একাদশ শ্রেণি দর্শন পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা পর্ব 3

একাদশ শ্রেণি দর্শন পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা পর্ব ৩

একাদশ শ্রেণি দর্শন পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা পর্ব ৩

প্রতিবর্ত ক্রিয়া কী?

প্রতিবর্ত ক্রিয়া

স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ ছাড়াই শুধুমাত্র বাহ্য উদ্দীপকের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে যে- সমস্ত প্রতিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়, সেগুলিকেই বলা হয় প্রতিবর্ত ক্রিয়া। এই ধরনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াগুলি কখনোই বিচারবুদ্ধিপ্রসূত নয়। এগুলিকে তাই সচেতন মনের ক্রিয়ারূপে গণ্য করা যায় না। আবার এগুলি সচেতনভাবে পূর্বপরিকল্পিতও নয় ও স্বাধীনভাবে কৃতও নয়। এগুলি আকস্মিকভাবেই সম্পাদিত। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, তীব্র গন্ধে হাঁচি হওয়া, বজ্রপাতে চমকে ওঠা, ভয় পেয়ে চিৎকার করা, তীব্র আলোকে চোখ বোজা, হঠাৎ ধমকে থতমত খাওয়া, প্রভৃতি হল প্রতিবর্ত ক্রিয়া। এই ধরনের ক্রিয়াগুলি কখনোই স্বাধীন ও সচেতনভাবে সম্পন্ন নয় বলে, এগুলির ভালো-মন্দ নির্ধারণ করা যায় না। অর্থাৎ, এগুলির নৈতিক বিচার আদৌ সম্ভব নয়। এই ধরনের অনৈচ্ছিক ক্রিয়াগুলিকে তাই অনৈতিক ক্রিয়ারূপেই গণ্য করা যায়।

আরও পড়ুন – একাদশ শ্রেণি দর্শন পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা পর্ব ২

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মানসিক স্তর কী?

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মানসিক স্তর

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে যে-সমস্ত স্তর উল্লেখ করা হয়েছে, এদের মধ্যে অন্যতম হল মানসিক স্তর। এই মানসিক স্তরকেই ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মূল বা প্রধান স্তর বলা হয়। কারণ ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু স্বাধীন ও সচেতনভাবে ক্রিয়া সম্পাদন করা হয়, সেহেতু তার জন্য মানসিক প্রস্তুতির অবশ্যই প্রয়োজন। ঐচ্ছিক ক্রিয়া সম্পাদনের ক্ষেত্রে এই মানসিক প্রস্তুতির বিষয়টি প্রথমেই দেখা যায় বলে, এই স্তরটিকে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ স্তররূপে গণ্য করা হয়। যে-কোনো A ঐচ্ছিক ক্রিয়ার পশ্চাতে এরূপ যে মানসিক স্তরটি দেখা যায়, তার মধ্যে আবার কতকগুলি উপস্তর বিদ্যমান। এই সমস্ত উপস্তরগুলি হল যথাক্রমে-[1] কর্মের উৎস, [2] লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য, [3] কামনা, [4] কামনার বিরোধিতা, [5] বিবেচনা এবং [6] নির্বাচন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

কামনার বিরোধিতা কী?

কামনার বিরোধিতা

আমাদের কামনা যদি একটি হয়, তাহলে আমরা সহজেই বস্তুটিকে হয়তো লাভ করতে পারি। কিন্তু অনেকসময় দেখা যায় যে, আমাদের কামনার বস্তু হল বহু। কিন্তু সব কামনাগুলিকে একসঙ্গে পূরণ করা সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য কামনার বস্তুগুলিকে সরিয়ে রেখে, একটি কামনার প্রতিই অগ্রাধিকার দিতে হয়। কোন্ কাম্যবস্তুগুলিকে সরিয়ে রেখে, কোন্ কাম্যবস্তুকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন কামনার বস্তুগুলির মধ্যে একপ্রকার দ্বন্দ্ব দেখা যায়। কামনাগুলির মধ্যে এরূপ পারস্পরিক দ্বন্দ্বকেই বলা হয় কামনার বিরোধিতা (Conflict of desires)।

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার দৈহিক স্তর কী?

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার দৈহিক স্তর

ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে মানসিক স্তরের পরিসমাপ্তির পরই শুরু হয় তার দৈহিক স্তর। কারণ, কামনার দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার পর যে সংকল্প তথা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, সেই সংকল্প তথা সিদ্ধান্তকে কর্মে পরিণত করার জন্য বিভিন্নরকম দৈহিক পরিবর্তন, অঙ্গ সঞ্চালন এবং অন্যান্য বাহ্যক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। এই ধরনের দৈহিক পরিবর্তন ও ক্রিয়া ছাড়া ঐচ্ছিক ক্রিয়া কখনোই সম্পন্ন হতে পারে না। এর জন্য দৈহিক স্তরেরও প্রয়োজনীয়তা আছে। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, ঐচ্ছিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য আমাদের শুধুমাত্র মানসিক স্তরের বিভিন্ন পর্যায়গুলিকে অতিক্রম করলেই চলবে না, তার জন্য প্রয়োজন হল দৈহিক স্তরের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

কামনা কাকে বলে?

কামনা

কামনা হল একপ্রকার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা, যাকে আমরা সাধারণত আকাঙ্ক্ষারূপে উল্লেখ করি। কামনা বা আকাঙ্ক্ষা হল এমনই এক মানসিক অবস্থা, যা আমাদের অভাববোধ থেকে উৎপন্ন এবং এরূপ অবস্থাকে পরিতৃপ্ত করার যে মানসিক ব্যাকুলতা বা উত্তেজনা, তাকেই বলা হয় কামনা (Desire)। আরও সহজ করে বলা যায় যে, আমরা যে বস্তুকে আমাদের নাগালের মধ্যে পাইনি, সেই বস্তুকে পাওয়ার যে মানসিক আকুলতা, তাকেই বলা হয় কামনা বা আকাঙ্ক্ষা।

নীতিবিজ্ঞানী লিলি (Lillie) তাঁর ‘An Introduction to Ethics’ গ্রন্থে কামনার ব্যাখ্যায় বলেছেন-‘কামনা বা আকাঙ্ক্ষার জন্যই আমরা কর্মে প্রবৃত্ত হই। আমরা ক্ষুধার্ত এবং সেকারণেই আমরা খাবারের কামনা করি ও খাদ্যগ্রহণ করি। আমরা অনুসন্ধিৎসু বলেই জ্ঞানের কামনা করি এবং সেজন্যই অধ্যয়ন করি (We act most commonly because of our desires. We are hungry and desire for food and so we eat; we are curious and desire for knowledge and so we study-p.21)’। অর্থাৎ বলা যায় যে, কামনাই আমাদেরকে কর্মে প্রবৃত্ত করে। সেকারণেই নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রে কামনার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ করা যায়।

অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জি (Mackenzie) তাঁর ‘A Manual of Ethics’ গ্রন্থে এরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, নির্দিষ্ট বা বিশেষ কোনো কামনা, সেই নির্দিষ্ট কামনার জগৎ (universe of desires) সম্পর্কেই অর্থপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। অন্য কোনো ক্ষেত্রে কিন্তু তা অর্থহীন হয়ে পড়ে। প্রত্যেকটি কামনা তাই এক- একটি বিশেষ কামনার জগতের অন্তর্ভুক্ত। মানুষের কামনার জগৎ কিন্তু একটি নয়, তা হল অসংখ্য। মানুষের মনে প্রতিনিয়তই কামনার জগতের পরিবর্তন হয়। স্বাভাবিকভাবেই তাই মানুষ একটি কামনার জগৎ থেকে আর-একটি কামনার জগতে প্রবেশ করে।

জ্ঞানগত উপাদান কী?

জ্ঞানগত উপাদান

কামনার জ্ঞানগত উপাদানের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যায় যে, আমাদের প্রত্যেকটি কামনার মধ্যে একপ্রকার অভাববোধের সচেতনতা যুক্ত থাকে। এরূপ অভাববোধ কোনো ব্যক্তির নিজেরও হতে পারে, আবার তা অন্য কারোরও হতে পারে। যাই হোক-না-কেন, অভাববোধের সঙ্গে আবার যুক্ত থাকে অভাববোধ দূরীকরণের ধারণা এবং তার পরিতৃপ্তিবোধও। কামনার জ্ঞানগত উপাদানকে তাই এভাবেই উল্লেখ করা যায় যে, [1] অভাবের চেতনা, [2] অভাবপূরণে কাম্যবস্তুর ধারণা, [3] কাম্যবস্তু লাভের উপায় এবং [4] পরিতৃপ্তির প্রত্যাশা। পরিতৃপ্তির প্রত্যাশাটি যতই বেড়ে যায়, ততই কামনার তীব্রতাও বেড়ে যায়। এই সমস্ত উপাদানগুলি একসঙ্গে মিলিত হয়ে কামনাকে সূচিত করে, যা আবার সুখদুঃখের ধারণাকে নির্দেশ করে।

অনুভূতি বা আবেগগত উপাদান কী?

অনুভূতি বা আবেগগত উপাদান

প্রত্যেকটি কামনা বা আকাঙ্ক্ষা যার সঙ্গে যুক্ত থাকে একপ্রকার অনুভূতি বা আবেগ। এই অনুভূতি বা আবেগকেই বলা হয় কামনার অনুভূতি বা আবেগমূলক উপাদান। কামনার অনুভূতি যেহেতু অভাববোধ থেকে নিঃসৃত, সেহেতু এই উপাদানটি সাধারণভাবে অপ্রীতিকররূপেই গণ্য। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, এই অপ্রীতিকর অনুভূতি থেকেই ভবিষ্যতে প্রীতিপূর্ণ অনুভূতি লাভ করা যায় বলেই, মানুষ এ থেকে কর্মপ্রেরণা লাভ করে। কারণ কাম্যবস্তুটি লাভ করা গেলে, তার অভাবটি যেমন দূর হয়, তেমনই আবার তার প্রাপ্তিতে তৃপ্তিলাভও হয়। এমনই এক সুখানুভূতির সৃষ্টি হয় কর্মকর্তার মনে। সুতরাং বলা যায় যে, কামনার ক্ষেত্রে যে একপ্রকার আবেগমূলক উপাদান বর্তমান, তা অস্বীকার করা যায় না।

কর্মপ্রবণতাগত উপাদান কী?

কর্মপ্রবণতাগত উপাদান

কামনা বা আকাঙ্ক্ষার বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, তা প্রথমে একপ্রকার অভাববোধের বিষয়কে সূচিত করে। এরপরই তা কিন্তু আবার কাম্যবস্তুলাভের বোধ এবং উপায়কেও নির্দেশ করে। এখানেই কিন্তু তার পরিসমাপ্তি ঘটে না, কারণ তা আমাদেরকে কর্মেও প্রবৃত্ত করে। কারণ কর্ম না করলে কখনোই কাম্যবস্তুটিকে পাওয়া সম্ভব নয়। কামনা তাই কাম্যবস্তু লাভের জন্য মানুষকে কর্মপ্রবৃত্তির পথে চালিত করে এবং কর্মের মাধ্যমেই তাকে লাভ করার চেষ্টা করে। এই কর্মের পথটি যে সবসময়ই সহজভাবে উপস্থিত হবে, এমনটি নাও হতে পারে।

কারণ, সেক্ষেত্রে নানারকম প্রতিকূলতার মধ্যে ব্যক্তিকে পড়তে হয়। এই সমস্ত প্রতিকূলতাগুলি পদে পদে আমাদের কর্মপ্রবৃত্তিকে বাধা দেয়। অর্থাৎ বলা যায় যে, আমরা খুব সহজেই আমাদের কাম্যবস্তুগুলিকে কখনোই লাভ করতে পারি না। বহু প্রতিকূলতার বাধা পেরিয়েই আমরা আমাদের কাম্যৰস্তুটিকে লাভ করতে সমর্থ্য হই। সুতরাং, উল্লেখ করা যায় যে, কর্মের প্রকৃতি যাইহোক-না-কেন, আমাদের কামনার কর্মপ্রবণতাগত উপাদানই হল কাম্যবস্তু লাভের সহায়ক।

নীতিতত্ত্বে কামনার উপাদানগুলি কি পারস্পরিকভাবে বিচ্ছিন্ন?

কামনার উপাদান হল তিনটি- [1] জ্ঞানগত, [2] অনুভূতিগত এবং [3] কর্মপ্রবণতাগত।

কামনার এই ত্রিবিধ উপাদানের মধ্যে কর্মপ্রবণতাগত উপাদানটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে নীতিবিজ্ঞানীরা মনে করেন। কারণ, কামনার এরূপ উপাদানই কামনার বাস্তবসম্মত তৃপ্তি দিতে সক্ষম। এরূপ উপাদনটিই আমাদের কামনাকে সরাসরিভাবে ঐচ্ছিক ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে। তা সত্ত্বেও বলা যায় যে, কামনার এই তিনটি উপাদানের মধ্যে কোনো একটি বিশেষ উপাদানের ওপর গুরুত্ব না দেওয়াই শ্রেয়তর। কারণ, কামনার এই সমস্ত উপাদানগুলি যৌথভাবে ক্রিয়া করে। একটি উপাদান তাই আর-একটি উপাদানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি থেকে আর-একটি তাই অনিবার্যভাবে নিঃসৃত। একটি উপাদানকে আর-একটি থেকে পৃথক করা উচিত নয়। সুতরাং সিদ্ধান্ত করা যায় যে, কামনার কোনো উপাদানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে, একটিকে আর- একটি থেকে বিচ্ছিন্ন না করে, এই তিনটি উপাদানের ওপরই সামগ্রিকভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এরূপ প্রচেষ্টাতেই কামনার পরিপূর্ণ স্বরূপটি আমাদের | কাছে উন্মোচিত হয়।

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment