ঐচ্ছিক ক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরগুলি উল্লেখ করো
ঐচ্ছিক ক্রিয়ার স্তরসমূহ
এ কথা ঠিক যে, ঐচ্ছিক ক্রিয়া হল এমনই ক্রিয়া যা মানুষের নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায়কে লাভ করার জন্য স্বাধীন ও সচেতনভাবে কৃত। এরূপ ক্রিয়াগুলি তাই নির্দিষ্ট ফল লাভের অভিপ্রায়েই কৃত হয়। ঐচ্ছিক ক্রিয়া সম্পাদনের প্রক্রিয়াটি কিন্তু জটিল, কারণ ঐচ্ছিক ক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করলে মূলত তিনটি স্তর পরিলক্ষিত হয়। এই তিনটি স্তর হল-[1] মানসিক স্তর (Mental Stage), [2] দৈহিক স্তর (Bodily Stage) এবং [3] বাহ্য পরিণাম স্তর (Stage of External Consequences)।
আরও পড়ুন – নৈতিক বিচারের প্রকৃত কর্তা কে তা আলোচনা করো
[1] মানসিক স্তর (Mental Stage)
ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে যে-সমস্ত স্তর উল্লেখ করা হয়েছে, এদের মধ্যে অন্যতম হল মানসিক স্তর। এই মানসিক স্তরকেই ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মূল বা প্রধান স্তর বলা হয়। কারণ ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু স্বাধীন ও সচেতনভাবে ক্রিয়া সম্পাদন করা হয়, সেহেতু তার জন্য মানসিক প্রস্তুতির অবশ্যই প্রয়োজন। ঐচ্ছিক ক্রিয়া সম্পাদনের ক্ষেত্রে এই মানসিক প্রস্তুতির বিষয়টি প্রথমেই দেখা যায় বলে, এই স্তরটিকে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ স্তররূপে গণ্য করা হয়। যে-কোনো ঐচ্ছিক ক্রিয়ার পশ্চাতে এরূপ যে মানসিক স্তরটি দেখা যায়, তার মধ্যে আবার কতকগুলি উপস্তর বিদ্যমান। এই সমস্ত উপস্তরগুলি হল যথাক্রমে- (i) কর্মের উৎস, (ii) লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য, (iii) কামনা, (iv) কামনার বিরোধিতা, (v) বিবেচনা এবং (vi) নির্বাচন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এই সমস্ত উপস্তরগুলিকে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
(i) কর্মের উৎস (Spring of Action)
ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মূল উৎস হল অভাববোধ (Feelings of want)। কারণ, কোনো কর্মের চিন্তাই ব্যক্তির মনে আসতে পারে না, যদি না তার কোনো অভাব থাকে। অর্থাৎ, অভাববোধই আমাদেরকে কর্মে প্রণোদিত করে। কারণ, কোনো বস্তুর অভাববোধ থেকেই সেই বস্তুকে পাওয়ার জন্য আমাদের মনে একপ্রকার অস্বস্তির ভাব উৎপন্ন হয়। এই অস্বস্তির ভাবকে কাটিয়ে তুলতেই আমরা কর্মসম্পাদনের কথা চিন্তা করি এবং এরূপ কর্মসম্পাদনের দ্বারাই সেই বস্তুটির অভাব পূরণ করার চেষ্টা করি।
( ii) লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য (End of motive)
একথা ঠিক যে, যে বস্তু আমাদের নাগালের মধ্যে নয়, সেই বস্তুটির অভাব আমাদের মনে জেগে ওঠে। এরূপ অভাববোধের বিষয়টি কীভাবে পরিতৃপ্ত হবে, সে সম্পর্কে আমরা একটা ধারণা গঠন করি। অর্থাৎ, বস্তুটির অভাব মেটানোর জন্য আমরা একটি পরিকল্পনা গঠন করি। এরূপ পরিকল্পনা গঠন করাকেই বলা হয় লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। শুধুমাত্র আমাদের অভাববোধই কাম্য বস্তুটিকে লাভ করতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন হল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে স্থির করে নেওয়া। লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য স্থির করে নেওয়ার পরই আমার কর্মে প্রবৃত্ত হই।
(iii) কামনা (Desire)
আমাদের মধ্যে যে অভাববোধ জাগরিত হয়, সেই অভাববোধের সঙ্গে যখন কাম্যবস্তু তথা লক্ষ্যবস্তুটির ধারণা যুক্ত হয়, তখন তাকে লাভ করার জন্য একপ্রকার মানসিক প্রবণতার সৃষ্টি হয়। এরূপ মানসিক প্রবণতাকেই বলা হয় কামনা (Desire)। মানুষের মনের মধ্যে যদি এরূপ কামনা জেগে না ওঠে, তাহলে মানুষ কখনোই স্বাধীন ও স্বেচ্ছাধীনভাবে কর্মে প্রবৃত্ত হতে পারে না। স্বাধীন ও স্বেচ্ছাধীনভাবে ক্রিয়া সম্পাদনের জন্য তাই কামনার উপস্থিতি একান্তভাবেই প্রয়োজন। এই কামনার মধ্যেই থাকে বস্তুটিকে লাভ করার একপ্রকার তাড়না বা তাগিদ, যা মানুষকে কর্মে প্রবৃত্ত করে।
(iv) কামনার বিরোধিতা (Conflict of Desires)
আমাদের কামনা যদি একটি হয়, তাহলে আমরা সহজেই বস্তুটিকে হয়তো লাভ করতে পারি। কিন্তু অনেকসময় দেখা যায় যে, আমাদের কামনার বস্তু হল বহু। কিন্তু সব কামনাগুলিকে একসঙ্গে পূরণ করা সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য কামনার বস্তুগুলিকে সরিয়ে রেখে, একটি কামনার প্রতিই অগ্রাধিকার দিতে হয়। কোন্ কাম্যবস্তুগুলিকে সরিয়ে রেখে, কোন্ কাম্যবস্তুকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন কামনার বস্তুগুলির মধ্যে একপ্রকার দ্বন্দ্ব দেখা যায়। কামনাগুলির মধ্যে এরূপ পারস্পরিক দ্বন্দ্বকেই বলা হয় কামনার বিরোধিতা (Conflict of desires)।
(v) বিবেচনা (Deliberation)
আমাদের মনের মধ্যে যখন বিভিন্নপ্রকার কামনার দ্বন্দ্ব দেখা যায়, তখন অন্যান্য সমস্ত কামনাগুলিকে পরিহার করে একটি নির্দিষ্ট কামনাকেই বেছে নিতে হয়। এই বেছে নেওয়া কামনাটির পরিতৃপ্তি সাধনের জন্যই আমরা কর্মে প্রবৃত্ত হই। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন থেকে যায় যে, আমরা কোন্ কামনাটিকে গ্রহণ করব এবং কোনগুলিকেই বা বর্জন করব? এরূপ প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতেই বিবেচনার বিষয়টি উঠে আসে। এর ফলে চিন্তাভাবনা বা বিচারবিবেচনা করে কামনাগুলির আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ধারণ করা হয়। এভাবে আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ধারণ করার ফলে কোন্ কামনাটি আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা নির্ধারিত হয়। এভাবেই আমরা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কামনাটিকেই গ্রহণ করি এবং অপরাপর কামনাগুলিকে বর্জন করি।
(vi) মনোনয়ন বা নির্বাচন এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ (Decision and Resolution)
আমাদের মনে যখন একাধিক কামনার মধ্যে বিরোধিতা দেখা যায়, তখন আমরা বিবেচনাপূর্বক একটিকে বেছে নিই এবং অপরগুলিকে বর্জন করি। এভাবেই আমাদের মধ্যে কামনার দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি ঘটে। আমরা আমাদের বিবেচনার মাধ্যমে স্বেচ্ছায় যে কামনাটিকে বেছে নিই, তার পরিতৃপ্তির জন্যই আমরা কর্ম করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এর ফলে আমরা আমাদের কামনা থেকে সৃষ্ট কর্মটিকে সম্পন্ন করার জন্য কিছু উপায়ের কথা চিন্তা করি এবং কর্মে প্রবৃত্ত হই। এভাবেই এখানে আমাদের ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মানসিক স্তরের পরিসমাপ্তি ঘটে।
[2] দৈহিক স্তর (Bodily Stage)
ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে মানসিক স্তরের পরিসমাপ্তির পরই শুরু হয় তার দৈহিক স্তর। কারণ, কামনার দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার পর যে সংকল্প তথা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, সেই সংকল্প তথা সিদ্ধান্তকে কর্মে পরিণত করার জন্য বিভিন্নরকম দৈহিক পরিবর্তন, অঙ্গ সঞ্চালন এবং অন্যান্য বাহ্যক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। এই ধরনের দৈহিক পরিবর্তন ও ক্রিয়া ছাড়া ঐচ্ছিক ক্রিয়া কখনোই সম্পন্ন হতে পারে না। এর জন্য দৈহিক স্তরেরও প্রয়োজনীয়তা আছে। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, ঐচ্ছিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য আমাদের শুধুমাত্র মানসিক স্তরের বিভিন্ন পর্যায়গুলিকে অতিক্রম করলেই চলবে না, তার জন্য প্রয়োজন হল দৈহিক স্তরের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
[3] বাহ্য পরিণাম স্তর (External Stage of Consequences)
ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে মানসিক স্তরের পরবর্তী দৈহিক স্তর সম্পন্ন হওয়ার ফলে বাহ্য জগতে অবশ্যই কিছু-না-কিছু পরিবর্তন ঘটে। এরূপ বাহ্য পরিবর্তনকেই ঐচ্ছিক ক্রিয়ার বাহ্য পরিণাম স্তররূপে গণ্য করা হয়। এরূপ স্তরটিকেই ঐচ্ছিক ক্রিয়ার সর্বশেষ স্তররূপে উল্লেখ করা হয়। সেকারণেই এরূপ স্তরটিকে পরিণাম স্তররূপে গণ্য করা হয়। এই স্তরেই আমাদের ঐচ্ছিক ক্রিয়ার কামনাটি বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করে এবং তার ফলে জাগতিক কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। তখনই এরূপ পরিবর্তনটিকে যথার্থ অথবা অযথার্থ, ন্যায় অথবা অন্যায়, উচিত অথবা অনুচিত-প্রভৃতি নৈতিক মাপকাঠিগুলির দ্বারা বিচার করা সম্ভব হয়। স্বাভাবিকভাবেই তাই ঐচ্ছিক ক্রিয়া নৈতিক ক্রিয়ার (Moral actions) অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।
1 thought on “ঐচ্ছিক ক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরগুলি উল্লেখ করো”