হলুদ পোড়া গল্পের প্রশ্ন উত্তর (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়) ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা

সূচিপত্র

হলুদ পোড়া গল্পের প্রশ্ন উত্তর (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়) ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা | Holud Pora Golper Long Question Answer Class Twelve 4th Semester Bengali

হলুদ পোড়া গল্পের প্রশ্ন উত্তর
হলুদ পোড়া গল্পের প্রশ্ন উত্তর

১। …গাঁ-সুদ্ধ লোক যেন অপ্রস্তুত হয়ে রইল।” -গ্রামের লোকদের এই অপ্রস্তুত হওয়ার কারণ কাহিনি অবলম্বনে আলোচনা করো।

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পটিতে কার্তিক মাসের মধ্যভাগে তিনদিনের ব্যবধানে উল্লিখিত গ্রামটিতে দুটি খুনের ঘটনা ঘটেছিল। মধ্যবয়সি জোয়ান বলাই চক্রবর্তীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল গ্রামের দক্ষিণে ঘোষদের মজা পুকুরের ধারে একটা মরা গজারি গাছের তলায়। সম্ভবত লাঠির অনেকগুলি আঘাতে তার মাথাটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় খুনটি ছিল শুভ্রা নামে ষোলো-সতেরো বছরের একটি রোগা ভীরু মেয়ের। গ্রামের শেষ সন্ধ্যাবাতিটি যখন জ্বালা হয়েছে এরকম সময়ে বাড়ির পিছনের ডোবার ঘাটে গলা টিপে মেরে কেউ শুভ্রার মৃতদেহ ফেলে রেখে গিয়েছিল।

বলাই চক্রবর্তীর অপমৃত্যু গ্রামের লোকদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল না, অনেকের কাছে তা কাম্যও ছিল। কিন্তু শুভ্রার মৃত্যু নিয়ে হইচই কম হলেও গ্রামের মানুষের কৌতূহল এবং বিস্ময় এই ঘটনায় সীমাহীন ছিল। গৃহস্থ ঘরের সাধারণ মেয়ে, সকলের চোখের সামনেই তার বেড়ে ওঠা, বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল এবং মাসখানেক আগে বাবার বাড়িতে এসেছিল সন্তান প্রসব করার জন্য। এরকম একটি গৃহস্থ ঘরের সাধারণ মেয়ের এই পরিণতি গ্রামের লোকদের কাছে অকল্পনীয় ছিল। তার মতো একটি মেয়ের জীবনে খাপছাড়াভাবে লুকানোর মতো কিছু আছে, যা এরকম ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনতে পারে; তা এমনকি পাশের বাড়ির মেয়েটির কাছেও অকল্পনীয় ছিল। সেই কারণেই শুভ্রার মৃত্যুতে গ্রামসুদ্ধ লোকেরা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল।

২। “…নানাজনের কল্পনা ও অনুমানগুলি গুজব হয়ে উঠতে উঠতে মুষড়ে যায়।” -যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা হয়েছে তা আলোচনা করো।

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পটিতে কার্তিক মাসের মধ্যভাগে তিনদিনের ব্যবধানে গ্রামটিতে দুটি খুনের ঘটনা ঘটে যায়। মধ্যবয়সি জোয়ান বলাই চক্রবর্তীর অপমৃত্যু গ্রামের লোকদের কাছে অপ্রত্যাশিত না হলেও যোলো-সতেরো বছরের শুভ্রার খুন হওয়া সকলকে বিস্মিত করে। যে মেয়েটি সকলের চোখের সামনেই বেড়ে উঠেছে, সাধারণ গৃহস্থ ঘরের মেয়েদের মতো বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে এবং মাসখানেক আগে বাবার বাড়িতে এসেছিল সন্তান প্রসব করার জন্য, তার এই পরিণতি গ্রামের মানুষদের ভাবনার বাইরে ছিল। মেয়েটির জীবনে এমন কোনো গোপন ঘটনা থাকতে পারে যা তাকে এই ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে, তা এমনকি পাশের বাড়ির মেয়েটির কাছেও অকল্পনীয় ছিল। গ্রামের লোকেরা ভাবতে থাকে তাদের চোখের আড়ালে ‘এই ভয়ানক অঘটনের ভূমিকা’ গড়ে উঠেছিল কিনা। দুটি খুনের মধ্যে কোনো যোগাযোগ আছে কিনা তাও তাদের আলোচনার বিষয় হয়। যে গ্রামে এই ঘটনা ঘটেছিল সেখানে বিশ-ত্রিশ বছর কেউ সেভাবে জখম পর্যন্ত হয়নি। তাই পরপর এই দুটি খুনের মধ্যে যোগসূত্র আবিষ্কারের জন্য সকলে অধীর হয়ে ওঠে। দুজন নিহতের একজন পুরুষ এবং একজন যুবতি নারী হওয়ায় জল্পনা আরও দানা বাঁধে। কিন্তু বলাই চক্রবর্তী কবে শুভ্রাকে শুধু চোখের দেখা দেখেছে তাও গ্রামের কেউ মনে করতে পারেনি। সে কারণে কল্পনা ও অনুমানে ‘বাস্তব সত্যের খাদ’ মেশানো সম্ভব হয় না, গুজবগুলি তাই বেড়ে ওঠার আগেই মুষড়ে পড়ে।

২। “দামিনী আওয়াজ করতে লাগলো সেই রকম।” -দামিনী কে ছিল? ঘটনাটি উল্লেখ করো।

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পটিতে দামিনী ছিল বলাই চক্রবর্তীর ভাইপো নবীনের স্ত্রী।

বলাই চক্রবর্তী খুন হওয়ার পরে তার যাবতীয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় ভাইপো নবীন। শহরের চল্লিশ টাকার চাকরি ছেড়ে নবীন অতঃপর সপরিবারে গ্রামে এসে থাকতে শুরু করে। কাকার খুনিকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সে পুরস্কারও ঘোষণা করে। এরকম পরিস্থিতিতে তার একুশ দিন গ্রামে অতিবাহন হয়ে গেছে। একদিন তার স্ত্রী দামিনী যখন সন্ধ্যাবেলা লণ্ঠন হাতে রান্নাঘর থেকে উঠোন পার হয়ে শোওয়ার ঘরে যাচ্ছিল, সেই সময় খুব হালকা একটা দমকা বাতাস বাড়ির পুব কোণের তেঁতুল গাছের পাতা ছুঁয়ে তার গায়ে এসে লাগে। দামিনীর হাত থেকে লণ্ঠন ছিটকে গিয়ে পড়ে দক্ষিণের ঘরের বারান্দায়। উঠোনে ছিটকে পড়ে হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে দামিনী অজ্ঞান হয়ে যায়। আর এই সময়েই ঝোড়ো হাওয়া দালানের আনাচে-কানাচে যেমন গুমরে গুমরে কাঁদে, দামিনী সেরকম আওয়াজ করতে থাকে।

৩। “আমি তো পাস করা ডাক্তার নই….।” -মন্তব্যটির প্রসঙ্গ নির্দেশ করো। বক্তা সম্পর্কে কাহিনি থেকে যা জানা যায় নিজের ভাষায় লেখো।

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পতে নবীনের স্ত্রী দামিনীর গায়ে বাতাস লাগে। দামিনীর হাত থেকে লণ্ঠন ছিটকে গিয়ে পড়ে দক্ষিণের ঘরের বারান্দায়। উঠোনে ছিটকে পড়ে হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে দামিনী অজ্ঞান হয়ে যায়। আর এই সময়েই ঝোড়ো হাওয়া দালানের আনাচে-কানাচে যেমন গুমরে গুমরে কাঁদে, দামিনী সেইরকম আওয়াজ করতে থাকে। শুভ্রার দাদা ধীরেন পাস না করা হলেও গ্রামের একমাত্র ডাক্তার। তাকেই ডেকে আনা হয় দামিনীর চিকিৎসার জন্য। দামিনী তখন অর্থহীন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, আপনমনে হাসছে-কাঁদছে, যারা তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছিল তাদের আঁচড়ে কামড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। ধীরেন তাকে দেখে কিছুটা আত্মপ্রত্যয়ের অভাববোধ করে। বলে যে, সে চিকিৎসা করতে পারে কিন্তু যেহেতু সে পাস করা ডাক্তার না; তাই দায়িত্ব নিতে ভরসা পাচ্ছে না। শা’পুরের কৈলাশ ডাক্তারকে ডাকার পরামর্শও সে দিয়েছিল।

ধীরেন ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে বিএসসি পাস করে সাত বছর গ্রামের স্কুলে ভূগোল পড়ায়। প্রথম দিকে প্রবল উৎসাহের সঙ্গে সাতচল্লিশখানা বই নিয়ে লাইব্রেরি, সাতজন ছেলেকে নিয়ে তরুণ সমিতি, সাধারণ অসুখ-বিসুখে বই পড়ে বিনামূল্যে ডাক্তারি এইসব কাজে জুড়ে ছিল। কিন্তু একটি গ্রাম্য মেয়েকে বিয়ে করে দু-বছরে চারটি ছেলেমেয়ের জন্ম হওয়ার পরে তার উদ্যমে ঘাটতি এসেছে। তার লাইব্রেরির বইয়ের সংখ্যা তিনশোতে এসেই থেমে গিয়েছে। এখন সেই বইয়ের তালাবন্ধ লাইব্রেরি তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়েই থেকে গিয়েছে। বছরে দু-তিনবার তরুণ সমিতির মিটিং হয়। আর ডাক্তারির বিনিময়ে ধীরেন এখন চার-আনা আট-আনা ফি নেয়, ওষুধ বিক্রিও করে।

৪। “…তারা প্রায় সকলেই বুড়ো ঘোষালের কথায় সায় দিল।” -বুড়ো ঘোষাল কে ছিল? তার কথার যে নানারকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল নিজের ভাষায় লেখো।

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পের উল্লিখিত অংশে বুড়ো ঘোষাল বলতে গ্রামের বয়স্ক মানুষ পঙ্কজ ঘোষালকে বোঝানো হয়েছে।

নবীনের স্ত্রী দামিনী যখন সন্ধ্যাবেলা লণ্ঠন হাতে রান্নাঘর থেকে উঠোন পার হয়ে শোওয়ার ঘরে যাচ্ছিল সেই সময় খুব হালকা একটা দমকা বাতাস বাড়ির পুব কোণের তেঁতুল গাছের পাতা ছুঁয়ে তার গায়ে এসে লাগে। দামিনীর হাত থেকে লণ্ঠন ছিটকে গিয়ে পড়ে দক্ষিণের ঘরের বারান্দায়। উঠোনে ছিটকে পড়ে হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে দামিনী অজ্ঞান হয়ে যায়। শুভ্রার দাদা ধীরেন পাস না করা হলেও গ্রামের একমাত্র ডাক্তার। তাকেই ডেকে আনা হয় দামিনীর চিকিৎসার জন্য। কিন্তু দামিনীকে দেখে ধীরেন বলে যে, সে চিকিৎসা করতে পারে কিন্তু যেহেতু সে পাস করা ডাক্তার না; তাই দায়িত্ব নিতে ভরসা পাচ্ছে না। শা’পুরের কৈলাশ ডাক্তারকে ডাকার পরামর্শও সে দিয়েছিল। এই আবহে পঙ্কজ ঘোষাল মন্তব্য করে যে, দামিনীর অসুখে ডাক্তারে কোনো লাভ হবে না। তিনি নবীনকে পরামর্শ দেন কুঞ্জ গুনিনকে অবিলম্বে ডেকে পাঠানোর জন্য। সেখানে উপস্থিত গ্রামের লোকেরা ঘোষালকে সমর্থন করে। নবীন কুঞ্জর পারিশ্রমিকের খোঁজ করে। কিন্তু ধীরেন তীব্র আপত্তি জানায়। নবীনের মতো একজন লেখাপড়া জানা জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি যেন কুঞ্জ গুনিনে ভরসা করার মতো ‘দুর্বুদ্ধি’ না করে, সে বিষয়ে ধীরেন তাকে সচেতন করে দেয়। নবীন পালটা যুক্তি হিসেবে বলে যে ‘খাপছাড়া অসুখে’ গুনিনদের চিকিৎসাতেই ভালো ফল পাওয়া যায়।

শেষপর্যন্ত অবশ্য সহপাঠী ধীরেনকেও সে এড়াতে পারে না। নবীন কৈলাশ ডাক্তার এবং কুঞ্জ দুজনকে আনতেই লোক পাঠিয়ে দেয়।

৫। “কুঞ্জ মাঝির সাথে তো চালাকি চলবে না।” -কোন্ প্রসঙ্গে বক্তা এ কথা বলেছে? নিজের বক্তব্যের সমর্থনে কুঞ্জ যা যা করেছিল তার বর্ণনা দাও।

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পে নবীনের স্ত্রী দামিনী যখন সন্ধ্যাবেলা লণ্ঠন হাতে রান্নাঘর থেকে উঠোন পার হয়ে শোওয়ার ঘরে যাচ্ছিল সেই সময় খুব হালকা একটা দমকা বাতাস বাড়ির পুব কোণের তেঁতুল গাছের পাতা ছুঁয়ে তার গায়ে এসে লাগে। দামিনীর হাত থেকে লণ্ঠন ছিটকে গিয়ে পড়ে দক্ষিণের ঘরের বারান্দায়। উঠোনে ছিটকে পড়ে হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে দামিনী অজ্ঞান হয়ে যায়। পঙ্কজ ঘোষালের পরামর্শ মতো নবীন ডেকে আনে কুঞ্জ গুনিনকে। ‘নামকরা’ গুনিন কুঞ্জ দামিনীকে প্রথম দর্শনেই নিশ্চিত হয়ে যায় ভরসন্ধ্যায় তাকে অশরীরী ভর করেছে এবং সহজে। ছাড়বেন না। সেই সঙ্গেই অভয় দেয় যে, শেষ অবধি দামিনীকে ছেড়ে যেতেই হবে। এই প্রসঙ্গেই সে উল্লিখিত মন্তব্যটি করে।

ঘরের দাওয়া থেকে প্রথমেই সকলকে উঠোনে নামিয়ে দেওয়া হল। তারপর কুঞ্জ মন্ত্র পড়তে পড়তে বারান্দায় জল ছিটিয়ে দিল। দামিনীর এলোচুল এমনভাবে দাওয়ার একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হল যে সে না পারল বসতে, না পালানোর উপায় থাকল। চুলে টান লেগে দামিনী ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলে ধীরেন বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তা গুরুত্ব পায় না। উপস্থিত মানুষেরা মুগ্ধ বিস্ময়ে কুঞ্জর কার্যকলাপ দেখতে থাকে। কুঞ্জ নানাদিকে ঘুরে ঘুরে দুর্বোধ্য মন্ত্র পড়তে থাকে। মালসাতে আগুন করে তাতে শুকনো পাতা আর শিকড় পোড়াতে থাকে। একসময়ে দামিনীর ছটফটানি কমে আসতে আসতে সে নিস্পন্দ হয়ে যায়। কুণ্ডু জানতে চায় তার পরিচয়। দামিনীর কাছ থেকে উত্তর আসে যে সে খুন হয়ে যাওয়া শুভ্রা। এবং পুনরায় কোনো প্রশ্ন করার আগেই শুভ্রা উত্তর দেয় যে বলাই চক্রবর্তী তাকে খুন করেছে। কুঞ্জর অভিপ্রায় এভাবে সফল হয়।

৬। “…. শুধু আছে তীব্র উত্তেজনা এবং কৌতূহল-ভরা পরম উপভোগ্য শিহরণ।” যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লেখক এ কথা বলেছেন নিজের ভাষায় লেখো।

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পে গায়ে বাতাস লেগে অসুস্থ হয়ে পড়া দামিনীকে সুস্থ করে তুলতে পঙ্কজ ঘোষালের পরামর্শে ডেকে আনা হয়েছিল নামকরা কুঞ্জ গুনিনকে। তার গুণপনা দেখার লোভে বহু মানুষ সেখানে ভিড় করেছিল। লেখকের ভাষ্যে অন্তত তিরিশ-পঁয়ত্রিশজন পুরুষ ও নারী এবং গোটা পাঁচেক লণ্ঠন জড়ো হয়েছিল। তার মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা খুব কম এবং কমবয়সি মেয়েদের সেখানে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো মানুষগুলি দাওয়ায় গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে থাকে। দামিনীর উপরে ভর করা অশরীরী তাড়ানোর জন্য কুঞ্জর ক্রিয়াকর্ম প্রায় অত্যাচারের পর্যায়ে চলে গেলে ধীরেন তীব্র আপত্তি জানায়। কিন্তু উপস্থিত জনতার ‘দুর্লভ রোমাঞ্চ’ গ্রহণের আকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করার কোনো ক্ষমতা দামিনীর স্বামী নবীনের ছিল না। নবীনের বাড়ির দাওয়াটি যেন হয়ে উঠেছে মঞ্চ। আর সেখানে জ্ঞানবুদ্ধির অতীত রহস্যকে সহজবোধ্য নাটকের রূপ দিয়ে অভিনয় করা হচ্ছিল। কুঞ্জ যেন সেখানে আমদানি করেছে ‘জীবনের শেষ সীমানার ওপারের ম্যাজিক’। দামিনীর মধ্যে অশরীরী আত্মার আবির্ভাব তখন সকলের কাছেই যেন অতিবাস্তব এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক। উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে তখন আর কোনো ভয়ের অনুভূতি নেই, পরিবর্তে আছে শুধুই ‘তীব্র উত্তেজনা এবং কৌতূহল-ভরা পরম উপভোগ্য শিহরণ’।

৭। “দামিনীর মুখ দিয়ে এছাড়া আর কোন জবাব বার হল না…” দামিনীর মুখ দিয়ে কোন্ জবাব বের হয়েছিল? ঘটনাটি উল্লেখ করো।

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পে দামিনী একমাত্র যে জবাব দিয়েছিল তা হল সে চাটুজ্যে বাড়ির শুভ্রা, এবং বলাই চক্রবর্তী তাকে খুন করেছে।

বাতাস লেগে আকস্মিকভাবে নবীনের স্ত্রী দামিনী অসুস্থ হয়ে পড়লে কুঞ্জ গুনিনকে ডেকে আনা হয় তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য। কুঞ্জ প্রথম দর্শনেই দামিনীর মধ্যে অশরীরী আত্মার অনুপ্রবেশ লক্ষ করে। অতঃপর বারান্দা থেকে সকলকে নামিয়ে সেখানে জল ছিটিয়ে মন্ত্র পড়তে পড়তে দামিনীর এলোচুল দাওয়ার একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর নানাদিকে ঘুরে ঘুরে কুঞ্জ দুর্বোধ্য মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকে এবং মালসাতে আগুন করে তাতে শুকনো পাতা আর শিকড় পোড়াতে থাকে। চামড়ার মতো উৎকট গন্ধে চারপাশ ভরে যায়। ধীরে ধীরে দামিনীর আর্তনাদ এবং ছটফটানি কমে আসে। খুঁটিতে পিঠ ঠেকিয়ে কাঠের মতো সোজা দাঁড়িয়ে সে অর্ধ-উন্মীলিত চোখে কুঞ্জর দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে কুঞ্জ তার নাকের কাছে ধরে। দামিনীর প্রায় বুজে আসা চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। কুঞ্জ অশরীরীর কাছে জানতে চায় তার পরিচয়। উত্তর আসে যে সে খুন হয়ে যাওয়া শুভ্রা। পঙ্কজ ঘোষাল কুঞ্জকে প্রশ্ন করতে বলেন যে কে তাকে খুন করেছে। কিন্তু সেই প্রশ্ন করার আগেই দামিনী উত্তর দেয় যে বলাই চক্রবর্তী তাকে খুন করেছে। নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকবার প্রশ্ন করার পরেও অন্য কোনো উত্তর তার কাছ থেকে পাওয়া যায় না। তারপরে একসময় তার কথা বন্ধ হয়ে যায়, নাকে হলুদ পোড়া ধরেও তাকে আর কথা বলানো যায় না।

৮। “ব্যাখাটা দেওয়া উচিত ছিল কুঞ্জ গুণীর।” -কোন্ প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছে? কুঞ্জ কী কথা বলেছিল? 

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পে কুঞ্জ গুনিনের তন্ত্রমন্ত্রের প্রয়োগে দামিনী স্বীকার করে যে সে শুভ্রা, অর্থাৎ খুন হয়ে যাওয়া শুভ্রা চক্রবর্তীর অশরীরী আত্মা ভর করেছে দামিনীকে। এবং আরেক খুন হয়ে যাওয়া চরিত্র বলাই চক্রবর্তী তাকে খুন করেছে। কাছাকাছি সময়ে দুটি খুন হওয়ায় গ্রামের লোকেরা দুটি খুনের সম্পর্ক আবিষ্কারে ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যাটি ছিল বলাই চক্রবর্তীর মৃত্যু ঘটেছিল শুভ্রা মারা যাওয়ার তিন দিন আগে। এই সমস্যার সমাধান করে দিয়েছিল প্রবীণ পঙ্কজ ঘোষাল। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে, জ্যান্ত মানুষই শুধু মানুষের গলা টিপে মারে না, শ্মশানে-মশানে বিশেষ তিথি-নক্ষত্রে ‘পথভোলা পথিক’-দের ঘাড় মটকে দেয়। অর্থাৎ বলাই চক্রবর্তীর আগে মৃত্যু ঘটলেও তার দ্বারা যে শুভ্রাকে হত্যা করা সম্ভব সেটাই পঙ্কজ বোঝাতে চায়। এই প্রসঙ্গেই মন্তব্যটি করা হয়েছে।

পঙ্কজ ঘোষাল যেভাবে শুভ্রার মৃত্যুর সঙ্গে বলাই চক্রবর্তীর যোগসূত্র তৈরি করেছিল, লেখকের ভাষ্যে তা আসলে করার কথা ছিল কুঞ্জ গুনিনের। কারণ অশরীরী আত্মার দামিনীর উপরে ভর করার ধারণা সেই দিয়েছিল। এখন পঙ্কজ ঘোষালের বক্তব্যকে সমর্থন করা ছাড়া নিজের মর্যাদা বাঁচানোর জন্য তার অন্য কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু কথাটাকে সে বলল একটু অন্যভাবে। সে বলল যে, বলাই চক্রবর্তী শুভ্রাকে খুন করেছে কিন্তু সোজাসুজি নিজে নয়। কারণ মরার একবছরের মধ্যে সেটা কেউ করতে পারে না। ওই সময়ের মধ্যে শ্রাদ্ধশান্তি না হলে একমাত্র তখনই সরাসরি সে মানুষের ক্ষতি করতে পারে। কুঞ্জর মতে বলাই চক্রবর্তী একজনকে ভর করে তার মধ্যস্থতায় শুভ্রাকে খুন করেছে সেই ব্যক্তির রক্তমাংসের হাত দিয়ে।

৯। “একমাত্র এই ভাবনা তাকে অন্যমনস্ক করে দেয়।” কার কথা বলা হয়েছে? যে পরিপ্রেক্ষিতে তার এই মানসিক অবস্থা তা নিজের ভাষায় লেখো।

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পের উল্লিখিত অংশে ধীরেন চাটুয্যের কথা বলা হয়েছে।

পঙ্কজ ঘোষাল বলেছিল যে, মরা মানুষ অর্থাৎ অশরীরীও মানুষের গলা টিপতে পারে। আর কুঞ্জ গুনিন বলে যে, বলাই চক্রবর্তী শুভ্রাকে খুন করেছে কিন্তু সোজাসুজি নিজে নয়। কারণ মরার একবছরের মধ্যে সেটা কেউ করতে পারে না। ওই সময়ের মধ্যে শ্রাদ্ধশান্তি না হলে একমাত্র তখনই সরাসরি সে মানুষের ক্ষতি করতে পারে। কুঞ্জর মতে, বলাই চক্রবর্তী একজনকে ভর করে তার মধ্যস্থতায় শুভ্রাকে খুন করেছে সেই ব্যক্তির রক্তমাংসের হাত দিয়ে। এইসব কথা অনেক কান ঘুরে পরদিন সকালে পৌঁছে যায় শুভ্রার দাদা ধীরেনের কানে। এবং ধীরেনের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া হয়। অগ্রহায়ণের উজ্জ্বল মিঠে রোদ তখন চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। বর্ষার পরিপুষ্ট গাছে আর আগাছার জঙ্গলে ‘পার্থিব জীবনের ছড়াছড়ি’। বাড়ির পিছনের ডোবাটি গাঢ় সবুজ কচুরিপানায় ঢাকা। তালগাছের গুঁড়ির ঘাটটি জল কমে অর্ধেকের বেশি ভেসে উঠেছে। তালকাঠের টুকরো দিয়ে ধাপগুলি ধীরেন সাত মাসের গর্ভবতী শুভ্রার ওঠানামার সুবিধার জন্যই তৈরি করে দিয়েছিল। পাড়ার লোকের ছড়ানো গুজব ধীরেনকে ক্ষুব্ধ করেনি বরং শুভ্রার খুনি কোন্দিক থেকে কীভাবে এবং কেন ঘাটে এসেছিল তা ধীরেন ভেবে যেতে থাকে এবং সেই ভাবনা তাকে অন্যমনস্ক করে দেয়।

১০। “সে যেন বাইরের কোনো বিশিষ্ট অভ্যাগত…।” -কে, কার সম্পর্কে এ কথা ভেবেছে? তার যে মনোভাবের প্রকাশ এখানে ঘটেছে আলোচনা করো।

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পের উল্লিখিত অংশে ধীরেন তার নিজের সম্পর্কেই এরকম ভেবেছিল।

বোন শুভ্রার মৃত্যু দাদা হিসেবে ধীরেনকে স্বাভাবিকভাবেই বিচলিত করেছিল। তালকাঠের টুকরো দিয়ে বাড়ির পিছনের ডোবার ঘাটের ধাপগুলি ধীরেন সাত মাসের গর্ভবর্তী শুভ্রার ওঠানামার সুবিধার জন্যই তৈরি করে দিয়েছিল। সেখানেই খুন হয়েছিল শুভ্রা। কার দ্বারা কেন শুভ্রা খুন হয়েছিল, কীভাবে কোন্দিক থেকে খুনি এসেছিল-এইসব ভাবনা ধীরেনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তার উপরে বাড়তি মানসিক চাপ তৈরি হয় শুভ্রার খুনের সঙ্গে বলাই চক্রবর্তীর সম্পর্কের গুজবে। স্ত্রী শান্তি সেই বিষয় উপস্থাপন করতে চাইলে সে প্রবল বিরক্তি প্রকাশ করে। স্কুলে যাওয়ার পথে যাদের সঙ্গে দেখা হল তারা মুখে কিছু না বললেও সে উপলব্ধি করে যে, তাদের তাকানোর ভঙ্গিতে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তারা ধীরেনের মনোভাব জানতে চাইছে। পুরোহিত তাকে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে দোষমোচনের প্রয়োজনীয় ক্রিয়াকর্ম বিষয়ে পরামর্শ দিলেন, উপদেশ দিলেন স্কুল থেকে ফেরার সময় বাড়ির সকলের জন্য মাদুলি নিয় যেতে। এবং স্কুলে গিয়ে তার অভিজ্ঞতা আরও অদ্ভুত হল। তার ‘সাত বছরের অভ্যস্ত অস্তিত্ব’-এর সঙ্গে কেউ যেন তাকে মেলাতে পারছে না। ছাত্ররা ক্লাসে হয় আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে, অথবা নিজেদের মধ্যে নীচুস্বরে কথাবার্তা বলছে। নিজেকে ধীরেনের মনে হয় সে যেন স্কুলে কোনো অভ্যাগত, স্কুল পরিদর্শন করতে এসেছে।

১১। “…অথবা এমন ঝাঁকি লেগে তার চিন্তা ও অনুভূতি বদলে যায়।” -কার সম্পর্কে এ কথা বলা হয়েছে? এর কী নিদর্শন গল্পে পাওয়া গিয়েছে?

উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ গল্পের উল্লিখিত অংশে ধীরেন চাটুয্যের কথা বলা হয়েছে।

বোন শুভ্রার মৃত্যু এবং তারপরে সেই খুনের সঙ্গে আর-এক খুন হওয়া ব্যক্তি বলাই চক্রবর্তীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ইত্যাদি ধীরেন চাটুয্যের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। তার চিন্তা ও অনুভূতির আকস্মিক পরিবর্তনে ধীরেনের চেতনাজগতে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। শুভ্রার মৃত্যুর ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্কুলের হেডমাস্টার ধীরেনকে একমাসের ছুটি নিতে বলেন এবং জানিয়ে দেন যে স্কুলের সেক্রেটারি মথুরবাবু ছুটি অনুমোদন করে দিয়েছেন। ধীরেন প্রাথমিকভাবে এ কথা শুনে অবাক হয়। মথুরবাবুর সঙ্গে দেখা করার কথাও ভাবে। কিন্তু চেতনার ‘ঝাঁকি’ তাকে অন্যভাবনায় নিয়ে যায়। একমাসের ছুটিতে মথুরবাবুর সঙ্গে দেখা করার অনেকসময় সে পাবে কিন্তু এখনই সেখানে না যাওয়া ভালো বলে তার মনে হয়। কারণ মথুরবাবুর যদি দয়া হয় এবং তার বোনের খুনের পিছনে যে কেলেঙ্কারির চর্চা হচ্ছে তা কাল্পনিক বলে যদি তিনি বুঝতে পারেন তাহলে তিনি হয়তো ছুটি বাতিল করে কাজে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে বসবেন। সেটা ধীরেনের পক্ষে ‘মুশকিল’ হবে। কারণ ধীরেন উপলব্ধি করতে পেরেছে যে প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে ছেলে পড়ানোর ক্ষমতা তার আর নেই। চেনা মানুষদের সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয়ে ধীরেন মাঠের পথ ধরে বাড়ি যেতে থাকে। এভাবে মনোজগতের এক বিপুল পরিবর্তন তার মধ্যে লক্ষ করা যায়।

আরো পড়ুন : ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়গুলির শ্রেণিবিভাগ MCQ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment