১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কংগ্রেসের আদিপর্বের কার্যকলাপের বিবরণ দাও

রাজনৈতিক কর্মসূচির দিক থেকে জাতীয় কংগ্রেস প্রথম দু’দশক কাল আদৌ আমূল সংস্কারবাদী ছিল না। কারণ- সরকারের বিরোধিতা করার সংস্কৃতি তখনও ভারতে গড়ে ওঠেনি। জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে (বোম্বাই, ১৮৮৫ খ্রি.) সভাপতির ভাষণে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসের চারটি মৌলিক উদ্দেশ্য প্রকাশ করেন। এগুলি হল-
- সারা দেশের জাতীয়তাবাদী ভারতীয়দের মধ্যে সংযোগ স্থাপন।
- জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও আঞ্চলিক বৈষম্যের বাধা দূর করে গণতান্ত্রিক পথে জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলা।
- ভারতের সামাজিক সমস্যাগুলির নিরসনের লক্ষ্যে যুক্তিবাদী ও মুক্তপন্থী আন্দোলন সংঘটিত করা।
- জাতীয় রাজনীতির লক্ষ্য ও কর্মসূচি সম্পর্কে আগাম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। লক্ষণীয় যে, কংগ্রেসের উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সরকারবিরোধী না হলেও ইংরেজ জনগণ ক্রমে কংগ্রেসের বিরূপ সমালোচনা শুরু করে। ইংরেজি পত্রপত্রিকায় মুসলমান প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি সম্পর্কে কটুক্তি করা হয়। উল্লেখ্য -যে, প্রথম অধিবেশনেই অন্তত দুজন মুসলিম সদস্য (আর এম সায়ানি ও এ এম ধরমসি) উপস্থিত ছিলেন। কংগ্রেসের তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বদরুদ্দিন তায়েবজী। তাঁর আহ্বানে চতুর্থ বার্ষিক সভায় (এলাহাবাদ) বহু মুসলিম অংশগ্রহণ করেন।
জাতীয় রাজনীতির নরমপন্থী পর্ব
প্রতিষ্ঠালাভের পর প্রথম কুড়ি বছর (১৮৮৫-১৯০৫ খ্রি.) কংগ্রেসের ইতিহাসে আদিপর্ব নামে পরিচিত। এই সময়কালে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কোনোরূপ গণ আন্দোলন সংগঠিত করে প্রশাসনকে বিব্রত করতে চাননি। তাঁরা প্রধানত, নিয়মতান্ত্রিক পথে এবং আবেদন-নিবেদন তথা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভারতীয়দের অভাব-অভিযোগ সরকারের সামনে আনতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, ইংরেজ প্রশাসকগণ ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা সহানুভূতির – সঙ্গে বিবেচনা করবেন। শুধু তাই নয়, কংগ্রেসি নেতাদের উদ্দেশ্যই — ছিল ইংরেজ সরকারের বিভিন্ন নীতির সমালোচনা করা এবং – সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সংস্কারসাধনের চেষ্টা করা-ভারত থেকে ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদ করা নয়। এই রাজনৈতিক নম্রভাবের জন্য প্রথম পর্বের কংগ্রেস নেতাদের নরমপন্থী – (Moderates) নামে অভিহিত করা হয়। আদিপর্বের নরমপন্থী নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- দাদাভাই নৌরজি, বদরউদ্দিন তায়েবজী, গোপালকৃয় গোখলে, ফিরোজ শাহ মেহতা, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পি আনন্দ চালু প্রমুখ।
নরমপন্থী নেতারা প্রায় সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, ধনী এবং পাশ্চাত্য মনোভাবের মানুষ। বস্তুত, পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ইউরোপীয় জ্ঞানভাণ্ডার ছিল তাঁদের আদর্শ ও প্রেরণার উৎস। ব্রিটিশ জাতি ও ব্রিটেনের রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর তাঁদের গভীর আস্থা ছিল। তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে, গণতন্ত্রের পীঠস্থান ব্রিটেন ভারতবর্ষকে আধুনিকতা ও প্রগতির পথে নিয়ে যাওয়ার কাজে আন্তরিক হবে। তাছাড়া দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামের অনুকূল পরিস্থিতি তখনও ভারতবর্ষে সৃষ্টি হয়নি। তাই জাতীয় চেতনাকে জাগ্রত করা ও সেই চেতনার ভিত্তি সুদৃঢ় করার কাজে তাঁরা আত্মনিয়োগ করেন। এজন্য এই সকল নেতৃবৃন্দ প্রথমে রাজনৈতিক বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে কৌতূহল জাগানো এবং জনগণের দাবিগুলিকে এমনভাবে সুসংবদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন যাতে তার সর্বভারতীয় চরিত্র প্রতিফলিত হয়।
আদিপর্বে কংগ্রেসের কর্মসূচি
আদিপর্বের কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দ নরমপন্থী হলেও নিষ্ক্রিয় ছিলেন না। এসময় কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য ছিল-
- জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জাতীয় আন্দোলন সংগঠন,
- রাজনৈতিকভাবে ভারতবাসীকে সচেতন করা
- সর্বভারতীয় নেতৃত্বদান,
- ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী আদর্শ প্রচার ইত্যাদি।
প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে ভারতের বিভিন্ন শহরে কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশন বসত এবং গৃহীত হত একাধিক প্রস্তাবও। এগুলি থেকে কংগ্রেসের উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক পথে এই পর্বের নেতৃবৃন্দ অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কার, নাগরিক অধিকার রক্ষা ইত্যাদির দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করেন।
অর্থনৈতিক দাবি
জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম দিককার নেতাগণ ইংরেজদের অর্থনৈতিক শোষণের ভয়াবহ রূপটি তুলে ধরার পাশাপাশি ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল্যায়ন ও তৎসংলগ্ন দাবিদাওয়ার উপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ইতিহাসবিদ বিপানচন্দ্রের মতে, জাতীয় জাগরণের প্রারম্ভেই জাতীয়তাবাদী নেতাগণ ভারতবাসীর ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার বিষয়ে অবহিত হয়েছিলেন। নরমপন্থী নেতারা যথার্থভাবে উপলব্ধি করেন যে, ব্রিটিশ অর্থনীতির একমাত্র লক্ষ্য হল- ভারতের উপর ঔপনিবেশিক শোষণ চালানো। এই লক্ষ্যে ইংরেজ শাসকগণ ত্রিমুখী নীতি গ্রহণ করেন, যথা- ভারতকে ব্রিটেনের কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সরবরাহকারী দেশে পরিণত করা, ভারতের বাজারকে ব্রিটিশ পণ্যের বিক্রয়কেন্দ্রে পরিণত করা এবং এদেশে ব্রিটিশ পুঁজি বিনিয়োগ করে শোষণ করা। জাতীয় কংগ্রেস এই তিনটি ক্ষতিকর অর্থনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দাদাভাই নৌরজি, রমেশচন্দ্র দত্ত, মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে, গোপালকৃষ্ণ গোখলে-সহ অনেকেই ব্রিটিশ অর্থনৈতিক শোষণের চিত্রকে সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।
- দাদাভাই নৌরজি ছিলেন ব্রিটিশ অর্থনীতির একজন অন্যতম সমালোচক। জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার বেশ কিছুকাল আগেই England’s Duties to India নামক একটি প্রবন্ধে ভারতবর্ষের দারিদ্র্য এবং ধনসম্পদ নির্গমনের ক্ষেত্রে এই অর্থনীতির যোগ নিয়ে তিনি বক্তব্য রাখেন। পরবর্তীকালে তিনি আরও বলেন যে, ‘ভারতীয়দের অবস্থা নিতান্তই ভূমিদাসের মতো। আমেরিকান দাসেদের চেয়েও শোচনীয়।’ Poverty and Un-British Rule in India গ্রন্থে দাদাভাই লেখেন যে, ‘ইংরেজ সরকারের নির্লজ্জ লুণ্ঠনের ফলে ভারতের অর্থনীতি ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবেই ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে’। বলা যেতে পারে যে, জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই ভারতের দারিদ্র্যকে জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনের অন্যতম বিষয়রূপে উত্থাপন করেন এবং এর কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক বহির্গমনকে গুরুত্ব দেন।
- দাদাভাই নৌরজি, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ নির্গমন তত্ত্ব (Drain Theory) দ্বারা প্রমাণ করেন যে, ব্রিটিশ সরকার তাদের পুঁজির লভ্যাংশ, উপঢৌকন, কর্মচারীদের বেতন ইত্যাদির মাধ্যমে ভারতের অর্থসম্পদ এবং মূলধনের একটা বড়ো অংশ ব্রিটেনে চালান করে দিচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রমেশচন্দ্র দত্ত The Economic History of India গ্রন্থে ঔপনিবেশিক অর্থনীতির স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন।
- একইভাবে তাঁরা প্রমাণ করেন যে, ইংরেজদের নীতির ফলেই ভারতের ঐতিহ্যমণ্ডিত তাঁতশিল্প ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে। একে তাঁরা অবশিল্পায়ন নামে চিহ্নিত করেন।
জাতীয়তাবাদী নেতাগণ কংগ্রেসের বিভিন্ন বার্ষিক অধিবেশনগুলিতে ভারতবর্ষের দারিদ্র্য তথা ঔপনিবেশিক শোষণের একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি তা প্রতিকারের জন্য বিভিন্ন দাবিদাওয়াও উত্থাপন করেন, যেমন-
- ভারতের দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের কারণ অনুসন্ধানের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা,
- ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন, রাজস্ব আদায়ের কঠোরতা হ্রাস ইত্যাদি দাবি করা,
- অবাধ বাণিজ্য নীতি রদ, ভারতীয় শিল্পকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, বিদেশি কাপড়ের উপর শুল্ক বৃদ্ধি করা, ভারতের শুল্কব্যবস্থার বৈষম্য দূর করা,
- ভূমিরাজস্বের হার কমানো, লবণ – শুল্ক তুলে দেওয়া, আবগারি শুল্ক হ্রাস করা,
- আধুনিক শিল্পের প্রসারের দাবি জানানো,
- সেচব্যবস্থার সম্প্রসারণ, সমগ্র দেশে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা,
- আদিবাসীদের সুবিধার জন্য অরণ্য আইনের সরলীকরণ ইত্যাদি।
প্রশাসনিক দাবি
জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন অধিবেশনে প্রশাসনের ভারতীয়করণ-এর দাবি উত্থাপন করেন।
- বস্তুত, কংগ্রেস মনে করত যে- প্রশাসনিক উচ্চপদগুলিতে অ-ভারতীয়দের নিয়োগের দরুন অর্থনৈতিক এবং নৈতিক দুই দিক থেকেই ভারতের ক্ষতি হচ্ছে।
- উল্লেখ্য যে, জাতীয়তাবাদী নেতা গোপালকৃষ্ণ গোখলে লিখেছিলেন, ‘বিদেশি ইংরেজ দ্বারা গঠিত শাসনব্যবস্থা….. নৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট মানহানিকর ও আপত্তিজনক। এই ব্যবস্থা ভারতীয় জাতির সামরিক গঠনকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। আমাদের দেশের বহু মানুষের মধ্যে সামরিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা আছে, তা অব্যবহারের ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
- আলোচ্য পর্বে তাই জাতীয় কংগ্রেস শাসন বিভাগের উচ্চপদগুলিতে যোগ্য ভারতীয়দের নিয়োগের দাবি-তোলে।
- পাশাপাশি কংগ্রেস আই সি এস (ICS) পরীক্ষার ভারতীয়করণ, ইংল্যান্ড ও ভারতে একই সময়ে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রহণ, এই পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের বয়স বাড়িয়ে ২৩ বছর করা, স্ট্যাটুটারি সিভিল সার্ভিসের অবসান ইত্যাদি প্রশাসনিক সংস্কারের দাবিপত্রও পেশ করে।
- তাছাড়া শাসন ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, বিচারের ক্ষেত্রে জুরিদের ক্ষমতা হ্রাস না করা, অস্ত্র আইন প্রত্যাহার, উচ্চ সামরিক পদে তথা পূর্ত, রেল, শুল্ক বিভাগে ভারতীয়দের নিয়োগ, পুলিশ প্রশাসনের সংস্কার, ভারতীয়দের সামরিক শিক্ষাদান-সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁরা দাবি জানান।
সাংবিধানিক বা শাসনতান্ত্রিক সংস্কার
কংগ্রেসের প্রধান দাবি ছিল- ভারতবাসীর স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের বিষয়টি। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন অধিবেশনে বেশকিছু সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ভারতীয় শাসনকাঠামোয় দেশীয় প্রতিনিধিদের আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়ার উপর তাঁরা গুরুত্ব দেন।
- ১৮৬১-র ইন্ডিয়ান কাউন্সিলস অ্যাক্ট (Indian Councils Act, 1861)-এর মনোনয়নের ভিত্তিতে আইনসভার কিছু পদ ভারতীয়দের জন্য দেওয়া হয়।
- কংগ্রেস দাবি করে যে, নির্বাচনের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। আইনসভাকে বাজেট ও দৈনন্দিন প্রশাসন সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার অধিকার দিতে হবে। এ ছাড়া কংগ্রেসের অন্যান্য দাবিদাওয়াগুলি ছিল-
- ভাইসরয়ের আইন পরিষদ এবং প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলির সম্প্রসারণ ও নির্বাচনের মাধ্যমে অধিক সংখ্যক নির্বাচিত ভারতীয় সদস্য নিয়োগ করা।
- উপযুক্ত সংখ্যক ভারতীয় সদস্য নিয়ে একটি রাজকীয় কমিশন গঠন করে ভারতের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধানের দাবি জানানো হয়।
- নিখিল ভারতীয় শাসন পরিষদে অন্ততপক্ষে দুজন এবং বোম্বাই ও মাদ্রাজের প্রাদেশিক গভর্নর এর শাসন পরিষদে একজন ভারতীয় সদস্য গ্রহণ করা।
- ভারত-সচিবের মন্ত্রণা পরিষদ (ইন্ডিয়া কাউন্সিল)-এর বিলুপ্তি ঘটানো। তাছাড়া ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস এক ধাপ এগিয়ে প্রস্তাব করেছিল যে, ব্রিটিশ কমন্স সভায় ভারতের প্রতিটি প্রদেশ থেকে অন্তত দুজন করে প্রতিনিধি নিয়োগ করা ইত্যাদি।
কংগ্রেসের এই সকল দাবিদাওয়ার প্রেক্ষিতে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে সরকার পাস করে ইন্ডিয়ান কাউন্সিলস অ্যাক্ট। এতে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হলেও গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রথা প্রবর্তিত হয়নি। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বস্তুত, এই আইনকে ভারতীয়দের দাবির প্রতি পরিহাস বলে কংগ্রেস তা গ্রহণে অসম্মতি জানায়। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের বেনারস অধিবেশনে সভাপতিরূপে গোপালকৃষ্ণ গোখলে স্বায়ত্তশাসনের জোরালো দাবি তোলেন। ঠিক পরের বছর (১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ) কলকাতা অধিবেশনে দাদাভাই নৌরজি স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে প্রথম বাণীমূর্তি দান করলেন- স্বরাজ কথাটির মাধ্যমে।
নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত দাবি
জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ভারতীয়দের গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কেও বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করতে থাকেন। যেমন-
- ভারতীয়দের বাস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রদান করার দাবি জানানো হয়।
- তাছাড়া ফৌজদারি আইনের কঠোরতার বিরুদ্ধেও জাতীয় কংগ্রেস প্রতিবাদ জানায়।
- সেইসঙ্গে মিউনিসিপ্যাল আইন (১৮৯৯ খ্রি.), বিশ্ববিদ্যালয় আইন (১৯০৪ খ্রি.) প্রভৃতি অগণতান্ত্রিক ও দমনমূলক আইনগুলির বিরুদ্ধেও তাঁরা সরব হন।
নরমপন্থী আন্দোলনে সরকারের মনোভাব
বস্তুত, ব্রিটিশ সরকার প্রথম থেকেই জাতীয়তাবাদীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করত। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার প্রথম কয়েক বছর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরূপতা প্রকাশ্যে আসেনি। কারণ- তাদের বিশ্বাস ছিল যে, উচ্চবিত্ত, শহুরে ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত কংগ্রেস নেতারা ব্রিটিশ সরকারের প্রকাশ্য বিরোধিতা করতে আগ্রহী হবেন না। কিন্তু নরমপন্থীদের কর্মধারা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের শোষণমূলক চরিত্র তুলে ধরলে ইংরেজরা ক্ষুব্ধ হন।
- নরমপন্থী নেতাদের নেমকহারাম বাবু, রাজদ্রোহী ব্রাহ্মণ ইত্যাদি নামে নিন্দা করা শুরু হয়। বড়োলাট লর্ড ডাফরিন কংগ্রেসকে সংখ্যালঘুদের সংগঠন বলে পরিহাস করেন।
- ক্রমবর্ধমান জাতীয় ঐক্যে ভাঙন ধরানোর লক্ষ্যে সরকার বিভাজন ও শাসন (Divide and Rule) নীতিকে বেশি করে প্রয়োগ করতে শুরু করে। কংগ্রেসের অধিবেশনে মুসলমানদের যোগ না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। লর্ড কার্জন ভারত-সচিব লর্ড জর্জ হ্যামিলটন (George Hamilton)-কে এক পত্রে লেখেন, ‘কংগ্রেস ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে। ভারতে কার্যকালে আমার মহান ইচ্ছা হল এই প্রতিষ্ঠানের শান্তিপূর্ণ ধ্বংস ত্বরান্বিত করা।
- বড়োেলাট লর্ড এলগিন (Lord Elgin) ১৮৯৮-তে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, ‘অসির সাহায্যে আমরা ভারত জয় করেছি, অসি দিয়েই তাকে শাসন করব।’ ওই বছরেই একাধিক আইন পাস করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাস্বাধীনতা খর্ব করা হয়। ব্রিটিশ পত্রপত্রিকাগুলি তীক্ষ্ণ ভাষায় জাতীয় কংগ্রেসকে আক্রমণ করে।
নরমপন্থী আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা / দুর্বলতা
বাস্তবক্ষেত্রে আদিপর্বে কংগ্রেসের আন্দোলন (১৮৮৫-১৯০৫ খ্রি.) খুব বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এক্ষেত্রে বলা যায়, আলোচ্য পর্বে সরকার ভারতে তৈরি কাপড়ের উপর ৫% উৎপাদন শুল্ক চাপিয়ে দেয় (১৮৯৪ খ্রি.)। ১৮৯৬-তে ব্রিটেন থেকে আমদানি করা সুতিবস্ত্রের আমদানি শুল্ক ৫% থেকে কমিয়ে ৩.৫% করে। শুধু তাই নয়, সাংবিধানিক সংস্কারের নামে ভারতবাসীকে কেবল প্রবঞ্চনা করা হতে থাকে। এককথায়, কংগ্রেসের প্রায় সব ন্যায্য দাবি সরকার অগ্রাহ্য করে। কংগ্রেসের এই ব্যর্থতার জন্য গবেষকরা নানা পদ্ধতিগত ত্রুটি ও দুর্বলতার উল্লেখ করেছেন। যেমন-
(i) সাংগঠনিক দুর্বলতা: ড. সুমিত সরকারের মতে, কংগ্রেস সঠিক অর্থে কোনও দল ছিল না। কর্মসূচি রূপায়ণের উপযোগী স্থায়ী কর্মীপরিষদ কংগ্রেসের ছিল না। এমন একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গণ আন্দোলন গড়ে তোলা ছিল প্রায় অসম্ভব।
(ii)যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতা: ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, প্রথম পর্বে কংগ্রেস নেতারা যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি। ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা, স্বাধীনতার জন্য বিমূর্ত ভালোবাসা, ইংরেজদের প্রতি ঘৃণা ইত্যাদি ভারতীয়দের মধ্যে যে নবচেতনা ও জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছিল, নরমপন্থীদের কাজের মধ্যে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি।
(iii) আদবকায়দা ও ধ্যানধারণা: আদিপর্বের কংগ্রেস নেতাদের উচ্চবর্গীয় (Elitist) আদবকায়দা, সাধারণ মানুষ সম্পর্কে অবজ্ঞা ও ভয়ের মানসিকতা-ভারতের আপামর সাধারণ মানুষদের থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করেছিল। লালা লাজপত রায় লিখেছেন, ‘কংগ্রেসের আন্দোলন জনগণের মধ্য থেকে, জনগণ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল না; এই আন্দোলন ছিল একটি আরোপিত প্রয়াস’। F1
(iv) জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা: অনিল শীলের মতে, কংগ্রেস প্রথম পর্বে কোনও কৃষি কর্মসূচি গ্রহণ করেনি। ফলে কৃষক শ্রেণি কংগ্রেসের কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহী ছিলেন না। তাছাড়া শ্রমজীবী শ্রেণি, নিম্নবর্ণের হিন্দু, সাধারণ মুসলিম জনগণও এই সংগঠন থেকে অনেক দূরে ছিলেন। এইজন্য অরবিন্দ ঘোষ জাতীয় কংগ্রেস-কে বিজাতীয় কংগ্রেস বলে অভিহিত করেছেন।
(v) আংশিক সময়ের সংগঠন: প্রথম পর্বের কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে তাঁদের পক্ষে সারা বছর ধরে কংগ্রেসের জন্য কাজ করে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁদের কাছে কংগ্রেসি রাজনীতি ছিল আংশিক সময়ের কাজ। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে তিন দিনের জন্য কংগ্রেসের অধিবেশন বসত। এইজন্য অশ্বিনীকুমার দত্ত কংগ্রেসের অধিবেশনকে ব্যঙ্গ করে বলেছেন তিন দিনের তামাশা। আবার অধ্যাপক সুমিত সরকার কংগ্রেসকে বছরে তিনদিনের মেলা বলেও উপহাস করেছেন।
(vi) সম্পদশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ : নেতাদের সঙ্গে সম্পদশালী গোষ্ঠীর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। বোম্বাই, এলাহাবাদের শিল্পপতিগোষ্ঠী; অন্যান্য স্থানে জমিদার, ইজারাদার প্রমুখ ছিলেন নেতাদের কাছের মানুষ। বলাবাহুল্য, এই সকল মানুষ ছিলেন র্যাডিক্যাল বা সংঘাতপূর্ণ কর্মসূচির বিরোধী।
(vii) তেজস্বিতার অভাব: ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন যে, ‘ইংল্যান্ডে ভারতের আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল অর্থের অভাবে; আর ভারতে আন্দোলন ভেঙে পড়ে তেজস্বিতার (Vigour) অভাবে।
(viii) ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অগাধ আস্থা: ড. অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে, ব্রিটিশ সরকারের নিরন্তর উদাসীনতা ও বিরূপতা সত্ত্বেও নরমপন্থী নেতারা আন্দোলন সংগঠন থেকে দূরে সরে থেকে জনপ্রিয়তা হারান। তিনি লিখেছেন, “…ঊনবিংশ শতকে ব্রিটিশরাজের উদারহস্ত থেকে যৎকিঞ্চিৎ সংস্কার লাভে ধন্য হওয়াটাই ছিল নরমপন্থীদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। আর সেই অ-দ্বিতীয় উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির জগতে তাঁদের অস্তিত্বটাই হয়ে ওঠে নিরর্থক…”।
নরমপন্থীদের অবদানের মূল্যায়ন
প্রকৃতিগতভাবে নরমপন্থী রাজনীতি (১৮৮৫-১৯০৫ খ্রি.) ছিল সীমিত চরিত্রের। ইংরেজদের উদারতার উপর অগাধ আস্থা, উচ্চবর্ণের মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছু প্রস্তাব পাস, ব্রিটিশ সরকারের কাছে বিনম্র আবেদন-নিবেদন-এর সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল তাঁদের কর্মসূচি। তাই চরমপন্থী নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক আদিপর্বে কংগ্রেসের কর্মধারাকে রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি (Political Mendicancy) বলে ব্যঙ্গ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কমলাকান্তের দপ্তর গ্রন্থের মুখ্য চরিত্র কমলাকান্তের মুখ দিয়ে বলেছেন, “জয় রাধেকৃয়, ভিক্ষা দাও গো- ইহাই আমাদের পলিটিক্স।” সম্ভবত নরমপন্থী রাজনীতি ভারতের তরুণ প্রজন্মের কাছে গ্রহণীয় হয়নি এবং সেই হতাশা থেকেই চরমপন্থী রাজনীতির উত্থান সহজ হয়েছিল।
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বলা যায়, জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে নরমপন্থী রাজনীতির অবদান একেবারে শূন্য ছিল না।
- আদিপর্বের রাজনীতিকরা ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম নির্মম সমালোচক। ঔপনিবেশিক অর্থনীতির শোষণমূলক চরিত্র তাঁরাই দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন।
- জাতীয় কংগ্রেস ছিল ভারতের একমাত্র সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান। কংগ্রেসের আন্দোলনের ফলে ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয় ও সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ব্যাপকমাত্রায় তাঁদের প্রভাব ছড়িয়েছিল। গোড়ার দিনগুলিতে এঁদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চার ঘটান নরমপন্থীরাই।
- রাষ্ট্রক্ষমতার স্থায়িত্ব নির্ভর করে জনসাধারণের আস্থার উপর। আদিপর্বের কংগ্রেস নেতারা ব্রিটিশ অর্থনীতির স্বরূপ প্রকাশ করে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের নৈতিক ভিত্তি শিথিল করে দেন।
- বিপানচন্দ্র লিখেছেন, ‘১৮৮৫-১৯০৫-এর যুগ ছিল জাতীয় আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপনের যুগ। আদি জাতীয়তাবাদীরা (নরমপন্থীরা) সেই ভিত্তি সযত্নেই স্থাপন করেছিলেন।’
- জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম সমালোচক রজনীপাম দত্ত-ও স্বীকার করেছেন যে, উচ্চশ্রেণিভুক্ত হলেও তাঁরা সাধারণ ভারতবাসীর স্বার্থ সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন না। তিনি আরও বলেন ‘নরমপন্থী নেতাদের বিদেশি শাসকের প্রতিক্রিয়াশীল দেশদ্রোহী ভৃত্য বলে গণ্য করা সমীচীন হবে না।’
- এস আর মেহরোত্রা নরমপন্থীদের বাস্তববাদী রাজনীতিক বলে প্রশংসা করেছেন। কারণ- বিংশ শতকের গোড়াতেও ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল প্রাথমিক স্তরে।
- পট্টভি সীতারামাইয়া লিখেছেন যে, ‘আমরা কোনোভাবেই মডারেটদের দোষ দিতে পারিনা। কারণ- তাঁরা ধাপে ধাপে একটা অট্টালিকা তৈরির ভিত গড়ে দিয়ে গেছেন।’
- বিপানচন্দ্র-সহ অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, ভারতবাসীর মননে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের সূচনা করার কাজে আদিপর্বের কংগ্রেসি নেতারা সফল হয়েছিলেন।
আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা প্রশ্ন উত্তর
আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার দর্শন প্রশ্ন উত্তর
আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টারের ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর
আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টারের ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর