আইনের উৎসগুলি আলোচনা করো

আইনের উৎসগুলি আলোচনা করো

আইনের উৎসগুলি আলোচনা করো
আইনের উৎসগুলি আলোচনা করো

আইনের উৎস

বাস্তব দিক থেকে সার্বভৌম শক্তির অনুমোদনকে আইনের একমাত্র উৎস বলে অভিহিত করা হলেও আইনশাস্ত্রের ইতিহাস ও আইনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় আইনব্যবস্থা একদিনে গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রের মতো আইনও দীর্ঘ ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফলে গড়ে উঠেছে। আইনের উৎস হিসেবে নানারকম সামাজিক শক্তি রয়েছে। সেইগুলিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আইনের মুখ্য উৎস বলে বর্ণনা করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হল্যান্ড-কে অনুসরণ করে বলা যায় এগুলি হল- প্রথা ধর্ম বিচারালয়ের রায়, ন্যায়বিচার, বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা ও আইনসভা কর্তৃক আইন প্রণয়ন (“The sources of Law are custom, religion, judicial decision, scientific discussions, equity legislation”)। নিম্নে উৎসগুলির বিস্তারিত আলোচনা করা হল-

প্রথা

আইনের সবচেয়ে প্রাচীন উৎস হল প্রথা (Custom)। সমাজে সুদীর্ঘকাল যাবৎ যে প্রচলিত আচার-ব্যবহার ও রীতিনীতির অস্তিত্ব থাকে,  তা প্রথায় রূপান্তরিত হয়।

সাধারণভাবে কোনো একসময় কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষ রীতিনীতির প্রবর্তন ঘটিয়েছিল, যা পরবর্তীকালে সমাজস্থ অনেক মানুষ অনুসরণ করতে থাকায় রীতিনীতিগুলি সমাজে স্থায়িত্ব লাভ করে এবং একটা সময়ের পর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দ্বারা আইনি মর্যাদা লাভ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হল্যান্ড প্রথার উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, একটি তৃণভূমির উপর দিয়ে ঠিক যেমনভাবে পায়ে চলা রাস্তা তৈরি হয়, অনুরূপভাবেই রীতিনীতি বা প্রথার উদ্ভব ঘটে।

প্রাচীন সমাজে প্রথার সাহায্যে দ্বন্দ্ব মীমাংসা করা হত। আদিম সমাজব্যবস্থায় মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক প্রথাগত নিয়মকানুনের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হত। কালক্রমে সেই নিয়মকানুনগুলি জনসম্মতি ও রাষ্ট্রের স্বীকৃতির মাধ্যমে স্থায়িত্ব লাভ করেছে। আধুনিককালেও অনেক রাষ্ট্রের আইনের মধ্যে প্রথাগত বিধানের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। ব্রিটেনে প্রচলিত অলিখিত সংবিধানের অধিকাংশই প্রথার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের (ভারতে) হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য প্রণীত আইনকানুনগুলিও মূলত প্রথাভিত্তিক।

ধর্ম

আইনের অপর উৎস হল ধর্ম (Religion)। প্রাচীনকালে সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় অনুশাসন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সাবেকি সমাজব্যবস্থা ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত হত। এই সময় ধর্ম ও আইন ছিল সমরূপ। ধর্ম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আইনের বিবর্তনে সহায়তা করেছিল। আদিম সমাজে যখন কোনো আইনের অস্তিত্ব ছিল না, তখন সমাজে শৃঙ্খলা, ঐক্য ও অনুশাসন বজায় রাখার জন্য ধর্মকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হত। এই সময় ধর্মীয় রীতিনীতিগুলিই মানুষের অজ্ঞতার সুযোগে তাদের আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করত। পরবর্তীকালে রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে বর্ণনা করে রাজার নির্দেশ মানাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।

তবে এগুলির পশ্চাতে ধর্মীয় সমর্থন ছিল বলেই তা স্থায়িত্ব লাভ করেছিল। অর্থাৎ, ধর্ম একদা প্রত্যক্ষভাবে আইনের জন্ম দিয়েছিল। উইলসন-এর মতে, প্রথম যুগে রোমের আইন কতকগুলি ধর্মীয় সূত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। ইহুদি সমাজে ধর্মীয় অনুশাসনের একটি বড়ো অংশ রাষ্ট্রীয় আইনে রূপান্তরিত হয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতেও অনুরূপ চিত্র দেখা যায়। আবার, ভারতে হিন্দু প্রথাগত আইন এবং মুসলমান প্রথাগত আইনের অস্তিত্ব দেখা যায়, যেগুলির পশ্চাতে ধর্মীয় প্রভাব বর্তমান। যেমন, হিন্দু আইনের উপর মনুসংহিতার ও মুসলিম আইনের উপর কোরানের প্রভাব উল্লেখ্য। তাছাড়া বর্তমান সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় আইনের গুরুত্ব রয়েই গেছে।

বিচারালয়ের রায়

আদিম সমাজে ক্রমশ জীবনযাত্রা জটিল হওয়ার জন্য সমাজে যে নানা ধরনের দ্বন্দ্ব দেখা দিত তার মীমাংসা করার জন্য উদ্ভব হয়েছিল নতুন ধরনের বিচারব্যবস্থার। রাজা বা দলপতির উপর বিচারের ভার ন্যস্ত করা হয়েছিল। ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে এই বিচারকরা যেসব রায় দিতেন, তা ভবিষ্যৎকালের বিচারকার্যে আইন হিসেবে গণ্য হত। বর্তমানেও অনেকসময় এভাবে বিচারালয়ের রায় (Judicial Decission) আইন সৃষ্টি করে। বিচারকরা আইনের যে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ প্রদান করেন তা থেকে আইনের অর্থ সুস্পষ্ট হয়। তাছাড়া বিচারপতিদের ঘোষিত সিদ্ধান্ত পরবর্তীকালে অনুরূপ মামলার ক্ষেত্রে নজির সৃষ্টি করে। এমনকি বিচারকগণ সময়ের সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রেখে পুরাতন আইনগুলিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যা সাবেকি আইনের অস্পষ্টতা ও অপূর্ণতাকে দূর করে। এসব নজিরকে বিচারক সৃষ্ট আইন (Judgemade Law) বলা হয়।

ন্যায়বিচার

আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল ন্যায়বিচার (Equity)। ন্যায় সর্বদা সমতা, সততা ও বিবেক অনুসারে বিচারকার্য পরিচালনা করে। বিচারকদের গুরুদায়িত্ব হল সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। দেশে প্রচলিত আইনকানুনের সাহায্যে যদি ন্যায়বিচারের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব না হয়, তাহলে নিজস্ব ন্যায়বোধ অনুসারে বিচারপতিদের বিচারকার্য সম্পাদন করতে হয়। এর ফলে নতুন আইনের সৃষ্টি হয়। হেনরি মেইন-এর মতে, এরূপ নতুন আইন সৃষ্টির ব্যবস্থা না থাকলে গতিশীল সমাজ ও সামাজিক ন্যায়বোধের সঙ্গে আইন সংগতি রেখে চলতে পারে না। তাই আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি ছাড়াও আইন সংশোধনের অন্যান্য পদ্ধতি থাকা আবশ্যক, যাতে সমাজের ন্যায় ব্যবস্থার সঙ্গে আইনের সংগতিবিধান করা যায়।

আইনজ্ঞদের আলোচনা

বিখ্যাত আইনজ্ঞ পণ্ডিতদের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা (Scientific Discussion) আইনের অপর একটি উৎস। আইনের অর্থ নিয়ে নানান মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এজন্য আইনের প্রকৃত ব্যাখ্যা আইনজ্ঞ পণ্ডিতদের রচিত বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রেই বিচারকদের পুরাতন সাবেকি আইনগুলিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করতে হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে ভারতে রাসবিহারী ঘোষের ‘বন্ধকী সম্পত্তি’ বিষয়ক পুস্তক এবং গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘স্ত্রীধন’ বিষয়ক পুস্তকে কোনো মামলার বিচারের সময় যে সিদ্ধান্তগ্রহণ করা হয়েছিল, সেই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

আইনের উপর পণ্ডিতদের এসব আলোচনা, ভাষ্য, টীকা ইত্যাদি বিচারের রায়দানের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। ইংল্যান্ডে ব্ল্যাকস্টোন (Blackstone), কোক (Coke) আমেরিকার রাষ্ট্রতাত্ত্বিক স্টোরি (Story) এবং কেন্ট (Kent) প্রমুখের টীকা ব্রিটেনের আইনব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচারপতি স্টোরি-র আইনি ব্যাখ্যা মার্কিন আইনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। আমাদের দেশে মনুস্মৃতি শাস্ত্রের ব্যাখ্যাকারগণ হিন্দু আইনের সংস্কারসাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ফলে বর্তমানে প্রতিটি দেশেই আইনজ্ঞদের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা আইনি উৎসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।

আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন

বর্তমান যুগে আইনসভা (Lagislature) কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে আইন রচনা হল আইনের প্রধান উৎস। আইনসভার সদস্যরা জনমতের সঙ্গে সংগতি রেখে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করেন। জনকল্যাণকর রাষ্ট্রে ব্যাপক দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য যেসব আইনের প্রয়োজন হয়, তা তৈরি করে আইনসভা। এর ফলে আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে প্রথা, ধর্ম ইত্যাদি উৎসগুলির গুরুত্ব ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে গিলক্রিস্ট (Gilchrist)-সহ অন্যান্যরা মনে করেন আইনসভা কর্তৃক আইন প্রণয়ন আইনের সর্বপ্রধান উৎস। আইনবিদ ওপেনহেইম (Oppenheim)-এর মতে, বর্তমানে প্রথা, ধর্ম বা বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা নয়, আইনের প্রধানতম ও একমাত্র উৎস হল জনগণের মত (There are not many sources of law but there is only one source of law, viz, common consent of the community.)।

উপসংহার

আইনের উৎসগুলির বিস্তারিত আলোচনার সাপেক্ষে পরিশেষে বলা যায় ধর্ম, প্রথা ও রীতিনীতি, বিচারকদের সিদ্ধান্ত, আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন প্রত্যেকটি আইনের ক্রমবিকাশে সাহায্য করেছে। কোনো একটি উৎস এককভাবে দেশের সার্বিক আইন প্রণয়ন করতে পারে না। তবে প্রথা, রীতিনীতি এবং ধর্ম প্রাচীনকালে আইনের উৎস হিসেবে বিবেচিত হলেও বর্তমানের আধুনিক শাসন ব্যবস্থায় এর প্রভাব প্রায় নেই বললেই চলে। পরিবর্তে বিচারকদের যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি, তাদের অভিজ্ঞ আলোচনা ও তাদের প্রদত্ত রায়গুলি আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে।

সুতরাং, আইনের উৎস আলোচনার উপসংহারে উইলসন-এর মতামতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায়, প্রথা আইনের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন উৎস হলেও ধর্মও  একই সময়ে আইন সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। পরবর্তী সময়ে বিচারকের রায় ও ন্যায়বিচার আইনের উৎস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু আধুনিককালের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক আইনসভা কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে আইন প্রণয়ন এবং আইনজ্ঞদের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা আইনের প্রধান উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

Also Read – The Garden Party questions and answers

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment