পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু
বাংলা সাহিত্যে ‘পুঁই মাচা’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক অনবদ্য সৃষ্টি। আপাততুচ্ছ নিতান্ত সাধারণ ঘটনাকে অবলম্বন করে এ গল্পে লেখক তৈরি করেছেন একটি মর্মস্পর্শী কাহিনি। আলোচ্য গল্পে সহায়হরি চাটুজ্যে নামে সহায়সম্বলহীন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ এবং তাঁর স্ত্রী ও তিন কন্যাসন্তানের জীবনযাপনের করুণ কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
গল্পে দেখা যায়, বিত্ত আর আভিজাত্য হারিয়ে সহায়হরির আর্থিক অবস্থা এবং সামাজিক অবস্থান বেশ নড়বড়ে। স্ত্রী এবং তিন কন্যার ভরণপোষণে প্রায় অসমর্থ সহায়হরির সংসারেও মন নেই তেমন। ‘পুঁই মাচা’ গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে এই সহায়হরি চাটুজ্যে এবং তাঁর স্ত্রী অন্নপূর্ণার বড়ো মেয়ে ক্ষেন্তি। স্বভাবচঞ্চল-ভোজনপটু এই মেয়েটির বয়স চোদ্দো-পনেরো বছর হলেও লোকসমাজে ক্ষেন্তির বয়স কমিয়ে তেরোর কাছাকাছি বলে থাকেন সহায়হরি।
আলোচ্য গল্পটির কাহিনিবৃত্ত আবর্তিত হয়েছে ক্ষেন্তিকে কেন্দ্র করেই। ব্রাহ্মণ বাড়ির বিবাহযোগ্যা মেয়ে ক্ষেন্তির বিবাহের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়ে উঠছে না দরিদ্র সহায়হরির পক্ষে। অবশ্য ক্ষেন্তির বিবাহের বন্দোবস্ত করেছিলেন সহায়হরি। গ্রামের মাতব্বর কালীময় ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে মণিগাঁয়ের শ্রীমন্ত মজুমদারের ছেলের সঙ্গে বিবাহ ঠিক হয়েছিল ক্ষেন্তির। কিন্তু পাত্রপক্ষ ক্ষেন্তিকে আশীর্বাদ করে যাওয়ার কয়েকদিন পর সহায়হরি জানতে পারেন ছেলের স্বভাবচরিত্র বিশেষ ভালো নয়। নিজের গ্রামের কোনো এক কুম্ভকারবধূর সঙ্গে অপকর্মের চেষ্টায় ধরা পড়ে খুব মার খেয়ে তার শয্যাগত হয়ে পড়ার খবর সহায়হরির কানে আসে। সুতরাং তিনি সে সম্বন্ধ ভেঙে দেন।
গ্রামের মাতব্বররা সহায়হরির এ সিদ্ধান্তে স্বাভাবিক কারণেই বিব্রত হন। গ্রামসমাজের নিয়মনীতি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং চৌধুরীদের চণ্ডীমণ্ডপে সহায়হরিকে এক ঘরে করে দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চলে।
এইসব আলোচনা স্ত্রী অন্নপূর্ণার কানে পৌঁছোলে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। এ ব্যাপারে চড়া সুরে স্বামীকে দু-কথা শোনালেও, সহায়হরিকে যথেষ্ট নির্বিকার থাকতে দেখা যায়। বড়ো মেয়ে ক্ষেন্তিও এসব ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়। তার বিবাহ নিয়েই বাবা-মায়ের মধ্যে যখন তীব্র বিবাদ বাধে তখন সে দুই বোন পুঁটি ও রাধীকে সঙ্গে নিয়ে এক-বোঝা পাকা পাকা পুঁইশাক আর কিছু চিংড়ি মাছ সংগ্রহ করে মহানন্দে বাড়ি ফেরে। বিবাহযোগ্যা কন্যার এমন বাউন্ডুলে আচরণে অন্নপূর্ণা অত্যন্ত রেগে যান। ছোটো মেয়ে রাধীকে বলেন পুঁইশাকগুলিকে খিড়কি পুকুরের ধারে ফেলে দিয়ে আসতে। সহায়হরির সামান্য অনুরোধেও কোনো কাজ হয় না। রাধী কলের পুতুলের মতো মায়ের নির্দেশ পালন করে।
সেদিন রান্না করতে বসে তবু এই অত্যন্ত অগোছালো, নিতান্ত নিরীহ, একটু অধিক মাত্রায় ভোজনপটু বড়ো মেয়েটির করুণ মুখখানির কথা মনে পড়ে অন্নপূর্ণার। তৎক্ষণাৎ উঠোনে, খিড়কি দোরের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা পুঁইডাঁটাগুলি কুড়িয়ে এনে চিংড়ি মাছ দিয়ে পুঁইশাকের তরকারি রাঁধেন চুপিচুপি। দুপুরবেলা খাবার পাতে পরম প্রিয় পুঁইশাকের চচ্চড়ি দেখে বিস্ময়ে-আনন্দে অস্থির হয়ে ওঠে ক্ষেন্তি। চেটেপুটে ক্ষেন্তির খাওয়া দেখে তৃপ্তি পান অন্নপূর্ণাও।
এদিকে আবারও কালীময়ের চণ্ডীমণ্ডপে ডাক পড়ে সহায়হরির। আশীর্বাদ হয়ে যাওয়ার পর মেয়ের বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্য তাকে ভর্ৎসনা করা হয়। এতে বিশেষ বিচলিত হন না তিনি। দুদিন পেরোতেই ক্ষেন্তির সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে বরোজপোতার বন থেকে আনন্দে উদ্ধার করে আনেন পনেরো-ষোলো সের ওজনের মেটে আলু। যথারীতি ধরা পড়ে যান বুদ্ধিমতী স্ত্রী অন্নপূর্ণার কাছে। মেয়ের বিবাহের ব্যবস্থা না করে সহায়হরির এ নির্বিকার জীবনযাপনে বিরক্ত হয়ে অন্নপূর্ণা বিস্তর বকাবকি করেন বাবা মেয়েকে।
দু-তিন দিন পর অন্নপূর্ণা দেখেন ভাঙা পাঁচিলের ধারের খোলা – জমিতে প্রবল শীতে ক্ষেন্তি একটি পুঁইচারা লাগাচ্ছে। অসময়ে চারা – পুঁতে ক্ষেন্তি মাকে বলে সে রোজ জল ঢেলে গাছটিকে বাঁচিয়ে রাখবে। – শীতে কাঁপতে কাঁপতে মুখুজে বাড়ি থেকে গোবর কুড়িয়ে আনে সে। – এভাবেই জীবনের প্রতি সোহাগে-বীতরাগে দিন চলে যায় সহায়হীন – সহায়হরির পরিবারের।
সময়ের নিয়মে পৌষ সংক্রান্তি আসে। দরিদ্র পরিবারেও সামান্য উপাচারে পিঠেপুলির আয়োজন করেন অন্নপূর্ণা। দীনদুখিনি মায়ের – বানানো নিতান্ত সাধারণ পিঠে খেয়েই অসাধারণত্বের স্বাদ পায় -রাধী-পুঁটি-ক্ষেন্তি। মুখ বুজে শান্তভাবে আঠারো-উনিশটা পিঠে খাওয়ার পর আর ক-খানা পিঠে নেওয়ার কথা অন্নপূর্ণা জিজ্ঞেস করলে ক্ষেন্তি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে। শান্ত-নিরীহ-ভোজনরসিক মেয়েটির ভবিষ্যৎ বিবাহিত জীবনের নিশ্চিত সুখ কল্পনা করে অন্নপূর্ণা শান্তি অনুভব করেন।
বৈশাখ মাসের প্রথমে সহায়হরির এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের ঘটকালিতে চল্লিশ বছর বয়সি এক পাত্রের সঙ্গে ক্ষেন্তির বিবাহ হয়ে যায়। পাত্রের দ্বিতীয় পক্ষের বিবাহ এটি। অযত্নে লালিত মেয়েটিকে পরের ঘরের অপরিচিত মহলে পাঠাতে বুক কেঁপে ওঠে অন্নপূর্ণার। মাত্র দু-মাস পর অর্থাৎ আষাঢ় মাসেই বাবাকে পাঠালে সে বাড়ি আসবে-এই সান্ত্বনায় অন্নপূর্ণাকে শান্ত করে। শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয় ক্ষেন্তি। ক্ষেন্তির আর ফেরা হয় না নিজের বাড়িতে।
বরপণের বাকি আড়াইশো টাকা পাত্রপক্ষকে মিটিয়ে দিতে না পারার অপরাধে বছর ঘুরে গেলেও বাপের বাড়ি পাঠানো হয় না ক্ষেন্তিকে। ফাল্গুন মাসে বসন্ত হয় ক্ষেন্তির। অসুস্থ মেয়েটির গা থেকে সোনার গয়নাগুলি খুলে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ক্ষেন্তিকে দিয়ে আসে টালায় সহায়হরির এক দূর সম্পর্কের বোনের বাড়িতে। সেখানেই মৃত্যু হয় ক্ষেন্তির।
মেয়ের মৃত্যুর এ নির্মমতাকে মেনে নিয়ে সময়ের নিয়মে নিরুপায় অন্নপূর্ণা পৌষ সংক্রান্তিতে আবার পিঠে বানাতে বসে। পুঁটি-রাধী আয়োজনে অংশগ্রহণ করে আগের মতোই। পুঁটির পিঠে খাবার আগে পুঁটির দিদির কথা মনে পড়ে। সকলের মন সেই উৎসব পার্বণের রাতে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ক্ষেন্তি নেই, রয়ে গেছে তার হাতে লাগানো সেই পুঁইচারাটি। উঠোনের কোণে মা-মেয়েদের দৃষ্টি আবদ্ধ হয়ে যায়। সেখানে বাড়ির সেই লোভী মেয়েটির স্মৃতি বিরাজ করছে, বহু সাধ করে তার নিজের হাতে পোঁতা পুঁই গাছটি কচি কচি সবুজ পাতাতে ভরে আছে। সব ডগাগুলি মাচায় ধরেনি-জীবন লাবণ্যে ভরে আছে গাছটি। সুস্পষ্ট, নধর, প্রবর্ধমান তার গতি। ঠিক যেমনটা ক্ষেন্তি বেঁচে থাকলে হত।
আরও পড়ুন – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কবিতার MCQ