বিশ্বায়ন (তৃতীয় অধ্যায়) রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্ন উত্তর ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার

সূচিপত্র

বিশ্বায়ন (তৃতীয় অধ্যায়) রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্ন উত্তর ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার | Globalisation Question Answer Class 12 Political Science

বিশ্বায়ন (তৃতীয় অধ্যায়) রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্ন উত্তর
বিশ্বায়ন (তৃতীয় অধ্যায়) রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্ন উত্তর

১। বিশ্বায়ন কাকে বলে?
অথবা, বিশ্বায়নের অর্থ ও সংজ্ঞা লেখো।

বিশ্বায়নের সংজ্ঞা: Globalisation-এর বাংলা প্রতিশব্দ হল বিশ্বায়ন। ‘বিশ্বায়ন’ হল একটি বহুমাত্রিক শব্দ। যার ব্যাপ্তি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী তাঁদের তত্ত্বে বিশ্বায়ন সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত প্রদান করেছেন। স্বভাবতই এর একমাত্রিক সংজ্ঞা নির্দেশ করা সহজসাধ্য নয়। নিম্নে বিশ্বায়নের সংজ্ঞা সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করা হল।

অ্যান্টনি গিডেনস-এর অভিমত: সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্টনি গিডেন্স (Anthony Giddens) বিশ্বায়নের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন, এটি হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা বিশ্বব্যাপী সম্পর্কের তীব্রতা বৃদ্ধি করে, যার পরিণতিতে বহুদূরের ঘটনা দ্বারা যেমন স্থানীয় ঘটনা প্রভাবিত হয়, তেমনি বিপরীতভাবে দূরের ঘটনাও স্থানীয় বিষয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। গিডেন্স-এর মতে, বিশ্বায়নের মূল চালিকাশক্তি হল আধুনিকতাপ্রসূত চারটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা -পুঁজিবাদ, শিল্পায়ন, নজরদারি ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ।

রোল্যান্ড রবার্টসন-এর অভিমত: বিশ্বায়নের ধারণার অন্যতম প্রবর্তক রবার্টসন (Roland Robertson) বলেছেন, বিশ্বায়ন হল বিশ্বের সংকোচন এবং বিশ্বজোড়া পরস্পর নির্ভরশীলতার অবস্থা। তাঁর মতে, বিশ্বায়ন হল পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার অবস্থা।

দীপক নায়ার-এর অভিমত: দীপক নায়ার (Deepak Nayyer) -এর মতে, বিশ্বায়ন হল এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক মুক্ত পরিবেশ এবং বিশ্ব অর্থনীতির অঙ্গীভূত দেশগুলির মধ্যে গভীর অর্থনৈতিক সমন্বয় জড়িত থাকে।

জোসেফ স্টিগলিৎজ-এর ভাভিমত: জোসেফ স্টিগলিৎজ (Joseph Stiglitz)-এর মতে, বিশ্বায়ন হল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনগণের মধ্যে এক নিবিড় সংযোগসাধনের প্রক্রিয়া, যা পরিবহণ ও যোগযোগের ব্যয় ব্যাপকভাবে হ্রাস করেছে। একইসঙ্গে দ্রব্যসামগ্রী, পরিসেবা, পুঁজি, জ্ঞান এমনকি বিশ্বজুড়ে মানুষের অবাধ চলাচলের অধিকারের উপর আরোপিত কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতাকেও দূর করেছে।

ডেভিড হেল্ড-এর অভিমত: ডেভিড হেল্ড (David Held) বিশ্বায়নের কার্যকলাপকে মিথস্ক্রিয়া ও ক্ষমতার আন্তর্মহাদেশীয় কিংবা আন্তঃআঞ্চলিক প্রবাহ নেটওয়ার্ক বলে বর্ণনা করেছেন।

পিটার মারকাস-এর অভিমত: পিটার মারকাস (Peter Marcus)-এর মতে বিশ্বায়ন হল পুঁজিবাদের এমন একধরনের বিশেষ রূপ যা ভৌগোলিক এবং মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমানভাবে পুঁজিবাদী সম্পর্কের সম্প্রসারণ ঘটায়।

গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা: সাধারণ অর্থে বিশ্বের এক প্রান্তের মানুষের সঙ্গে অন্য নানা প্রান্তের বা দেশের অবাধ বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ, পারস্পরিক আদানপ্রদান-সহ বাজার অর্থনীতির প্রভাবপ্রতিক্রিয়াই হল বিশ্বায়ন।

২। বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্য:

বিশ্বায়ন এমন একটি প্রক্রিয়া যা বহুমাত্রিক (Multidimensional) অর্থাৎ এর প্রভাব জনজীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

① মুক্ত বাজার অর্থনীতি: বিশ্বব্যাপী পুঁজির গমনাগমন বা আর্থিক লেনদেনই হল বিশ্বায়ন। মুক্ত বাজার অর্থনীতির ধারণার উপর বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া নির্ভরশীল। এটি এমন এক বৈশ্বিক মুক্ত বাজার যেখানে পণ্য, পুঁজি, প্রযুক্তি ও পরিসেবার গমনাগমন রাষ্ট্রীয় সীমার দ্বারা আবদ্ধ নয়। এ ছাড়া এই নীতি অনুসরণ করার ফলে শুল্কের হার কমানো, শেয়ার বাজারের উপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ শিথিল এবং একচেটিয়া বেসরকারি সংস্থাগুলিকে নানা সুযোগসুবিধা ও অধিকার প্রদান করা ইত্যাদির প্রবণতা দেখা যায়।

② উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিলগ্নিকরণ: বিশ্বায়নের অবশ্যম্ভাবী ফল হল উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিলগ্নিকরণ। যেসমস্ত রাষ্ট্র মিশ্র অর্থনীতির অনুসারী ছিল তারা উদারীকরণের পথে অগ্রসর হতে বাধ্য হয়। পূর্বেকার সংরক্ষণবাদের অবসান ঘটে এবং জাতীয় বাজারগুলি আন্তর্জাতিক বাজারের প্রয়োজনে নিজেদের উন্মুক্ত করতে বাধ্য হয়।

③ রাষ্ট্রীয় সীমানার উন্মুক্তকরণ: বিশ্বায়নের সংরক্ষণবাদের বিরোধিতা করে এবং বিদেশি পণ্য ও পরিসেবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সীমানা উন্মুক্ত করার কথা বলে। জাতীয় বাজার ও দেশীয় পণ্যের বিকাশের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত সংরক্ষণমুখী বিধিনিষেধকে অকাম্য বলে মনে করা হয়। স্কট বার্চিল-এর মতো তাত্ত্বিকেরা সংরক্ষণবাদকে জাতীয় স্বার্থবিরোধী বলে মনে করেন।

④ বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা: বিশ্বায়ন জাতীয় সীমানা অতিক্রমকারী আন্তঃরাষ্ট্রীয় নজরদারিমূলক ও নিয়ন্ত্রণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রভাব বৃদ্ধি করেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলি যেমন-GATT, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার ইত্যাদির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অনেকসময় এরা উন্নয়নশীল দেশের রাজস্ব নীতি, এমনকি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে। এপ্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের কাঠামোগত সমঝোতার নীতির উল্লেখ করা যায় যা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির উপর ঋণদানের শর্ত হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

⑤ সরকারি ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ: অনেকের মতে বিশ্বায়ন রাষ্ট্রীয় সীমানার পরম্পরাগত অলঙ্ঘনীয়তার ধারণাকে অসার প্রতিপন্ন করেছে। বিশ্বায়ন বিশ্বব্যাপী চাহিদা ও দাবির সর্বজনীনতার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের বহুমুখী কার্যসম্পাদনকারী ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জও জানিয়েছে।

⑥ উদারীকরণ : বিশ্বায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল উদারীকরণ। উদারীকরণের মূল কথা হল দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে সরকারি প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। এটি ছাড়া বিশ্বায়ন অসম্পূর্ণ বা অসফল। এর মাধ্যমে বানিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধ শিথিল করে বা অপসারণ করে। ফলত বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলি বহুজাতিক সংস্থার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলির বাজার দখল করতে বিশেষভাবে উদ্যোগী। যা জাতীয় অর্থনীতিকে বিশ্ব বাজারের সঙ্গে যুক্ত করতে সহায়তা করে।

⑦ ভুবন গ্রাম প্রতিষ্ঠা: বিশ্বায়নের ফলে যোগাযোগ বিপ্লব সাধিত হয়েছে। বৈদ্যুতিন যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপ্লব দূরত্ব ও সময়ের ব্যবধান। বেশ অনেকটাই হ্রাস করেছে এবং ভুবন গ্রাম প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে।

পরিশেষে উল্লেখ্য যে, বিশ্বায়ন বিশ্বব্যাপী মুক্ত বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একদিকে যেমন প্রতিটি দেশের পণ্য ও পরিসেবা নীতির পরিবর্তন এনেছিল, তেমনি অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক সম্পদ ও জ্ঞানের আদানপ্রদানের মাধ্যমে একটা বৈশ্বিক নাগরিক সমাজের রূপরেখা নির্মাণ করেছিল।

৩। বিশ্বায়নের কারণ সম্পর্কের আলোচনা করো।

বিশ্বায়নের কারণ:

বিশ্বায়ন হল একটি বিশ্বব্যাপী বহমান প্রক্রিয়া। নিম্নে বিশ্বায়নের কারণগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল।

① বিশ্বব্যাপী মতাদর্শের আবির্ভাব : বিশ্বায়নের আবির্ভাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল-সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতনের পর বিশ্বে দ্বিমেরুর স্থান দখল করল একমেরু এবং বিশ্বব্যাপী একটিমাত্র মতাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সেটি হল পুঁজিবাদী দুনিয়ার মদতে গড়ে ওঠা নয়া উদারনীতিবাদ। বিশ্ববাসী আজ উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, পুঁজিবাদী দুনিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত বিশ্বায়নের প্রভাব থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখা যাবে না। এই কারণেই বিশ্বায়নের ফলে মূলধনের সচলতা সহজেই উৎপাদিত দ্রব্যসমূহকে বিশ্ববাজারে উপস্থিত ও বিক্রয় করতে সক্ষম করে তুলেছে।

② রাষ্ট্রগুলির পরিবর্তে সংস্থাগুলির সদর্থক ভূমিকা: বিশ্বায়নের আবির্ভাবের অন্যতম একটি কারণ হল, রাষ্ট্রনেতা, রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার পরিবর্তন। এরা মনে করেন, উন্নয়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমাগত ক্ষীণ হয়ে আসছে । তার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (IMF) এবং উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের নিমিত্ত আন্তর্জাতিক ব্যাংক (IBRD) প্রভৃতি সংস্থাগুলি বিশ্বের অর্থব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন ও পুনর্গঠনের জন্য সদর্থক ভূমিকা পালন করেছে।

③ প্রযুক্তির উন্নতি: বিংশ শতকের ৮০-এর দশকে বা তার পরবর্তীকালে বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা, কারিগরি কৌশল ইত্যাদি ক্ষেত্রে অভুতপূর্ব বিপ্লব এসেছিল। মূলধন ও প্রযুক্তিগত কৌশলের আদানপ্রদান আজ বিশ্বজনীন হয়েছে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ই-মেল ইত্যাদির মতো যোগাযোগ প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির ফলে বিশ্বব্যাপী জনগণের মধ্যে সহজ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। ফলে শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলির পক্ষে পুঁজি ও কারিগরি কৌশলকে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য ও লোক নিয়োগ করা সহজ হয়েছে। এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এবং কৃত্রিম উপগ্রহ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলে বিশ্বায়নকে আরও বেশি গতিশীল করে তুলেছে।

④ রাজনৈতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক চুক্তি: বিশ্বায়নের আবির্ভাবের অন্যতম একটি কারণ হল বিশ্বের রাষ্ট্রনেতা, প্রশাসক ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে বহু আলোচনা ও আন্তর্জাতিক চুক্তি স্থাপন। যার ফলে বহুদেশ একে অপরের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটাচ্ছে যা বিশ্বায়নের গতিকে আরও দ্রুততর করেছে।

⑤ অর্থনৈতিক উন্নয়ন: বিশ্বায়নের আবির্ভাবের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল অর্থনৈতিক উন্নতির বিকাশ। বিশ্বায়ন নামক বিশ্বব্যাপী প্রবহমান প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রগুলির উপর আরোপিত কৃত্রিম বাধানিষেধ শিথিল হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রগুলি ন্যূনতম রাষ্ট্রে (Minimal state)-এ পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে পণ্য ও পরিসেবামূলক আদানপ্রদান বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যবসা করছে। এর ফলে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন দ্রুত প্রসারিত হয়।

⑥ সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান : বর্তমানে প্রতিটি রাষ্ট্র তার সংস্কৃতি চর্চার নিজস্বতা দাবি করতে পারে না। এক্ষেত্রে একটি বিশ্বময়তার ছবি পরিলক্ষিত হতে দেখা গেছে। এক দেশের সংস্কৃতি অন্য দেশে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে। নাচ, গান, চলচ্চিত্র, খবর, ফ্যাশান, বিজ্ঞাপন ইত্যাদির মাধ্যমে এক দেশের সংস্কৃতি অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, ফলে সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে কোন রাষ্ট্র আজ নিজস্বতা দাবি করতে পারছেন না। এক্ষেত্রে একটি বিশ্বগ্রাম ব্যবস্থায় সংস্কৃতি চর্চার একটি অভিন্ন পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ফলে বলা যায় সংস্কৃতির আদান প্রদান বিশ্বায়নের আবির্ভাবের অন্যতম একটি কারণ।

৪। বিশ্বায়নের বিভিন্ন দিকগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, বিশ্বায়নের বিভিন্ন রূপগুলির পর্যালোচনা করো।
অথবা, বিশ্বায়নের প্রকৃতি আলোচনা করো।

বিশ্বায়নের বিভিন্ন রূপ: বিশ্বায়ন হল একটি আন্তর্জাতিক তথা বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়া। রবসনের মতানুযায়ী, বিশ্বায়নের ধারণায় পৃথিবী ছোটো হয়ে আসে, সমগ্র দুনিয়া সম্পূর্ণ একটি একক হিসেবে গণ্য করার চেতনা সৃষ্টি হয়। নিম্নে বিশ্বায়নের বিভিন্ন রূপগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল।

① অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন: বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মূলে রয়েছে তার অর্থনৈতিক প্রকৃতি। বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করতে যে সংস্থাগুলি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে তার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মূল দিকগুলি হল-বিশ্বজুড়ে মুক্ত বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার, লগ্নি পুঁজির অবাধ চলাচল, বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থাগুলির অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে অভিগমন ও নির্গমন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ মাধ্যমের অবাধ বিস্তার প্রভৃতি।

② রাজনৈতিক বিশ্বায়ন:  ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দের ওয়েস্টফেলিয়ার শান্তিচুক্তির পরবর্তী পর্ব থেকে ভূখণ্ডভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রাথমিক একক বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি এবং বিশ্ববাজার দখলের মধ্য দিয়ে যে আর্থসামাজিক বিশ্বায়নের সূচনা হয়েছিল তার প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছিল। বিশেষ করে, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তবে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিশ্বায়ন জাতিরাষ্ট্র ধারণার বিপরীতে অবস্থান করে। অবাধ পুঁজির মুনাফাকে গণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্রগুলি কখনোই সমর্থন করেনি। আবার বিশ্বায়নের পাশ্চাত্যের প্রবক্তাগণ সম্পূর্ণরূপে জাতিরাষ্ট্রের বিলোপসাধন চান না, বরং তারা এমন এক বিশ্বব্যবস্থা আশা করেন যেখানে ধনতান্ত্রিক শ্রেণির স্বার্থে একচেটিয়া বাণিজ্যও রক্ষা পাবে আবার অপরপক্ষে স্বায়ত্তশাসনমূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলির অস্তিত্বও বজায় থাকবে। এই চিন্তার মূল উদ্দেশ্য হল-সর্বশক্তিসম্পন্ন জাতিরাষ্ট্রগুলি বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে যতটা পাল্লা দিতে পারবে, স্বল্পক্ষমতাসম্পন্ন স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলি তা পারবে না। তাই আঞ্চলিক স্তরে বৃহৎ পুঁজির অধীনে তারা চালিত হয়। এভাবে বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিকতা লক্ষ করা যায়। রাজনৈতিক বিশ্বায়নের বাস্তবায়ন দেখা যায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে সারা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন দেখা যায়। এই সমস্ত সংগঠনগুলি জাতির সীমানাকে ছাড়িয়ে বৈশ্বিক স্তরে বিকশিত হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (UN), অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংগঠন (OECD), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) ইত্যাদির কথা বলা যায়।

③ সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন: সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিশ্বায়নের মূল লক্ষ্য হল সারা বিশ্বজুড়ে একধরনের সমজাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলা। বিশ্বায়ন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে যে সমজাতীয় সংস্কৃতি নির্মাণ করতে চায় তাকে অনেকে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর একটি অংশের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত পণ্যসামগ্রী, তথ্যপ্রযুক্তি, ধ্যানধারণা অন্য রাষ্ট্রে চালান করে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে মানুষে মানুষে সাংস্কৃতিক ভেদাভেদ মুছে যাচ্ছে, আর এ কাজে সাহায্য করছে উন্নত প্রযুক্তি, যথা- ইন্টারনেট, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি।

পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বায়ন হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব ‘ভুবন গ্রামে’ পরিণত হয়েছে। যার ফলে পৃথিবীব্যাপী পারস্পরিক সংযোগ সম্পর্ক এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।

৫। বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক প্রভাবগুলি আলোচনা করো।
অথবা, অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, বিশ্বায়ন কীভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছে তার মূল্যায়ন করো।
অথবা, অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করো।

বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক প্রভাব: বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় অর্থনীতির উপর যেই সমস্ত ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাবগুলি পড়েছে সেগুলি হল-

ইতিবাচক প্রভাব :

① বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে এবং GATT চুক্তির দৌলতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিভিন্ন দেশগুলিতে বিদেশি পুঁজির প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বায়নের ফলে দেশের বাইরে ব্যবসাবাণিজ্য ও বিনিয়োগের নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফলে উন্নয়নশীল দেশ ও স্বল্পোন্নত দেশগুলি বিদেশি বিনিয়োগ ও বর্ধিত বাণিজ্যের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে।

② নতুন বাজারে পণ্য বিপণনের সুযোগ: বিশ্বায়নের ফলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যভুক্ত দেশগুলি নিজেদের উৎপাদিত দ্রব্য বাইরের দেশের নতুন বাজারে বিনা বাধায় বিপণনের সুযোগ লাভকরেছে। এতে একদিকে যেমন তাদের পণ্যের বিক্রি বেড়েছে অন্যদিকে তেমনি মুনাফাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

③ নতুন প্রযুক্তি ও জ্ঞানের প্রসার: বিশ্বায়ন সারা পৃথিবী জুড়ে যেভাবে নতুন প্রযুক্তি ও জ্ঞানের প্রসার ঘটিয়েছে তার ফলে বিভিন্ন দেশ একে অপরের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়ে অনেক সমৃদ্ধ হতে পেরেছে। এই সমৃদ্ধি আর্থিক ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছে।

নেতিবাচক প্রভাব:

① ধনী দেশগুলির স্বার্থ ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলির আধিপত্য: বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এটা বলা হয় যে, বিশ্বায়ন ধনী দেশগুলির স্বার্থে কাজ করেছে এবং বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থাগুলির আধিপত্য বিস্তারে সাহায্য করেছে। ফলে স্থানীয় ছোটো কোম্পানিগুলি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে নিজেদের ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে।

② ধনী ও দরিদ্র বৈষম্য বৃদ্ধি: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখকরা অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের নেতিবাচক ফলাফল বিশ্লেষণ করে এটা দেখিয়েছেন যে, এর ফলে ধনী বিশ্ব আরও ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্র বিশ্ব দরিদ্রতর হচ্ছে। ১৯৯০-এর দশকের শেষার্ধে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় ব্যাপক উদারীকরণের ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক মন্দা প্রমাণ করে যে, বিশ্বায়ন উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব ও প্রবৃদ্ধি এখনও সুনিশ্চিত করতে পারেনি।

③ পরিবেশের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংকট: পরিবেশের ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন এক আন্তর্জাতিক সংকট তৈরি করেছে। বিশ্বায়নের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলি উন্নয়নশীল বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করেছে ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক পরিবেশকে কর্পোরেট সংস্থাগুলি পণ্যায়িত করেছে। এ ছাড়া বসুন্ধরা সম্মেলনের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করার ফলে বিশ্ব উন্নায়ন কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উপসংহার: একুশ শতকে বিশ্বায়ন একটি অপরিহার্য আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। কোনো দেশের পক্ষে এই প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্রমাগত উন্নত দেশগুলির উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৬। বিশ্বায়নের রাজনৈতিক প্রভাবগুলি আলোচনা করো।
অথবা, রাজনৈতিক বিশ্বায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলি লেখো।
অথবা, বিশ্বায়ন কীভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছে তার মূল্যায়ন করো।
অথবা, রাজনৈতিক বিশ্বায়নের ফলাফল সম্পর্কে ব্যাখ্যা করো।

বিশ্বায়নের রাজনৈতিক প্রভাব:

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাবই লক্ষণীয়। যথা-

ইতিবাচক দিক:

① বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সংহতিসাধন: বিশ্বায়ন বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে নিবিড় সংহতি গড়ে তুলেছে। আধুনিক বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে একাকী বিচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকা সম্ভব নয়। বিশ্বায়ন এই বাস্তবতাকে তুলে ধরে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একটি অভিন্ন যোগসূত্র গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে।

② সক্ষমতা বৃদ্ধি: অনেকে মনে করেন, বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্রগুলি উন্নতমানের তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কাজে দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ও উন্নত প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সারা বিশ্বকে জানা ও বোঝার কাজও অনেক সহজ হয়ে গেছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষ করে বিদেশনীতি নির্ধারণের কাজে রাষ্ট্রের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

③ শান্তি স্থাপন: বিশ্বায়ন যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক পরিণতি সম্পর্কে সমস্ত জনগণকে সচেতন করে যুদ্ধের প্রতি জনগণের অনীহা বৃদ্ধি করেছে। যার ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাস পেয়েছে এবং শান্তির পরিবেশ গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া সন্ত্রাসবাদ দমনের ক্ষেত্রে সমস্ত রাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

নেতিবাচক দিক:

① জাতিরাষ্ট্রের সংকট: রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন জাতিরাষ্ট্রের সংকট সৃষ্টি করেছে বলে অনেকে মনে করেন। জাতিরাষ্ট্রগুলির সাবেকি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণা বিশ্বায়নের যুগে বহুলাংশে অচল হয়ে পড়েছে। বিশ্বায়নের যুগে রাষ্ট্রকে তার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণের আগে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশিকার সঙ্গে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অন্যান্য বিধিনিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে চলতে হয়। কাজেই চরম সার্বভৌমত্বের ক্ষমতা রাষ্ট্র এখন আর আগের মতো ভোগ করতে পারে না।

② নয়া এলিট শ্রেণি দৃষ্টি: বিশ্বায়নের ফলে বিদেশের বহুজাতিক সংস্থাগুলির দেশীয় অংশীদারিত্ব সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থাগুলি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে কর্পোরেট পুঁজিবাদের ভিত্তি রচনা করে। এই নয়া এলিট শ্রেণি বর্তমানে অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের রাষ্ট্র তথা রাজনীতির নির্ণায়ক।

③ সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের স্রোতে সন্ত্রাসবাদের আতঙ্ক দেশ-বিদেশ নির্বিশেষে ছড়িয়ে পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতি, যে-কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবাধে প্রবেশ এবং নতুন নতুন মারণাস্ত্রের সৃষ্টি বিশ্ববাসীর মনে ভয় ও ত্রাস বাড়িয়েছে।

উপসংহার: তবে মনে রাখা উচিত রবার্ট হলটন প্রমুখ মনে করেন, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের উপর সাম্প্রতিককালের বিধিনিষেধ কেবল বিশ্বায়নের ফসল নয়। ১৯৫০-এর দশক থেকেই ক্রমশ রাষ্ট্রীয় চরম ক্ষমতার ধারণা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। জগদীশ ভগবতীও মনে করেন নারী অনুন্নয়ন, শিশুশ্রম কিংবা অপুষ্টি যা উপ-সাহারীয় অঞ্চলগুলিতে প্রকট, সেগুলির জন্য বিশ্বায়ন দায়ী নয়। বরং বিশ্বায়ন এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে রাষ্ট্রকাঠামোর গণতন্ত্রীকরণের পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

৭। সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের প্রভাবগুলি লেখো।
অথবা, সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের সুফল ও কুফলগুলি লেখো।
অথবা, সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, বিশ্বায়ন কীভাবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছে তার মূল্যায়ন করো।

সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের প্রভাব :

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাবই লক্ষণীয়। যথা-

ইতিবাচক দিক :

① দেশীয় অর্থনীতির বিকাশ: সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের ফলে বিভিন্ন দেশের স্থানীয় সংস্কৃতিকে জানা ও বোঝার জন্য বৈশ্বিক পর্যটকদের মধ্যে আগ্রহ বা কৌতূহল দেখা দিয়েছে। তার ফলে সাংস্কৃতিক ভ্রমণ, স্থানীয় শিল্পীদের তৈরি হস্তশিল্পের সামগ্রীর আন্তর্জাতিক বিপণন ইত্যাদির ফলে দেশীয় অর্থনীতির বিকাশ ঘটে।

② সৃজনশীলতার ডিজিটাল রূপান্তর: বিশ্বায়ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং স্ট্রিমিং পরিসেবার মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের সৃজনশীলতাকে ডিজিটালাইজড্ করে তাকে সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে সহজলভ্য করে পৌঁছে দিচ্ছে। ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, স্পটিফায়ের মতো প্ল্যাটফর্মগুলির ব্যবহারকারীদের কাছে খুব সহজেই বিভিন্ন ধরনের সিনেমা, সঙ্গীত, টিভি শো, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি সহজলভ্য হয়ে উঠেছে।

③ বহুসংস্কৃতিবাদ: বিশ্বায়ন তথাকথিত ‘অপর’ সংস্কৃতির সঙ্গে আদানপ্রদানের দ্বার উন্মুক্ত করার ফলে বিশ্বের মানুষ অন্যদেশের মূল্যবোধ, ধারণা জীবনচর্চা, শিল্প দক্ষতা ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার ফলে বর্তমানে সব দেশেই বহুসংস্কৃতিবাদ গড়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে বিদেশি পোশাক পরিচ্ছদের জনপ্রিয়তা, ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য সহ খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী ম্যাকডোনাল্ড কিংবা কেএফসি, ডমিনো’স, পিৎজা হাট-এর অনুপ্রবেশের কথা বলা যায়।

নেতিবাচক দিক:

① জাতীয় সংস্কৃতির বিলুপ্তি: বিশ্বায়ন সারা পৃথিবী জুড়ে যে একই ধরনের ভোগবাদী পণ্যসংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাইছে তার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলির বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে বৈচিত্র্যপূর্ণ আঞ্চলিক জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হতে বসেছে। ফলে বর্তমানে সব দেশেই জাতীয় সংস্কৃতি ক্রমশ বিলুপ্ত হতে বসেছে।

② পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রসার: উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ফলে যে বিশ্বজনীন সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা নিয়ে দ্বিমত নেই। তবে উন্নয়নের নাম করে মূলত বাণিজ্যিক স্বার্থে পশ্চিমি দেশগুলি ভোগবাদী সংস্কৃতি উন্নয়নশীল দেশগুলির উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। টিভি, সিনেমা, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে হিংসা, পশ্চিমি সংস্কৃতির ছোঁয়া, অনলাইন গেমস্ এবং নারী সৌন্দর্যের পণ্যায়ন ও বিজ্ঞাপন কিশোর-কিশোরীদের হৃদয়ে বিকৃত মানসিকতার জন্ম দিচ্ছে এবং তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করে বিপথে চালিত করছে। এর ফলস্বরূপ জাতীয় চেতনা, সুস্থ চিন্তার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

③ নারী সমাজের বিপন্নতা: বিশ্বায়নের ফলে মহিলাদের জন্য কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই তবে তাদের প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায়ন ঘটেনি। বিজ্ঞাপন জগতে, বিমান, হোটেল, সোশ্যাল মিডিয়া, ফ্যাশন প্রভৃতি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান তৈরি হলেও এই ক্ষেত্রগুলি নারী সৌন্দর্যকে একপ্রকার পণ্যায়নে পরিণত করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের মর্যাদাহানিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অভাবের তাড়নায় নারীরা বিভিন্ন প্রলোভনের শিকার হচ্ছে। তারা নানান অমর্যাদাকর পেশায় নিযুক্ত হয়ে পড়েছে। তাই নারী পাচার, নারী নির্যাতন, শিশু পাচারের মতো ঘটনা এই বিশ্বায়নের যুগেও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা কর্তৃক নিযুক্ত মহিলা শ্রমিকরাও অস্থায়ীভাবে এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে কাজ করছে। শ্রম আইন না মানার ফলে বিভিন্ন শিল্প অফিসগুলি দ্বারা মহিলা কর্মচারীরা শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।

উপসংহার: বস্তুত বিশ্বায়ন জাতীয় মূল্যবোধ ও জাতীয় চরিত্রের সাবেকি ধারণাকে পরিবর্তিত করেছে। বর্তমানে একদিকে যেমন বৈশ্বিক নাগরিক সমাজের ধারণা গড়ে উঠেছে, তেমনই জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বনাগরিকতার ধারণা জনপ্রিয় হয়েছে। তবে অধ্যাপক কে এম পানিক্কর-এর মতে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে বর্তমানে যে সাংস্কৃতিক আক্রমণ চলেছে সেটি আসলে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা।

৮। বিশ্বায়ন কীভাবে বিশ্বের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছে তার মূল্যায়ন করো।

ভূমিকা: বিশ্বায়ন হল একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। বিশ্বায়ন বলতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দেশ ও জনগণের মধ্যে এক নিবিড় সংযোগসাধনের প্রক্রিয়াকে বোঝায়। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে এই সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করা হল।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্র: বিশ্বায়ন মূলত একটি অর্থনৈতিক ধারণা। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রভৃতি অর্থনৈতিক সংস্থা বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করেছে। এর ফলে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটেছে বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশ ও স্বল্পোন্নত দেশগুলি বিদেশি বিনিয়োগ ও বর্ধিত বাণিজ্যের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে। অন্যদিকে আবার বহুজাতিক সংস্থা কর্তৃক গৃহীত বৈষম্যমূলক নীতির ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলির উন্নত দেশগুলির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যার ফলে ধনী দেশগুলি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে অবাধে শোষণ করে চলেছে। যার পরিণামস্বরূপ ধনী আরও ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্র আরও দরিদ্রতর হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের একটি নীতি হল কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস কর্মসূচি বা ‘Structural Adjustment Program’ এই নীতির সহজ অর্থ হল বিশ্বায়নের নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনে দেশের সাবেকি অর্থনৈতিক কাঠামোকে সংস্কার করতে বা সংশোধন করতে হবে। বিশ্বায়নের কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসকে কার্যকরী করার দায়িত্বে থাকা তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার এই নির্দেশিকা মেনে চলার ফরমান জারি করে। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলি কলকারখানায় ও রাষ্ট্র পরিচালিত সংস্থাগুলিতে ব্যাপক কর্মীছাঁটাই, কর্মী সংকোচন, লক আউট, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ এবং বেসরকারি পুঁজির লগ্নিকরণ এবং জাতীয় ব্যয়ের সংকোচন ইত্যাদি করতে হয়। এর ফলে স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা বহুগুণ বেড়ে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন সমাজের অনগ্রসর ও দুর্বল শ্রেণির গরিব মানুষেরা।

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র : সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিশ্বায়নের মূল লক্ষ্য হল সারা বিশ্বজুড়ে একধরনের সমজাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলা। এর ফলে একদিকে যেমন-দেশীয় অর্থনীতির বিকাশ ও সৃজনশীলতার ডিজিটাল রূপান্তর ঘটছে তেমনি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে বিশ্বের মানুষ অপর সংস্কৃতির মূল্যবোধ ঐতিহ্য ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারছে এবং অন্য দেশের সামাজিক ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের পোশাকের ক্ষেত্রে সহজলভ্যতা, ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভাষা সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে। অন্যদিকে আবার বিশ্বায়ন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে যে সমজাতীয় সংস্কৃতি নির্মাণ করতে চায় তাকে অনেকে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই নতুন সংস্কৃতির প্রত্যয়ে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলির নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ক্রমশ বিলুপ্ত হতে বসেছে। যার প্রভাবে ভাষা, পোশাক ও খাদ্যরুচির বদল ঘটেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়-তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে দেশীয় খাদ্যের পরিবর্তে পিৎজা, বার্গার ইত্যাদি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

উপসংহার: উক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় বাজার অর্থনীতির উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ, এবং সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহারের দ্বারা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াটি প্রসারিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়া একদিকে যেমন বিশ্বজুড়ে মানুষের সামনে অগ্রগতির সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে, অন্যদিকে তেমনি নানাভাবে বিপদের সম্ভাবনাকেও ডেকে এনেছে।

আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment