প্রধান আঞ্চলিক সংগঠনসমূহ প্রশ্ন উত্তর (দ্বিতীয় অধ্যায়) | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান

সূচিপত্র

প্রধান আঞ্চলিক সংগঠনসমূহ প্রশ্ন উত্তর (দ্বিতীয় অধ্যায়) | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান | HS 4th Semester Political Science 2nd Chapter Long Question Answer

প্রধান আঞ্চলিক সংগঠনসমূহ প্রশ্ন উত্তর
প্রধান আঞ্চলিক সংগঠনসমূহ প্রশ্ন উত্তর

১। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্ভব কীভাবে ঘটেছে? অথবা, ECSC থেকে EU তে রূপান্তরের প্রক্রিয়া আলোচনা করো।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্ভব: ১৯৫০-এর দশক থেকে ইউরোপে সংহতি প্রয়াসের একটি সুসজ্জিত ধারা পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিম ইউরোপের বেশিরভাগ দেশই এর সদস্য হয়।

ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা পরিষদ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্শাল পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইউরোপের অর্থনৈতিক সহযোগিতা পরিষদ অর্থাৎ Organisation for European Economic Cooperation (OEEC) গঠন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ‘মার্শাল পরিকল্পনার’ অধীনে যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন কার্য সফল করে তোলার লক্ষ্য গৃহীত হয়। OEEC প্রথম ইউরোপে আর্থিক সহযোগিতার ভিত্তিপ্রস্তর রচনা করে।

ইউরোপীয় কোল অ্যান্ড স্টিল কমিউনিটি : ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে দ্বন্দ্ব ইউরোপের শান্তি ও সহযোগিতা স্থাপনের পথে প্রধান বাধা ছিল। তাই এই বাধা দূর করে ইউরোপে সংহতি স্থাপন করতে এবং শিল্প, বাণিজ্য, জ্বালানী, পরিবহন ইত্যাদি বিষয়ে আন্তঃসহযোগিতার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল প্যারিস চুক্তির পরিণতিস্বরূপ ইউরোপীয় কোল ও স্টিল কমিউনিটি অর্থাৎ ECSC সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী তথা অংশগ্রহণকারী ছয়টি রাষ্ট্র ছিল-বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ড এবং পশ্চিম জার্মানি। এই সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য ছিল এর সদস্যরাষ্ট্রগুলির মধ্যে কোক কয়লা, কয়লা, লৌহ ইস্পাতজাত পণ্যের উৎপাদন ও বাণিজ্যের পথে সমস্তরকম প্রতিবন্ধকতার অবসান ঘটানো। ১৯৫৭-র মার্চ মাসে ইতালির রাজধানী রোমে একটি অভিন্ন বাজার গঠনের উদ্দেশ্যে ছয়টি রাষ্ট্র চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা রোম চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তির পরিণতিতে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায় (European Economic Community বা EEC) গড়ে ওঠে, যা ‘কমন মার্কেট’ নামেও পরিচিত। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি থেকে এই অর্থনৈতিক গোষ্ঠী সক্রিয়ভাবে কার্য পরিচালনা শুরু করে।

ইউরোপীয় কমিউনিটি স্থাপন: ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্বসূরী হল ইউরোপীয় কমিউনিটি। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস-এ স্বাক্ষরিত ব্রাসেলস চুক্তি বা সংযুক্তিকরণ চুক্তি দ্বারা এই তিনটি সংস্থা ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়, ইউরোপীয় কোল অ্যান্ড স্টিল কমিউনিটি এবং ইউরোপীয় অ্যাটমিক এনার্জি কমিউনিটি একত্রিত হয়ে ইউরোপীয় গোষ্ঠী গঠিত হয়।

ম্যাসট্রিক্ট চুক্তি : যাইহোক ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে রোম চুক্তি সংশোধনের মাধ্যমে একক ইউরোপীয় আইন প্রণয়ন করে ইউরোপের ঐক্যসাধনের প্রক্রিয়াকে দ্রুত করার চেষ্টা শুরু হয়। এই আইন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) গঠনের পথ প্রশস্ত করে। এর পরিণতি পরিলক্ষিত হয় ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত ম্যাসট্রিক্ট চুক্তির মধ্যে দিয়ে। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে নেদারল্যান্ডের ম্যাসট্রিক্ট শহরে ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের প্রতিনিধিগণ মিলিত হয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা ম্যাসট্রিক্ট চুক্তি বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন চুক্তি নামে পরিচিত। তার ফলস্বরূপ গঠিত হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যা ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়।

২। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাফল্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

অথবা, গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সংগঠন হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তাৎপর্য আলোচনা করো।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংগঠনটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলভাবে ভূমিকা পালন করে চলেছে। এগুলি হল-

(i) সদস্যরাষ্ট্রগুলির মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্যোগ: ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্যরাষ্ট্রগুলির মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিক্ষা, বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি করার জন্য কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে।

(ii) বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ: ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন একটি ব্যতিক্রমী আঞ্চলিক সংগঠন যার নিজস্ব বিদেশনীতি রয়েছে। সদস্যরাষ্ট্রগুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সামগ্রিকভাবে একটি যৌথ বিদেশনীতি তৈরি করে। অনেকসময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্যরাষ্ট্রগুলির পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্বও করে থাকে। অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলির স্বতন্ত্রভাবে বিদেশনীতি প্রণয়নের আবশ্যিকতা পড়ে না।

(iii) অভিন্ন মুদ্রা ‘ইউরো’ প্রচলন: ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার সদস্যদেশগুলির জন্য একটি অভিন্ন মুদ্রা ‘ইউরো’ চালু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এটি একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো আঞ্চলিক সংগঠন এই ধরনের অভিন্ন মুদ্রা চালু করতে পারেনি। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত ৭টি দেশ (বুলগেরিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রোমানিয়া ও সুইডেন) ইউরো ব্যবহার করে না।

(iv) একক বাজার: ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধীনে একটি একক বাজার রয়েছে। এই বাজারে সদস্যদেশগুলিতে উৎপাদিত জিনিসপত্রের অবাধ কেনাবেচা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই একক বাজারে সদস্যদেশগুলির উৎপাদিত পণ্য, পুঁজি ইত্যাদির অবাধ আদানপ্রদান সুনিশ্চিত করেছে।

(v) বাণিজ্য নীতি ও অন্যান্য নীতি: ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য অঞ্চল। এই বাণিজ্যিক অঞ্চলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে বাণিজ্য চুক্তি হয় তার তত্ত্বাবধানও ইউরোপীয় ইউনিয়ন করে থাকে। বাণিজ্য ছাড়াও পরিবেশ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, গবেষণা ও উন্নয়নের বিষয়ে নীতি নির্দেশিকা তৈরি করার কাজও করে থাকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

(vi) আইন প্রণয়ন ও আইনি বিরোধ নিষ্পত্তি: ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্যরাষ্ট্রগুলির জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করে থাকে। তার পাশাপাশি সদস্যরাষ্ট্রগুলির মধ্যে কোনো আইনি বিরোধ থাকলে তা মীমাংসা করা বা আইনি বিরোধের নিষ্পত্তি করার কাজও করে থাকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

৩। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্যর্থতাগুলি সম্পর্কের আলোচনা করো।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্যর্থতা: একুশ শতকের দিক থেকে EU বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে শুরু করেছে। জাতিগত ভাবাবেগ ইউরোপের সংহতি রক্ষার ক্ষেত্রে নতুন সমস্যা তৈরি করেছে।

(i) মুদ্রা সংকট প্রতিরোধে ব্যর্থতা: সমগ্র ইউরোপ জুড়ে অভিন্ন মুদ্রার প্রচলনের ফলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সফল হয়েছে ঠিকই, তবে অত্যধিক ঋণভারে জর্জরিত হওয়ার কারণে বহু রাষ্ট্র যেমন- গ্রিস, স্পেন, আয়ার্ল্যান্ড আন্তর্জাতিক অর্থ সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল। মূলত গ্রিস, স্পেন ও ইতালিতে অনিয়ন্ত্রিত ব্যাংক ঋণের প্রসারের ফলে আর্থিক মন্দা দেখা দেয়। গ্রিসকে আর্থিক সংকট থেকে রক্ষা করতে EU ব্যাপক আর্থিক অনুদান দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় ইউরোপেও আর্থিক ধস নামার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আয়ব্যয় জনিত বৈষম্য তীব্র হয়। অন্যান্য ইউরোপীয় ও বিদেশি রাষ্ট্র যে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল তা তুলে নিতে থাকে যা ইউরোপের আর্থিক সংকটকে প্রকট করে তোলে। এর ফলে ২০০৮ সাল থেকে ইউরোপীয় ঋণ সংকটে জর্জরিত সদস্যদেশগুলি অভ্যন্তরীণ খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছে।

(ii) নিরাপত্তা সুনিশ্চিতকরণের প্রশ্নে ব্যর্থ: ম্যাসট্রিক্ট চুক্তির শর্তানুযায়ী সমগ্র ইউরোপ জুড়ে অভিন্ন নিরাপত্তা নীতি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলিতেও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া ইউরোপে বেশকিছু সন্ত্রাসবাদী আক্রমণও ঘটেছে। – যেমন- ২০০৪ সালে মাদ্রিদে ট্রেনে বোমা হামলা হয়, নরওয়ে ও ফ্রান্সে উগ্রপন্থী হামলায় প্রচুর লোক নিহত হয়, ফলে EU সার্বিক নিরাপত্তা রক্ষা ও সন্ত্রাসবাদ দমনে ব্যর্থ হয়েছে।

(iii) অভিবাসন ও শরণার্থী সমস্যা: বিগত কয়েক বছরব্যাপী ইউরোপে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী আগমনের বিষয়টি EU-কে এক গভীর সংকটের মধ্যে ফেলেছে। গত এক দশকে ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে বহু মানুষ ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে। পূর্ব ইউরোপের স্বল্পোন্নত দেশগুলি যেমন-পোল্যান্ড, শ্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরী থেকে প্রচুর অভিবাসী পশ্চিম ইউরোপের উন্নত রাষ্ট্রগুলিতে উন্নত জীবনধারণের আশায় আশ্রয় গ্রহণ করে। যা নিয়ে দেশগুলির মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক দেশ শরণার্থী গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। ফলে দূরদূরান্ত থেকে আগত বহু শরণার্থীর পুনর্বাসন নিয়ে আজও কোনো সঠিক সমাধানের রাস্তা বেরোয়নি।

(iv) অখন্ডতা রক্ষায় ব্যর্থ: অখণ্ড ইউরোপের যে আশা জাগিয়ে EU গড়ে উঠেছিল তা রক্ষায় EU ব্যর্থ হয়েছে। এর সবথেকে বড়ো প্রমাণ হল ব্রিটেনের EU থেকে বেড়িয়ে আসা বা Brexit। ব্রিটেনের বেড়িয়ে আসার পর EU-এর কর্তৃপক্ষদের মনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রসঙ্গত জার্মানির তৎকালীন চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মর্কেল এবং EU-এর অন্যান্য নেতৃত্ব EU-কে অখন্ড রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল।

৪। সার্ক গঠনের উদ্দেশ্য ও নীতিগুলি আলোচনা করো।

সার্ক গঠনের উদ্দেশ্য: সার্কের সনদের ১নং ধারায় এর উদ্দেশ্যসমূহ সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি হল:

  • দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের সার্বিক কল্যাণসাধন এবং তাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি সাধন করা।
  • এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক প্রগতি ও সাংস্কৃতিক বিকাশ প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার করা।
  • দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে সমষ্টিগত স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি করা।
  • সদস্যদেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, বিশ্বাস গড়ে তোলা ও পারস্পরিক সমস্যা অনুধাবনে। বোঝাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা।
  • অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের ক্ষেত্রে সদস্যরাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সহযোগিতা ও পারস্পরিক সাহায্যের সম্পর্ক গড়ে তোলা।
  • বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা শক্তিশালী করা।
  • সমস্বার্থসম্পন্ন অন্যান্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংগঠনগুলির সঙ্গে সহযোগিতা করা।

সার্কের নীতিসমূহ: সার্কের উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে সার্কের সনদের ২ নং ধারায় নিম্নলিখিত নীতিসমূহ সংযোজিত হয়েছে। যথা-

  • সার্কের সদস্যগণ ধনী, দরিদ্র, ক্ষুদ্র, বৃহৎ, শক্তিশালী, শক্তিহীন নির্বিশেষে সমমর্যাদার অধিকারী হবে। ফলে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা, সমতা, ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়ে সাম্যনীতি অনুসৃত হয়েছে। পাশাপাশি সার্কের রাষ্ট্রগুলি পারস্পরিক আদানপ্রদানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে, সার্কের রাষ্ট্রগুলি একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।
  • রাষ্ট্রগুলি পারস্পরিক শ্রদ্ধা বিনিময়ের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করবে।
  • সদস্যরাষ্ট্রগুলির এই পারস্পরিক সহযোগিতা তাদের দায়িত্বপূর্ণ কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। সার্কের কোনো রাষ্ট্র এমন কোনো আচরণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে যা অন্য সদস্যরাষ্ট্রের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এই নীতিসমূহের রূপায়ণের জন্য সনদে সার্কের কতকগুলি দায়িত্বও বর্ণিত হয়েছে। যেমন- সহযোগিতামূলক কর্মসূচির সমন্বয়সাধন।কর্মসূচি ও প্রকল্প নির্ধারণ করে সেগুলির অর্থসংস্থান অনুমোদন করা। আঞ্চলিক ক্ষেত্র ও বহির্দেশের থেকে অর্থ সংস্থানের জন্য সচেষ্ট হওয়া। সহযোগিতামূলক কর্মসূচি নির্ধারণের জন্য নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করা।

৫। SAARC-এর সাফল্যগুলি আলোচনা করো। অথবা, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে সার্কের ভূমিকার মূল্যায়ন করো।

অথবা, সার্কের কার্যাবলি বিশ্লেষণ করো।

অথবা, সার্ক কি একটি সফল সংগঠন? মূল্যায়ন করো।

সার্কের সাফল্য: আর্বিভাব লগ্ন থেকেই সার্কের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সদস্যরাষ্ট্রগুলি পারস্পরিক আদানপ্রদান বৃদ্ধি করেছে। এর উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলি হল-

① পারস্পরিক সহাযাগিতা: সার্কের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে আঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিমাণ পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া অভিন্ন নদীগুলির জলবণ্টন, তথ্যপ্রযুক্তির আদানপ্রদান, উপগ্রহভিত্তিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে নানা প্রকার যৌথ কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে।

② SAPTA স্বাক্ষর : ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা, বাংলাদেশে SAPTA অর্থাৎ SAARC Preferential Trading Arrangement চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মাধ্যমে সার্কভুক্ত দেশগুলি পরস্পরকে বহুবিধ বাণিজ্যিক সুবিধাদানের অঙ্গীকার করে। এই সকল সুবিধার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-রফতানি শুল্ক তুলে দেওয়া, নির্দিষ্ট কিছু দ্রব্যে শুল্ক ছাড়, অভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা প্রভৃতি। দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক সহযোগিতা প্রসারে এটি ছিল একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। যা আরও প্রসারিত হয় SAFTA-র মাধ্যমে।

③ SAFTA চুক্তি স্বাক্ষর: সার্কের সদস্যরাষ্ট্রগুলির মধ্যে আন্তর্দেশীয় বাজার ও অর্থনৈতিক আদানপ্রদানের লক্ষ্যে SAFTA বা দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল নামে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

④ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব বৃদ্ধি: সার্ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে তার সাফল্যের নজির রেখেছে। ফলে বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সার্কের গুরুত্ব ও সম্মান যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশুকল্যাণ বিষয়ে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনিসেফের UNICEF) সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি, ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও পরিবেশ বিষয়ে UNDP-এর সঙ্গে চুক্তি, ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে মাদক দ্রব্যের নিষিদ্ধকরণ বিষয়ে UNDCP-এর সঙ্গে চুক্তি, এশিয়া প্যাসিফিক টেলিকমিউনিটির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি প্রভৃতি ছিল এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

⑤ সফল দ্বিপাক্ষিক চুক্তি: সার্কভুক্ত দেশগুলির বিশেষত জলসম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সার্কের পদক্ষেপ প্রশংসাযোগ্য। যেমন-ভারত-নেপাল মধ্যে বিভিন্ন সময়ে সুসম্পর্কের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। মহাকালী নদী চুক্তি, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর জলবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তিগুলি স্বাক্ষরের ফলে দেশগুলির মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধের অবসান হয়েছে এবং উন্নয়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সম্ভব হয়েছে।

৬। সাফটার উদ্দেশ্যগুলি কী কী?

উত্তর সাফটার উদ্দেশ্যসমূহ: সাফ্টার উদ্দেশ্যগুলি হল-

① SAFTA চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলির সম্মতি, প্রবিধান, সিদ্ধান্ত, বোঝাপড়া এবং প্রোটোকল দ্বারা SAFTA সংগঠন পরিচালিত হবে।

② মারাকেশ চুক্তির অধীনে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং অন্যান্য চুক্তি অনুযায়ী SAFTA-র সদস্যরাষ্ট্রগুলি তাদের অধিকার ও কর্তব্য সুনিশ্চিত করবে।

③ সাফ্টা চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিকতা ও সুবিধা আদানপ্রদানমূলক নীতি গড়ে তুলতে হবে। যাতে সমস্ত চুক্তিকারী দেশগুলি শিল্প ও আর্থিক উন্নয়ন, বাণিজ্য এবং শুল্ক নীতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে সমানভাবে উপকৃত হয়।

④ সাফটাভুক্ত দেশগুলি পণ্যের অবাধ চলাচল, উন্মুক্ত বাণিজ্য, শুল্ক অপসারণ-সহ অন্যান্য সমতুল্য ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করবে।

⑤ সাফটা চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রগুলি বাণিজ্য সংক্রান্ত ক্ষেত্রগুলিতে আইনের সমন্বয় সাধন করবে।

(6) স্বল্পোন্নত দেশগুলির (ভুটান, নেপাল, আফগানিস্তান) বিশেষ চাহিদাকে স্বীকৃতি প্রদান করে তাদের অনুকূলে অগ্রাধিকারমূলক চুক্তির ব্যবস্থা করবে।

৭। আসিয়ান কীভাবে গঠিত হয়? এর সদস্যসংখ্যা কত?

অথবা, আসিয়ান গঠনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

আসিয়ান গঠনের ইতিহাস ও সদস্যসংখ্যা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পর্বে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছে। ঠান্ডা লড়াই পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলকে ব্যবহার করেছে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে, যার ফসল হল ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণপূর্ব এশীয় চুক্তি সংগঠন বা Southeast Asia Treaty Organiztion (SEATO)। কিন্তু এই অঞ্চলের বাষ্ট্রসমূহ সামরিক জোট অপেক্ষা ১৯৬০-র দশকের শুরু থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলায় অধিক আগ্রহী ও উদ্যোগী হয়। ফলস্বরূপ ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে এই অঞ্চলের পাঁচটি দেশ ফিলিপাইনস্, ইন্দোনেশিয়া, মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড মিলিত হয়ে যৌথ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের লক্ষ্যে ব্যাংকক ঘোষণাপত্র বা আসিয়ান ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করে। যার ফসল হল দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার জাতিগুলির সংগঠন বা আসিয়ান ASEAN)। ‘আসিয়ান’-এর পুরো নাম হল Association of Southeast Asian Nations।

পরবর্তীকালে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ আসিয়ানের সদস্যপদ গ্রহণ করেছে। এগুলি হল যথাক্রমে বুনেই (১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ), ভিয়েতনাম (১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ), লাওস (১৯৯৭খ্রিস্টাব্দ), মায়ানমার (১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ) এবং কম্বোডিয়া (১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ)। বর্তমানে আসিয়ান ১০টি দেশ নিয়ে গঠিত একটি আঞ্চলিক সংগঠন। এর সদর দফতরটি ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় অবস্থিত।

১০টি স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র ছাড়াও এই সংগঠনের দুটি পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র রয়েছে যথা- পাপুয়া নিউ গিনি খ্রিস্টাব্দ) এবং ইস্ট তিমুর (২০০২ সাল)।

৮। আসিয়ানের সাফল্যগুলি আলোচনা করো।
অথবা, একটি সফল আঞ্চলিক সংগঠন হিসেবে আসিয়ানের ভূমিকা আলোচনা করো।
অথবা, আসিয়ান যে একটি সফল সংস্থা হিসেবে বিকশিত হয়েছে, তা দেখানোর জন্য চারটি কারণ উল্লেখ করো।

আসিয়ানের সাফল্য: এই উদ্দেশ্যগুলি বাস্তবায়ন করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। আঞ্চলিক সংগঠন হিসেবে আসিয়ানের সাফল্যগুলি হল-

(i) আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা: দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মালয়শিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে আসিয়ানের বিদেশ মন্ত্রীগণ মিলিত হয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়াকে Zone of Peace, Freedom and Neutrality (ZOPFAN) হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এই অঞ্চলটিকে ‘পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল’ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আসিয়ানের ১০টি সদস্যরাষ্ট্র ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর ‘দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল চুক্তি’ (Southeast Asia Nuclear Weapon Free Zone Treaty – SEANWFZ Treaty) স্বাক্ষর করা হয়।

(ii) আর্থিক অগ্রগতি সুনিশ্চিতকরণ: ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল বা ASEAN Free Trade Area (AFTA) গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। AFTA-এর লক্ষ্য হল আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলির প্রতিযোগিতার সামর্থ্য যাতে যৌথভাবে বৃদ্ধি করা যায় তার উদ্যোগ নেওয়া। এর পাশাপাশি, বাণিজ্য শুল্ক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে এই অঞ্চলের বাণিজ্যের বিকাশ ঘটানো। আসিয়ান ‘মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল’-কে কার্যকর করার জন্য সাধারণ কার্যকরী অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক স্বাক্ষরিত হয়। যার মাধ্যমে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলির উৎপাদিত পণ্যগুলিকে এর আওতায় আনা হয়।

এ ছাড়া দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় আমদানি শুল্ক বিলোপের অঙ্গীকার করা হয় যাতে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে একটি আসিয়ান অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ASEAN Economic Region গড়ে তোলা যায়।

(iii) সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সহযোগিতা: ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় আসিয়ান সাংস্কৃতিক তহবিল স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হল আসিয়ান সদস্যগুলির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা এবং আসিয়ানের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান বৃদ্ধি করা, সর্বোপরি আসিয়ান সাংস্কৃতিক সহযোগিতা কর্মসূচির অর্থায়নের ব্যবস্থা করা।

(iv) বহুপাক্ষিক অংশীদারিত্ব: বিভিন্ন শীর্ষ সম্মেলনে এবং ফোরামের মাধ্যমে আসিয়ান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, জাপান-এর মতো প্রধান আন্তর্জাতিক শক্তিগুলির সঙ্গে তার বহুপাক্ষিক অংশীদারিত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এর ফলে আসিয়ানের ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য অনেক বেড়ে গেছে।

এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে আসিয়ান প্লাস থ্রি-র মাধ্যমে আসিয়ানের ১০টি সদস্য গণপ্রজাতন্ত্রী চিন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা সম্প্রসারিত করে।

এ ছাড়া ২০০৭ সালে আসিয়ান প্লাস সিক্স গঠিত হয়। এতে আসিয়ানের ১০টি সদস্যের সঙ্গে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ৬টি রাষ্ট্র যথা-চিন, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ড অন্তর্ভুক্ত। এই বহুপাক্ষিক অংশীদারিত্বের মূল লক্ষ্যই হল অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলিতে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।

৯। সাফটা সম্পর্কে যা জানো লেখো।

অথবা, সাফটা কী?

SAFTA গঠন: দক্ষিণ এশিয়াকে শুল্ক। মুক্ত বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ২০০৪ সালে ৬ জানুয়ারি ইসলামাবাদ সম্মেলনে। দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এই চুক্তি কার্যকর হয়। SAFTA চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হল সার্কের সদস্যরাষ্ট্রগুলির মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পারস্পরিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলিকে সুযোগসুবিধা প্রদান করা। এ ছাড়া এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো South Asian Economic Union বা দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গড়ে তোলাই ছিল SAFTA-র অন্যতম মূল লক্ষ্য। পাশাপাশি দেশগুলির মধ্যে শুল্কগত বাধা-সহ অন্যান্য বাধা হ্রাস করে বাণিজ্যিক স্বচ্ছতা আনাও সাফল্টার উদ্দেশ্য ছিল।

SAFTA চুক্তি অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গড়ে তোলার জন্য সার্কের সদস্যরাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যে কতকগুলি নীতি অনুসরণ করবে। এগুলি হল-

① আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য সংক্রান্ত সকল বিধিনিষেধ দূর করে পণ্যের অবাধ ও মসৃণ চলাচল নিশ্চিত করবে।

② সদস্যরাষ্ট্রগুলি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলে ন্যায়সংগত ও স্বচ্ছ প্রতিযোগিতার পরিবেশ গড়ে তুলবে এবং বাণিজ্য ও শুল্কব্যবস্থা থেকে প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্র যাতে সমান মুনাফা লাভ করতে পারে তা নিশ্চিত করবে।

③ ভবিষ্যতে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও পারস্পরিক লাভ বৃদ্ধির জন্য একটি উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলবে।

④ SAFTA বাস্তবায়িত করার জন্য মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল পরিকল্পনা ও বিবাদ নিষ্পত্তির উপযোগী কার্যকরী সাংগঠনিক ব্যবস্থা গঠন করবে।

১০। আসিয়ানের ব্যর্থতাগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।

আসিয়ানের ব্যর্থতা: আসিয়ানের বিবিধ সাফল্য থাকলেও নানা ব্যর্থতাও রয়েছে। যথা-

① মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থতা: আসিয়ানভুক্ত দেশগুলি একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার নীতি গ্রহণ করেছে। এই নীতির সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রগুলি যথেচ্ছভাবে আইনের। অনুশাসন, মানবাধিকার ইত্যাদি লঙ্ঘন করে থাকে। যেমন- মায়ানমারে রোহিঙ্গা জনজাতির উপর মায়ানমার সরকারের অকথ্য অত্যাচার তাদের মানবাধিকারকে লঙ্ঘন করেছিল। কিন্তু এই নীতির কারণে আসিয়ান কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি বরং এসব ক্ষেত্রে আসিয়ান নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।

② সদস্যদের পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি : আসিয়ানভুক্ত দেশগুলির নিজেদের মধ্যেও পারস্পরিক সমস্যা ও ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে। জলসীমা ও স্থলসীমান্তকে কেন্দ্র করে সদস্যরাষ্ট্রগুলির বৈরিতাও আসিয়ান-এর অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া ফিলিপাইনসে উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির কার্যকলাপও আসিয়ানের উদ্বেগের কারণ। শুধু তাই নয়, উদ্বাস্তু সমস্যা হল সদস্যরাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিরোধের অপর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

③ আর্থিক বৈষম্য: আসিয়ান তার সদস্যরাষ্ট্রগুলির মধ্যে আর্থিক বৈষম্য দূর করার ব্যাপারে তেমন কোনো সফলতা অর্জন করতে পারেনি। যার ফলে সিঙ্গাপুর ও মালয়শিয়ার মতো আসিয়ানের ধনী সদস্যরাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলি যেমন-মায়ানমার, লাওস, ভিয়েতনামের সঙ্গে একইরকম সুযোগসুবিধা লাভ করে নিজেদের আরো উন্নত করে অন্যদের তুলনায় বহুগুণ এগিয়ে গেছে। এজন্য আসিয়ানের দেশগুলির মধ্যে একটি অসম বিকাশ লক্ষ করা যায়।

④ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব : যেহেতু আসিয়ানের শীর্ষ সম্মেলনই এর সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এবং সকল সদস্যরাষ্ট্রের সম্মতিতেই আসিয়ানের সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সেজন্য যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহমত ও সম্মতি পেতে দীর্ঘ সময় লাগে। ফলস্বরূপ দক্ষিণ চিন সাগরকে কেন্দ্র করে চিনের সঙ্গে আসিয়ান রাষ্ট্রগুলির বিরোধ বা অন্যান্য আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যার দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হয় না।

উপসংহার: সমালোচনা সত্ত্বেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সামগ্রিকভাবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় আঞ্চলিক শান্তি, সহযোগিতা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ব্যাপারে আসিয়ান উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এবং এই অঞ্চলের আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে চলেছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য ASEAN একাধিক সংস্থা গড়ে তুলেছে। যেমন- আসিয়ান ইউনিভার্সিটি নেটওয়ার্ক, আসিয়ান টুরিজম ইনফরমেশন সেন্টার, এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং সেন্টার ছাড়াও আসিয়ান চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, আসিয়ান বিজনেস ফোরাম ইত্যাদি। ASEAN-এর সাফল্যে আগ্রহী হয়ে দশটি রাষ্ট্র তার সহযোগী হিসেবে থাকতে উৎসাহী, যথা- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভারত, চিন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ ছাড়া বর্ধিত আকারে একটি ASEAN Regional Forum গড়ে তোলা হয়েছে আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার করা এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পারস্পরিক বিশ্বাস গড়ে তোলার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। এ ছাড়া এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ASEAN-এর নেতৃত্বে East Asia Summit নামে নতুন মঞ্চ গড়ে উঠেছে। চিন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াও এই মঞ্চে সামিল হয়েছে।

আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment