বাঙালি ও তার সংস্কৃতি রচনা – আজকের পর্বে বাঙালি ও তার সংস্কৃতি রচনা আলোচনা করা হল।
বাঙালি ও তার সংস্কৃতি রচনা
বাঙালি ও তার সংস্কৃতি রচনা
ভূমিকা
সংস্কৃতি বলতে বুঝায় সংস্কার, উন্নয়ন, অনুশীলন দ্বারা লব্ধ বিদ্যাবুদ্ধি রীতি-নাতি ইত্যাদির উৎকর্ষ, সভ্যতা জনিত উৎকর্ষ, কৃষ্টি। প্রত্যেক ভাষার কিছু গুণব্যঞ্জক শব্দ আছে যার সুস্পষ্ট অর্থ প্রকাশ করা অনেক সময় সম্ভব নয়। সংস্কৃতি কথাটি এই ধরনের একটি শব্দ। এর ব্যাপক অর্থ হল জাতির অন্তরঙ্গ প্রতিভা ও চিৎপ্রকর্ষের বহিঃপ্রকাশ-মানসচর্চা, ভাবসাধনা ও কর্মসাধনার বাস্তব রূপায়ণ। সুতরাং বাঙালির সংস্কৃতি বলতে বুঝতে হবে তাদের মানস প্রকৃতি, ঐতিহ্য, সামাজিক অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান, শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম-কর্ম প্রভৃতি। বাঙালির সমগ্র প্রাণসত্তার পরিচয় মিলবে তার প্রবর্ধমান সংস্কৃতির মধ্যে। বাংলায় বাংলাভাষী জনসমষ্টির মধ্যে, দেশের জলবায়ু ও তার আনুষঙ্গিক ফলস্বরূপ এই দেশের উপযোগী জীবনযাত্রার পদ্ধতিকে অবলম্বন করে এবং মুখ্যত প্রাচীন ও মধযুগের ভাবধারায় পুষ্ট হয়ে, বিগত সহস্র বৎসর ধরে যে বাস্তব, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে-তাই হল বাঙালি-সংস্কৃতি।
বাঙালি সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ
দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ও ভারতীয় আর্যের সংমিশ্রণে বাঙালি জাতির উদ্ভব। আদিম বাঙালি, রক্ত ও ভাষার দিক দিয়ে যে অনার্য ছিল, ইতিহাস তার সাথী। উত্তর-ভারতের গাঙ্গেয় সভ্যতা ও আর্যসভ্যতার প্রভাবে বাঙালির নবজন্ম হয়। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে প্রকৃত পক্ষে বাঙালি-সংস্কৃতির জাগরণের সূত্রপাত। বাংলার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ঐতিহ্যের ধারা অনুসরণ করে। তবে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের জাতি থেকে বাঙালিকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। বাঙালির সহজাত আর্য মানসিকতার ওপর আর্যজাতির মানসপ্রকৃতির প্রভাবচিহ্ন যখন মুদ্রিত হল তখন বাঙালি চরিত্রে উল্লেখযোগ্য বিকাশের প্রধান কারণ সর্বভারতীয় হিন্দুর চিৎপ্রকর্ষের ব্যাপক প্রভাব। পরবর্তীকালে ক্রমবিকাশের ধারাপথে অগ্রসরণকালে বাংলার সংস্কৃতি ঐতিহাসিক কারণে হিন্দু-মুসলমান-যুরোপীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটেছে।
বাঙালি সংস্কৃতির তিনটি যুগ বাঙালির সংস্কৃতিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক হতে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত প্রাচীন যুগ; দ্বাদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক মধ্যযুগ এবং অষ্টাদশ শতক থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত আধুনিক যুগ। প্রাচীন যুগে বাঙালি সংস্কৃতি ছিল বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির বিশেষ এক অভিব্যক্তি। মধ্যযুগে পাঠান-মোগলের সময় হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটে এবং বাঙালি সংস্কৃতির বৃহত্তম বিকাশ ঘটে। ব্রাহ্মণ্য-বৌদ্ধ-জৈনধর্মের সম্মিলিত প্রভাবে এদেশে যে সংস্কৃতির জন্ম হল, তুর্কী বিজয়ের পর রাজশক্তি পুষ্ট ইসলাম তাকে তেমন পরিবর্তিত বা বিপর্যস্ত করতে পারেনি। যদিও তখন শাসক ছিল মুসলমান, বাংলার ভূমিতে বসবাস করার ফলে তাঁরা বাঙালিত্ব অর্জন করেছিল।
ইসলাম ধর্ম ও বাঙালি-সংস্কৃতি: যে ইসলাম ধর্ম বাংলায় প্রচারিত হয়েছিল তা সম্পূর্ণভাবে কোরাণ অনুসারী নয়। ইসলামের সুফী মতই বাংলায় প্রাধান্য লাভ করায় হিন্দু সংস্কৃতির সাথে মুসলমান সংস্কৃতির সহযোগিতা সম্ভব হয়েছিল। কারণ সুফীসাধনা ও বাঙালির আধ্যাত্মিক সাধনার অন্তঃপ্রকৃতির মিল আছে। মুসলমান বিজেতারা নতুন কিছু ভাবধারা এদেশে আনলেও কোনো উচ্চতর কৃষ্টি তাঁরা সাথে করে আনেননি এবং ইসলামি সংস্কৃতি এদেশে প্রচারের জন্য বিশেষ আগ্রহ দেখাননি।
বর্তমান বাঙালি সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটল ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে। আমাদের আদি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল গ্রামকে কেন্দ্র করে। কিন্তু বর্তমানের সংস্কৃতি নগর কেন্দ্রিক। বিজাতীয় শিক্ষা, বর্তমান রাজনীতি ও অর্থনীতি, বর্তমানের উপযোগী নানামুখী চিন্তাধারা বাঙালির ভাবজীবনে ও কর্মসাধনায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
উপসংহার
প্রত্যেক জাতির লোকসংস্কৃতি ও উচ্চতর সংস্কৃতি কতকগুলি বস্তু, অনুষ্ঠান প্রভৃতিকে আশ্রয় করে বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করে। বাঙালির প্রতিভা ভারতীয় সভ্যতার ভান্ডারকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছে। বাংলার উচ্চতর সংস্কৃতি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করেছে একথা ও বলা যায় না। বাঙালির মধ্যে ভাবসাধনা কর্মসাধনা ও জ্ঞানসাধনার ত্রুটি যদি না দেখা দেয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাঙালি সংস্কৃতি প্রবর্ধমান হয়ে উঠবে।
আরও পড়ুন – বাংলার উৎসব রচনা