অধিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন তত্ত্ব আলোচনা করো
অধিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন তত্ত্ব
অধিকার সম্পর্কিত তত্ত্বগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব, আইনগত তত্ত্ব, আদর্শবাদী তত্ত্ব এবং মার্কসীয় তত্ত্ব।
(1) স্বাভাবিক অধিকার বিষয়ক তত্ত্ব
স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বটি হল অধিকার সম্পর্কিত সবচেয়ে প্রাচীন মতবাদ। প্রাচীন গ্রিসের স্টোয়িক দর্শনে এবং রোমান আইনবিদদের লেখায় স্বাভাবিক অধিকারের ধারণার প্রথম সন্ধান পাওয়া যায়। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টমাস হক্স, জন লক্ এবং জ্যাঁ জ্যাক রুশোর রচনায় স্বাভাবিক অধিকার সম্পর্কিত তত্ত্বের বিকাশ ঘটে। পরবর্তীকালে স্পেনসার, গিডিংস, বেখাম, গ্রিন ও ল্যাস্কির লেখাতেও এই তত্ত্বটি সমর্থিত হয়।
- মূল বক্তব্য: যেসব অধিকার মানুষের সহজাত, যে অধিকারগুলি নিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করে, সেগুলিকে স্বাভাবিক অধিকার বলে। এই অধিকারগুলি সর্বজনীন ও চিরন্তন। স্বাভাবিক অধিকার মানুষের গায়ের রঙের মতো। জন্মসূত্রে মানুষ এই অধিকার লাভ করে বলে একে স্বাভাবিক অধিকার বলা হয়। প্রাক্-সামাজিক ও প্রাক্-রাজনৈতিক এই অধিকারের উৎস রাষ্ট্র বা সমাজ কেউই নয়। এই কারণে সমাজ বা রাষ্ট্র স্বাভাবিক অধিকারের উপর কোনোরকম বিধিনিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। স্বাভাবিক অধিকার সমস্ত রকম নিয়ন্ত্রণমুক্ত। স্বাভাবিক অধিকার বলতে কোন্ কোন্ অধিকারকে বোঝাবে, সে সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত না হলেও সাধারণভাবে জীবনের বা বাঁচার অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার এবং সম্পত্তি ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের অধিকারকে স্বাভাবিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
- সমালোচনা: সমালোচকদের মতে, স্বাভাবিক অধিকার শব্দটির কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা না থাকায় কোন্ট স্বাভাবিক অধিকার এবং কোন্টি নয়, সে সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেননি। তাছাড়া রাষ্ট্র ও সমাজনিরপেক্ষ স্বাভাবিক অধিকারের ধারণা সম্পূর্ণ অবাস্তব কল্পনা।
(2) আইনগত তত্ত্ব
স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে অধিকার সম্পর্কিত আইনগত তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। অনেকে মনে করেন, সার্বভৌমিকতার একাত্ববাদী ধ্যান-ধারণা থেকে এই তত্ত্বের সৃষ্টি। ব্যোম, অস্টিন, সলমন্ড, রিচি প্রমুখ হলেন অধিকারের আইনগত তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা।
- মূল বক্তব্য: অধিকারের আইনগত তত্ত্বের মূল বক্তব্য হল, রাষ্ট্রবহির্ভূত কোনোরকম অধিকারের অস্তিত্ব বাস্তবে থাকতে পারে না। যাবতীয় অধিকারের উৎস হল রাষ্ট্র। বেত্থাম-এর মতে, অধিকার হল আইনের সন্তান (“Right is the Child of Law”)। বাস্তবে প্রচলিত আইনই হল অধিকারের প্রকৃত ভিত্তি। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক আইন হল নিছক একটি কাল্পনিক আইন। এই কারণে কাল্পনিক আইন থেকে যে অধিকারের জন্ম হয় তার প্রকৃতিও কাল্পনিক হয়। আইনগত মতবাদের প্রবক্তাদের মতে, রাষ্ট্রের একটি মৌলিক আইনগত কাঠামো আছে, যার সাহায্যে অধিকারের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের কাজ করা হয়। বস্তুত, আইনের মাধ্যমে অধিকারের সৃষ্টি হয় বলে আইনের রদবদলের সঙ্গে অধিকারেরও রদবদল ঘটে। অধিকারের আইনগত তত্ত্বের প্রবক্তাদের বক্তব্য হল, অধিকার ভোগের জন্য নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি আনুগত্য দেখানো বাধ্যতামূলক।
- সমালোচনা: অধিকারের আইনগত তত্ত্বের সমালোচনা করে ল্যাস্কি বলেন, অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট হয় না। রাষ্ট্র শুধুমাত্র অধিকারের স্বীকৃতি দেয় এবং তাকে সংরক্ষণ করে। আইনগত তত্ত্বে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সমালোচকরা এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেছেন যে, রাষ্ট্র যদি নাগরিকের অধিকার খর্ব করে বা সকলের কল্যাণকারী অধিকারগুলিকে স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে ব্যক্তি অবশ্যই রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতিরোধ করতে পারে। মার্কসবাদী সমালোচকদের মতে, রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় আইন কখনোই শ্রেণিস্বার্থমুক্ত হতে পারে না।
(3) আদর্শবাদী তত্ত্ব
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে জার্মান আদর্শবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সত্তার পূর্ণ বিকাশের জন্য যে তত্ত্বের অবতারণা করেন, তা থেকেই অধিকারের আদর্শবাদী তত্ত্বের জন্ম হয়।
- মূল বক্তব্য: অধিকারের আদর্শবাদী তত্ত্বের মূল বক্তব্য অনুসারে, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য বাহ্যিক শর্তগুলি হল অধিকার। জার্মান আদর্শবাদী দার্শনিক কান্ট এবং ইংরেজ দার্শনিক গ্রিন ব্যক্তির অধিকারকে নৈতিক মানদণ্ডে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এই মতবাদের অবতারণা করেছেন। কান্ট-এর মতে, নৈতিক দিক থেকে স্বাধীন ব্যক্তিকে প্রকৃত স্বাধীন ব্যক্তি বলা যেতে পারে। গ্রিন-এর মতে, ব্যক্তির দাবি যখন সর্বজনীন কল্যাণ কামনায় নিয়োজিত হয়, তখন তাকে প্রকৃত অধিকার বলা যেতে পারে। আদর্শবাদী দার্শনিকরা অধিকার ভোগ করার সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যপালনের বিষয়টিকেও যুক্ত করতে চেয়েছেন। তাঁদের মতে, একজন ব্যক্তির অধিকার ভোগের বিষয়টি তার কর্তব্যপালনের সঙ্গে শর্তসাপেক্ষ। আদর্শবাদী দার্শনিকরা স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, সমাজ বা রাষ্ট্রনিরপেক্ষ কোনো অধিকার বাস্তবে থাকতে পারে না। রাষ্ট্র একটি অখন্ড সামগ্রিক সত্তা, ব্যক্তি তার অংশমাত্র।
- সমালোচনা: সমালোচকদের মতে, অধিকারের আদর্শবাদী তত্ত্বে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্রের যুপকাষ্ঠে বলি দেওয়া হয়েছে। এই তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা হেগেল যে সর্বাত্মক বা সর্বশক্তিমান আত্মসচেতন নৈতিক সত্তাবিশিষ্ট রাষ্ট্রের কথা বলেছেন, তা আসলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তির অধিকারের পরিপন্থী।
(4) মার্কসীয় তত্ত্ব
অধিকার সম্পর্কে মার্কসীয় মতবাদ গতানুগতিক ও প্রচলিত দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকৃতির। রাষ্ট্র এবং আইন নিয়ে যে ব্যাখ্যা মার্কস দিয়েছিলেন, তা থেকেই অধিকার সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বের উৎপত্তি।
- মূল বক্তব্য: অধিকারের মার্কসীয় তত্ত্বের মূল বক্তব্য হল, প্রতিটি সমাজে অধিকারের ধারণা সেই সমাজের অর্থনৈতিক বিন্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গড়ে ওঠে। উৎপাদন ব্যবস্থা হল সমাজের মূল ভিত্তি। – রাষ্ট্র, আইন, অধিকার প্রভৃতি উপরিকাঠামো এই ভিত্তির উপর নির্ভরশীল। উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে উপরিকাঠামো পরিবর্তিত হয়। তাই মানুষের অধিকারের প্রকৃতি উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে তার সম্পর্ক দ্বারা নির্ধারিত হয়। মার্কস-এর মতে, শোষিত সমাজব্যবস্থায় শ্রেণিবৈষম্য থাকায় অধিকারের ক্ষেত্রেও বৈষম্য দেখা যায়। এ ধরনের সমাজে অধিকার মুষ্টিমেয় শাসকশ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাই বৈষম্যমূলক সমাজে অধিকার হল শুধুমাত্র উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী মালিক শ্রেণির অধিকার। একমাত্র শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার রক্ষা করা সম্ভব হয়। মার্কসীয় অধিকার তত্ত্বের মূল ভিত্তি হল অর্থনৈতিক অধিকার। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে, অর্থনৈতিক অধিকার হল অন্যান্য অধিকারের নির্ধারক। সমাজতান্ত্রিক সমাজে অর্থনৈতিক অধিকারের গুরুত্ব স্বীকার করে তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তার ফলে সব মানুষ সব অধিকার সমানভাবে ভোগ করার সুযোগ পায়।
- সমালোচনা: অধিকারের মার্কসীয় তত্ত্ব ত্রুটিমুক্ত নয়। সমালোচকদের মতে, মার্কসীয় তত্ত্বে অধিকারের প্রকৃতি বিশ্লেষণে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিষয়ের উপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে এটি ঠিক নয় বলে সমালোচকরা দাবি করেন। ব্যক্তির অধিকারবোধের পিছনে ধর্ম, আদর্শ ইত্যাদির অবদানও কম নয়। তাছাড়া মার্কসীয় তত্ত্বে রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। বস্তুত, মার্কসীয় তত্ত্বে ব্যক্তির চেয়ে সমাজের সমস্যা ও শ্রেণিগত সমস্যাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতা অবহেলিত হয়েছে।
মূল্যায়ন
অধিকার সম্পর্কিত উপরোক্ত তত্ত্বগুলি আলোচনার শেষে এ কথা বলা যায় যে, অধিকারের প্রকৃতি উন্মোচনে তত্ত্বগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
- স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। সামন্তসমাজের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে স্বাভাবিক অধিকারের মতবাদ অতীতে সামগ্রিক প্রতিবাদ হিসেবে কাজ করেছে। এমনকি বর্তমানেও জীবনের অধিকার ও স্বাধীনতার অধিকারকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।
- অধিকারের আইনগত মতবাদের মূল্যও অপরিসীম। আধুনিক সার্বভৌম জাতীয় রাষ্ট্রে এই মতবাদের বক্তব্য স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে আইন হল অধিকারের প্রধান উৎস। আইন কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত না হলে নাগরিকরা কোনো অধিকার ভোগ করতে পারে না।
- অধিকার সম্পর্কিত আদর্শবাদী তত্ত্বের গুরুত্ব উপেক্ষণীয় নয়। এই তত্ত্বে অধিকারের নৈতিক দিকের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে আদর্শবাদীরা সমাজকে নৈতিক অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। অনেকের মতে, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের অধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক অধিকাররূপে ঘোষণা করে তত্ত্বটি গণতন্ত্রকে আরও মজবুত করেছে। সর্বোপরি অধিকারভোগ কর্তব্যপালনের উপর নির্ভরশীল, যা আদর্শবাদী তত্ত্ব সামাজিক শৃঙ্খলাবোধ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে।
- অধিকারের মার্কসীয় তত্ত্বের স্বতন্ত্র তাৎপর্য রয়েছে। অধিকার বস্তুটি সমাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সমাজব্যবস্থার বদলের সঙ্গে অধিকারের রূপ ও প্রকৃতিরও বদল ঘটে এই সত্যতা মার্কসীয় তত্ত্বে তুলে ধরা হয়েছে এবং দাস সমাজব্যবস্থা থেকে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অধিকারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এটা দেখানো হয়েছে। তাছাড়া শ্রেণিবৈষম্যমূলক সমাজে অধিকার যে কখনোই সর্বজনীন হতে পারে না তা-ও মার্কসীয় তত্ত্বে প্রমাণিত হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও অধিকার সম্পর্কিত তত্ত্বগুলির অবদান অপরিসীম।
Also Read – The Garden Party questions and answers