সবার উপরে মানুষ সত্য রচনা
ভূমিকা
শিখাইলে সেই সত্য তুচ্ছ নয় মনুষ্যত্ব দেব নয়, মানুষই অমর। কবিশেখর কালিদাস রায়ের এই চিরসত্যের রূপটি কালের কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত। সভ্যতা সৃষ্টির প্রথম লগ্ন থেকে চিন্তনে ও মননে মানুষ তার শ্রেষ্টত্ব প্রমাণ করে আসছে। সেই শ্রেষ্টত্ব তার সঙ্গবদ্ধতায়, চিন্তায়, জ্ঞান বুদ্ধিতে, হৃদয়ধর্মের প্রকাশে। মানুষের প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হল তার বুদ্ধির তিঘ্নতা। জন কল্যান সাধনের শ্রেষ্ট পন্থা মানুষের সেবা। মানুষের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত হওয়া এবং অন্যের মনে মমত্ব বোধ জাগিয়ে তোলা -মানুষের মহান পবিত্র কর্তব্য।
মানবিকতার অবমাননার কারণ
মানবসভ্যতার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে মানবতার বাণী। মানুষ যখন প্রকৃতিশক্তির কাছে নিজেদের অসহায় মনে করে তখন মেতে ওঠে দেব দেবীর পুজোয়, তাদের মূলধন হয় ধৰ্ম্ম, মানবতাবোধ বাধাপ্রাপ্ত হয়। মানুষ মানুষকে করে পীড়ন শোষন, সংকীর্ণতার বিভীষিকা আত্মপ্রকাশ করে। মানুষ যখন তার প্রকৃত মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে তখন জাতপাতের কুসংস্কারে সে নিয়োজিত হয়। মধ্যযুগে ঘটেছিল মানবতার চেতনার অবক্ষয়। তখন মানুষ হারিয়ে ফেলল ধর্মের আবরণে আত্মবিশ্বাস, শুরু হল ধর্মের অনাচার, মানুষের ওপর উৎপীড়ন। গৌতমবুদ্ধ প্রচার করলেন, ‘মানবমৈত্রী ও করুণা’র অমৃত বাণী।
সমাজের অস্পৃশ্য ঘৃণ্য মানুষ মানবতার স্বীকৃতিতে স্ব- জীবনের সাধনায় অভিষিক্ত হল। হিংসায় উন্মত্ত পাশ্চাত্য উদ্বোধিত হল যীশুখ্রিস্টের মানবপ্রেমের মহৎ প্রেরণায়। কৃত্রিম ভেদাভেদ দূর করতে প্রয়াসী হলেন অনেকে, এগিয়ে এলেন মার্টিন লুথার, জোয়ান-অব-আর্কের মতো মহান মানবপ্রেমিক ও দেশপ্রেমিকগণ। হজরত মহম্মদ ধর্মের কথা ঘোষণা করলেও মানুষের গুরুত্বকে স্থান দিয়েছেন সবের্বাচ্চে। মহাপুরুষ মহম্মদ গভীর ভগবদ্বিশ্বাসী হয়েও ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন আন্তরিক মানব প্রত্যয়ের প্রেরণায় ভ্রাতৃত্বের আদর্শে উদ্ভাসিত হয়ে।
আধুনিক যুগের প্রেক্ষাপটে মানবতা
আধুনিক যুগে নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে মানুষ তার নতুন পরিচয় জানল, উচ্চারিত হল মানবিকতার কথা, ধর্ম- সংস্কার-স্বার্থের বাধন থেকে মুক্ত মানুষের ‘স্বাধীন বিকাশ’ প্রশংসিত হল। প্রতিষ্ঠিত হল এই ‘মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় সে মানুষ, আর কিছু নয়’। (Man is a man for all that). সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ উপলব্ধি করল মানুষই সমস্ত শক্তির উৎস-সমাজ সৃষ্টিতে, মানুষের গুরুত্ব আরোপে মানবমহাত্ম্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “আমায় নইলে ত্রিভূবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে”।
সভ্যতার সংকট
মানবকল্যানই শ্রেষ্ঠ মানবধর্ম এই চিরসত্য প্রচারিত হলেও বিবেকহীন মানুষের দ্বারা লাঞ্ছিত অপমানিত হতে লাগল বৃহত্তম জনসমাজ। ধর্মযুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ প্রভৃতি মানবতার অবমাননার নামান্তর মাত্র। সারা পৃথিবীতে ধর্মের নামে দাঙ্গা, হানাহানি হয়েছে, ঘটেছে দেশভাগের মতো দুঃখজনক ঘটনা। জাতের দোহাই দিয়ে মানুষই ঘৃণা করেছে মানুষকে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন-
বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথায় খুঁজিছ ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেই জন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।
জনসেবার মাধ্যমে জনকল্যানই মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
মানবতার পরিচয়
এখন মানব সেবায় এগিয়ে এসেছে বহু প্রতিষ্ঠান, প্রত্যেক রাষ্ট্রের সংবিধানে মানবিকতার কথা উল্লেখ আছে। সমাজের মহান কর্তব্য হল, ‘সর্বসংস্কার মুক্ত মানবসত্য’ উপলব্ধির আলোকে জনকলানমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করা। মানবকল্যানের সাধন-ব্রতই সমস্ত মানুষের মহান ব্রত। এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হলে অমানবতার অন্ধকার থেকে আলোকের পথে হবে উত্তরণ, হবে ভেদাভেদ ভুলে ত্বরান্বিত মানবসভ্যতার সুস্থ গতি। সার্থক হবে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের স্বপ্ন-ভবিষ্যৎ,
মানুষে মানুষে নাই যে বিশেষ নিখিল ধরা ব্রহ্মম।
উপসংহার
মানুষের মন থেকে কুসংস্কার ঘৃণা-বিদ্বেষের প্রাচীর অপসারিত হলে সবার মুখে উচ্চারিত হবে চন্ডীদাসের উচ্চারিত কবিতার অভিব্যক্তি, ‘শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।
আরও পড়ুন – ধর্ম ও কুসংস্কার রচনা