ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্য:
ছোটোগল্পের শুরু যেমন আকস্মিকভাবে-মাঝখান থেকে তেমনই তার সমাপ্তি ও মাঝপথে, একান্ত নাটকীয়ভাবে, অতৃপ্তিতে।
ছোটোগল্পে জীবনের খণ্ডচিত্র বর্ণিত হয়, এবং সেই খণ্ডচিত্রের মধ্যেই পাঠক উপলব্ধি করেন সমগ্রের ব্যঞ্জনা।
স্বল্প আয়তনে ছোটোগল্পের আয়োজন বাহুল্যবর্জিত।
ছোটোগল্পের ভাষা ব্যঞ্জনাধর্মী, সংকেতময়, শিল্পিত ও সংক্ষিপ্ত।
ছোটোগল্প হল একমুখী-তার একটিমাত্র সামগ্রিক বক্তব্য।
ছোটোগল্প সংক্রান্ত প্রশ্ন ও উত্তর
১। বাংলা ছোটোগল্পের ধারায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটোগল্পসমূহের শিল্পগুণ বিচার করো।
ভূমিকা: রবীন্দ্র পরবর্তী কথাসাহিত্যের ধারায় এক মহাবিস্ময় প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ‘অতসী মামি’ গল্পের মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যাকাশে তাঁর আবির্ভাব। স্বয়ং গল্পকার একে ‘রোমান্সে ঠাসা অবাস্তব কাহিনি’ বলেছেন।
গল্পবুননশৈলী: নরনারীর পারস্পরিক সম্পর্ককে মানিক জৈবিক প্রবৃত্তি, জটিল মনস্তত্বের আলোয় বিবৃত করেছেন। মানুষের যে মন অবচেতনের অন্ধকারে নিমগ্ন- মানুষের আচরণের নিয়ন্ত্রকরূপে তারই ব্যাখ্যা করতে চাইলেন লেখক। প্রাগৈতিহাসিক গল্পে মানুষের মনের গহন অন্ধকারের প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন এবং তুলে এনেছেন আদিম প্রবৃত্তির গভীর তত্ত্বকথা। নৃশংস ডাকাত ভিখু এই গল্পের নায়ক।
সভ্যতার মুখোশ খুলে তার বিকৃত ও বিকারগ্রস্ত রূপটিকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চিত্রিত করেছেন ‘সরীসৃপ’ গল্পে। আবার বন্ধমূল সংস্কার কীভাবে মানবজীবনের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে-তার উজ্জ্বল উদাহরণ ‘টিকটিকি’ ও ‘হলুদ পোড়া’ গল্প দুটি।
কালের প্রভাব: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘শিল্পী’ গল্পটির মধ্য দিয়ে তাঁতশিল্পী মদনের শিল্পীসত্তার দ্বন্দ্বসংকটকে সুন্দরভাবে উপস্থাপিত করেছেন। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তেভাগা আন্দোলনকে নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারানের নাতজামাই’ ও ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ গল্প দুটি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
ফ্রয়েডীয় প্রভাব: মানুষের জীবনের দ্বন্দ্বমুখর জীবনচিত্র এবং ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব বাত্ময় হয়ে উঠেছে গল্পকারের একাধিক গল্পে। যেমন- ‘সর্পিল’ গল্পে ধর্মান্ধ শঙ্করের স্ত্রী কেতকীর দাম্পত্যের অসুখ তার জীবনে এনেছে দ্বিতীয় পুরুষকে, যা বিপর্যয় এনেছে শঙ্কর কেতকীর দাম্পত্যজীবনে।
মূল্যায়ন: বাংলা ছোটোগল্পের প্রবহমানতায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এমন এক শিল্পী, যিনি জীবনকে দেখেছেন নির্মোহ বাস্তবের দৃষ্টিকোণ থেকে। তত্ত্বকথার আলোকে তাঁর চরিত্রগুলি উঠে আসেনি, বরং বাস্তবসম্মত চরিত্রগুলির মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে মানবসত্যের শাশ্বতবাণী।
২। বাংলা ছোটোগল্পের ধারায় কথাসাহিত্যিক তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা করো।
বাংলা কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায় পদবিধারী লেখক হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এঁদের অসামান্য অবদানের কথা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করতেই হয়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতি ও মানুষের অচ্ছেদ্য, অমলিন, শান্ত, সমাহিত সম্পর্কে মায়াজাল রচনা করেছেন। তাঁর রচনায় অনেক জটিল সমস্যা সত্ত্বেও মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার মাধ্যমে কিছুটা নিরাসক্ত ও উদার। তাঁর রচিত ‘পুঁইমাচা’, ‘মৌরীফুল’ গল্প দরিদ্র গ্রামবাসীর জীবন-আখ্যান।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়: তারাশঙ্কর ডুব দিয়েছেন মানবজীবনের কঠিন রুক্ষতায়। বিরাট পটভূমিতে বৃহত্তর জীবনকে দেখা ও তার জটিল চেহারাকে ফুটিয়ে তোলায় তিনি তুলনারহিত। রুক্ষ রাঢ় অঞ্চলের কঠিন প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন তিনি। ‘নারী ও নাগিনী’, ‘অগ্রদানী’, ‘তারিণী মাঝি’ ইত্যাদি ছোটোগল্পে মানুষের জৈবনিক প্রবৃত্তি চিত্রিত করেছেন গল্পকার।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় ধরা পড়েছে মার্কসীয় চেতনার প্রতিফলন। একই সঙ্গে যৌনতা, মনোবিকার, জটিল মনস্তত্ত্বকে রহস্যময় করে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর কথাসাহিত্যে। ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘সরীসৃপ’, ‘শিল্পী’ ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত ছোটোগল্প।
এইভাবে বাংলা কথাসাহিত্যের সমৃদ্ধির জন্য উক্ত তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ই যে স্বমহিমায় স্মরণীয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাংলা ছোটোগল্পের ধারায় পরশুরামের অবদান আলোচনা করো।
আধুনিক বাংলা হাস্যরসের ধারায় কথাশিল্পী পরশুরাম অর্থাৎ রাজশেখর বসু অনবদ্য। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিদগ্ধ রসিক সমাজ এক বিস্ময়কর প্রতিভার সন্ধান পেলেন। সাহিত্যরচনাকে পরশুরাম ব্রতপালনের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
গল্পগ্রন্থ: পরশুরাম উপন্যাস রচনা করেননি। ছোটোগল্পের মধ্যেই তাঁর সৃষ্টিলীলা সংহত রেখেছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থের সংখ্যা ৯টি- ‘গড্ডলিকা’ (১৯২৪), ‘কঞ্জলী’ (১৯২৭), ‘হনুমানের স্বপ্ন’, ‘গল্পকল্প’, ‘ধুস্তরীমায়া’, ‘কৃয়কলি’, ‘নীলতারা’, ‘আনন্দীবাঈ’, ‘চমৎকুমারী’।
অবদান: রসায়নশাস্ত্রের সঙ্গে কর্মসূত্রে জড়িত হওয়ায় নিজের রচনায় তিনি এমন চমক সৃষ্টি করেন যে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসু হয়েছেন। ধর্মের নামে অপ্রত্যাশিত লাভের লোভ দেখিয়ে দশ লক্ষ টাকা মূলধনের কোম্পানি খুলে ভেড়ার পালকে প্রবঞ্চিত করার কলাকৌশল ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’-এর বিষয়বস্তু। আদ্যোপান্ত কৌতুক হাস্যের সুন্দর উদাহরণ ‘লম্বকর্ণ’। সামাজিক স্যাটায়ারের চরমোৎকর্ষ ঘটে ‘ভূশন্ডীর মাঠে’ গল্পে। ‘কজ্জলী’-র প্রথম গল্প ‘বিরিঞ্চিবাবা’-তে ভণ্ড সাধুবাবাদের প্রতিনিধি বিরিঞ্চিবাবার পর্বতপ্রমাণ প্রবঞ্চনা ধরিয়ে দিয়ে পরশুরাম বিমূঢ় সমাজের চোখ খুলে দিলেন। ‘উলটপুরাণ’ গল্পটি উদ্ভট পরিকল্পনার উদ্ভাস। পরশুরাম রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য পুরাণাদি থেকেই গল্পের উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। ‘গল্পকল্প’ থেকেই পরশুরাম সাধুভাষা পরিত্যাগ করে চলিতভাষা গ্রহণ করেছেন। পরশুরামের ব্যঙ্গাত্মক রচনা কোনোদিনই ব্যক্তিগত অসূয়ায় পরিণত হয়নি। পরশুরাম হাস্যরসের ক্ষেত্রে সার্বভৌম শিল্পী-এ কথা অনস্বীকার্য।
৩। ছোটোগল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্রের কৃতিত্বের মূল্যায়ন করো।
কল্লোলকালের বিশিষ্ট লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র উপন্যাস অপেক্ষা ছোটোগল্প রচনায় অধিক কৃতিত্ব দাবি করেন।
অবদান: তিনি গল্প লেখা শুরু করেন ১৯২৪ সালে। বিশিষ্ট গল্পগ্রন্থ হল- ‘বেনামী বন্দর’, ‘পুতুল ও প্রতিমা’, ‘মৃত্তিকা’, ‘ধূলিধূসর’, ‘মহানগর’ ইত্যাদি। তাঁর প্রথম গল্প ‘শুধু কেরানী’ ১৩৩০-এর চৈত্র সংখ্যা ‘প্রবাসী’-তে প্রকাশিত হয়। এই গল্পে কেরানি জীবনের দহন, অপ্রাপ্তির জ্বালা এবং বাস্তব জীবনের নিদারুণ যন্ত্রণা স্থান পেয়েছে। ‘পুন্নাম’ গল্পে বাৎসল্যের মধ্যেও নৈরাশ্য এবং ভীষণ আত্মপ্রবঞ্চনার পরিচয় আছে। ‘হয়তো’ ও ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে’ গল্পের প্রথমটিতে অস্থিরতা, অসংগতি এবং পরেরটিতে এক অসহায় নারীর জীবনকথা বর্ণিত। ‘চুরি’ গল্পে শিক্ষকজীবনের দুঃখকষ্ট বর্ণিত। দারিদ্র্য যে নীতি ও আদর্শনিষ্ঠ মানুষকেও পথভ্রষ্ট করে তার পরিচয় আছে ‘সংসার সীমান্তে’ ও ‘মহানগর’ গল্পে। জীবন যে কত অসহায় এবং মানুষকে বাঁচার অভিপ্রায়ে, যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত জীবন বেছে নিতে হয়, তার পরিচয় আছে এই দুটি গল্পে।
তাঁর খ্যাতি মূলত মনস্তাত্ত্বিক গল্পরচনার মধ্যে। ‘শৃঙ্খল’, ‘স্টোভ’, ‘ভূমিকম্প’ প্রভৃতি গল্পে মনোবিকলন ও বর্তমান জীবনসংকট নিপুণভাবে আঁকা। রোমান্টিক ভাবনা এবং মনস্তাত্ত্বিক রহস্যজালের যথার্থ পরিচয় আছে ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পে। মূল্যবোধের ক্ষয়, নীতি ও আদর্শভ্রষ্ট জীবনের প্রতি আসক্তি এবং আত্মযন্ত্রণার দহনে দগ্ধ হওয়ার রূপময় বিন্যাস তাঁর গল্পের সম্পদ। কাহিনির এইরূপ অভিনব উপস্থাপনায় প্রেমেন্দ্র মিত্র বাংলা ছোটোগল্পে সমাদৃত হয়ে থাকবেন।
৪। ছোটোগল্পকার হিসেবে বনফুলের সার্থকতা আলোচনা করো।
ছোটোগল্পকার বনফুল: ছোটোগল্পকার হিসেবে বনফুল মানবজীবনের বহুরূপী রূপকেই প্রকাশ করেছেন। সুন্দর-কুৎসিত, উদার-নীচ, আত্মসুখ- পরার্থপরতা-বনফুল মানুষের জীবনকে তার যথাযথ মূল্যে সাহিত্যে রূপায়িত করেছেন।
বনফুলের জীবনদর্শনটিকে বোঝানোর জন্য ‘মানুষ’ গল্পটি উল্লেখ্য। দাম্পত্যজীবনের ট্র্যাজেডি এক পক্ষে অত্যন্ত শোকাবহ ও অন্যপক্ষে হাস্যকর ও হয়ে উঠেছে ‘অদ্বিতীয়া’ গল্পে।
বনফুলের ডাক্তারি জীবনের অভিজ্ঞতার রসে জারিত গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখ্য- ‘নাথুনির মা’, ‘ত্রিফলা’, ‘সুরবালা’, ‘গণেশজননী’ ইত্যাদি। বনফুলের সমাজসমস্যামূলক গল্পের মধ্যে উল্লেখ্য- ‘সনাতনপুরের অধিবাসীবৃন্দ’, ‘ঝুলন পূর্ণিমা’, ‘মাধব মুখুজ্জে’ প্রভৃতি।
মানুষের আচরণ ও ধ্যানধারণার স্বরূপ উদ্ঘাটনে বনফুল-এর সন্ধানী দৃষ্টি জীবনের নানান বিচিত্র দিক নিষ্ঠুর সত্যের আলোয় উজ্জ্বল করে তুলেছেন। আমাদের বীরপূজার মোহে আমরা যে নিরপেক্ষ বিচারশক্তিও হারিয়েছি তার উদাহরণ ‘নাম’ গল্পটি।
নকল ভদ্রতার মুখোশ খুলে দেখানোর কাজে ‘শ্রীপতি সামন্ত’ আর ‘ছোটলোক’ গল্প দুটি স্মরণীয়। ‘বুধনী’ গল্পে আদিম জৈব প্রবৃত্তির সর্বগ্রাসী প্রেমক্ষুধার প্রকাশ ঘটেছে। ‘ঐরাবত’ গল্পে প্রকৃতির প্রাণধর্মের বিজয় প্রকাশিত। ইন্দ্রিয়ের সর্বদ্বার রুদ্ধ করে চিত্ত নিরোধের পথে প্রাকৃতিক নিয়ম যে অতিক্রম করা যায় না, ব্রহ্মচারী ত্রিগুণানন্দের উদ্ভট জীবনে সেই সত্যই প্রকাশিত। ‘মানুষের মন’ গল্পে মানবরহস্যের চরম শিল্প প্রকাশ পেয়েছে। ছোটোগল্পে বনফুলের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি গল্পের রূপসৃষ্টিতে। বাংলায় ‘পোস্টকার্ড স্টোরি’ বা Five minutes স্টোরি কথনের তিনিই পুরোধাস্থানীয় সাহিত্যিক। গল্প আকারে কত ছোটো ও হালকা হয়ে জীবনের কত বৃহৎ ও গভীর সত্যকে প্রকাশ করা যায়, তার নমুনা বনফুলের ‘নিম গাছ’ গল্পটি। তাঁর ছোটোগল্পের রচনাশৈলীতে জীবনসত্যের স্বরূপসাধনাই তাঁর জীবনসাধনা।
৫। বাংলা ছোটোগল্পে আশাপূর্ণা দেবীর অবদান আলোচনা করো।
“উপন্যাস আমাকে অনেকটা প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে। তবু ছোটোগল্পের ওপরেই আমার পক্ষপাত।” কথাগুলি বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শিল্পী আশাপূর্ণা দেবীর। মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস, ভাগ্যবিড়ম্বনার বাস্তব চিত্র, জীবনের চড়াই-উৎরাইগুলিকে তিনি ঘড়ির কাঁটায় ধরে অতীত থেকে ভবিষ্যতের কালপ্রবাহে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ছোটোগল্পের ছোটোমুখে তিনি বড়োকথা শুনিয়েছেন। তাঁর প্রথম গল্প ‘পত্নী ও প্রেয়সী’ প্রকাশিত হয় ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায়।
বৈশিষ্ট্য: আশাপূর্ণার অগণিত গল্পের ভিড়ে শ্রেষ্ঠ গল্প ‘ছিন্নমস্তা’ ১৯৪৯-এ শারদীয়া আনন্দবাজারেই এটি প্রকাশিত হয়। চিরপরিচিত মধ্যবিত্ত বাঙালি অন্দরমহলের শাশুড়ি-বউমার দ্বন্দ্বের কাহিনি এটি। মা- বউয়ের প্রতিযোগিতার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে অবশেষে মৃত্যু হয় বিমলেন্দুর। আত্মসুখ আত্মপ্রতিষ্ঠার নির্মম পরিণতি পৌরাণিক আখ্যানের সঙ্গে মিলেমিশে গল্পের নামকরণকে সার্থক করে তুলেছে।
গল্পসম্ভার: এ ছাড়া সংসারের সামঞ্জস্যবিধানে নারী প্রতিমুহূর্তে কীভাবে অভিনেত্রী হয়ে ওঠে তার গল্প ‘অভিনেত্রী’। মধ্যবিত্ত সংসার, অভাব অনটনের বাস্তব চিত্র, পরিণতি, দাম্পত্য সমস্যা প্রকাশ পেয়েছে লেখিকার ‘অঙ্গার’, ‘ফাটল’ ইত্যাদি গল্পে। এ ছাড়া তাঁর ‘বস্তুক’, ‘স্বর্গের টিকিট’, ‘পরাজিত হৃদয়’, ‘আয়োজন’, ‘ছুটি নাকচ’, ‘বড়ো রাস্তা হারিয়ে’ বহু বিচিত্র জীবন-উপাখ্যান বলে চলে। সাদামাটা জীবনের অভিনব জীবনচিত্র লিখনে বাংলা ছোটোগল্পের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথাশিল্পী আশাপূর্ণা দেবী এ কথা বলাই বাহুল্য।
৬। বাংলা ছোটোগল্পের ধারায় সুবোধ ঘোষের অবদান আলোচনা করো।
কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ সম্পর্কে স্বয়ং মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন, “ছোটোগল্পের ক্ষেত্রে তিনি একটি নতুন দিগন্ত খুলেছেন।”
বৈশিষ্ট্য: জীবনবৈচিত্র্যের প্রতিচ্ছবিই সুবোধ ঘোষের গল্পরূপে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, আর্থসামাজিক দ্বন্দ্ব, ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ, অত্যাচার, মধ্যবিত্ত শ্রেণির দ্বিধান্বিত অবস্থান, রাশিয়ার নতুন সমাজব্যবস্থা, সাম্যবাদের লড়াই কালের এই দোলাচলতার মাঝেই ছোটোগল্পকার সুবোধ ঘোষের আত্মপ্রকাশ। তাঁর প্রথম গল্প উঠে এসেছে তাঁরই কনডাক্টর জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। ‘অযান্ত্রিক’- মানুষ আর যন্ত্রের, একালে কী গভীর সম্পর্ক তা-ই চিত্রিত হয়েছে এই গল্পে।
গল্পসম্ভার: সামন্ততন্ত্র ও বণিকতন্ত্রের দ্বন্দ্ব, সমাজে মধ্যবিত্তের স্বার্থান্বেষী গোত্রান্তর অর্থাৎ স্বভাবচরিত্রের পরিবর্তন ‘গোত্রান্তর’ গল্পের বিষয়বস্তু। শ্রমিক শোষণের ব্যাপারে সামন্ততন্ত্র ও বণিকতন্ত্র-এর যে কোনো ভেদ নেই- তারই নির্মম পরিণতি দেখা যায় ‘ফসিল’ গল্পে। সামন্ত শক্তির বিরোধিতা করে বণিকতন্ত্রের দাস হতে গিয়ে শ্রমিক দুলাল মাহাতো মৃত্যু ডেকে আনে নিজের। মানবসভ্যতার অবক্ষয়ের নির্মম সত্য প্রকাশিত হয়েছে উক্ত গল্পে।
এ ছাড়া লেখকের জটিল মনস্তত্ত্বের গল্প ‘সুন্দরম’, ‘গরল অমিয় ভেল’। আর্য-অনার্য সংঘাতের প্রেক্ষাপটে অনার্য লড়াই, ব্রিটিশ শক্তির খ্রিস্টধর্ম প্রচার, বীরসা মুন্ডার নেতৃত্ব, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের ঐতিহাসিক পটভূমিতে রচিত হয় স্টিফান হোরোর গল্প ‘চতুর্থ পাণিপথের যুদ্ধ’।
লেখকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘পরশুরামের কুঠার’গল্পে দেখা যায় নাগরিক সভ্যতার নাগপাশে জননীর বেশ্যায় পরিণত হওয়ার কাহিনি। প্রণয়মূলক আখ্যানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘জতুগৃহ’, ‘ঠগিনী’, ‘শুক্লাভিসার’। আদিবাসী সমাজের কৃষ্টি-সংস্কৃতি রূপায়িত হয়েছে ‘মহিংসী’ গল্পে।
বিষয়বৈচিত্র্যে, আর্থসামাজিক পটভূমির সুনিপুণ চিত্রণে, গহন মনের অনালোকিত দিকের প্রকাশে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনচিত্র রূপায়ণে সর্বোপরি আঙ্গিক বৈচিত্র্যে বাংলা ছোটোগল্পের ধারায় সুবোধ ঘোষ চিরসমুজ্জ্বল।
৭। বাংলা ছোটোগল্পে মহাশ্বেতা দেবীর অবদান আলোচনা করো।
মহাশ্বেতা দেবীর গল্পের চরিত্ররা কখনও উঠে আসে ইতিহাসের পাতা থেকে, কখনও তাঁর গল্প গিয়ে দাঁড়ায় শবর, ঘেরিয়া, মুন্ডা, সাঁওতালদের আদিবাসী পল্লির অরণ্যছায় নিভৃত নির্জনে-তাদের শোষণ-বঞ্চনার, বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্প শুনবে বলে-তাঁর গল্পে এসে পৌঁছোয় নতুন এক ভারতবর্ষ। তিনি বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাসের অনন্য কথাকার।
পর্ব বিভাজন: মহাশ্বেতা দেবীর প্রাথমিক পর্বের গল্পগুলিতে চিত্রিত হয়েছে নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কথা। পাশাপাশি অভিজাত ও উচ্চবিত্ত মানুষের অন্তঃসারশূন্যতা উঠে এসেছে তাঁর গল্পে। দ্বিতীয় পর্বের গল্পে উঠে এসেছে পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অন্ত্যজ, দলিত, প্রান্তিক মানুষেরা। জীবন ও শিল্পের অভিনব সমন্বয় ঘটেছে মহেশ্বেতা দেবীর গল্পে।
গল্পসম্ভার: মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনবৃত্ত, কখনও আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব, কখনও বা উমেদারি-চাটুকারিতার নিদর্শন পাওয়া যায় তাঁর ‘পরমাত্মীয়’, ‘ছায়াবাজি’ প্রভৃতি গল্পে। মনোবিকলনের ছবি ধরা পড়েছে লেখিকার ‘আত্মজা’ গল্পে। নিরন্ন, অভুক্ত মানুষের অতৃপ্ত ক্ষুধার কথা প্রকাশ পেয়েছে ‘জন্মতিথি’, ‘বাণ’, ‘ব্রাহ্মণ’, ‘ভাত’ প্রভৃতি গল্পে।
সামাজিক বৈষম্য, অসমবণ্টন, মূল্যবোধ অবক্ষয়ের জীবন্ত দলিল মহাশ্বেতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘স্তনদায়িনী’। মহাবিদ্রোহের আবহে রচিত হয়েছে ‘চম্পা’ গল্পটি। লোককাহিনিই উপস্থাপিত হয়েছে ‘বাঁয়েন’, ‘পিন্ডদান’ প্রভৃতি গল্পে।
মহাশ্বেতা দেবীর কথাসাহিত্যে ‘মা’ শব্দটি অজস্র বৈচিত্র্য নিয়ে এসেছে বারবার। ‘সাঁঝ সকালের মা’ গল্পেও দেখি গুণিন মা সারাদিন দেবী হয়ে যে চাল-ডাল-ফলমূল পায়, রাতে তাই দিয়ে ছেলেকে ভাত রেঁধে দেয়। আর সন্ধ্যা ও সকালেই ছেলের কেবল ‘মা’ ডাকের সুযোগ মেলে। স্বামী, সন্তান, পৌত্র হারিয়ে নিঃস্ব-অনাথ নারীর বলিষ্ঠ জীবনসংগ্রাম প্রকাশ পেয়েছে ‘বুদালী’ গল্পে।
এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের জন্য রচিত ‘গল্পের গরু ন্যাদোশ’ ‘ছেলেটা’, ‘রানার’, ‘বিড়ালের দেশে যাওয়া’ প্রভৃতি গল্প উল্লেখযোগ্য। উপসংহার: সাবলীল ভাষা, গল্পের পরতে পরতে মাটির স্পর্শ, বাস্তবানুগ সংলাপ, এমনকি ইতিহাস থেকে শুরু করে রাজনীতি সমাজনীতির সুনিপুণ চিত্রণ মহাশ্বেতা দেবীর ছোটোগল্পকে কালজয়ী করে তুলেছে।
৮। স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা পরবর্তীকালীন বাংলা ছোটোগল্পের গতিপ্রকৃতি আলোচনা করো।
গতিপ্রকৃতি আলোচনা: একের পর এক বিশ্বযুদ্ধ, দীর্ঘ দুশো বছরের পরাধীনতার গ্লানি, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব, ক্ষত এঁকে রাখল যে স্বাধীনতার বুকে, সেই পরম প্রত্যাশিত স্বাধীনতাও দেশকে সুস্থির হতে দেয়নি। উদ্বাস্তু সমস্যা, বেকারত্ব, খাদ্য-বস্ত্রের সংকট, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল আন্দোলন, মার্কসবাদ বাংলার রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে যে বদল এনেছিল-সেই বিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আবির্ভূত হলেন নতুন কালের কণ্ঠেরা। তাঁদের কলমে সাহিত্যে খোদিত হল এক নতুন ভারতবর্ষের ইতিহাস।
“‘কল্লোলে’র প্রথম মশালচী” রূপে মনীশ ঘটক যুবনাশ্ব ছদ্মনামে আত্মপ্রকাশ করলেন ‘গোষ্পদ’ গল্প নিয়ে। তাঁর ‘পটলডাঙার পাঁচালী’-র অন্ত্যজ-ব্রাত্য জীবনই যেন অনুরণিত হল পরবর্তীকালে কন্যা মহাশ্বেতার ‘ভাত’, ‘নুন’, ‘হারুন সালেমের মাসি’, ‘রুদালী’ প্রভৃতি গল্পে। সরোজ কুমার রায়চৌধুরীর ‘আধুনিক কপালকুণ্ডলা’ গল্পে বর্ণিত হয়েছে আধুনিক জীবনের অসংগতির রূপটি। আবার সৈয়দ মুজতবা আলী-র ‘চাচাকাহিনী’-তে চিত্রিত হয়েছে নাৎসিবাদ প্রভাবিত সমাজের নৈরাশ্য ও অস্থিরতার ছবি।
আধুনিক নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার কাহিনির পাশাপাশি আশাপূর্ণা দেবীর গল্পে চিত্রিত হল মধ্যবিত্ত জীবনের স্বপ্ন ও ইতিহাস। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাস্বরূপ, মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের অবক্ষয়, জটিল মনস্তত্ত্ব রাশিয়ার নতুন সমাজব্যবস্থার প্রতি শহুরে শিক্ষিত সমাজের আকর্ষণ ফুটে উঠল সুবোধ ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী প্রমুখ সাহিত্যিকদের গল্প। সমকালের ব্যতিক্রমী শিল্পী ছিলেন কমলকুমার মজুমদার। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের নানা বৃত্তির মানুষ তাদের জীবনের ও মননের নানা বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির হয়েছে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পে।
একদিকে ‘টেনিদার গল্প’-এ আবালবৃদ্ধবনিতার জন্য হাস্যরসের উপহার অন্যদিকে দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, কালোবাজারি, শ্রেণিবৈষম্য মানবমনের জটিলতা-কুটিলতা স্থান পেয়েছে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে। নারীজীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আশাভঙ্গের বেদনা লিপিবদ্ধ হয়েছে সাবিত্রী রায়, বাণী রায়ের গল্পে। অন্যদিকে, শোষিতের উত্থান ও শোষকের পরাজয়ের কথা নিয়ে এলেন কথাকার সোমেন চন্দ। ‘ইঁদুর’ তাঁর জনপ্রিয় একটি গল্প। মানুষের মনোজগতের নানা স্তর বিশ্লেষিত হয়েছে বিমল করের ‘ইঁদুর’, ‘নিষাদ’ ইত্যাদি গল্পে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে রচিত হয়েছে সমরেশ বসুর ‘আদাব’।
স্বাধীনতা উত্তরকালের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ একটি জীবন্ত দলিল।
স্বাধীনতা সমাজে মানবিক সম্পর্ক ও মূল্যবোধের যে পরিবর্তন সূচিত করছিল, তা-ই ঈষৎ বক্র ভাষাভঙ্গিমায় উঠে আসে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে। উদ্বাস্তু সমস্যায় জর্জরিত বাঙালির জীবনযন্ত্রণা চিত্রিত হয়েছে প্রফুল্ল রায়ের গল্পে। এ ছাড়া সমকালে গল্প বলার আঙ্গিকে অভিনবত্ব এনেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র দত্তরা।
এক ব্যতিক্রমী প্রেমিক সত্তা, প্রকৃতি ও নারীকে অবিচ্ছিন্নভাবে ধারণ করল গল্পের আখ্যানে তিনি বুদ্ধদেব গুহ। অন্যদিকে, শোষণ-বঞ্চনা- হতাশার কথাকার হয়ে উঠেছিলেন দেবেশ রায়। এ ছাড়াও জনপ্রিয় গল্পরচনায় বিশিষ্টতা লাভ করেছেন, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, দীপক চন্দ্র, নবনীতা দেবসেন, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ কথাশিল্পীরা। সাম্প্রতিক কালে তাঁদেরই উত্তরাধিকার বহন করে নিয়ে চলেছেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী, হর্ষ দত্ত, স্মরণজিৎ চক্রবর্তী, দেবারতি মুখোপাধ্যায়, উল্লাস মল্লিক, প্রচেত গুপ্ত প্রমুখ কথাকারেরা।
৯। সূচনা পর্বে বাংলা শিশুসাহিত্য সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ রচনা করো।
সূচনা পর্বে বাংলা শিশুসাহিত্য: রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, শিশুপুরাণই হল পৃথিবীর সবচেয়ে আদিপুরাণ এবং তা প্রায় মানুষের সমবয়সি। তাই শিশুমনের উপযোগী করে সাহিত্যরচনার একটি প্রয়াস ছোটো- বড়ো সকল সাহিত্যিকের মধ্যেই লক্ষ করা যায়। চর্যাপদ থেকে বাংলা সাহিত্যের যাত্রাপথ শুরু হয়েছে বলে যদি আমরা মেনে নিই, তাহলে কিন্তু বলতেই হয় সেই একাদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলায় শিশুসাহিত্য প্রায় কিছুই রচিত হয়নি। অবশ্য, বাংলায় অনূদিত রামায়ণ বা মহাভারত-এ শিশু মনোরঞ্জনের উপযোগী নানা কাহিনি স্থান পেত। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এদেশে শিশুপাঠ্য লেখার প্রথম প্রয়াস লক্ষ করা যায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’ গ্রন্থের কথা। শিশুদের অক্ষরপরিচয়ের জন্য বিদ্যাসাগর লিখলেন ‘বর্ণপরিচয়’। তাদের নৈতিক চরিত্র দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনে এরপর তিনি স্কুলপাঠ্য হিসেবে রচনা করলেন ‘আখ্যানমঞ্জুরী’, ‘বোধোদয়’, ‘কথামালা’ প্রভৃতি গ্রন্থ। অক্ষয় দত্তের ‘চারুপাঠ’ও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। শিশুদের অক্ষর পরিচয়কে আরও আনন্দময় করে তুলতে যোগীন্দ্রনাথ সরকার তাঁর বইগুলি করে তুললেন সচিত্র। তাঁর রচিত কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল- ‘হাসিখুশি’, ‘হাসিরাশি’, ‘ছবি ও গল্প’, হাসিখেলা। লক্ষণীয়, প্রথম পর্যায়ে শিশুদের বইগুলি কিন্তু মোটেও মৌলিক ছিল না, তা ছিল নানা লোককথা বা সংস্কৃত, ইংরেজি বা হিন্দি গ্রন্থের অনুবাদ।
১০। উপেন্দ্রকিশোর থেকে আধুনিক পর্ব পর্যন্ত শিশুসাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উপেন্দ্রকিশোর ও অন্যান্য: বাংলা শিশুসাহিত্য প্রথম পরিপূর্ণতা লাভ করে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর রচনায়। তিনি রূপকথা-উপকথা, প্রচলিত গল্প, দেশি-বিদেশি নানান লেখার অনুবাদের মধ্য দিয়ে শিশুমনের উপযোগী বহু সাহিত্য রচনা করেন (যথা- ‘টুনটুনির বই’, ‘পানতাবুড়ি’ ইত্যাদি)। এই ধারার সার্থক অনুসারী হলেন সুকুমার রায়। প্রচলিত বাংলা ছড়া অথবা কবিতার বাইরে তিনি উদ্ভট বা ননসেন্স কবিতার এক মায়াময় জগৎ তৈরি করলেন। পরবর্তীকালে শিশু-কিশোর সাহিত্যধারায় নতুন মাত্রা যোজনা করলেন সুখলতা রাও, পুণ্যলতা চক্রবর্তী, লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ রায়।
দক্ষিণারঞ্জন ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর: দক্ষিণারঞ্জন মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘ঠাকু’মার ঝুলি’ ইত্যাদি গ্রন্থে শিশুমন আপ্লুত হল রূপকথার গল্পে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘রাজকাহিনী’, ‘নালক’, ‘বুড়ো আংলা’ ইত্যাদি গ্রন্থে রূপকথা বলার প্রাচীন ধরনটি ক্রমশ আধুনিক হয়ে উঠল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শিশুমনের উপযোগী বহু গ্রন্থ লিখেছেন। যথা- ‘শিশু’, ‘শিশু ভোলানাথ’, ‘সে’, ‘খাপছাড়া’ ইত্যাদি।
আধুনিক পর্ব: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘লালু’-র গল্পগুলি এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ শিশুসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (গোয়েন্দা গল্প), প্রেমেন্দ্র মিত্র (ঘনাদা), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (টেনিদা), সুনির্মল বসু, বিমল ঘোষ, অখিল নিয়োগী, আশাপূর্ণা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিকদের বিভিন্ন রচনা উল্লেখযোগ্য শিশুসাহিত্য হিসেবে জনপ্রিয়।
আরও পড়ুন | Link |
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
তেলেনাপোতা আবিষ্কার বড় প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
আগুন নাটকের বড়ো প্রশ্ন উত্তর | Click Here |