দাঁড়িয়ে অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে জেগে উঠেছে তাঁর অভিনয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল অতীত। অভিনয়ের জন্য একসময় জীবনের একমাত্র প্রেমের সম্পর্ককে ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি, তাঁর কাছে -অভিনয়ই ছিল বেঁচে থাকার অবলম্বন। অতীতের ওই দিনগুলিতে অনায়াসেই তিনি ফুটিয়ে তুলতেন ‘রিজিয়া’ নাটকে বক্তিয়ারের চরিত্র কিংবা ‘সাজাহান’ নাটকে ঔরঙ্গজেবের চরিত্র। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গলার কাজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নতুন চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতাও তাঁর নষ্ট হয়েছে-“… থিয়েটারের দেওয়ালে… লিখে দিয়ে গেল প্রাক্তন অভিনেতা রজনী চাটুজ্জের প্রতিভার অপমৃত্যুর করুণ সংবাদ!”। পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করতে করতে, বিভিন্ন চরিত্রের পুনরাভিনয়ের মাধ্যমে ‘জীবনের পাত্র শূন্যতায় রিক্ত’ হয়ে যাওয়ার উপলব্ধি গ্রাস করে অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে।
৩। ‘নানা রঙের দিন’ নাটকের মূল বক্তব্য সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, “রজনীকান্তের চরিত্রের মধ্যে একজন অভিনেতার চিরকালীন যন্ত্রণাই প্রকাশিত হয়েছে।”-আলোচনা করো।
আন্তন চেখভের সোয়ান সং অবলম্বনে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটিতে স্মৃতির পথ ধরে একজন অভিনেতার নিজেকে খোঁজার পটভূমিতে রয়েছে তাঁর বর্তমানের অসহায়তা এবং গ্লানি। এই গ্লানির একদিকে যেমন রয়েছে তাঁর ব্যক্তিজীবনের নিঃসঙ্গতা, অন্যদিকে রয়েছে অভিনয় জীবনের অপ্রাপ্তির হতাশা। নিঃসঙ্গ ব্যক্তিজীবন: পরিবারের কেউ না থাকায় একাকিত্বের কারণে তাঁর মনে জন্ম নেয় তীব্র অবসাদ। বারবার ফিরে আসে অভিনয়ের কারণে যৌবনের প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার দুঃসহ স্মৃতি।
অপ্রাপ্তির হতাশা: একসময়ের প্রধান চরিত্রাভিনেতা আজ দিলদারের মতো নিতান্তই গৌণ চরিত্রে অভিনয় করেন এবং “তাও আর বছর কয়েক পরে মানাবে না”-এই হতাশাই হয়তো অভিনেতা রজনীকান্তকে নেশার প্রতি আসক্ত করে তোলে। আর এই নেশার ঘোর থেকে মুক্তি পেতেই স্মৃতির পথ ধরে হাঁটেন তিনি। তখন ‘রিজিয়া’ নাটকে বক্তিয়ারের চরিত্রে কিংবা, ‘সাজাহান’ নাটকে ঔরঙ্গজেবের চরিত্রে অভিনয়ের স্মৃতি তাঁকে সেই শূন্য প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকারপ্রায় মঞ্চে সাময়িকভাবে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে। পরমুহূর্তেই বর্তমানের শূন্যতা ঘিরে ধরে তাঁকে। তাঁর মনে হয় মঞ্চ থেকে নেমে এলে অভিনেতার আর কোনো সামাজিক স্বীকৃতিই থাকে না। ইতিকথা: এভাবেই ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে একজন অভিনেতার জীবনের রূপ ও রূপান্তরের ছবিকে সার্থকভাবে তুলে ধরেছেন নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
৪।’নানা রঙের দিন’ নাটকের সংলাপ সৃষ্টিতে নাট্যকারের দক্ষতা আলোচনা করো।
‘অ্যারিস্টট্ল’ নাটক রচনার জন্য যে ছ-টি অঙ্গের উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে একটি হল সংলাপ। বিষয়ের ‘সঙ্গে দর্শকের সংযোগ তৈরি হয় এই সংলাপের মাধ্যমে। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে নাট্যকার একজন অভিনেতার জীবনের হতাশা এবং অতীতের স্মৃতিচারণার মাধ্যমে রূপ ও রূপান্তরের ছবিকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
বক্তৃতাধর্মী দীর্ঘ সংলাপ: দর্শকশূন্য অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে নেশাগ্রস্ত অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় নিজের মুখোমুখি নিজেই দাঁড়িয়ে বক্তৃতাধর্মী এবং দীর্ঘ ‘সংলাপগুলি বলেছেন। নিজের উপরে তাঁর নিয়ন্ত্রণ হারানোর বিষয়টিই যেন প্রকাশিত হয় দীর্ঘ সংলাপে। অসংলগ্ন, এলোমেলো ও অতিদীর্ঘ সংলাপগুলিকে আরও বাস্তবগ্রাহ্য করেছে মধ্যে মধ্যে হিন্দি সংলাপের প্রয়োগ -“বাঃ বাঃ বুঢ়া। আচ্ছাহি কিয়া।” সংলাপের ভিতরে সংলাপ: অজিতেশের সংলাপের আর-একটি বৈশিষ্ট্য হল সংলাপের ভিতরে সংলাপ নির্মাণ।
নিজের কথা বলতে বলতেই রজনীকান্তের বিবেকও যেন কথা বলে উঠেছে। একই সংলাপের মধ্যে তৈরি হয়েছে দুটি সত্তার চেতনাগত বিপরীতধর্মিতা। আবার “মাইরি, এই না হলে অ্যাকটিং।” ইত্যাদি কথ্যবুলির অসাধারণ প্রয়োগও দেখা যায় নাটকটিতে। আবার রজনীকান্তের যন্ত্রণার প্রকাশে ভাষায় গাম্ভীর্যও সৃষ্টি করেছেন নাট্যকার-“একেবারে নিঃসঙ্গ… ধু-ধু করা দুপুরে জ্বলন্ত মাঠে বাতাস যেমন একা-যেমন সঙ্গীহীন…”। এভাবেই চরিত্রের অবস্থার পরিবর্তন ও বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ‘নানা রঙের দিন’-এর সংলাপ অনন্য মাত্রা পেয়েছে।
৫। ‘নানা রঙের দিন’ নাটক অবলম্বনে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্র বিশ্লেষণ করো।
অথবা, ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের যে নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের ছবি ফুটেছে আলোচনা করো।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ-নাটক ‘নানা রঙের দিন’-এ আটষট্টি বছরের প্রবীণ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ই মুখ্য চরিত্র। নাটকটিতে দর্শকশূন্য অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে কখনও একা, কখনও প্রম্পটার কালীনাথ সেনের সঙ্গে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রজনীকান্ত যে কথাবার্তা বলেছেন, তা থেকে তাঁর চরিত্রের দুটি দিক উন্মোচিত হয়েছে। কখনও ব্যক্তি রজনীকান্ত, কখনও অভিনেতা রজনীকান্তের জীবন উঠে এলেও শেষপর্যন্ত একই সুতোয় গাঁথা হয়েছে এই দুটি জীবন।
ব্যক্তি রজনীকান্ত: রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় পারিবারিক সূত্রে রাঢ়বাংলার সবংশজাত ব্রাহ্মণ। যৌবনে সুপুরুষ রজনীকান্ত শুধুমাত্র অভিনয়ের নেশায় পুলিশের চাকরিতে ইস্তফা দেন। অভিনয়ের কারণেই প্রেমিকার সঙ্গেও তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে তিনি বুঝতে পারেন তিনি একজন নিঃস্ব, রিক্ত, একাকী মানুষ। বিশাল পৃথিবীতে কোনো স্বজন না থাকার মানসিক যন্ত্রণায় ক্রমাগত বিদ্ধ হতে থাকেন তিনি।
অভিনেতা রজনীকান্ত: পঁয়তাল্লিশ বছর থিয়েটারে জীবন কাটানোর পর রজনীকান্ত জীবনের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে পুরোনো স্মৃতির মধ্যেও আনন্দকে খুঁজেছেন। ‘রিজিয়া’ নাটকের বক্তিয়ার কিংবা ‘সাজাহান’ নাটকের ঔরঙ্গজেবের সংলাপ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি যেন অভিনেতা রজনীকান্তকে জীবিত রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই আবার হতাশা গ্রাস করেছে তাঁকে। ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার বা তার অভিনয়ের দিন শেষ হতে চলার যন্ত্রণা তাঁকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। তাঁর মনে হয়েছে যে, তিনি আসলে একা, কারণ সমাজজীবনে অভিনেতার কোনো স্বীকৃতি নেই, সম্মান নেই।
৬। ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে প্রম্পটার কালীনাথ সেনের চরিত্র আলোচনা করো।
কথামুখ: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ-নাটক ‘নানা রঙের দিন’-এ কালীনাথ সেন হলেন থিয়েটারের প্রম্পটার, যাঁর বয়স ষাটের কাছাকাছি। গভীর রাতে অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় যখন নেশার ঘোরে বুঁদ হয়ে একা মঞ্চে অসংলগ্ন আচরণ করছেন, তখনই ময়লা পাজামা পরে, কালো চাদর গায়ে এলোমেলো চুলের কালীনাথ সেনের মঞ্চে প্রবেশ ঘটে।
আশ্রয়হীন: আশ্রয়হীন কালীনাথের ব্যক্তিগত জীবনও রজনীকান্তের মতো বা তার থেকেও দুঃখের। তাই তিনি রোজ লুকিয়ে থিয়েটারের গ্রিনরুমে ঘুমোতে যান।
জীবনের হতাশাকে মানিয়ে নেওয়া: সারাজীবনের সমস্ত হতাশা, না-পাওয়া, আক্ষেপের সঙ্গে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। আর – এখানেই রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য। গভীর রাতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যখন রজনীকান্তের গলায় একরাশ হতাশা ঝরে পড়ে, তখন কালীনাথবাবু তাঁকে বারেবারে পুরোনো দিনের কথা না ভাবার পরামর্শ দেন।
নাটকে নিবেদিত প্রাণ: প্রম্পটার কালীনাথও যে নাটকের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক ব্যক্তিত্ব, তা বোঝা যায় যখন রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি মঞ্চের উপরে অনায়াস দক্ষতায় ‘সাজাহান’ নাটকে মহম্মদের সংলাপ থেকে শুরু করে দক্ষতার সঙ্গে বলে যান।
মানবিকতা: কালীনাথের চরিত্রে মানবিকতার প্রকাশ দেখা যায়। হতাশ এবং অবসাদগ্রস্ত রজনীকান্তের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। গভীর রাতে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিতেও চেয়েছেন। “আপনার প্রতিভা এখনও মরেনি…”-এই কথার মাধ্যমে তিনি হতাশ রজনীকান্তকে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছেন। ইতিকথা: এককথায় বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্তের চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলায় পার্শ্বচরিত্র হিসেবে প্রম্পটার কালীনাথ সেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন।
৭। ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে যে দুটি সত্তার প্রকাশ দেখা যায়, তা আলোচনা করো।
কথামুখ: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটির বেশিরভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে কেন্দ্রীয় চরিত্র আটষট্টি বছরের বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যয়ের স্বগতোক্তি। আর এই স্বগতোক্তির সূত্র ধরেই বেশ কিছু অংশে রজনীকান্তের দুটি সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
আন্তরসত্তা: গভীর রাতে শূন্য প্রেক্ষাগৃহে মঞ্চের উপরে সম্পূর্ণ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তাঁর আন্তরসত্তার জাগরণ ঘটে। সেই সত্তাই রজনীবাবুকে অর্থাৎ নিজেকেই শরীরের দিকে নজর দিতে বলে, নিজের বয়সের কথা ভেবে মদের নেশা ছেড়ে দিতে বলে। যখন অন্য প্রবীণ মানুষেরা সংযত জীবন কাটান, পরিমাণমতো খাওয়াদাওয়া করেন, ঈশ্বরের নাম করেন-তখন মাঝরাতে দিলদারের পোশাক পরে রজনীবাবুর ‘পেটভর্তি মদ গিলে’ ‘থিয়েটারি ভাষায়’ ‘আবোলতাবোল’ বকা একেবারেই যুক্তিযুক্ত মনে হয় না তাঁর।
অভিনয়সত্তা: এই আন্তরসত্তার অন্যপিঠে আছে আর-এক সত্তার করুণ বাস্তব। সেখানে রয়েছে বয়সের ভারে ক্রমশ জীর্ণ হয়ে আসা এক বৃদ্ধ অভিনেতা। সেই অভিনেতার গলায় একদিকে শোনা যায় ব্যক্তিজীবনের নিঃসঙ্গতার হাহাকার, অন্যদিকে থাকে অভিনেতা হিসেবে ক্রমশ নিজের ক্ষমতা হারানোর যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণা থেকেই রজনীকান্তবাবু স্মৃতির পথে হাঁটেন। নিজের অভিনয় জীবনের স্বর্ণযুগে অভিনীত উল্লেখযোগ্য চরিত্ররা ভিড় করে তাঁর মনে। পেশাগত জীবনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনেও সব হারানোর এই হতাশাই চূড়ান্ত হয়ে ওঠে অভিনেতা রজনীকান্তের বাহ্যিক চেতনায়।
৮। নানা রঙের দিন’ নাটকের সমাপ্তির তাৎপর্য আলোচনা করো।
নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অনুবাদ-নাটক ‘নানা রঙের দিন’-এর সমাপ্তিতে বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মুখে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণভাবে শেকসপিয়রের নাটকের একাধিক সংলাপ ব্যবহার করেছেন। ‘ওথেলো’ নাটকের তৃতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে ইয়েগোর প্ররোচনায় ডেসডিমোনার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ওথেলো উচ্চারণ করেছিলেন- “Farewell the tranquil mind!”-ব্যক্তিগত বিষণ্ণতায় যুদ্ধক্ষেত্রকে বিদায় জানিয়েছিলেন তিনি। নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্তের ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতা আর ক্রমশ শেষ-হতে-চলা অভিনয় জীবনের হতাশাকে মেলাতে চেয়েছেন একইভাবে।
অন্যদিকে, ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে সেইটেন যখন ম্যাকবেথকে লেডি ম্যাকবেথের মৃত্যুসংবাদ দেয়, তখন তাঁর যন্ত্রণাবিদ্ধ উচ্চারণ “Life’s but walking shadow…” যেন হারিয়ে যাওয়া অসাধারণ অভিনয়ের দিনগুলিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাওয়া হতাশ রজনীকান্তের যন্ত্রণার সঙ্গে মিলে যায়। কিংবা নেপথ্য থেকে ভেসে আসা রিচার্ড দ্য থার্ড-এর সংলাপ- “A horse! A horse! My kingdom for a horse!” -যুদ্ধক্ষেত্রে প্রিয় ঘোড়ার মৃত্যুতে বিষণ্ণ রিচার্ডের এই উচ্চারণ, অভিনয় জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে অতীতের সোনালি দিনগুলোর জন্য রজনীকান্তের আক্ষেপকেই প্রকাশ করে।
৯। ‘নানা রঙের দিন’ একাঙ্ক নাটক হিসেবে কতখানি সার্থক আলোচনা করো।
মাত্র একটি অঙ্ক বা সর্গ বা পরিচ্ছেদে সমাপ্ত, দ্রুতসংঘটিত নাটকই হল একাঙ্ক নাটক। এটি এমন এক ধরনের নাটক যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল একমুখিতা। অবশ্য আদর্শ নাটকের সমস্ত লক্ষণ একাঙ্ক নাটকেও উপস্থিত থাকে।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটি হল প্রবীণ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ফেলে আসা অভিনয়জীবনের স্মৃতিরোমন্থন। মঞ্চে দেখা যায়, দিলদারের পোশাক পরে মধ্যরাতের শূন্য প্রেক্ষাগৃহে এই মানুষটি নেশার ঘোরে রয়েছেন। আসলে তিনি রয়েছেন স্মৃতির ঘোরে। পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিনয়জীবনের স্বর্ণযুগ পেরিয়ে এসেছেন সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ এই সু-অভিনেতা। অভিনয়ের জন্য সব কিছু ত্যাগ-করা এই মানুষটি হতাশাদীর্ণ হয়ে বলেছেন, “অভিনেতা মানে একটা চাকর, একটা জোকার, একটা ক্লাউন।” তাঁর মনে হয়েছে, “যারা বলে ‘নাট্যাভিনয় একটি পবিত্র শিল্প’-তারা সব গাধা-গাধা।” কিন্তু জীবনসায়াহ্নে উপনীত অভিনেতা সেই অভিনয়ের মধ্যেই আত্মতৃপ্তি এবং গর্বের উপাদান খোঁজেন। অতীতকে সম্বল করে, মঞ্চের রঙিন দিনগুলিকে আঁকড়ে ধরে এই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ অনুভব করেন, “স্মৃতি সততই সুখের।”
সুতরাং, এক এবং অভিন্ন বিষয় নিয়েই এই নাটকটি রচিত হয়েছে। আর নাটকের প্রাণ হল দ্বন্দ্ব, সেই নাট্যদ্বন্দ্বও এই নাটকটিতে উপস্থিত রয়েছে। অভিনেতা রজনীকান্তের অন্তর্দ্বন্দ্ব নাটকটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ‘ঘটনার ঘনঘটা’ এখানে অনুপস্থিত। মাত্র দুটি চরিত্রের (কালীনাথ ও রজনীকান্ত) সংলাপের মধ্য দিয়ে নাটকটি নির্মিত হয়েছে। রজনীকান্ত চরিত্রটির দীর্ঘ সংলাপ মাঝেমধ্যেই নাটকটির গতি রুদ্ধ করে দিলেও প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠক বা দর্শক টানটান অবস্থায় উপভোগ করতে পারেন এর নাট্যরস। সুতরাং, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’-কে আমরা শিল্পসার্থক একাঙ্ক নাটক বলতেই পারি।
১০। “জানো, কালীনাথ, একটি মেয়ে।”-যেভাবে বক্তা কালীনাথকে বর্ণনা করেছেন তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। রজনীর জীবনে এই মেয়েটির প্রভাব আলোচনা করো। ২+৩
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে প্রধান চরিত্র রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় সহ-চরিত্র কালীনাথ সেনকে উদ্দেশ করে তার জীবনের একমাত্র প্রেম সম্পর্কটির উল্লেখ করেছেন। প্রথম যখন তিনি থিয়েটারে আসেন, তখনই রজনীকান্তের অভিনয় দেখে মেয়েটি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। রজনীকান্তের বর্ণনা অনুযায়ী সে ছিল বেশ বড়ো লোকের মেয়ে এবং সুন্দর দেখতে। লম্বা, ফরসা, ছিপছিপে গড়নের। আর দারুণ ভালো ছিল তার মন, সে মনে কোনো জটিলতা ছিল না।
কিন্তু তারই মধ্যে কোথাও যেন আগুন লুকিয়ে ছিল, “গ্রীষ্মের বিকেলে পশ্চিম আকাশে সূর্যাস্তের মেঘে যে আগুন লুকিয়ে রাখে, সেই আগুন।” তার দীর্ঘ কালো চোখ রজনীকান্তের কাছে যেন ছিল “কোন অচেনা দিনের আলো”। অদ্ভুত ছিল তার হাসি। আর রাশি রাশি কালো চুল, যা ছিল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, তা যেন দুর্গম পাহাড়কে ধসিয়ে দিতে পারে, পৃথিবীতে প্রলয় ঘটাতে পারে। মেয়েটিকে দেখে মুগ্ধ রজনীকান্তের মনে হয়েছিল “ভোরের আলোর চেয়েও সুন্দর সে”।
অভিনেতা রজনীকান্তের জীবনে এই মেয়েটির প্রভাব বহুমাত্রিক। মেয়েটির সৌন্দর্য এবং স্বভাবে আকৃষ্ট রজনীকান্তের মধ্যে প্রাথমিকভাবে তৈরি হয়েছিল প্রবল মুগ্ধতা। আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠতা, ঘনিষ্ঠতা থেকে প্রেম এবং একদিন তার পরিণতি ঘটানোর ইচ্ছাতেই রজনীকান্ত তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মেয়েটি পালটা প্রস্তাব দেয় রজনীকান্তকে, -বিয়ের জন্য থিয়েটার ছেড়ে দিতে হবে। সম্পর্কের সেখানেই ইতি ঘটে, কিন্তু রজনীকান্তের মনে এক নতুন উপলব্ধির জন্ম হয়,-“বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে, থিয়েটারের লোকের সঙ্গে জীবনভর প্রেম করতে পারে, কিন্তু বিয়ে? নৈব নৈব চ।” এবং সম্পর্কের এই ব্যর্থতা রজনীকান্তকে আরও এক উপলব্ধিতে পৌঁছে দেয় যে, যারা বলে ‘নাট্যাভিনয় এক পবিত্র শিল্প’ তারা মিথ্যা বলে। নাটকের অভিনেতাদের কোনো সামাজিক স্বীকৃতি নেই।