তিমির হননের গান কবিতার প্রশ্ন উত্তর | জীবনানন্দ দাশ | ক্লাস ১২ চতুর্থ সেমিস্টার | Class 12 timir hononer gaan kobitar long question answer | WBCHSE
১। “কোনো হ্রদে/কোথাও নদীর ঢেউয়ে/কোনো এক সমুদ্রের জলে …..- উদ্ধৃতাংশটি কোন্ কবির রচিত কোন্ কবিতার অন্তর্ভুক্ত? কবির বক্তব্য স্পষ্ট করো। ২+৩
কবিতা ও কবি: উদ্ধৃতাংশটি কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত ‘তিমির-হননের গান’ কবিতার অংশ।
কবির বক্তব্য: কবিতার সূচনায় কবি জীবনানন্দ দাশ যেন সভ্যতার সূচনালগ্নে পৌঁছে গিয়েছেন, বন্দনা করেছেন সৃষ্টির আদিপিতা সূর্যকে। সমগ্র মানবসমাজের হয়ে প্রকৃতির কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন কারণ সৃষ্টির শুরুতে সমস্ত প্রাণীসমাজ প্রকৃতির দ্বারাই লালিত ছিল। হ্রদ, নদী ও সমুদ্র-এই তিন বৃহৎ জলীয় আধারকে কবি যেন জীবনেরই গভীরতা-গতি-ব্যাপ্তির সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চেয়েছেন। আবার একথাও আমাদের মনে রাখতে হবে জলেই প্রথম জীবনের সঞ্চার হয়েছিল, জলভাগ সরে গিয়েই স্থলভূমির সৃষ্টি, সভ্যতার বিবর্তনের ফলে এককোশী জীব থেকে বহুকোশী জীব হিসেবে- পৃথিবীর সবথেকে বুদ্ধিমান প্রজাতি মানুষের উদ্ভব হয়। > তারা একে অপরের সঙ্গে জলের মতো সহজে মিশে গড়ে তুলেছিল শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ মানবসমাজ। অনুভব করেছিল জীবনের অর্থকে, সৃষ্টির এই আলোড়নের দ্বারা মানুষ জীবনকে বুঝে নিতে, চিনে নিতে চেয়েছিল। কবি মানবসভ্যতার বর্তমান শোচনীয় অবস্থাকে অতিক্রম করার অভিপ্রায়ে সেই জীবনবিকাশের প্রারম্ভপর্বের কথাই স্মরণ করেছেন।
২। “পরস্পরের সাথে দু-দন্ড জলের মতো মিশে…”- ‘পরস্পরের সাথে বলতে কী বোঝানো হয়েছে? কবির মনোভাব নিজের ভাষায় লেখো। ২+৩
পরস্পরের সাথে-র অন্তর্নিহিত অর্থ: আমাদের মানবসভ্যতার যখন সূচনা হয়েছিল তখন মানুষের মন ছিল জলের মতো সরল। প্রকৃতির সকল প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে মানুষ জীবনকে উপলব্ধি করতে চেয়েছিল। জীবনের এই কঠিন পথে মানুষ বুঝেছিল একা সংগ্রাম করে টিকে থাকা সহজ নয়, বরং একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে সংঘবদ্ধ হয়ে এগোলে অনেক অসম্ভবও সম্ভব হতে পারে। এই কারণে তার মধ্যে দেখা গিয়েছিল একে অপরের সঙ্গে জলের মতো মিশে থাকার প্রবৃত্তি।
কবির মনোভাব: সভ্যতার ধারাবাহিক এগিয়ে চলার ইতিহাসে মানুষ ক্রমশ যাযাবর থেকে সভ্য, সুশিক্ষিত নাগরিক জীব হয়ে উঠেছে। তার মধ্যে যেমন এসেছে ক্ষমতার লোভ, লড়াই করে আত্মরক্ষা ও ক্ষমতা বিস্তারের প্রবণতা তেমনই সে হারিয়ে ফেলেছে ‘পরস্পরের সাথে’ মিশে একত্রিত হয়ে বাঁচার প্রেরণাকে। যে প্রেম, বন্ধুত্ব, সহমর্মিতার মতো মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলির জন্য মানুষ পৃথিবীর সবথেকে উৎকৃষ্ট জীব বলে বিবেচিত সেই গুণগুলিই মানুষের মন থেকে ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে। একসময় যে মানুষ জলের মতো সহজে, সাবলীলভাবে একে অপরকে আপন করে নিয়েছিল বর্তমানে সে-ই হয়ে উঠেছে আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর এক জীব যা নিয়ে কবি আক্ষেপ করেছেন।
৩। “সেই এক ভোরবেলা শতাব্দীর সূর্যের নিকটে”- এখানে ভোরবেলা শব্দটি কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে? শতাব্দীর সূর্যের নিকটে’ কারা, কী পেয়েছিল? ২+৩
ভোরবেলা: কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘তিমিরহননের গান’ কবিতায় মানবসভ্যতার সূচনালগ্নের কথা বলতে গিয়ে ‘ভোরবেলা’-র প্রসঙ্গ এনেছেন, কারণ ভোের দিনের প্রারম্ভকালকে প্রকাশ করে। আর মানবসভ্যতার ভোরে অর্থাৎ বহু শতাব্দী আগে পৃথিবীতে যখন মানবজীবনের প্রথম আরম্ভহয়েছিল- তখন সেখানে মিথ্যাচার, স্বার্থপরতা, লোভ, হিংসার অন্ধকার ছিল না, ছিল প্রকৃতির অগাধ আলো। মানুষের জীবনের সেই সরল-সুন্দর প্রথম প্রভাতের কথাই কবি এখানে বলতে চেয়েছেন।
শতাব্দীর সূর্যের থেকে প্রাপ্তি: ভোরবেলা যেমন মানবজীবনের প্রথম পদক্ষেপের কথা মনে করায় তেমনই ‘শতাব্দীর সূর্য’ বললে আমাদের সেই শক্তিমান জ্যোতিপুঞ্জের কথা মনে পড়ে যায়, যা সমস্ত সৃষ্টির উৎস- কারণ আমরা প্রত্যেকেই সূর্যের জাতক। সূর্যের আলোই মানুষকে দিয়েছিল শক্তির দীক্ষা, উদারতা এবং সত্যের পথে এগিয়ে চলার সাহস। তাই তারা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া বা মিলেমিশে থাকার মাধ্যমে মানবসভ্যতাকে গড়ে তুলতে পেরেছিল। সুতরাং সূর্য যেমন প্রাণের উৎস তেমনই সূর্যালোকের শক্তিতেই আমাদের সভ্যতার জয়যাত্রা। অর্থাৎ পৃথিবীতে জীবের অস্তিত্ব এবং জীবনকে বুঝে নেওয়ার যে রসদ, সেই সবকিছুই আমরা বহু শতাব্দী ধরে সূর্যের কাছ থেকেই পেয়ে আসছি। এই প্রাপ্তির কথাই কবি জীবনানন্দ দাশ উদ্ধৃত অংশে বলতে চেয়েছেন।
৪। “আমাদের জীবনের আলোড়ন-/ হয়তো বা জীবনকে শিখে নিতে চেয়েছিলো।”- প্রসঙ্গ উল্লেখ করে উদ্ধৃতাংশের বিশ্লেষণ করো। ৫
প্রসঙ্গ: কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘তিমিরহননের গান’ কবিতায় এক গভীর দার্শনিক সত্যকে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন এই প্রকৃতিতে সূর্য হল আলোর অকৃত্রিম উৎস। শতাব্দীপ্রাচীন হলেও সূর্যের আলো এবং শক্তি আমাদের সত্যের পথে এগিয়ে চলার প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে। তাই আমরা যারা সভ্যতার ধারক বাহক সেই আমরাই আসলে সূর্যের সন্তান।
উদ্ধৃতাংশের বিশ্লেষণ: ‘আলোড়ন’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ আন্দোলন বা প্রবল আবর্তন। এর সঙ্গে ‘জীবন’ শব্দটির সংযোগ ঘটিয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ জীবনের উত্তাপ, স্ফূর্তি, স্পর্ধা, কর্মক্ষমতাকে ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। তিনি স্মরণ করেছেন মানবসভ্যতার সূচনাপর্বকে যখন মানুষের এগিয়ে চলার শক্তি, প্রেরণা, উচ্ছ্বাস এবং প্রত্যাশার আলোর উৎস ছিল সূর্য। সূর্যের আলোতেই মানুষ চিনে নিতে পেরেছিল জীবনের সঠিক পথকে। নতুন পাওয়া জীবনকে মন-প্রাণ দিয়ে অনুভব করার যে প্রবল আকুতি, তাকেই কবি ‘জীবনের আলোড়ন’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
৫। “অন্য এক আকাশের মতো চোখ নিয়ে/আমরা হেসেছি,/আমরা খেলেছি; অন্য এক আকাশের মতো চোখ’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? আমরা হেসেছি,/আমরা খেলেছি;’- এ কথা কেন বলা হয়েছে? ২+৩
অন্য এক আকাশের মতো চোখ: ‘তিমিরহননের গান’ কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ দ্রুত সময়ের পট পরিবর্তন করে সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকে বর্তমানকালে এসে পৌঁছেছেন। এই সুদীর্ঘ কালের পথ নিয়ে ভাবার সময় কবি উপলব্ধি করেছেন যে আকাশ আমাদের কাছে প্রকৃতির চিরচেনা অসীম এক অংশ। অতীতে মানুষের দৃষ্টিও ছিল সেই আকাশের মতোই প্রসারিত। সেই দৃষ্টিতে কোনো সীমাবদ্ধতা ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সেই – গভীর, সুস্পষ্ট দৃষ্টিকে হারিয়ে মানুষের দৃষ্টি হয়ে গিয়েছে অন্য এক আকাশের মতো খণ্ডিত, অস্পষ্ট এবং সংকীর্ণ।
হাসি-খেলার উচ্ছ্বাস: বহু যুগ পূর্বে পৃথিবীর মাটিতে নেমে আসা সূর্যালোকের দীপ্তি ছড়িয়ে পড়েছিল মানুষের চোখে। কিন্তু সেই চোখের – দৃষ্টি ক্রমশ স্বার্থপরতার আঁধারে ম্লান হয়ে এল। সেই সংকীর্ণ, আত্মকেন্দ্রিক ৪ দৃষ্টি নিয়ে মানুষ জীবনকে দেখেছে, হেসেছে, খেলেছে, বংশগতিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। কিন্তু একবারও ভাবেনি জীবনের প্রতি এই মোহ আসলে অন্ধত্বের নামান্তর, এই স্বার্থপর হাসি-খেলার উন্মত্ততা আসলে মানুষের চেতনাকে অন্ধকারের পথে ঠেলে দিচ্ছে। কবি আমাদের মন ও আচরণের এই অন্ধকার সম্পর্কেই সচেতন করতে চেয়েছেন।
৬। “স্মরণীয় উত্তরাধিকারে কোনো গ্লানি নেই ভেবে”- ‘স্মরণীয় উত্তরাধিকার শব্দবন্ধটি এই কবিতায় কেন এসেছে? ‘গ্লানি নেই’ বলারই বা কারণ কী? ২+৩
স্মরণীয় উত্তরাধিকার: স্মরণীয় শব্দটি দিয়ে যা কিছু মনে রাখার বা স্মরণ করার যোগ্য তা বোঝানো হয়। অন্যদিকে ‘উত্তরাধিকার’ হল উত্তরপুরুষ হিসেবে পূর্বপুরুষদের থেকে সম্পদ প্রাপ্তির অধিকার। এখানে কবি উক্ত শব্দবন্ধের দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন সভ্যতার প্রারম্ভ থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষ তার জীবনের পথে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল- তাই-ই তার ‘স্মরণীয় উত্তরাধিকার’। কিন্তু এই উত্তরাধিকারে আজ থাবা বসিয়েছে মানুষের অমানবিক আচরণ যাকে কবি মানবসভ্যতার ‘গ্লানি’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
মানি নেই বলার কারণ: এই কবিতায় ‘গ্লানি’ অর্থে মানুষের মনের মলিনতাকে ইঙ্গিত করেছেন কবি। গ্লানির বোধ একমাত্র সেই মানুষেরই হতে পারে যার চেতনা আছে, যে চিন্তা করে। নিজের কাজের গাফিলতি বা স্খলনকে চিহ্নিত করে যে সংশোধনে সচেষ্ট হয় সে-ই প্রকৃত বোধসম্পন্ন মানুষ। কিন্তু বর্তমানে মানুষ তার স্বার্থপর জীবনযাপনের পথে নিজের ত্রুটিকেই স্বীকার করতে চায় না, আত্মগ্লানিতে ভোগা তো দূরের কথা। মানুষের ‘স্মরণীয় উত্তরাধিকার’ যে কেবল হাসি-খেলার বিষয় নয়, তাতে মিশেছে মানুষের অন্তরের অন্ধকার, আর সেই নিয়ে মানুষের মনে কোনো গ্লানি নেই, নিজেকে সে নির্দ্বিধায় বিলাসিতার অন্ধকারে সঁপে দিয়েছে, তা উপলব্ধি করেই কবি সে বিষয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন।
৭। একদিন ভালোবেসে গেছি।”- এখানে ‘ভালোবাসা’ শব্দটির তাৎপর্য লেখো। উদ্ধৃতাংশটিতে কবির বক্তব্য নিজের ভাষায় প্রকাশ করো। ২+৩
ভালোবাসা-র তাৎপর্য: ‘ভালোবাসা’ শব্দটি দিয়ে সাধারণত গভীর প্রীতিবোধকে বোঝানো হয়। প্রাচীনকাল থেকে জীবনের পথে চলতে চলতে মানুষ একে অপরকে ভালোবেসেছে, এর ফলে মানববন্ধন সুদৃঢ় হয়ে সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে মানুষ স্বার্থপর, নিজেকে ভালোবাসতে, ভালো রাখতেই সে মগ্ন। তাই পৃথিবীতে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আজ বিপন্ন।
কবির বক্তব্য: ভালোবাসা, প্রীতি, সৌহার্দ্য বর্তমান পৃথিবীতে বিপন্ন বলেই মানুষের সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের বন্ধন, আত্মীয়তার সূত্রগুলি আলগা হয়ে পড়েছে। বহু যুগ পূর্বে মানুষ যে মানুষের দিকে নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সেই হাত আজ কলঙ্কিত। পৃথিবীর যেসকল মনীষী শুনিয়েছিলেন মানবপ্রেমের বাণী, তাঁদের সেই স্মরণীয় উত্তরাধিকার আজ মানুষ ভুলতে বসেছে। কী পেলাম, কী পেলাম না, কী কী পেতে হবে— প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই দ্বন্দ্বে মানুষ সদাই চিন্তিত। ক্ষণিকের প্রাপ্তিতেই সে সন্তুষ্ট, কোন্টা মোহ আর কোন্টা প্রকৃত ভালোবাসা সে বিষয়ে মানুষ অন্ধকারে। মানুষের মনে জমে থাকা এই অন্ধকার নিয়েই কবি ভাবিত-কারণ মানববন্ধন আলগা হলে ভেঙে পড়বে আমাদের সমাজব্যবস্থা, বিপন্ন হবে সংহতি। সেই আশঙ্কা থেকেই কবি আমাদের আত্মপ্রেমে মগ্ন না হয়ে বিশ্বপ্রেমে মনোনিবেশ করার বার্তা দিয়েছেন।
৮। “সেই সব রীতি আজ মৃতের চোখের মতো তবু” -‘সেই সব রীতি’ বলতে কোন্ রীতির কথা বলা হয়েছে? তাকে ‘মৃতের চোখের মতো’-ই বা বলা হয়েছে কেন? ২+৩
যে রীতি: জীবনে চলার পথে মানুষ যা কিছু অর্জন করেছে তার মধ্যে অন্যতম হল নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। একে অপরকে হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে মানুষ গড়ে তুলেছিলো আত্মীয়তার বন্ধন ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ। কিন্তু বর্তমান সময়ে মানুষ হয়ে উঠেছে আত্মকেন্দ্রিক ও সুবিধাবাদী, ক্ষণিকের প্রাপ্তির মোহে অন্ধ মানুষ অতীতের সেইসব আন্তরিক রীতি ভুলতে বসেছে। ফলে মানুষে-মানুষে সম্প্রীতি, স্বার্থহীন ভালোবাসার যে রীতি, যে স্মরণীয় উত্তরাধিকার তা ক্রমশ বিনষ্ট হয়ে চলেছে।
মৃতের চোখের মতো বলার কারণ: একদা যেসব অভ্যাস মানুষকে প্রগতির পথে চালিত করেছিল, মানুষের দৃষ্টিকে করেছিল আকাশের মতো উদার- সেইসব গৌরবময় সংস্কার, সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ আজ মানুষের মনের অন্ধকারের কাছে পরাজিত। ফলে মানবতা বিপন্নতার সম্মুখীন, বিশ্বশান্তি প্রশ্নচিহ্নের মুখে। যে আকাশের মতো দৃষ্টির প্রসারতা নিয়ে মানুষ মানুষকে আপন করে নিত, সেই দৃষ্টিতে বর্তমানে কেবলই সংকীর্ণতার আঁধার দেখা যায়। কবি মানুষের এই ভাবলেশহীন নির্বিকার দৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করেছেন মৃতের চোখের। কেন-না, বিংশ শতকের বাংলা প্রত্যক্ষ করেছিল দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, দুটো মহাযুদ্ধ, শরণার্থী সমস্যা, বেকারত্ব। অথচ এত কিছু দেখার পরেও মধ্যবিত্ত নাগরিকের দৃষ্টিতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। ধরা পড়েনি অনুভূতির কোনো বিশেষ প্রতিফলন। তাই কবি জীবনানন্দ দাশ মধ্যবিত্ত নাগরিকের এই উদাসীন, আত্মকেন্দ্রিক দৃষ্টিকে ‘মৃতের চোখের মতো’ বলেছেন।
৯। “তারার আলোর দিকে চেয়ে নিরালোক।”- ‘তারার আলো’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? ‘নিরালোক’ শব্দটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। ২+৩
তারার আলো: সূর্যের আলোকে আমরা সহজেই প্রত্যক্ষ করতে পারি, কিন্তু সূর্য ব্যতীত অন্য কোনো তারার আলো পৃথিবীর ততোটা কাছাকাছি এসে পৌঁছোয় না, পৃথিবী থেকে শত যোজন দূরে অবস্থিত নক্ষত্রদের আলো ম্লান, রহস্যময় হয়ে আমাদের চোখে ধরা দেয়। এই নক্ষত্রময় অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের দিকে মৃতের মতো চোখ তুলে চেয়ে আছে স্বার্থপর, ইতিহাসবিমুখ মধ্যবিত্ত শ্রেণি। অথচ একটা সময় ছিল যখন নক্ষত্র পথভোলা পথিককে পথ দেখাত, নাবিককে দিক নির্ণয়ে সাহায্য করত। ঠিক সেভাবেই সমসময়ের অন্ধকারে পথভ্রষ্ট কবি যেন নক্ষত্রের কাছে আলোর দিশা প্রার্থনা করেছেন।
নিরালোক-এর তাৎপর্য: আলো নেই এমন অবস্থাই নিরালোক। কবি জীবনানন্দ দাশ এখানে সেই নিরালোক অবস্থার কথা বলতে চেয়েছেন যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) এবং দুর্ভিক্ষের (১৯৪৩) করালগ্রাসে বাংলার আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। পাঠ্য কবিতা রচনার সময় কবি এই পরিস্থিতির সম্মুখীন তো হয়েই ছিলেন তার সঙ্গে তিনি আরও লক্ষ করেছিলেন নাগরিকতার সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরম উদাসীনতা। অর্থাৎ শুধু বাহ্যিক জগত নয়, মানুষের মনেও জমে উঠেছিল স্বার্থপরতার আঁধার যা কবিকে হতাশ এবং ব্যথিত করেছিল। তাই কবি সমকালীন সমাজ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভাবলেশহীন হৃদয়ের অবস্থাকে ‘নিরালোক’ বলে বিশেষায়িত করেছেন। তিনি মানবসমাজের সকল গৌরবময় রীতিকে স্মরণ করেছেন যা বর্তমান পরিস্থিতিতে মৃতের চোখের মতো নিষ্প্রভ। কবি সেই প্রাণহীন দৃষ্টিতে জ্বালাতে চেয়েছেন জ্ঞানের আলো, আকাশভরা নক্ষত্রের কাছে প্রত্যাশা করেছেন অগ্রগতির দিশা।
১০। “হেমন্তের প্রান্তরের তারার আলোক।”- প্রসঙ্গ উল্লেখ করে উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য লেখো। ৫
প্রসঙ্গ: মানুষের জীবনে যে দুর্দিন ঘনিয়ে এসেছিল বিংশ শতাব্দীর চারের দশকে, সেই দুঃসময়ের কথাই বর্ণনা করতে গিয়ে কবি আলোচ্য পঙ্ক্তিটির ব্যবহার করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন একদা যেসব রীতি প্রগতির পথে মানুষকে চালিত করেছিল সেসব স্মরণীয় উত্তরাধিকার আজ মানুষ ভুলতে বসেছে। সেইসব ঐতিহ্য আজ মৃতের চোখের মতো নিষ্প্রভদৃষ্টি তুলে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। সেই আকাশে আলো নেই, রয়েছে শুধু মিটমিটে তারার অস্পষ্টতা।
উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য: হেমন্ত হল শীতের পূর্ববর্তী ঋতু যা কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস জুড়ে অবস্থান করে। এইসময় কৃষিজমি থেকে ফসল কেটে নেওয়া হয়। রাতের অন্ধকারে সেই উন্মুক্ত প্রান্তরে কেবল থাকে কুয়াশা আর সেই কুয়াশায় আচ্ছন্ন আকাশে নক্ষত্রের স্নান আলো। এ ছাড়া হেমন্ত মানেই আমরা যেমন প্রকৃতির শুষ্কতা, পাতাঝরার দিনের আগাম আভাস পাই, ঠিক সেরকমভাবেই আমাদের সভ্যতাও যেন সংকটের মুখে। মানুষের শুভবুদ্ধি, সুচেতনা সবই যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন। কুয়াশাঘন হেমন্ত-প্রান্তরে যেমন তারার আলো ক্ষীণ তেমনই মানুষও যেন যাবতীয় জ্ঞান, চেতনা, তার উত্তরাধিকার, ঐতিহ্যবোধকে হারিয়ে ‘নিরালোক’ অর্থাৎ অন্ধকারে অবস্থান করছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় হেমন্ত ঋতুর কথা বারবার এসেছে মানুষের মনের বিষাদ, উর্বর জমি থেকে ফসল কেটে নেওয়ার পরবর্তী শূন্যতা, কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারকে বোঝাতে। তা ছাড়া এই ঋতুতেই পূর্বপুরুষের উদ্দেশে আকাশপ্রদীপ জ্বালানো হয়। কবি আলোচ্য কবিতাতেও আমাদের স্মরণীয় উত্তরাধিকার থেকে শুরু করে সমসাময়িক অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থাকে চিত্রিত করতে হেমন্ত ঋতুর অনুষঙ্গ এনেছেন।
১১। সেই জের টেনে আজো খেলি সেই জের’ বলতে কীসের জের বোঝানো হয়েছে? ‘আজো খেলি’ কথাটির তাৎপর্য কী? ৩+২
সেই জের এর প্রসঙ্গ: সাধারণত পূর্বে করা কাজের রেশকেই ‘জের’ বলা হয়। কবি এখানে ‘সেই জের’ বলতে আমাদের সভ্যতার অন্ধকারের অনুগামী হওয়ার মনোবৃত্তিকে চিহ্নিত করেছেন। সৃষ্টির লগ্নে মানুষ সূর্যের পূজারী, সত্যের উপাসক হলেও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সে ক্ষমতালোভী, স্বার্থপর হয়ে উঠল। ফলে যুদ্ধ, হত্যা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মন্বন্তরে বিধ্বস্ত হল পৃথিবী- যা মানবসভ্যতার ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। অথচ মানুষ এরকম পরিস্থিতিতে তার শুভবুদ্ধিকে কাজে না লাগিয়ে উদাসীন, নির্বিকার হয়ে থেকেছে। মানবসভ্যতার এই কলঙ্কিত ইতিহাসের জের টেনেই সে নিশ্চিন্তভাবে জীবনযাপনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছে। ফলে মানবসভ্যতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চললেও আদতে তা ক্রমশ আরও সংকটাপন্ন অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে।
আজো খেলি-রতাৎপর্য: কবি যখন আলোচ্য কবিতাটি লিখেছিলেন তখন বঙ্গদেশ মন্বন্তরে-মহামারি-কালোবাজারিতে বিধ্বস্ত। তবুও একশ্রেণির সুবিধাবাদী, মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ তখনও ‘খেলা’ করেছে অর্থাৎ তাদের জীবনযাপনের অভ্যস্ত রীতিতে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। পথে-প্রান্তরে মৃতদেহের সারি, লঙ্গরখানায় ক্ষুধার্ত মানুষের লম্বা লাইন তাকে পীড়িত করেনি বরং সে আরও বেশি আত্মমগ্ন থেকেছে নিজের সুখের চিন্তায়, নিজের কল্পনায়, নিজের দুঃখবিলাসিতায়- যা কবিকে মর্মাহত করেছে।
১২। স্বতই বিমর্ষ হ’য়ে ভদ্র সাধারণ/চেয়ে দ্যাখে তবু সেই বিষাদের চেয়ে”- কারা, কোন্ দৃশ্য, কেন চেয়ে দ্যাখে? এখানে কোন্ বিষাদের কথা বলা হয়েছে? ২+৩
যারা, যে দৃশ্য, যে কারণে: আলোচ্য কবিতায় কবি ‘ভদ্র সাধারণ’ বলতে শহুরে, আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিদের বুঝিয়েছেন। মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির ফলে নগরে আগত শরণার্থীদের জীবনযন্ত্রণা ও অসহায়তাকে তারা দূর থেকে দ্যাখে কিন্তু সামর্থ্য থাকলেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় না। কারণ, মানবিকতাশূন্য এই শ্রেণির মানুষ কেবল নিম্নবর্গীয় শোষিত শ্রেণির মানুষের দুর্ভোগকে উপভোগ করে।
যে বিষাদ: কবি পাঠ্য কবিতায় তেতাল্লিশের মন্বন্তরক্লীষ্ট সময়ের সামগ্রিক অন্ধকারকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ক্ষুধাকাতর, মরণাপন্ন মানুষের ক্রমাগত আর্তনাদে কলকাতা নগরী যখন বিপর্যস্ত তখন নাগরিকদের একাংশের অমানবিক উদাসীনতায় কবি বিস্মিত এবং ব্যথিত হয়েছেন। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাগরিক শিক্ষিত কিন্তু সংবেদনশীল নয়। শহরের বুকে কান্নার রোল শুনে, মৃতদেহের সারি প্রত্যক্ষ করে তারা বিমর্ষ হয় কিন্তু সেই বিমর্ষতায় মিশে থাকে বিরক্তি এবং নিজের চাহিদা পূরণ না হওয়ার অবসাদ। স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক এই শ্রেণির মানুষের মনে সমবেদনা নেই, নেই কোনো গ্লানিবোধ। তারা শহরের পথে, ওভারব্রিজে, নর্দমায় ক্ষুধাতুর দেহ প্রত্যক্ষ করে বিষণ্ণ বোধ করলেও, সমাজকে এই অবক্ষয়ের হাত থেকে মুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেয় না। কবি এখানে তাদের এই কৃত্রিম বিষাদ বা দুঃখ বিলাসিতার কথাই বলতে চেয়েছেন।
১৩। আরো বেশি কালো-কালো ছায়া/লঙ্গরখানার অন্ন খেয়ে-কালো-কালো ছায়া বলতে কী বোঝানো হয়েছে? তারা লঙ্গরখানার অন্ন খায় কেন?
কালো-কালো ছায়া: সময়টা ১৯৪৩, বাংলার বুকে ঘনিয়ে এল মন্বন্তরের ছায়া; সেই মন্বন্তরের মাঝে খাবারের সন্ধানে গ্রাম থেকে মানুষ উঠে এল শহরে। শহরে বসবাসকারী উচ্চবিত্ত নাগরিক কালোবাজারির মাধ্যমে মুনাফা লুটতে লাগল। আর মধ্যবিত্ত নাগরিক এরকম আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে আত্মগ্লানিতে ফেটে না পড়ে বিরক্ত হল। কারণ মন্বন্তরক্লীষ্ট সময়ে তাদের ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণ হচ্ছিল না, ফলে স্বভাবতই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত শ্রেণি মূল্যবৃদ্ধি, বিশ্বযুদ্ধ, বেকারত্ব নিয়ে চিন্তিত ও বিষণ্ণ ছিল। কিন্তু তাদের মনের এই বিষন্নতার ছায়ার থেকেও বৃহত্তর ক্ষুধার আঁধার ঘনিয়ে এসেছিল বাংলার বুকে যা তাদের মৃতের মতো চোখে ধরা পড়েনি। খিদের জ্বালায় শহরে চলে আসা মানুষের ক্ষীণ চেহারা দেখে মানুষ নয়, মানুষের কালো ছায়া বলে ভ্রম হয়েছিল কবির, সেকথাই তিনি কবিতার উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটিতে প্রকাশ করেছেন।
লজ্জারখানা প্রসঙ্গ: লঙ্গরখানা হল দুর্গত মানুষদের বিনামূল্যে খাওয়ার স্থান। সাধারণত সরকারি বা কখনও বেসরকারি উদ্যোগে এখানে খাদ্য বিতরণ করা হয়। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময় বাংলার বুকে প্রচুর লঙ্গরখানা খোলা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা পর্যাপ্ত ছিল না। দেশের উৎপাদক শ্রেণি অর্থাৎ কৃষিজীবি, শ্রমজীবি মানুষের উপরেই এই মন্বন্তরের সর্বাধিক প্রভাব পড়েছিল। একটু ভাত, নিদেনপক্ষে সামান্য ফ্যানের প্রত্যাশায় তারা লাইন করে দাঁড়িয়েছিল লঙ্গরখানার সামনে- যাদের অস্থিসর্বস্ব চেহারা দেখে কবির মনে হয়েছে তারা মানুষ নয়, সমাজের বুকে যে অবক্ষয়ের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে এরা যেন তার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
১৪। “মধ্যবিত্ত মানুষের বেদনার নিরাশার হিসেব ডিঙিয়ে ‘মধ্যবিত্ত কারা? ‘বেদনার নিরাশার হিসেব ডিঙিয়ে বলতে কী বোঝানো হয়েছে? ২+৩
মধ্যবিত্ত: আর্থিক দিক থেকে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যবর্তী অবস্থাযুক্ত শ্রেণিকে ‘মধ্যবিত্ত’ বলা হয়। সামাজিক বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি এদের কিছু মানসিক বৈশিষ্ট্যও থাকে। উচ্চবিত্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতিহীনতা, পলায়নবাদী মনোভাব ও এই শ্রেণির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কাজেই এই বৈশিষ্ট্যগুলির সাপেক্ষে বিচার করতে গেলে ‘মধ্যবিত্ত মানসিকতা’ কথাটির অর্থ বুঝতে পারা যায়। এই মানসিকতা যে-কোনো উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্তেরও থাকতে পারে, আবার আর্থিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিটি ব্যক্তির মানসিকতা একরকম নাও হতে পারে।
বেদনার নিরাশার হিসেব: তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে যখন গ্রামীণ, নিরন্ন মানুষ মহানগরীর পথেঘাটে খিদের জ্বালায় মৃত্যুর মুখে পতিত ৪ হয়েছিল তখন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজ। তারা নিজেদের আয়-ব্যয়, যুদ্ধের বাজারে ক্ষয়ক্ষতি, ব্রিটিশ সরকারের চাপানো করের বোঝা, সর্বোপরি নিজের ভালো থাকার চিন্তায় মশগুল ছিল। কবির মতে তাদের এই হিসাব-কষা জীবনের নিরাশা, বেদনার পরিমাণকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল মন্বন্তরে ক্ষুধাকাতর মানুষের সংখ্যা তথা মৃতের সংখ্যা। তবুও তা মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষগুলোকে ব্যস্ত করে তোলেনি। সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণি এবং শোষিত শ্রেণির মধ্যে বিভাজনের যে দেয়াল তা ক্রমশ উচ্চ থেকে উচ্চতর হয়, নক্ষত্রের আলোর নীচে মৃত্যু ঘটে শত শত বুভুক্ষু মানুষের যারা একদিন বাংলার মাটিতে ফসল ফলিয়েছিল। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই বিপর্যয়ে মানবিকতার যে ক্ষতি হয়েছিল তার হিসাব কবি মেলাতে পারেননি। আলোচ্য কবিতার ছত্রে ছত্রে তাই কবি জীবনানন্দ দাশের আত্মগ্লানি, আশঙ্কা, হতাশা, ধিক্কার ব্যক্ত হয়েছে।
১৫। “নর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজে উঠে নর্দমায় নেমে-” পাঠ্য কবিতায় নর্দমা এবং ওভারব্রিজের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো। ৩+২
নর্দমার প্রসঙ্গ: নর্দমা হল সেই সংকীর্ণ, কলুষিত জায়গা যেখানে ময়লা-আবর্জনা এসে জমা হয়ে নোংরা, কালো জলের তোড়ে একসময় ভেসে যায়। তেতাল্লিশের আকালে গ্রামের মানুষ যখন শহরে আসে খাদ্য এবং বাসস্থানের আশায় তখন স্বাভাবিকভাবেই স্বার্থপর নাগরিক সভ্যতা তাদের আপন করে নেয়নি। ফলে খাদ্যের জন্য তাদের ভিক্ষা, লঙ্গরখানার খাবার বা সরকারি ক্যাম্পের উপর ভরসা করতে হয়েছিল। নিতান্তই স্বল্প সেই আয়োজনে তাদের চাহিদা পূরণ হয়নি। নির্মম মহানগরী নর্দমার পার্শ্বস্থ স্থানে খোলা আকাশের নীচে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেখানে বসবাস করার পাশাপাশি নর্দমাতেই তারা ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টের সন্ধান চালাত। তাদের বেঁচে থাকার ধরন যেন নর্দমার কীটের মতোই হয়ে গিয়েছিল। মন্বন্তরক্লীষ্ট সময়ে মানুষের দুরবস্থাকে প্রকাশ করতেই কবি এই কবিতায় নর্দমার প্রসঙ্গ এনেছেন।
ওভারব্রিজের তাৎপর্য: মন্বন্তরের পরিস্থিতিতে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ জীবনের পথ হারিয়ে সামান্য খাদ্যের আশায় শহরের ফুটপাথে, নর্দমাসংলগ্ন স্থানে, ওভারব্রিজের উপরে জড়ো হয়েছিল। অনাহারে মৃত মানুষের লাশ ডিঙিয়ে পথচলতি মানুষ এগিয়ে যেত তার গন্তব্যের দিকে। আসলে ফুটপাথ ও নর্দমা থেকে ওভারব্রিজের উচ্চতা অনেকটাই। এ যেন নিম্নবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে থাকা ব্যবধানের সূচক। তা ছাড়া মধ্যবিত্ত-উচ্চাকাঙ্খী মন পৌঁছোতে চায় একটু বেশি ভালো থাকার, স্বচ্ছন্দে থাকার মতো উচ্চবিত্ত অবস্থায়- কিন্তু তার এই আকাশকুসুম ভাবনা এই দুর্ভিক্ষকালে অচিরেই নিরাশার অন্ধকারে ডুবে যায়। এসময়ে গ্রাম থেকে আসা শ্রমজীবী, নিম্নবিত্ত মানুষ ও মধ্যবিত্ত ভদ্র-সাধারণ উভয় পক্ষেরই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল। তাই মধ্যবিত্তের ভাবনার এই পতন যেন সেই ওভারব্রিজ থেকে পুনরায় নর্দমায় নেমে আসার মতোই। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনের সংকীর্ণতা ও ক্লেদাক্ততা যেন নর্দমার সঙ্গেই তুলনীয়। তাই এই কবিতায় ওভারব্রিজ ও নর্দমার একাধিক বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে যা কবির সমাজভাবনাকে প্রকাশ করেছে।
১৬। “ফুটপাত থেকে দূর নিরুত্তর ফুটপাতে গিয়ে”- পঙক্তিটিতে প্রযুক্ত ‘ফুটপাত’ ও ‘দূর ফুটপাত – শব্দবন্ধ দুটির ব্যাখ্যা দাও। ৫
প্রসঙ্গ: বাংলায় হঠাৎ ঘনিয়ে ওঠা তেতাল্লিশের মন্বন্তর সামাজিক জনজীবনকে যেন মৃত্যুর ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গনের আওতায় এনে দাঁড় করিয়ে দিল। শুধু খাদ্যের আশ্বাসে যে অনাহারক্লিষ্ট গ্রামীণ মানুষগুলি শহরের আদি -অন্তহীন ফুটপাথে এসে জড়ো হয়েছিল, কবি তাদের হতশ্রী ও দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থানকে চিহ্নিত করতেই ফুটপাথের প্রসঙ্গ এনেছেন।
ফুটপাত ও দূর নিরুত্তর ফুটপাত: মূলত শহুরে পথের দুপাশে পথিকজনের পায়ে চলার জন্য নির্দিষ্ট বাঁধানো রাস্তাকে ফুটপাথ বলা যেতে পারে। কবিতায় এই পঙ্ক্তিটিতে ‘ফুটপাত’ শব্দটি সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। মন্বন্তরে মৃতপ্রায়, বিপন্ন অনাহারী মানুষেরা নিছক খাদ্যের সন্ধানে এসে জড়ো হয়েছিল শহরের ফুটপাথে। তাদের এই অবস্থান শহুরে মধ্যবিত্ত বাবুদের কাছে মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। তারা ভাবে- এরা যেন শহরের নিশ্চিন্ত আরামদায়ক জীবনে এসে জুড়ে বসা কোনো উটকো ঝামেলা। তাদের স্বতঃসিদ্ধ, সুখী জীবনের পাশে দুমুঠো অন্ন ও ফ্যান চাওয়ার উচ্চকিত আওয়াজ তাই নিঃসন্দেহে বিব্রত করেছিল তাদের। ফুটপাথে পড়ে থাকা মানুষগুলো করুণার দানস্বরূপ এতটুকু ভাত বা ফ্যান পেলেই, সেটুকুকে আশ্চর্য প্রাপ্তি বলে মনে করেছে আর সেই সামান্য ভাতটুকুও না জুটলে তারা সরে সরে গিয়েছে আরও দূরের কোনো ফুটপাথে একটু অন্নের আশায়। কিন্তু স্থান পরিবর্তন করে দূরের ফুটপাথে গেলে সেই স্থানও খাদ্যের প্রার্থনায় বেশিরভাগ সময়ই নিরুত্তর থেকেছে। কারও থেকে কোনোপ্রকার সদুত্তর না পেয়ে অনেকক্ষেত্রে ফুটপাথেই চিরঘুমে ঢলে পড়েছে তারা। তাদের সব জীবনযন্ত্রণার অবসান ঘটেছে ফুটপাথেই। কিন্তু, এই নির্মম ঘটনা দিনের পর দিন প্রত্যক্ষ করেও চুপ থেকেছে শহুরে ফুটপাথ, সোচ্চার হয়নি কোনো নাগরিক- তাই কবির এই হতাশাময় উক্তি।
১৭। “নক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা ম বে যেতে জানে।” ‘নক্ষত্রের জ্যোৎস্না’ কেমন? সেখানে ‘ঘুমাতে বা মরে যেতে’ জানার তাৎপর্য কী?
নক্ষত্রের জ্যোৎস্না: নক্ষত্র বলতে সাধারণত তারকা বা তারাকে বোঝায়। ব্রহ্মাণ্ডের এই বৃহৎ জ্যোতিপুঞ্জের মধ্যে সূর্যালোক এবং চাঁদের আলো পৃথিবী থেকে স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। কিন্তু নক্ষত্রের আলো হয়তো পৃথিবীতে এসে পড়লেও সেই আলো মিটমিটে, ম্রিয়মান। সূর্যালোক ও জ্যোৎস্না যেমন পৃথিবীকে আলোকিত করে, নক্ষত্রের আলো সেভাবে তীব্র হয়ে পৃথিবীর কাছে পৌঁছোয় না। তা কেবল অন্ধকারে মেশা ক্ষীণ আলোর আভাস মাত্র। নিজে আলোকিত হওয়ার ক্ষমতাটুকু থাকলেও পৃথিবীকে আলোকময় করে তোলার ক্ষমতা তার নেই।
ঘুমাতে বা মরে যেতে জানার তাৎপর্য: তেতাল্লিশের মন্বন্তরে বাংলার বুকে শুরু হয়েছিল মৃত্যুর মিছিল। খাদ্যের প্রত্যাশায় গ্রাম থেকে শহরে চলে আসা মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল নর্দমা সংলগ্ন ফুটপাথ থেকে ওভারব্রিজ সর্বত্র। ভিক্ষাবৃত্তি করে অথবা লঙ্গরখানার খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করে দিন গুজরান করা এই মানুষেরা বেশিদিন খিদের সঙ্গে লড়াই করতে পারেনি। অনাহারক্লীষ্ট শরীরে তারা খোলা আকাশের নীচে মৃত্যুঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল। তাদের জীবনসংগ্রামের কথাই এখানে বলতে চেয়েছেন কবি। তবে এই নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের মৃত্যুতে মধ্যবিত্ত নাগরিকের কিছুই এসে যায়নি। কবি মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিভূ হলেও সংবেদনশীল। তাই ‘জ্যোৎস্না’ বা ‘চন্দ্রালোক’ নিয়ে যে প্রচলিত রোমান্টিকতা, তাকে আঘাত করতে চেয়েছেন তিনি। অন্ধকার পথে খোলা আকাশের নীচে নক্ষত্রের মরা আলোয় এইসব নিরন্ন মানুষের মরণঘুমের বীভৎসতার ছবি এঁকে তিনি সমকালীন পরিস্থিতির বাস্তব ঘটনাগুলিকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন আলোচ্য কবিতায়।
১৮। “এরা সব এই পথে”-‘এরা’ বলতে কারা? ‘এই পথে’-র নির্দেশ কী? ২+৩
এরা হল: পরাবাস্তবতার কবি জীবনানন্দ দাশ-এর ‘তিমিরহননের গান’ কবিতায় উদ্ধৃত ‘এরা’ হল নিম্নবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি যারা জীবনের ঘূর্ণিপাকে পড়ে লঙ্গরখানার আনাচে-কানাচে ধুঁকতে থাকে আর ফুটপাথে নর্দমায় কীটপতঙ্গের মতো মরে যায়। কবির কথায় এরাই অন্নহীন, পরিচয়হীন, দিকচিহ্নহীন জীবনপথের সেই মানুষেরা, যাদের মৃত্যু হলেও খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই। নর্দমার ধারে এদের নিরন্ন অনাহারক্লিষ্ট শুকিয়ে যাওয়া দেহ পড়ে থেকে কেবল মধ্যবিত্ত মনকে বিব্রত করে।
এই পথে-র নির্দেশ: ‘পথ’ শব্দটি যেন আলোচ্য কবিতায় জীবনপথের অভিমুখ নির্দেশ করে। আবার এও দেখা যায়- শহরের পথের দুপাশেই বিস্তৃত হয়ে থাকে ‘ফুটপাত’। গ্রাম থেকে আসা ক্ষুধার্ত, এতটুকু অন্নের জন্য ভিক্ষুক মানুষগুলি এই পথ ও পথের প্রান্তদেশকেই অবলম্বন করেছিল। – কিন্তু পথ মানুষকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিলেও, সাধারণভাবে উত্তরায়ণের মার্গ দর্শন করাতে চাইলেও আলোচ্য কবিতায় পথ শুধু মানুষকে মৃত্যুমুখীই করেছিল। এই পথে চলে কারও উত্তরণ তো হয়ইনি, বরং চরম আশাভঙ্গও হয়েছিল। কবি দেখিয়েছেন- পথে ও পথপ্রান্তে জড়ো হওয়া অজস্র ক্ষুধাকাতর মানুষ নগরে এসে ভেবেছিল- বাঁচবে, বেঁচে উঠবে, নগরের বিত্তশালী বাবুরা তাদের জীবনের সহায় হবে কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ফুটপাথ থেকে ‘দূর নিরুত্তর ফুটপাতে’ গিয়ে ‘এরা’ যেন জীবন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাদের আর গন্তব্যে পৌঁছোনো হয়নি, ব্যর্থ হয়েছে সমস্ত পথ।
১৯। “ওরা সব ওই পথে- তবু”- ‘ওরা’ বলতে কারা? ‘ওই পথে বলার পর পঙ্ক্তিতে ‘তবু শব্দটি কেন এসেছে? ২+৩
ওরা যারা: আলোচ্য কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ ‘ওরা’ বলতে সমাজের সুবিধাভোগী, ক্ষমতালিঙ্গু শ্রেণির কথা বুঝিয়েছেন। নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্য তারা সাধারণ মানুষের চরম ক্ষতি করতেও পিছপা হয় না। তেতাল্লিশের মন্বন্তরও এইসব মানুষের লালসাজাত কালোবাজারির প্রধানতম ফলাফল যা কেড়ে নিয়েছিল হাজার-হাজার মানুষের মুখের গ্রাস শুধু নয়, প্রাণও। সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণিও এদের কাছাকাছি থাকতে চায়, এরা উচ্চবিত্তের ক্ষমতাবলয়ের পরিধি ছুঁয়ে থাকে আবার বলিপ্রদত্ত, নিপীড়িত সাধারণ মানুষের জন্য বিমর্ষ হয়, ছদ্ম প্রতিবাদ জানায় রাজপথে অথচ সেখানেই পড়ে থাকা অনাহারক্লীষ্ট মৃতদেহকে সন্তর্পণে ডিঙিয়ে যায়, এড়িয়ে যায় তাদের ক্ষুধার আর্তনাদকে।
তবু শব্দের প্রয়োগ: ‘তবু’ শব্দটি আসলে কবিমনের অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রতীক। এই দ্বন্দ্ব বিশ্বাসের সঙ্গে অবিশ্বাসের, দ্বিধাগ্রস্ততার। ‘ওই পথে’ বলতে সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির পথ আর ‘এই পথে’-র অর্থ নিম্নবিত্ত, নির্যাতিত মানুষের পথ- এই দুই পথের মাঝামাঝি মধ্যবিত্ত শ্রেণির পথের অবস্থান। এই শ্রেণির মধ্যে ক্ষমতার খিদে আছে আবার মন্বন্তরগ্রস্ত মরণাপন্ন মানুষদের জন্য একপ্রকার লোকদেখানো বিমর্ষতাও আছে। তবে সবকিছুর ঊর্দ্ধে আছে তার আত্মকেন্দ্রিকতা, সবসময় সে নিজেকে নিয়েই ভাবতে ব্যস্ত। অন্যের দুরবস্থার প্রতি তার কোনো সহানুভূতি নেই, নেই কোনো সমাজসংস্কারের আকাঙ্খা। কিন্তু তবু কবি আশা করেছেন যে এই শ্রেণি একদিন দিন বদলের ডাক দেবে কারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণি চিন্তাশীল, একদিন না একদিন তারা উপলব্ধি করবেই যে সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে- তারা সভ্যতার অগ্রদূত, তারা আলোর পথযাত্রী। আত্মকেন্দ্রিকতার অন্ধকারের পূজারী তারা নয়। কবি আসলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেকার চিরাচরিত দ্বন্দ্ব আবার চরম হতাশার সঙ্গে আশাবাদের কথা শোনাতেই ‘তবু’ শব্দটির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।
২০। “মধ্যবিত্তমদির জগতে/আমরা বেদনাহীন-অন্তহীন বেদনার পথে।”- ‘মধ্যবিত্তমদির জগতে শব্দবন্ধটির তাৎপর্য লেখো। ‘অন্তহীন বেদনার পথে বলতে কী বোঝানো হয়েছে? ২+৩
তাৎপর্য: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে সারা পৃথিবী জুড়ে যে নৈরাজ্যের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, যেন তারই প্রতিচ্ছবি ধরা পড়েছিল তেতাল্লিশের মন্বন্তরে। তাই কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন-
"মন্বন্তর শেষ হ'লে পুনরায় নব মন্বন্তর"
একসময় যে স্বর্ণযুগ অস্তিত্বময় ছিল, তা আজ অন্তর্হিত। তার জায়গায় বর্তমানে যেন নেমে এসেছে ধ্বংসের অন্ধকার। বর্তমানে কালের পথে উঠে এসেছে, গা-বাঁচিয়ে চলা মধ্যবিত্ত মানবশ্রেণি। সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষদের সঙ্গে এই মধ্যবিত্তদের মাঝখানের তফাৎটুকু কবি নির্দেশ করেন ‘এরা’-‘ওরা’ শব্দ দুটির প্রয়োগে। মন্বন্তরের দহনদিনে নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ যখন ক্ষুধায় কাতর, তখনও মধ্যবিত্তশ্রেণি নিছকই বিমর্ষ হয়। কারণ তারা ‘মধ্যবিত্তমদির’। মদিরতা মানে মত্ততা। এই শ্রেণির মানুষেরা আত্মপ্রেমে মজে থাকে, এমতাবস্থায় অন্যকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার কথা এদের মনে আসে না। কারও কোনো দুরবস্থা এদের সামান্যতম পীড়িতও করে না। কবি একে এক ধরনের মদিরতা বলে ব্যঙ্গ করেছেন। মধ্যবিত্তজনের এই আত্মমত্ত, আবিষ্ট মানসিক অবস্থানকেই কবি এখানে ‘মধ্যবিত্তমদির’ বলে প্রকাশ করেছেন।
অন্তহীন বেদনার পথে-র অর্থ: নিম্নবর্গীয় মানুষজনকে মন্বন্তর উপহার দিয়েছিল- নর্দমা-ফুটপাথ-লঙ্গরখানা। এই পরিস্থিতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ভাবলে দেখা যায়- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দা সমাজজীবনে যে গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল, তাতে মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষজনও তাদের মূল্যবোধ ভুলে গিয়ে হয়ে উঠেছিল স্বার্থকামী, আত্মকেন্দ্রিক ও নিছক সুখে বেঁচে থাকার মন্ত্রে দীক্ষিত। নিম্নবিত্তরা ফুটপাথে ক্ষুধা-যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে মরে যেতে পারে, কিন্তু মধ্যবিত্তরা তা পারে না, কারণ তারা জীবনবিলাসী। আত্মকেন্দ্রিকতা বা স্বার্থপরতায় আক্রান্ত ‘এরা’ সমূহ বিপদ-ঝঞ্ঝা থেকে গা-বাঁচিয়ে আত্মরক্ষা করতে সদা তৎপর। জীবনের নিরাপদ বৃত্ত পরিধি ছুঁয়ে, আত্মসুখে নিমজ্জিত থাকাতে অভ্যস্ত। নগরের পথে-প্রান্তে মৃত্যুর মিছিল, বিঘ্নিত জীবনযাপনের পরিসরে নিরন্নতার হাহাকার, নিছক একটু ‘ফ্যান’-এর জন্য মানুষের ক্ষুধার্ত চিৎকার মধ্যবিত্ত মানুষকে ব্যথিত করে না, বিব্রত করে। তখন সেই ‘অন্তহীন বেদনার পথে’-র থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মধ্যবিত্ত ‘ভদ্র সাধারণ’ সুখের স্বপ্নে বিভোর হয়। চতুর্দিকের এই বেদনাময় পরিস্থিতিতেও তার আত্মকেন্দ্রিকতার ঘেরাটোপে কোনো আঘাত লাগে না।
২১। “জীবিত বা মৃত রমণীর মতো অন্ধকারে-মহানগরীর মৃগনাভি ভালোবাসি।”- উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। ৫
তাৎপর্য: মানবসভ্যতার চিরকালীন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং মানবিকতা যখন মানুষেরই লোভ-লালসার শিকার হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হল, তখন চতুর্দিকে ঘনিয়ে এল স্বার্থপরতার অন্ধকার। মানুষ তখন সূর্যালোকের মতো দীপ্তিমান প্রজ্ঞার আলোয় নয়, ঝাঁপ দিল জৈবিক ক্ষুধা মেটানোর অন্ধকারে। তার জীবনে তখন রমণী প্রিয়তমা নয়, হয়ে উঠল কেবলই ভোগ্যপণ্য। এমনকি সে জীবিত নাকি মৃত তা দিয়েও কিছু এসে যায় না, ব্যক্তির ভোগবাসনা বা প্রবৃত্তি চরিতার্থ হচ্ছে কিনা সেটাই আসল ব্যাপার। মানুষের নৈতিকতাবোধের অবক্ষয়কে এভাবেই চিহ্নিত করেছিলেন কবি। উল্লেখ্য রমণী যেমন মানবসভ্যতার কাছে সেসময় কেবল ভোগবিলাস, পরিতৃপ্তির সামগ্রীরূপে প্রতীত হয়েছিল তেমনই মধ্যবিত্ত নাগরিককে তার ভোগবিলাসের সামগ্রী জুগিয়েছিল মহানগর। আর সেই ভোগ্যপণ্যের মদিরতায় সম্পর্কের বৈধতা-অবৈধতা বা আচরণের নৈতিকতা-অনৈতিকতার প্রভেদ কেবলই গুলিয়ে যায়। মানুষ ক্রমশ তলিয়ে যায় বিলাসিতার অন্ধকারে। কস্তুরী মৃগের নাভিনিঃসৃত সুগন্ধে মৃগ নিজেই যেমন মাতোয়ারা হয়ে ছুটে বেড়াতে থাকে, মধ্যবিত্ত সমাজও সেরকম নাগরিক সুখের নেশায় সমস্ত মানবিক ধর্মকে উচ্ছন্নে দিয়ে তিমিরবিলাসিতায় গা ভাসায়। মৃগনাভির জন্য হরিণ যেমন নাগরিক সমাজে পণ্য, ঠিক তেমনই আমাদের মনের লোভ-লালসাই আমাদের অবক্ষয়ের কারণ। আমরাও ওই কস্তুরী মৃগের মতোই নিজের মোহে উন্মত্ত, আত্মহারা। কবি জীবনানন্দ দাশের সচেতন শব্দ প্রয়োগে ‘জীবিত বা মৃত রমণী’ বা ‘মহানগরীর মৃগনাভি’ হয়ে উঠেছে স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, ভোগবিলাসী মধ্যবিত্ত নাগরিকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তোলার সার্থক চিত্রকল্প।
২২। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নক্ষত্রচেতনা কীভাবে প্রকাশ পেয়েছে তা আলোচ্য ‘তিমিরহননের গান’ কবিতা অবলম্বনে লেখো।
নক্ষত্রচেতনা: কবি জীবনানন্দ দাশের এক নিজস্ব মনোভাষা বা কবিভাষা রয়েছে যার সঙ্গে প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। সেই কবিভাষার সঙ্গে নক্ষত্রজগতেরও এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সন্ধ্যার পর মহাকাশে যেমন একটি-দুটি করে তারা আপন মনে জ্বলে ওঠে এবং তার মৃদু আলো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে, জীবনানন্দের কাব্যভাষাও যেন তেমনই মগ্ন চেতনার আস্তরণ ভেদ করে আমাদের হৃদয়ে এসে পৌঁছায়, মনকে এক অদ্ভুত আবেশে আচ্ছন্ন করে দেয়। পাঠক বোঝে এই নিজস্ব কবিভাষার অন্তরালেই লুকিয়ে আছে এক রক্তাক্ত, ক্লেদাক্ত, আধুনিক সভ্যতার পটভূমি। পাঠ্য
‘তিমিরহননের গান’ কবিতাতেও তাই প্রথমে এসেছে শতাব্দীপ্রাচীন সূর্যের কথা, যার আলো সভ্যতার শুরু থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত সমস্ত প্রাণকে বেঁচে থাকার শক্তি জুগিয়ে চলেছে। কিন্তু সভ্যতার ক্রমবিবর্তনে আমাদের প্রাচীন অভ্যাস, ঐতিহ্য, সংস্কার ক্রমশ মৃতের চোখের মতো নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছে। তবু আমরা-
“তারার আলোর দিকে চেয়ে নিরালোক।” একসময়ে যে নক্ষত্র আমাদের পথ চিনতে, দিক নির্ণয় করতে সাহায্য করেছে সেই নক্ষত্রসমূহের কাছেই যেন কবি জীবনজিজ্ঞাসার সদুত্তর প্রার্থনা করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আলোচ্য ‘তিমিরহননের গান’ কবিতার উৎস কাব্যগ্রন্থ ‘সাতটি তারার তিমির’-এর প্রতিটি কবিতায় রয়েছে সমাজ ও মানুষ সম্পর্কিত অজস্র প্রশ্ন। সাতটি নক্ষত্র ক্রেতু, পুলহ, পুলস্ত্য, অত্রি, অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ, মরীচি) যখন একটি রেখার দ্বারা সংযুক্ত হয় তখন সেটি একটি জিজ্ঞাসা চিহ্নেরই জন্ম দেয়। যেন সমকালীন নৈরাজ্যের সম্মুখীন হয়ে সাতজন ঋষিপ্রতিম নক্ষত্র নির্বাক হয়ে গিয়েছে। আর চতুর্দিকে মন্বন্তরক্লীষ্ট সময়ের ভয়াবহতার শিকার নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ যারা পথের উপর “নক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা ম’রে যেতে জানে।” আবার এ কথাও বুঝতে হবে যে এই নক্ষত্রভাবনা কিংবা নক্ষত্রসংযোগ থেকেই তাঁর কবিতা আশাবাদে পৌঁছে যাচ্ছে, যে আশাবাদ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে উদ্ভূত নয়, একজন সমাজদ্রষ্টার সামগ্রিক চিন্তার ফসল। সুতরাং কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পৃথিবী ও মহাকাশের ব্যবধান মুছে গিয়ে সৃষ্টি হয় এক নতুন ভাষ্যের যা পাঠককে নক্ষত্রলোকের নিবিড় সান্নিধ্য প্রদান করে।
২৩। গীতিকবিতা হিসেবে জীবনানন্দ দাশের ‘তিমিরহননের গান’ কবিতাটি কতখানি সার্থক তা লেখো। ৫
গীতিকবিতার স্বরূপ: প্রাচীন গ্রিসে Lyre বা বীণা সহযোগে গায়ক তার ব্যক্তিগত অনুভবকে সংগীতের মাধ্যমে প্রকাশ করত, সেই সংগীতকেই বলা হত Lyric। এই Lyric-ই বাংলা গীতিকবিতার উৎস। পাশ্চাত্য লিরিকের মতো বাংলা গীতিকবিতার ক্ষেত্রেও কবিহৃদয়ের একান্ত ব্যক্তিগত ভাবাবেগ প্রাধান্য পায়। তবে কবিমনের আনন্দ-বেদনা গীতিকবিতার মূল বিষয় হলেও সার্থক আধুনিক গীতিকবিতায় বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর জীবন ও অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটে। এমনকি প্রাচীন লিরিকের ক্ষেত্রেও কবির লেখনী দ্বারা ফুটে উঠেছে সাধারণ মানুষের আশা-নিরাশার কলরব। অর্থাৎ কবিমনের ব্যক্তিগত অনুভূতির সঙ্গে গীতিকবিতায় থাকে এক সর্বজনীন আবেদন। প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশপ্রীতি, ধর্মীয় বা ভক্তিমূলক প্রভৃতি সকল বিষয় নিয়েই গীতিকবিতা রচিত হতে পারে।
সার্থকতা: “সেই এক ভোরবেলা শতাব্দীর সূর্যের নিকটে আমাদের জীবনের আলোড়ন-“
সময়টা বিংশ শতাব্দীর চারের দশক। দেশভাগ-পূর্ববর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মন্বন্তর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে পর্যুদস্ত ভারতবর্ষে ঘনিয়ে উঠেছিল অবক্ষয়ের অন্ধকার। তারই মাঝে সমাজচেতনার সঙ্গে রোমান্টিক আত্মমগ্নতার মিশেল ঘটিয়ে আলোয় ফেরার গান গাইলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। আলোচ্য ‘তিমিরহননের গান’ কবিতাটি আক্ষরিক অর্থেই আমাদের চেতনার তিমিরকে বিনষ্ট করে গভীর আত্মোপলব্ধির সঞ্চার ঘটায়। আমাদের স্মরণ করায় যে আমরা ছিলাম সূর্যের জাতক, সত্যের পূজারী। মানবসভ্যতার শুরুতে একে অপরের প্রতি সহমর্মিতার দ্বারা ঐক্যবদ্ধ সমাজ আমরাই গড়ে তুলেছিলাম। কিন্তু বর্তমানে সেই আমাদেরই ক্ষমতালিঙ্গু, আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবের দরুন পৃথিবীতে নেমে এসেছে নৈরাজ্যের আঁধার। সেই আঁধার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কবি আস্থা রেখেছেন মানুষেরই শুভবুদ্ধির উপর। তিমিরের বিলাসিতা ছেড়ে আমরাই আবার চেতনার নবজাগরণে ‘তিমিরবিনাশী’ হয়ে উঠব এটাই কবির আশা। কবি এখানে মধ্যবিত্ত জনসাধারণেরই একজন হয়ে মানবসভ্যতার আলো-আঁধারের দ্বন্দ্বকে তাঁর কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। বর্তমান সময়ের পাশাপাশি সভ্যতা সৃষ্টির প্রথম ভোরের কথা ইতিহাস-সচেতন কবির কবিতায় বারবার এসেছে। পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব, বিবর্তন, অস্তিত্বের সংকট এবং তার থেকে উত্তরণ-সবটুকুই কবি ব্যক্তিগত সুরেই প্রকাশ করেছেন কিন্তু একইসঙ্গে তিনি হয়ে উঠেছেন আমাদেরই প্রতিনিধি। একজন যথার্থ গীতিকবির মতোই এই কবিতায় কবির, মানব ও প্রকৃতির দূরত্বকে অতিক্রম করার ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। তার সঙ্গে সংশয় ও বিপন্নতা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এই কবিতাকে সার্থক আধুনিক গীতিকবিতা করে তুলেছে। চিত্রকল্পের যথার্থ প্রয়োগ এবং মননের ঔজ্জ্বল্য তাঁর গীতিকবিতার এক অদ্বিতীয় সম্পদ, আলোচ্য ‘তিমিরহননের গান’ কবিতাতেও যার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কাজেই আধুনিক গীতিকবিতা হিসেবে ‘তিমিরহননের গান’ কবিতাটি সর্বান্তকরণে সার্থক।
২৪। আলোচ্য কবিতায় কবি একবার বলেছেন “সূর্যালোক মনোরম মনে হ’লে হাসি।” আবার বলেছেন- “সূর্যালোক প্রজ্ঞাময় মনে হ’লে হাসি;”- কবির এই উদ্দেশ্যকে নিজের ভাষায় প্রকাশ করো। ৫
ভূমিকা: কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙ্ক্তিবিন্যাস একেবারেই ভিন্নধর্মী, যতিচিহ্ন বা শব্দের সামান্য অদলবদলে পরিবর্তিত হয়েছে কবিতার মূল সুর অথবা অন্তর্নিহিত অর্থ। আলোচ্য ‘তিমিরহননের গান’ কবিতাতেও ‘সূর্যালোক’ শব্দটির একাধিকবার ব্যবহার আমরা দেখতে পাই। শব্দটি আলোচ্য কবিতার শুরুতে, মাঝে ও শেষে তিনবারই ভিন্নভাবে কবিবক্তব্য প্রকাশের সহায়ক হয়ে উঠেছে।
ব্যাখ্যা: কবি আলোচ্য কবিতার শুরুতেই প্রাণশক্তির উৎস হিসেবে সূর্যের বন্দনা করেছেন। তারপর কবিতার মাঝামাঝি জায়গায় এসে মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ের কথা বলেছেন; আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে আমরা মৃত্যুমিছিল, অন্নের জন্য মানুষের হাহাকারের মাঝেও দিব্যি ভালো আছি। সূর্যালোক তার সমস্ত শক্তি দিয়েও মানুষের চেতনার অন্ধকারকে দূর করতে পারছে না। এই অন্ধকারময় পরিস্থিতিতে ‘সূর্যালোক মনোরম’ বলে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে প্রাপ্তির হাসি হাসে মধ্যবিত্ত, সুবিধাভোগী শ্রেণি তথা মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ। সূর্যালোক যেখানে নেই-ই, চতুর্দিকে নৈরাজ্যের ঘন অন্ধকার, তার মাঝে বসে নীতিভ্রষ্ট, তিমিরবিলাসী মধ্যবিত্ত নতুন ভোরের প্রত্যাশা করে, শুঁয়োপোকা যেমন তার চারপাশে গড়ে তোলে নিশ্চিন্ত আবরণ, স্বার্থপর মধ্যবিত্ত সমাজও তেমনই এক কৃত্রিম পরিবেশ নির্মাণ করে নিজের চারপাশে, যার অভ্যন্তরে শুধুই ‘মধ্যবিত্তমদিরতা’, আত্মকেন্দ্রিকতার আঁধার। বহির্জগতের বিপর্যয়, মানুষের ক্ষুধার্ত হাহাকার যে আবরণকে ভেদ করে মধ্যবিত্তের হৃদয়ে পৌঁছোয় না।
মন্বন্তরক্লীষ্ট এই সময়ে মানবিকতার সূর্যালোক বিলুপ্ত হয়ে ঘনিয়ে উঠেছিল লোভ-লালসা-স্বার্থপরতার তিমির। এই বেদনার্ত পরিবেশেও মধ্যবিত্ত হৃদয়হীন নাগরিক কোনো সমবেদনা অনুভব করেনি। যে সূর্যালোক তার চেতনার আলোকিত উৎস, প্রজ্ঞার আধার ছিল তা আজ অন্ধকারাচ্ছন্ন। কবিতার শেষাংশে কবি বলেছেন “সূর্যালোক প্রজ্ঞাময় মনে হ’লে হাসি”-যখন মানবিকতাবোধ নিঃশেষ হয়ে যায় তখন সূর্যালোককে ‘প্রজ্ঞাময়’ বলে প্রচার করা, মানবতা নিয়ে স্থূল বাণী ছড়ানো নিছকই কৌতুককর হয়ে ওঠে। কবি জীবনানন্দ দাশ এভাবেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বিদ্রুপের কশাঘাতে আহত করেছেন, সত্যের মুখোমুখি না হয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির গা-বাঁচানো মনোবৃত্তিকে আক্রমণ করতে চেয়েই তিনি বারবার এই কবিতায় সূর্যালোকের প্রসঙ্গ এনেছেন।
আরো পড়ুন : হলুদ পোড়া গল্পের প্রশ্ন উত্তর
আরো পড়ুন : হারুন সালেমের মাসি গল্পের প্রশ্ন উত্তর