তোমার দেখা একটি মেলা রচনা
ভূমিকা
মেলা বলতে মিলন-ক্ষেত্র বোঝায়। মেলায় রচিত হয় পরস্পরের সাথে ভাববিনিময়ের মাধ্যমে মিলন-সেতু। মেলার গুরুত্ব খুবই প্রাচীন কাল থেকে। সাধারণত মেলা বসে সমুদ্র তীরে, কোন দেবমন্দিরে বা নিদিষ্ট কোন স্থানে বিশেষ করে উৎসব উপলক্ষ্যে, সমবেত হয় অজস্র মানুষ।
মেলার তাৎপর্য
মেলার যেমন অর্থনৈতিক দিক আছে তেমনি মনস্তাত্ত্বিক দিকও গুরুত্বপূর্ণ। মেলায় বহু মানুষের ভাবের আদান-প্রদান ঘটে, চিত্ত হয় প্রসারিত, মন আনন্দে ভরে যায়, দূর হয় শরীরের অবসাদ। মেলায় থাকে সারি সারি দোকান, বিক্রি হয় পণ্যসামগ্রী। পারস্পরিক ভাব-চিন্তা এবং আত্মিক ভাব-চিন্তার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে একটি অখন্ড সামাজিকতা।
পশ্চিমবঙ্গে মেলা
বাঙালি বারো মাসে তেরো পার্বণে মেতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেেছন, “মেলা ভারতের পল্লির সার্বজনীন উৎসব। কোনো উৎসব প্রাঙ্গ নের মুক্ত অঙ্গনের সরল গ্রামবাসীর মনের উচ্ছ্বসিত মিলনস্থল হইল মেলা।” পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত মেলাগুলি হল মহিষাদলের রথের মেলা, মাহেশের রথের মেলা, শান্তিপুরের রাসের মেলা, শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা, গঙ্গাসাগর মেলা, কেঁদুলির জয়দেবের মেলা, চুরুলিয়ার নজুরুল মেলা, নানুরের চন্ডীদাসের মেলা, ফুলিায়ার কৃত্তিবাসের মেলা, চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর মেলা, জলপাইগুড়ির জলেশ্বরের মেলা প্রভৃতি।
বন্ধুদের সাথে সেবার শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা দেখতে গিয়েছিলাম। গ্রামছাড়া রাঙামাটির পথ ধরে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এগিয়ে চলেছে মেলার দিকে। শহরের মানুষ, দেশ-বিদেশ, গ্রাম থেকে লোক এসে ভিড় করছে মেলায়, কোথাও চলছে আলখাল্লা-গায়ে বাউলের গান হাতে একতারা। দূর থেকে ভেসে আসছে তেলেভাজার গন্ধে ভরা জনকোলাহল। আমার সাথে আছে কয়েকজন বন্ধু। মাঝে মাঝে ভিড়ের ঠেলায় ছন্দপতন হচ্ছে চলার। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দেখলাম চলছে সার্কাস, নাগর দোলায় চড়ে আনন্দ উপভোগ করছে ছোটোও বড়োরা।
মেলার একপ্রান্তে চলছে কবিগানের লড়াই। তার পাশে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা, মাথার খোঁপায় গোঁজা হলুদ ফুল সাঁওতাল মেয়েরা ধামসা-মাদলের বোলের তালে তালে পুরুষদের সাথে নাচছে। ভূন্নডাঙার মাঠে বাজি পোড়ান দেখলাম। এইভাবে কেটে গেল সারারাত। তবে প্রয়োজন মত খাবার কিনে খেয়েছি এবং ঘুরতে ঘুরতে যখন ক্লান্তি বোধ করেছি তখন কোথাও বসে বিশ্রাম করেছি। ছোটো বোনের জন্য কিনলাম কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল ও কাচের চুড়ি।
উপসংহার
মেলা সত্যি মানুষের মিলন স্থল। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ এসে মিলিত হয় মেলায়। কেনা-বেচা হয় নানা ধরনের জিনিষপত্র। বিক্রেতাদের মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে লাভের অঙ্ক দেখে এবং যারা মেলা দেখতে গেছে তারা আনন্দে হয় আত্মহারা। মেলায় বিভিন্ন ধরনের মানুষের সংস্পর্শে যেমন অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি হয় তেমনি প্রীতি ও ঐক্যের মেলবন্ধন রচিত হয। মেলা দেখার সেই স্মৃতি আজও স্বস্মরণীয় হয়ে আছে। অবসর সময়ে সেই স্মৃতি বার বার ভেসে ওঠে মনে। মন ব্যগ্র হয় কখন বছর ঘুরে আসবে, আবার মেলার আনন্দ সাগরের স্রোতে হারিয়ে যাব নিজে কর্মময় জীবনের সকল অবসাদ ভুলে গিয়ে।
পৌষমেলার মাধ্যমেই গ্রাম বাংলার মেলার রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। এই মেলার মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষের হৃদয়ের আদানপ্রদান ঘটে। জাতের পার্থক্য ভুলে গিয়ে বিবিধের মাঝে মিলনের মহান আদর্শ ফুটে ওঠে মেলাপ্রাঙ্গ ণের পবিত্রভূমিতে, চেনা যায় দেশাত্মাকে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভাব অনটন, প্রাত্যহিক তুচ্ছ স্বার্থের হানাহানি হারিয়ে যায় মেলার মহান অঙ্গনে। বৈচিত্রহীন ক্লেদাক্ত জীবনের গ্লানি-কালিমা মিলন যজ্ঞের আসরে নবপ্রাণ পেয়ে সঞ্জীবিত হয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের পাথেয় সঞ্চয়ে সাহায্য করে। কিছুদিনের অর্থকরী স্বাচ্ছন্দ সৃষ্টি হয় মেলায় কেনা-বেচার মাধ্যমে। প্রত্যক্ষ করা যায় গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির অপরূপ নিদর্শন।
মেলা গ্রামীণ জীবনে নিয়ে আসে এক সুখকর তৃপ্তি, আমাদের চেতনায় দেয় নতুন পরিবেশের, নতুন অনুভূতির আনন্দ। সহজ সরল মানুষের আনন্দমুখর কলরব ও অনাবিল আনন্দময় মুহূর্তগুলি মনে মেলার স্মৃতি জাগিয়ে রাখে। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা এমনই এক আনন্দানুভূতি ও অভিজ্ঞতায় ভরপুর এক অক্ষয় স্মৃতি আমার মনের মণিকোঠায়।
আরও পড়ুন – একটি ছুটির দিন রচনা