সংবিধান সংশোধন এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন (ষষ্ঠ অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান

সূচিপত্র

সংবিধান সংশোধন এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন (ষষ্ঠ অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান | Constitutional Amendments and Local Self-Government (6th Chapter) Question Answer Class 12 Semester

সংবিধান সংশোধন এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন (ষষ্ঠ অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর
সংবিধান সংশোধন এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন (ষষ্ঠ অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর

IV

 

1. ভারতের সংবিধান সংশোধনের তিনটি পদ্ধতি সম্পর্কে লেখো।
অথবা, ৩৬৮ নং ধারানুসারে ভারতীয় সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতি আলোচনা করো।

ভারতের সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতি:

ভারতীয় সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। তিনটি পদ্ধতির মধ্যে দুটি পদ্ধতি সম্পর্কে ৩৬৮ নং ধারায় উল্লেখ আছে। অপরটি মূলত সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা যায় বলে ৩৬৮ নং ধারায় এটির’ উল্লেখ করা নেই। তবে এই পদ্ধতিগুলির মাধ্যমে সংবিধানকে সংশোধন করে সময়োপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। সংবিধানে উল্লিখিত এই সংশোধন পদ্ধতিগুলি পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করা হল।

সরল পদ্ধতি: সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতিতে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধান সংশোধন করা যায়। এর মাধ্যমে নতুন রাজ্যের সৃষ্টি বা পুরোনো রাজ্যের সীমানা অথবা নাম পরিবর্তন, বিধান পরিষদ সৃষ্টি বা বিলোপসাধন, দেশের নির্বাচন, নাগরিকতা অর্জন ও বিলোপ প্রভৃতির পরিবর্তন করা যায়। সংবিধান সংশোধনের এই পদ্ধতিটি সম্পর্কে বিক্ষিপ্তভাবে সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে।

আংশিক জটিল পদ্ধতি: ৩৬৮ নং ধারায় উল্লিখিত সংবিধান সংশোধনের এই পদ্ধতি অনুযায়ী সংবিধানের কিছু নির্দিষ্ট অংশের সংশোধনের ক্ষেত্রে বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাৎ, পৃথকভাবে পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের মোট সদস্যের অর্ধেকের বেশি এবং উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন হয়। এভাবে দুটি কক্ষে সংবিধান-সংশোধনী প্রস্তাবটি অনুমোদিত হওয়ার পর তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতি প্রস্তাবটিতে সম্মতি জানালে সংশোধনী -আইনটি কার্যকরী হয়। অবশ্য ২৪তম সংশোধনী আইন অনুযায়ী সংবিধান-সংশোধনী বিলে রাষ্ট্রপতির সম্মতি প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে কোনো সংবিধান-সংশোধনী বিল নিয়ে পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের মধ্যে যদি মতবিরোধ সৃষ্টি হয় তবে সংশ্লিষ্ট বিলটি বাতিল হয়ে যায়। কোনো যৌথ অধিবেশন এজন্য ডাকা হয় না।

জটিল পদ্ধতি: উক্ত দুই পদ্ধতি অপেক্ষা সংবিধান সংশোধনের এই পদ্ধতিটি জটিল। এই পদ্ধতি অনুযায়ী, প্রথমে সংশোধনী প্রস্তাবটিকে পৃথকভাবে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের মোট সদস্যদের অর্ধেকের বেশি এবং উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ কর্তৃক সমর্থিত হতে হয়। এরপর প্রস্তাবটিকে রাজ্য আইনসভাগুলির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে অন্তত অর্ধেক রাজ্য আইনসভার অনুমোদন আবশ্যক। রাজ্য আইনসভাগুলিতে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাৎ উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের অধিকাংশের সমর্থনে সংশোধনী প্রস্তাবটি পাস করাতে হয়। অর্ধেক রাজ্য আইনসভা কর্তৃক অনুমোদিত হলে প্রস্তাবটিকে রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে অবশিষ্ট রাজ্যগুলির সম্মতি প্রদর্শন বা প্রত্যাখ্যানের গুরুত্ব থাকে না। যেমন- বেরুবাড়ি মামলা (১৯৬০ খ্রি.)। রাষ্ট্রপতি বিলটি স্বাক্ষর করলে তা সংশোধিত হয়। প্রস্তাবের কোনো পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাজ্য আইনসভাগুলির নেই। রাজ্য আইনসভাগুলি কেবল বিলটিকে সমর্থন বা বাতিল করতে পারে। যেসব বিষয় এই পদ্ধতির মাধ্যমে সংশোধন করা যায় তার মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও তার পদ্ধতি সংসদে রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্ব, সংবিধান এবং তার সংশোধন পদ্ধতি সম্পর্কে সংসদের ক্ষমতা ইত্যাদি। এইরূপ সংবিধান সংশোধন পদ্ধতিটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে।

2. সংবিধান-সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, কোনো বিল কীভাবে সংবিধান সংশোধনী আইনে পরিণত হয়?

সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের পদ্ধতি:

৩৬৮ নং ধারায় সংবিধান-সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের বিষয়টি বর্ণিত রয়েছে।

① সংবিধান-সংশোধনী প্রস্তাব কেবলমাত্র পার্লামেন্টের যে-কোনো কক্ষে অর্থাৎ নিম্নকক্ষ লোকসভা বা উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় উত্থাপন করা যায়। কোনো রাজ্য আইনসভায় এরূপ সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা যায় না।

② এক্ষেত্রে মন্ত্রীরা সরকারি বিল (Public Bill)-এর মাধ্যমে বা মন্ত্রী ছাড়া পার্লামেন্টের যে-কোনো কক্ষের সদস্য বেসরকারি বিল (Private Bill)-এর মাধ্যমে সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারেন। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবটি সর্বদা একটি বিলের আকারেই উত্থাপন করতে হয় এবং সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির কোনো পূর্ব অনুমতির প্রয়োজন হয় না।

③ বিলটি পার্লামেন্টে উত্থাপিত হওয়ার পর সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অথবা পৃথকভাবে দুটি কক্ষে বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে (কক্ষের মোট সদস্যসংখ্যার অধিকাংশ এবং উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন) পাস করাতে হয়।

তবে বিলটি নিয়ে দুটি কক্ষের মধ্যে মতবিরোধ উপস্থিত হলে বিলটি বাতিল হয়ে যায়। এক্ষেত্রে যৌথ অধিবেশন আহবানের কোনো বিষয় নেই।

(4) যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সংক্রান্ত বিধানগুলি সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রথমে পার্লামেন্টের দুটি কক্ষে পৃথকভাবে বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা সংশোধনী বিলটি পাস হওয়ার পর রাজ্য আইনসভাগুলির সম্মতির জন্য প্রেরিত হয়। রাজ্য আইনসভাগুলির অন্তত ৫০ শতাংশ বা অর্ধেক আইনসভা এই সংশোধনী প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করলেই তা রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের জন্য প্রেরিত হয়।

⑤ সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরিত হলে তিনি তাতে স্বাক্ষর প্রদানে বাধ্য থাকেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কখনোই ভিটো প্রদান করতে পারেন না বা সদস্যদের পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন না।

⑥ রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর লাভের পর বিলটি সংবিধান-সংশোধনী আইনে পরিণত হয়। অর্থাৎ সংবিধান সংশোধিত হয়।

3. সংবিধান সংশোধন পদ্ধতির চারটি সমালোচনা লেখো।
অথবা, সংবিধান সংশোধন পদ্ধতির ত্রুটিগুলি আলোচনা করো।

সংবিধান সংশোধন পদ্ধতির সমালোচনা:

ভারতের সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি। সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। সমালোচকরা বিভিন্ন কারণে সংবিধান সংশোধন পদ্ধতির সমালোচনা করেছেন। যথা-

① পার্লামেন্টের প্রাধান্য: সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা এককভাবে সংসদ বা পার্লামেন্টের হাতে ন্যস্ত। ভারতে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো কোনো পৃথক সংস্থা সাংবিধানিক সভা বা সাংবিধানিক পরিষদ গঠনের বিধান উল্লিখিত নেই। সংবিধান সংশোধন করতে হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট। এমতাবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে সংবিধান সংশোধন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সমর্থন জোগাড় করা কঠিন হয় না। ফলে ক্ষমতাসীন দল নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী, নিজেদের সুবিধার্থে সংবিধান সংশোধন করতে পারে।

② রাজ্যের স্বাধিকারবিরোধী: সমালোচকদের মতে সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতিগুলি রাজ্যগুলির স্বাধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে। কারণ কোনো রাজ্য পুনর্গঠনের বিষয়ে পার্লামেন্ট একক ক্ষমতা ভোগ করে। অর্থাৎ কোনো রাজ্যের নাম ও সীমানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। – ফলে রাজ্যগুলির অস্তিত্ব অনেকাংশেই কেন্দ্র সরকারের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।

③ যুগ্ম অধিবেশনের ব্যবস্থা নেই: সংবিধান-সংশোধনী বিল পাসের ক্ষেত্রে যদি পার্লামেন্টের দুই কক্ষ রাজ্যসভা ও লোকসভার মধ্যে বিরোধ, বাধে এবং অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় তাহলে তা মীমাংসা করার জন্য দুই কক্ষকে নিয়ে যুগ্ম অধিবেশন আহবান করার কোনো বিধান নেই। কিন্তু সাধারণ কোনো বিল পাসের ক্ষেত্রে অচলাবস্থা দেখা দিলে তা সমাধানের জন্য যৌথ অধিবেশনের ব্যবস্থা কর হয়েছে।

④ দীর্ঘায়িত প্রক্রিয়া: যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয়গুলি সংশোধনের ক্ষেত্রে রাজ্য আইনসভাগুলির অর্ধেকের অনুমোদন লাগে। কিন্তু সমস্যা হল, রাজা আইনসভায় যে সংশোধনী বিল প্রেরিত হয় সেই সকল বিলে কতদিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে সেবিষয়ে সংবিধানে কিছু উল্লেখ নেই। ফলে রাজ্য আইনসভাগুলি তাদের সমর্থন বা প্রত্যাখ্যান জানাতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে। এমনকি সব রাজা আইনসভাগুলির মতামত প্রদান বাধ্যতামূলক না হওয়ায় অনেকসময়ই সংশোধনী বিল গুরুত্ব পায় না। একারণে যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয়গুলিতে সংবিধান । সংশোধন সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে।

4. ভারতীয় সংবিধান সংশোধনে পার্লামেন্টের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভারতীয় সংবিধান সংশোধনসংশোধনে পার্লামেন্টের ভূমিকা:

ভারতীয় সংবিধান সংশোধনে পার্লামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যথা-

  • সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব লোকসভা বা রাজ্যসভা যে-কোনো একটি কক্ষে উত্থাপন করা যায়।
  • সংশোধনী বিল পাস করার জন্য উভয়কক্ষে উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন।
  • সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে উভয়কক্ষে বিস্তারিত আলোচনা ও বিতর্ক হয়।
  • সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উভয় কক্ষের সমান গুরুত্ব রয়েছে; যে-কোনো একটি কক্ষে প্রস্তাব পাস না হলে সংশোধন সম্ভব নয়।
  • উভয়কক্ষে সংশোধনী পাস হওয়ার পর তা রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। এইভাবে পার্লামেন্ট সংবিধান সংশোধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তবে এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে পার্লামেন্ট যথেচ্ছভাবে সংবিধানকে সংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারে না। সংবিধানের সকল অংশকে পরিবর্তন করা যায় কি না তা নিয়েও দীর্ঘ মতবিরোধ রয়েছে। শঙ্করীপ্রসাদ বনাম ভারত সরকার মামলায় (১৯৫১খ্রি.) সুপ্রিমকোর্ট রায় দেয় পার্লামেন্ট সংবিধানের সকল অংশ সংশোধন করতে পারবে। আবার গোলকনাথ বনাম পাঞ্জাব সরকার মামলায় (১৯৬৭ খ্রি.) সুপ্রিমকোর্ট রায় দেয় পার্লামেন্ট নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংশোধন করতে পারবে না। তবে এক্ষেত্রে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য মামলা হল ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা রাজ্য মামলা। এই মামলায় পার্লামেন্ট কর্তৃক নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংশোধন করার বিষয়টি সুপ্রিমকোর্ট স্বীকার করে নেয়। কিন্তু এপ্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টে বলা হয় সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামো’ (Basic structure) পরিবর্তনের ক্ষমতা পার্লামেন্টের নেই। তবে এখনও পর্যন্ত সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামো’-র সংজ্ঞা সুপ্রিমকোর্ট দেয়নি। যদিও পার্লামেন্ট সুপ্রিমকোর্টের এই রায়কে মেনে নেয়নি, তাই ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে ঘোষণা করা হয় সংবিধান সংশোধন ক্ষমতার ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের কোনো বিধিনিষেধ থাকবে না। এমনকি সংবিধান সংশোধনের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে কোনো মামলা করা যাবে না। ফলে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের একাধিপত্য স্থাপিত হয়। কিন্তু ১৯৮০ – খ্রিস্টাব্দে মিনার্ভা মিলস্ মামলায় সুপ্রিমকোর্ট এই সংশোধন আইনটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিরোধী বলে বাতিল করে দেয় এবং যে-কোনো সংবিধান সংশোধন বিচারবিভাগীয় সমীক্ষার (Judicial Review) অধীন বলে ঘোষণা করে। ফলে আপেক্ষিকভাবে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে তা বিচারবিভাগীয় সমীক্ষা এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামো তত্ত্ব দ্বারা সীমাবদ্ধ।

5. ভারতের সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীকে কেন ‘Mini Constitution’ বা ‘সংবিধানের ক্ষুদ্র সংস্করণ’ বলা হয়?

৪২তম সংবিধান সংশোধন:

ভারতের সংবিধান সংশোধনের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী হল ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৪২তম সংবিধান সংশোধন। ইন্দিরা গান্ধির আমলে স্মরণ সিং-এর নেতৃত্বাধীন কমিটির সুপারিশে এটি সম্পাদিত হয়, যা ভারতের সংবিধানের ইতিহাসে তীব্র বিতর্কের, জন্ম দিয়েছিল। কারণ এই সংশোধনের মাধ্যমে। সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয় এবং বহু নতুন ধারা যুক্ত করা হয়। এজন্য ৪২তম সংবিধান-সংশোধনীকে অনেকে ‘Mini Constitution’ বা ‘সংবিধানের ক্ষুদ্র সংস্করণ’ বলে অভিহিত করে। এই সংবিধান-সংশোধনী দ্বারা সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ আইনি ও রাজনৈতিক পরিবর্তন করা হয় এবং সংবিধানকে আরও কার্যকরী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলা হয়। এই সংশোধনে ভারতকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ৪২তম সংবিধান-সংশোধনীর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংশোধন হল-

① প্রস্তাবনায় পরিবর্তন: এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনা সংশোধন করে সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শব্দ দুটি যুক্ত করে ভারতকে ‘সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র’, হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া ‘সংহতি’ শব্দটিও যুক্ত করা হয়।

② নির্দেশমূলক নীতি সংযোগ: এই সংশোধনের মাধ্যমে মৌলিক অধিকারের উপরে নির্দেশমূলক নীতি স্থান পায়। কারণ সংশোধনী অনুযায়ী নির্দেশমূলক নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সাম্যের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘিত হলেও তা অবৈধ হিসেবে বাতিল হয়ে যাবে না। এ ছাড়া প্রাকৃতিক নিরাপত্তা, শিশু নিরাপত্তা, দরিদ্রদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা লাভ-সহ বিভিন্ন নির্দেশমূলক নীতি সংযোজিত হয়।

③ মৌলিক কর্তব্যের সংযুক্তি: সংবিধানে চতুর্থ অধ্যায়ে ‘ক’ নামক অংশ (Part IV-A) অন্তর্ভুক্ত করে ভারতের নাগরিকদের ১০টি মৌলিক কর্তব্যের সংযুক্তি করা হয়।

④ সপ্তম তফসিলে পরিবর্তন: রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয় থেকে বন সংরক্ষণ ও শিক্ষাকে সরিয়ে যুগ্ম তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

তবে এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, জনতা দলের আমলে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৪৪তম সংবিধান-সংশোধনীতে ৪২তম সংশোধনীর বহু সংশোধন পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়।

6. তুমি কী ভারতীয় সংবিধানকে নমনীয় মনে করো?
অথবা, তুমি কী মনে করো ভারতীয় সংবিধান সুপরিবর্তনীয়তা ও দূষ্পরিবর্তনীয়তার সংমিশ্রণ বা ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে বিশ্লেষণ করো।

ভারতীয় সংবিধান প্রণেতারা সংবিধানে সংশোধনের ক্ষেত্রে অনেক মৌলিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। প্রকৃতিগতভাবে তারা সংবিধানকে সম্পূর্ণ সুপরিবর্তনীয় বা সম্পূর্ণ দুষ্পরিবর্তনীয় হিসেবে চিহ্নিত করতে চাননি। ভবিষ্যত ভারত গড়ার ভাবনা তাদের চিন্তাধারাকে সচেতন করেছিল। সেজন্য সংবিধান সংশোধনের যে তিনটি পদ্ধতি আছে তাতে অনেকটা সুপরিবর্তনীয় ও কিছুটা দুষ্পরিবর্তনীয় বিষয়ের সন্ধান মেলে। প্রথম অর্থাৎ সরল পদ্ধতিতে খুবই সরলভাবে সংবিধান সংশোধন করা যায়। কারণ সংসদের উভয় কক্ষের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব। যেমন- নতুন রাজ্য গঠন বা পুরাতন রাজ্য পুর্নগঠন বা নাম পরিবর্তন। কিন্তু সংবিধানের ৩৬৮ নং ধারায় যে দুটি পদ্ধতিতে সংবিধান সংশোধন করা যায় তার দ্বিতীয় পদ্ধতি আংশিক জটিল এবং তৃতীয় পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ জটিল পদ্ধতি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পদ্ধতিকে সংবিধানের কিছু অংশকে দুষ্পরিবর্তনীয় করে রাখা হয়েছে। যেখানে দ্বিতীয় পদ্ধতিতে পৃথকভাবে পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের মোট সদস্যের অর্ধেকের বেশি এবং উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন। আবার জটিল পদ্ধতিতে পৃথকভাবে পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের মোট সদস্যের অর্ধেকের বেশি রাজ্য আইনসভার অনুমোদন প্রয়োজন হয়। তাই উক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ভারতীয় সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি ব্রিটেনের মতো নমনীয় নয় অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অনমনীয়ও নয়। বরং ভারতীয় সংবিধান হল সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের সংমিশ্রণ।

7. ৭৩তম সংবিধান-সংশোধনী আইনের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।

৭৩তম সংবিধান সংশোধনী আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ:

এই সংশোধনী আইনের মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানের নবম অংশে (Part IX) বর্ণিত পঞ্চায়েত সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল-

① গ্রামসভা: এই আইন পাসের ফলস্বরূপ পঞ্চায়েতিরাজ ব্যবস্থার ভিত্তিরূপে প্রতিটি গ্রামে একটি করে গ্রামসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি গ্রামীণ পর্যায়ে পঞ্চায়েত অঞ্চলে থাকা সকল ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হয়। রাজ্য আইনসভা কর্তৃক নির্ধারিত পঞ্চায়েত সম্পর্কিত নানান ক্ষমতা ও কার্যাবলি গ্রামসভার দ্বারা সম্পাদিত হয়।

② ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থা: ভারতের প্রতিটি রাজ্যে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা দরকার। পঞ্চায়েতের তিনটি স্তর হল-গ্রামীণ স্তর, মধ্যবর্তী স্তর এবং জেলা স্তর।

তবে যে রাজ্যগুলিতে মোট জনসংখ্যা ২০ লক্ষের কম, সেখানে পঞ্চায়েতের মধ্যবর্তী স্তর গঠিত হবে না।

③ বিশেষ আসন সংরক্ষণ : পঞ্চায়েতের প্রতিটি স্তরে সমগ্র জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে তপশিলি জাতি ও উপজাতিগুলির জন্য আসন সংরক্ষণ করা হবে। এইসব সংরক্ষিত আসনের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আসন তপশিলি জাতি ও উপজাতিভিত্তিক মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ করা হবে।

এ ছাড়া মহিলাদের জন্য পঞ্চায়েতের মোট আসনসংখ্যার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আসন (তপশিলি জাতি ও উপজাতির মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন-সহ) সংরক্ষিত রাখতে হবে।

④ কার্যকালের মেয়াদ: প্রত্যেকটি পঞ্চায়েতের কার্যকালের মেয়াদ হবে ৫ বছর। এই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে রাজ্য সরকার কোনো পঞ্চায়েতকে ভেঙে দিতে চাইলে সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতকে তার সপক্ষে মতামত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। এ ছাড়া পঞ্চায়েতের কার্যকালের সময়সীমা শেষ হওয়ার পূর্বেই নতুন পঞ্চায়েত গঠনের জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়া সমাপ্ত করতে হবে। তবে কোনো পঞ্চায়েতকে ভেঙে দিলে ভাঙার সময় থেকে ৬ মাসের মধ্যে সেখানে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এই নবনির্বাচিত পঞ্চায়েত অবশিষ্ট সময়ের কাজগুলি সম্পন্ন করবে।

⑤ রাজ্য নির্বাচন কমিশন: পঞ্চায়েতগুলির নির্বাচন পরিচালনা, তত্ত্বাবধান এবং ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের ভার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এই কমিশনে একজন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার থাকেন, যিনি রাজ্যপাল কর্তৃক নিযুক্ত হন। রাজ্যপাল রাজ্য আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন অনুসারে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের চাকরির শর্তাবলি ও কার্যকালের মেয়াদ নির্ধারণ করে থাকেন।

8. গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষমতাগুলি আলোচনা করো।
অথবা, গ্রাম পঞ্চায়েতের কার্যাবলি আলোচনা করো।

গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষমতা ও কার্যাবলি:

গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষমতা ও কার্যাবলির পরিধি সুবিন্যস্ত। তাই একে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়-

আবশ্যিক কর্তব্যসমূহ: গ্রাম পঞ্চায়েতের বাধ্যতামূলক কার্যগুলি হল- জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা, উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা, বার্ষিক পরিকল্পনার রূপায়ণ, জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও বর্জ্য নিষ্কাশন করা, প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, পশ্চাত্পদ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষা সুনিশ্চিতকরণ এবং বয়স্ক শিক্ষার প্রসার ঘটানো।

স্বেচ্ছাধীন কর্তব্যসমূহ: গ্রাম পঞ্চায়েত স্বেচ্ছায় যে কার্যগুলি করে থাকে সেগুলি হল-জনসাধারণের স্বার্থে রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করা, বৃক্ষরোপণ ও বনজ সম্পদ সংরক্ষণ, কূপ, পুকুর, জলাশয় খনন, বাজার, হাট, মেলা স্থাপন, হস্তশিল্পজাত সামগ্রীর প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা করা।

হস্তান্তরিত কর্তব্যসমূহ: রাজ্য সরকার কর্তৃক হস্তান্তরিত কোনো জনহিতকর কার্যের পরিচালনা করার দায়িত্বপালন, রাজ্য সরকার অনুমোদিত কোনো কর্তৃপক্ষ যদি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি সম্পর্কিত প্রকল্পের দায়িত্ব গ্রাম পঞ্চায়েতকে প্রদান করে তখন তা যথাযথভাবে পালন করা।

আরোপিত ক্ষমতাসমূহ: গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, প্রসূতিসদন ও শিশুমঙ্গল কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা করা, পতিত জমি উদ্ধার ও সেখানে চাষের ব্যবস্থা করা, সামাজিক বনসৃজন ও কৃষি খামার প্রস্তুত করা, সামাজিক, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।

নিয়ন্ত্রণমূলক দায়িত্বসমূহ: গৃহের কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয়ে অনুমতিদান, শুল্ক নির্ধারণ, শুল্ক আরোপ, ফি সংগ্রহ, মোটরচালিত পাম্পের মাধ্যমে সেচের কাজে ব্যবহৃত নলকূপের রেজিস্ট্রিকরণ ইত্যাদি।

9. পৌরসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করো।

ক্ষমতা ও কার্যাবলি: ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ পৌর আইনের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৬৩ থেকে ৬৬নং ধারায় পৌরসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। পৌরসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলিকে তিন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন- বাধ্যতামূলক কাজ, স্বেচ্ছাধীন কাজ এবং অর্পিত কাজ। এই তিন ধরনের কার্যাবলি নিম্নে আলোচনা করা হল।

① বাধ্যতামূলক কাজ: পশ্চিমবঙ্গ পৌর আইনের (১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে) ৬৩নং ধারায় পৌরসভার বাধ্যতামূলক কার্যাবলি সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই বাধ্যতামূলক কার্যাবলির মধ্যে পূর্ত সংক্রান্ত কার্য, নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা সংক্রান্ত কার্য, প্রশাসনিক কার্য এবং জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত কার্য প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। পৌরসভার কয়েকটি বাধ্যতামূলক কার্যের উদাহরণ হল– জনসাধারণের ব্যবহারযোগ্য শৌচাগার, রাস্তাঘাট, সেতু, সাবওয়ে প্রভৃতি নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, স্বাস্থ্যকর পানীয় জল সরবরাহ, টিকাকরণ কর্মসূচি প্রভৃতির ব্যবস্থা করা, নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং পরিকল্পিত উন্নয়ন সাধন করা, পৌরসভার প্রশাসনিক কার্য সংক্রান্ত নথিপত্র এবং পরিসংখ্যান সংকলন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা।

② স্বেচ্ছাধীন কাজ : পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইনের ৬৪নং ধারায় পৌরসভার স্বেচ্ছাধীন কাজ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। এই স্বেচ্ছাধীন কার্যাবলির মধ্যে জনকল্যাণসাধন সংক্রান্ত কার্য, শিক্ষাক্ষেত্রে কার্য, উন্নয়নের ক্ষেত্রে কার্য প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। পৌরসভার কয়েকটি স্বেচ্ছাধীন কাজের উদাহরণ হল- প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি কারণে পৌর এলাকার। সীমানার মধ্যে ত্রাণ প্রদানের ব্যবস্থা করা, জনগণের স্বার্থে ডেয়ারি স্থাপন করা, ব্যক্তিদের মূর্তি, প্রতিকৃতি এবং চিত্র স্থাপন করা, গৃহহীনদের আশ্রয় দানের ব্যবস্থা করা, ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্পে সহায়তা প্রদান করা।

③ অর্পিত কাজ : পৌরসভাকে রাজ্য সরকার কর্তৃক অর্পিত বেশিকিছু কার্য সম্পাদন করতে হয়। এইসব কাজগুলিকে পৌরসভার অর্পিত কাজ বলে। এই কাজগুলি করার জন্য রাজ্যসরকার পৌরসভাকে প্রয়োজনীয় অর্থ ও কর্মী প্রদান করে। রাজ্য সরকারের নির্দেশে পৌরসভাকে যেসব কার্য সম্পাদন করতে হয় সেগুলি হল-নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা রূপায়ণ করা, জল সরবরাহ এবং স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা, নগর উন্নয়নের পরিকল্পনা করা, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো, কর্মসংস্থান সংক্রান্ত কর্মসূচি প্রস্তুত করা, জনস্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণের ব্যবস্থা করা।

10. কলকাতা কর্পোরেশনের গঠন সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভূমিকা: কলকাতা পৌরনিগম তিনটি পৌর কর্তৃপক্ষ নিয়ে গঠিত হয়। যথা- কর্পোরেশন, স-পরিষদ মেয়র এবং মেয়র। নিম্নে কর্পোরেশনের গঠন সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করা হল।

গঠন:

কার্পারেশন: কর্পোরেশনে ১৪১ জন কাউন্সিলার বা পৌর প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন। এই কাউন্সিলারগণ (পৌরপিতা) ১৪১টি ওয়ার্ড থেকে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হন। এ ছাড়াও কর্পোরেশনে পৌর প্রশাসন বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। কয়েকজন ব্যক্তি রাজ্য সরকার কর্তৃক মনোনীত হন। বলা বাহুল্য এই সমস্ত ব্যক্তিগণ কর্পোরেশনে ভোটদানের অধিকারী নয়। কলকাতা কর্পোরেশনের। পৌরসভার মতোই আসন সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে।

স-পরিষদ মেয়র: কর্পোরেশনের প্রধান প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে স-পরিষদ মেয়র কাজ করে থাকে। মেয়র, ডেপুটি মেয়র ও অনধিক ১০ জন নির্বাচিত সদস্যকে নিয়ে স-পরিষদ মেয়র বা মেয়র পরিষদ গঠিত হয়। অর্থাৎ ১ জন মেয়র, ১ জন ডেপুটি মেয়র এবং ১০ জন সদস্য তথা সর্বাধিক ১২ জন সদস্যকে নিয়ে স-পরিষদ মেয়র গঠিত হয়। নির্বাচনের পর নির্বাচিত কাউন্সিলারগণ নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করেন। মেয়র ডেপুটি মেয়রকে নিযুক্ত করেন। মেয়রই নির্বাচিত কাউন্সিলারদের মধ্য থেকে ১০ জনকে মেয়র পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন। এই পরিষদ তার যাবতীয় কাজকর্মের জন্য যৌথভাবে কর্পোরেশনের কাছে দায়বন্ধ থাকে।

মেয়র: মেয়র হলেন কর্পোরেশনের প্রশাসনিক প্রধান এবং সমগ্র কর্পোরেশন তাঁকে। কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। নির্বাচনের পর প্রথম সভায় নতুন নির্বাচিত কাউন্সিলারগণ নিজেদের মধ্যে থেকে ১ জনকে মেয়র হিসেবে নির্বাচন করে। থাকেন। সাধারণত ১ জন মেয়রের কার্যকালের মেয়াদ ৫ বছর। তবে মৃত্যু, পদত্যাগ, অপসারণ, সদস্যপদ বাতিল নানা কারণে নির্দিষ্ট কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই মেয়রের পদ শূন্য হতে পারে।

11. পৌরসভা সংক্রান্ত ৭৪তম সংবিধান সংশোধন আইনের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।

বৈশিষ্ট্য: পৌরসভা সংক্রান্ত ৭৪তম। সংবিধান সংশোধন আইনের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

① পৌরসভার শ্রেণিবিভাজন: ৭৪তম সংবিধান-সংশোধনী আইনে ৩ ধরনের স্থানীয় সরকার গঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন-

নগর পঞ্চায়েত (Nagar Panchayat)।
পৌর পরিষদ (Municipal Council)।
পৌরনিগম (Municipal Corporation)।

তবে এখানে একটি ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। যদি কোনো শহুরে অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে – পৌর পরিসেবা প্রদান করা হয় তবে রাজ্যপাল সেই অঞ্চলটিকে শিল্প পৌরসভা (Industrial Township) হিসেবে নির্ধারণ করতে পারেন।

② ওয়ার্ড কমিটিসমূহ: এক বা একাধিক ওয়ার্ডের সমন্বয়ে একটি ওয়ার্ড কমিটি গঠিত হয়। তিন লক্ষ বা তার বেশি জনসংখ্যাবিশিষ্ট পৌরাঞ্চলের পৌরসভার জন্য একটি বা তার বেশি ওয়ার্ড কমিটি গঠন করতে হয়। রাজ্য আইনসভা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কমিটিগুলির গঠনপ্রকৃতি নির্ধারণ করে। একটি ওয়ার্ডের নির্বাচিত পৌর প্রতিনিধিরা ওয়ার্ড কমিটির সদস্য হিসেবে নির্ধারিত হন।

③ অন্যান্য কমিটি: রাজ্য আইনসভা প্রয়োজন মনে করলে অন্যান্য কমিটি গঠন করতে পারে। এই অন্যান্য কমিটির সভাপতিগণকে পৌরসভার সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করা হয়ে থাকে।

④ হিসাবনিরীক্ষা: পৌরসভাগুলির হিসাব পরীক্ষার ক্ষেত্রেও রাজ্য আইনসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজ্য আইনসভা কর্তৃক প্রনীত আইনের মাধ্যমেই পৌরসভা হিসাব পরীক্ষনিরীক্ষা করে থাকে।!

12. কর্পোরেশনের মেয়রের নিয়োগ, কার্যকাল, অপসারণ এবং ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করো।
অথবা, কর্পোরেশনের মেয়র সম্পর্কে যা জানো লেখো।

মেয়র: কর্পোরেশনের মেয়রের নিয়োগ, কার্যকাল, অপসারণ, ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল।

নিয়োগ: নির্বাচনের পর প্রথম সভায় নতুন নির্বাচিত কাউন্সিলারগণ নিজেদের মধ্যে থেকে ১ জনকে মেয়র হিসেবে নির্বাচন করে থাকেন।

কার্যকাল: সাধারণত ১ জন মেয়রের কার্যকালের মেয়াদ ৫ বছর। তবে মৃত্যু, পদত্যাগ, অপসারণ, সদস্যপদ বাতিল নানা কারণে নির্দিষ্ট কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই মেয়রের পদ শূন্য হতে পারে। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে চাইলে মেয়রকে কাউন্সিলার পরিষদের কাছে লিখিতভাবে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হয়। ওই পদত্যাগপত্রটি গৃহীত হলেই মেয়রের পদ খালি হয়ে যায়।

অপসারণ: মেয়রের অপসারণের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ সভার আয়োজন করতে হয়। কাউন্সিলারদের এক-তৃতীয়াংশের সমর্থনে এই সভা আয়োজিত হয়। ওই বিশেষ সভায় মেয়রের পদত্যাগ সম্পর্কিত প্রস্তাবটি সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে মেয়র পদচ্যুত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মেয়র তাঁর পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার দিন থেকে ৬ মাসের মধ্যে তাঁর পদচ্যুতি সংক্রান্ত প্রস্তাব পেশ করা যায় না। আবার কোনো কারণবশত মেয়রের পদচ্যুতি সংক্রান্ত প্রস্তাব একবার বাতিল হলে প্রস্তাব বাতিলের দিন থেকে পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে এরূপ প্রস্তাব উত্থাপন করা যায় না। মেয়রের পদ শূন্য হলে এক মাসের মধ্যেই নতুন মেয়র নির্বাচন করতে হয়।

ক্ষমতা ও কার্যাবলি: মেয়র যেসমস্ত কার্য সম্পাদন করেন সেগুলি হল- ডেপুটি মেয়র ও স-পরিষদ মেয়রের অন্যান্য সদস্যদের নিয়োগ, স-পরিষদ মেয়রের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন, স-পরিষদ মেয়রের সভা আহবান এবং ওই সভায় সভাপতিত্ব করা, সংশ্লিষ্ট পরিষদে কোন্ কোন্ বিষয়ের উপর আলোচনা হবে তা নির্ধারণ করা, স-পরিষদের কোনো সদস্যকে পদচ্যুত করতে চাইলে লিখিত আদেশ জারি করা, পৌরসভার প্রধান নির্বাহী আধিকারিকের যাবতীয় কার্যাবলি তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করেন।

আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment