পরিবেশ দূষণ রচনা
পরিবেশ দূষণ রচনা
ভূমিকা
পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে উপযুক্ত পরিবেশের ফলে।বায়ুমন্ডলে ছিল প্রাণের প্রসূতি অফুরন্ত অক্সিজেন, খাদ্যে ও জলে ছিল সতেজ-শুদ্ধতা। যার ফলে জীবনের দ্রুত বিকাশ সম্ভব হয়েছিল পৃথিবীতে, তার মধ্যে উন্নত প্রাণী মানুষ। সূচিত হলো অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রকৃতির সাথে আপোষহীন সংগ্রাম। প্রকৃতিকে সংহারের জন্য প্রয়োজন হল জনশক্তি। সম্মিলিত পেশীশক্তি প্রকৃতির রোষানল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে, তার দ্রুত বংশবিস্তার ও বিজ্ঞানের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পৃথিবীতে শুরু হল অতি-যান্ত্রিকতা। নাগরিক সভ্যতায় নেমে এল অভিশাপ, হারিয়ে গেল বায়ুমন্ডলের বিশুদ্ধতা। নির্বিচারে প্রকৃতির অপব্যবহারে মানুষ পৃথিবীতে ডেকে আনল ক্ষয়, মহামারী, বায়ুমন্ডল দূষণের ফলে প্রকৃতিও ক্ষিপ্ত হয়ে নিচ্ছে প্রতিশোধ।
আবহাওয়া দূষণের সুত্রপাত
পৃথিবীতে আগুন আবিষ্কারের পর থেকেই সূচিত হল প্রাণের ধাত্রী অক্সিজেন ধ্বংস-লীলা। আগুন বায়ুমন্ডলের অক্সিজেনের অণুপাত হ্রাস করে জীবনের অনুকূল পরিবেশের ভারসাম্য শুধু নষ্ট করল না, ধোঁয়া এবং ভস্মকণায় তাকে করে তুলল কলুষিত। গাছ কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে সালোকসংশ্লেষের সময় ও অক্সিজেন ত্যাগ করে। কিন্তু মানুষ সেই বৃক্ষকে ছেদন করে যে মানুষের সবচেয়ে উপকারী বন্ধু তাকে। বৃক্ষ-ছেদন করে মানুষ প্রকারান্তরে নিজেদের অস্তিত্ব বিলোপের নির্মম খেলায় মেতে আছে। নিজের কবর নিজেই খুঁড়ছে মানুষ বুদ্ধিশ্রেষ্ঠ প্রাণী হয়েও।
শিল্প-বিপ্লব ও পরিবেশ দূষণ
বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে ঘটেছে শিল্প-বিপ্লব, যা মানব-সভ্যতার অগ্রগতিকে করেছে ত্বরান্বিত। কিন্তু শিল্প-বিপ্লবই আবহাওয়াকে করছে সবচেয়ে বেশি দূষিত। আবিষ্কার হয়েছে বাষ্পশক্তি ও বিদ্যুৎশক্তি যার উপাদানের মূলে রয়েছে যে দহন তা বাতাসের অক্সিজেনের অনুপাত হ্রাস করে শ্বাসরোধী-বিষ করে তুলছে বায়ুমন্ডলকে প্রাণঘাতী। কাঠ, কয়লা, তৈল জাতীয় বস্তু দহনের ফলেও বায়ুমন্ডল দূষিত হচ্ছে। শিল্পের বর্জ্য বন্ধ জল ও আবহাওয়ায় ছড়াচ্ছে বিষ। প্লাস্টিক যেমন প্রয়োজনীয় বস্তু তেমনি চল্লিশ মাইক্রো থেকে কম ঘন ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে এজন্য যে তার ব্যবহারের ফলে দূষণ ছড়ায়, যেহেতু প্লাস্টিক পুনঃব্যবহার হয় না ও সহজে নষ্ট হয় না।
পারমাণবিক শক্তি ও দূষণ
এখন বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানব-সভ্যতাকে পৌঁছে দিয়েছে পারমাণবিক যুগে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার কথা ভাবলে এখনও সারা পৃথিবীর মানুষ শঙ্কিতহন। এই মহাযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা বর্ষণের ফলে শুধু হিরোসিমা ও নাগাসাকি বিধ্বস্ত হয়নি তার প্রবল বিষক্রিয়ায় সন্নিহিত ভূখন্ডের মানুষ, জীবজন্তু এমন কি উদ্ভিদ ও নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিল্পে নবযুগের সূচনা হয়েছে এবং পারমাণবিক তাপকেন্দ্র প্রভৃতির বর্জ্য পদার্থের দ্বারা পরিবেশ দূষণের ফলে ক্যানসারের মতো দূরারোগ্য ব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে নিউট্রন ও পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে যদিও তাঁরা একথা জানে যে এর ফলে পরিবেশে ছড়াচ্ছে বিষ। এখন যুদ্ধক্ষেত্রের সীমা জল, স্থল, মহাকাশকেও গ্রাস করেছে। যার ফলে যুদ্ধে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিষ ডেকে আনছে বিপর্যয়।
ভূ-প্রকৃতিতে প্রতিক্রিয়া
আজ পৃথিবীর দিকে দিকে যে ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর মিছিলের কালো ছায়া, অবক্ষয় ও মহামারী সংক্রামিত হচ্ছে, তার কারণ ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ। নির্মূল হচ্ছে বনজঙ্গল-বৃক্ষরাজি, সৃষ্টি হচ্ছে মরুভূমি, বায়ুমন্ডলের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ায় কমছে বৃষ্টিপাতের পরিমান, বিপর্যস্ত হচ্ছে ঋতুচক্রের বিবর্তন, শস্যোৎপাদনের পরিমান হচ্ছে ক্রমহ্রাসমান, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পাহাড়-পর্বতের বরফ গলে নদী-সমুদ্রের জলস্ফীতির ফলে বন্যা-প্লাবন ধেয়ে আসছে। বাড়ছে দূষণ জলস্রোত স্তব্ধ হওয়ায়।
আক্রান্ত মানুষ
দূষিত বায়ুমন্ডলে রচিত হচ্ছে রোগ-জীবাণুর স্বর্গভূমি। ফলে যক্ষা, ক্ষয়রোগ, শ্বাসরোগ, উদরাময়, স্নায়ুরোগ, ক্যানসার প্রভৃতি দূরারোগ্য ব্যাধি আজ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ অভিশাপে ভরিয়ে দিচ্ছে। এই দূষিত বায়ুমন্ডলে সুস্থ সন্তানের জন্ম ও তার সুস্থ বিকাশের প্রতিশ্রুতি দিনের পর দিন হয়ে যাচ্ছে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর।
মহাকাশ দূষণ ও তার প্রতিক্রিয়া
মহাকাশে বিমান-চালনা, রকেট উৎক্ষেপ, যুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার প্রভৃতির ফলে স্ট্রাটোস্ফিয়ারের প্রাণ-প্রদায়ী মূল্যবান গ্যাস ‘ওজোন’ হারিয়ে ফেলছে তার মাত্রা ক্ষমতা। তার ফলে, সূর্যের ‘আলট্রা-ভায়োলেট রে’ বা অতিবেগুনী রশ্মি অবাধে পৃথিবী-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে উদ্ভিদ ও মানুষসহ প্রাণিজগতের হয়ে উঠতে পারে দুর্জয় প্রাণঘাতী। ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন মোটরযান থেকে যে পরিমান কার্বন-মনোক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়, তাতে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে বেশি ছড়ায় বিষ। বাতাসে কার্বন-মনোক্সাইডের পরিমাণ অনুপাত হিসাবে লন্ডন প্রথম, কলকাতা দ্বিতীয় ও নিউইয়র্ক তৃতীয় স্থানে।
প্রতিকার
সতর্ক না হলে হয়তো এইভাবে দূষিত এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় একদিন পৃথিবী থেকে প্রাণের অস্তিত্ব বিলোপ হয়ে যেতে পারে। পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ৫ই জুন, ‘বিশ্ব পরিবেশ-দিবস’ রূপে পালিত হয়। এখন আর আবহাওয়া দূষণ নয়, চাই শুদ্ধিকরণ। মনে রাখতে হবে আমাদের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করতে হবে অরণ্যসংহার নয়, নতুন করে অরণ্য সৃষ্টি। সভ্যতার অগ্রগতিতে বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে নিশ্চয় স্বাগত জানাতে হবে। কিন্তু প্রকৃতি দূষণ যাতে প্রতিরোধ হয় সে ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে।
আরও পড়ুন – বাংলার উৎসব রচনা