লোকমাতা রানি রাসমনি প্রবন্ধ রচনা 800+ শব্দে

লোকমাতা রানি রাসমনি প্রবন্ধ রচনা

লোকমাতা রানি রাসমনি প্রবন্ধ রচনা
লোকমাতা রানি রাসমনি প্রবন্ধ রচনা

লোকমাতা রানি রাসমনি প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও মৃত্যুর ফলে ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গেল, নেমে এল দূর্যোগের কালো রাত। মানুষ কিন্তু মাথা নত করে এই বিদেশী প্রভুত্বকে মনের দিক থেকে মেনে নিতে পারেননি, ইংরেজের অন্যায়, অতাচার ও শোষনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষনা করেছেন। ইংরেজ শাসনের প্রথমের দিকে শোষিত মানুষের দুঃখ মোচনে ও বৃটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রানি রাসমনি।

জন্ম ও বাল্যকাল

লোকমাতা রানি রাসমনির জন্ম ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর (অন্যমতে ২৬শে সেপ্টেম্বর) মামার বাড়িতে, বর্তমানে উত্তর চবিবশ পরগনার কাঁচড়াপাড়ার নিকট কোনা গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। তাঁর পিতার নাম হরেকৃষ্ণ দাস ও মাতার নাম রামপ্রিয়া। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান। জন্মের পরে তাঁর নাম রাখা হয় রাসমনি। তাঁর মা তাঁকে আদর করে ডাকতেন রানি নামে। পরে দুটো নাম একত্রিত হয়ে রানি রাসমনি হয়েছে। রাসমনি জন্মেই দেখলেন বিদেশী শাসকের অত্যাচার, ক্ষুধার্ত অসহায় মানুষের কান্না, কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজকে।

মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি হারালেন চিরকালের জন্য মাকে। নিঃসন্তান বিধবা পিসি ক্ষেমঙ্করী দেবী তাঁকে সন্তান স্নেহে প্রতিপালন করেন। অর্থের অভাবে তাঁর স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তাছাড়া সেসময় নারীশিক্ষারও ব্যবস্থা ছিলনা। তাই তিনি তাঁর পিতার কাছে পড়তে বসতেন। এছাড়া রামায়ন ও মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণের নানা লীলা কাহিনীর কথা পিতার কাছ থেকে শুনে নিজেকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ করতেন। ছোটো বেলা থেকে তাঁর মধ্যে দেখা যায় ত্যাগ, সেবা, সাহস, আত্মশক্তি প্রভৃতি গুনের সমাবেশ। কেউ অসুস্থ হলে বা বিপদে পড়লে তিনি ধর্মের বিভেদ ভুলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন, যদিও তখন জাতিভেদ প্রথা ছিল প্রকট।

কর্মজীবন

লোকমাতা রানি রাসমনি এগারো বছর বয়সে জানবাজারের জমিদার তথা রাজা রাজচন্দ্র দাসের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখনকার দিনে জমিদারকে প্রজারা রাজা বলে সম্বোধন করত। ভারতের ভাগ্যাকাশে তখন দূর্যোগের ঘনঘটা। মানুষ অন্ধ-কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। হিন্দুধর্মের গোঁড়া ব্রাহ্মণতন্ত্রের ফলে সৃষ্টি হয়েছে জাতিভেদ প্রথা, মানুষ ঘৃণা করছে মানুষকে। নব্য তরুণেরা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির চাকচিক্যে আকৃষ্ট হয়ে দেশীয় সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করতে থাকে। এছাড়া দীর্ঘ বছরের মোঘল শাসনের ফলে ধর্মান্তরণেও মানুষের সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন শিথিল হতে থাকে। অথচ সমস্ত মানুষের মধ্যে ঐক্য ছাড়া বিদেশী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব নয়।

লোকমাতা রানি রাসমনি জমিদার বাড়ির গৃহবধূ হয়ে এলেও ভুলে গেলেন না তাঁর কৈশোরও কৈশোরের স্মৃতি। তাঁকে খুব ভাবিয়ে তুলত মানুষের দারিদ্র-দুঃখ-যন্ত্রনা ও দেশশাসনের লাঞ্ছনা। তিনি দক্ষিণেশ্বরে প্রতিষ্ঠা করেন ভবতারিনী মন্দির। তিনি বললেন, এই মন্দির হবে সর্বধর্মের সমন্বয় কেন্দ্র। যে জমিতে মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে আগের থেকে মুসলমানের কবরস্থান ও খ্রিস্টানের কুঠিবাড়ি ছিল। তিনি তা ধবংস করলেন না এবং বললেন সমস্ত ধর্মের মানুষ এই মন্দিরে প্রবেশ করে পুজো দিতে পারবেন। এছাড়া বিভিন্ন পুজো-পার্বনে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষকে একত্রিত করে ধর্মীয় বিচ্ছেদ রোধের চেষ্টা করলেন যাতে ভবিষ্যতে সম্মিলিত জনশক্তি ব্রিটিশ নামক জগদ্দল শক্তিকে সমূলে উৎখাত করতে পারে। তিনি ও তাঁর স্বামী রাজচন্দ্র দাস ছিলেন সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রথার বিরোধী এবং বিধবা বিবাহের সমর্থক।

রাজা রামমোহন রায়ের চেষ্টায় সতীদাহ প্রথা বিলোপের আইন পাশ হয়। কিন্তু এই আইন পাশের পরে তিনি অকালে দেহত্যাগ করেন। তাঁর অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন রানি রাসমনি ও রাজচন্দ্র দাস। বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়, যাতে বিধবা বিবাহিত জীবনের মাধ্যমে সমাজে নারীর উপযুক্ত সম্মান পায়। অজস্র অর্থ ব্যয় করেন বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টাকে সফল করার জন্য। নীল চাষ করলে কৃষকদের ক্ষতি হত। নীলকরেরা জোর করে কৃষকদের নীল চাষ করতে বাধ্য করত এবং তা না করলে তাদের ওপর নির্মম অত্যাচার করত। তিনি তাঁর জমিদারী থেকে নীলকরদের তাড়িয়ে দেন এবং নীলবিদ্রোহে সহযোগীতা করেন। ফলে ব্রিটিশরা বাধ্য হয় আইন করে নীল চাষ বন্ধ করতে।

তিনি গঙ্গায় বাবুঘাট, হুগলির বাবুগঞ্জে রাসমনি ঘাট, কালীঘাটে রাসমনি ঘাট, গোলবাড়িতে পিতার নামে ঘাট, বাগবাজারে যোগমায়া দেবী ঘাট প্রভৃতি নির্মান করেন যাতে স্নানের সুবিধা হয়। গঙ্গাসাগরের যাত্রীদের সুবিধার জন্য নিমতলায় বিশ্রামাগার ও শ্মশান যাত্রীদের জন্য বিশ্রাম কক্ষের ব্যবস্থা করেন। ব্যারাকপুর প্রভৃতি স্থানে পানীয় জলের জন্য পুকুর খনন, পারাপারের সুবিধার জন্য সেতু প্রভৃতি নির্মান, সুস্বাস্থ্যের জন্য কলকাতায় নর্দমার নির্মাণ, বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে যাত্রীনিবাসের ব্যবস্থা করেন। সুবর্নরেখা থেকে পুরী পর্যন্ত রাস্তা নির্মান করেন তীথযাত্রীর যাতায়াতের সুবিধার জন্য। তিনি ব্রিটিশ শক্তিকে দেখতেন সন্দেহের চোখে।

একবার গোরা সৈন্য তাঁর প্রাসাদ আক্রমণ করলে তিনি নিজে তরবারি নিয়ে প্রতিরোধ করেন। ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে দু’বছর বারো জন সৈন্য মোতায়েন করেন প্রাসাদ পাহারা দিতে এবং প্রাসাদের ক্ষতিপূরণও দেয়। অসহায় মানুষের জন্য তিনি ছিলেন সমব্যথী। ব্রিটিশরা গঙ্গায় মাছ ধরার জন্য জলকর আইন করলে রাসমনি ঘুসুড়ি থেকে গার্ডেনরিচ পর্যন্ত গঙ্গা লিজ নিয়ে দুই প্রান্তে বেড়ার ব্যবস্থা করলেন। নৌকা জাহাজ প্রভৃতির যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেলে রাসমনির বুদ্ধির কাছে পরাজয় স্বীকার করে ইংরেজ সরকার জলকর আইন প্রত্যাহার করে ও লিজের দশ হাজার টাকা ফেরৎ দেয়।

তাঁর নির্মিত বাবুরোড দিয়ে দুর্গাপুজোর শোভাযাত্রা গেলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে এই অজুহাতে ব্রিটিশরা বাধা দিলে তিনি রাস্তা বেড়া দিয়ে আটকে দেন। যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে ইংরেজ শক্তি মাথা নত করতে বাধ্য হয় এবং অন্যায় স্বীকার করে। শিক্ষা ও সুস্বাস্থ্যের জন্য কলকাতায় প্রথম জ্বর রোগের চিকিৎসালয়ে, শিক্ষা বিস্তারের জন্য হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠায়, ডিস্ট্রিক্ট চ্যারিইেবল সোসাইটিতে, মেটকাফ হল ও পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্টায় তিনি ও রাজচন্দ্র দাস বহু অর্থ দান করেন।

উপসংহার

দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর মন্দিরে পূজারী হিসাবে শ্রীরামকৃষ্ণ যোগ দেন। এই মন্দির এবং শ্রীরামকৃষ্ণ ও পরবর্তী সময়ে স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে ভারতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণের সূচনা হয়। লোকমাতা রানি রাসমনির প্রয়ান ঘটে ৩১ মে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে।

আরও পড়ুন – রাজা রামমোহন রায় প্রবন্ধ রচনা

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment