আগুন নাটকের বিষয়বস্তু

আগুন নাটকের বিষয়বস্তু

আগুন নাটকের বিষয়বস্তু
আগুন নাটকের বিষয়বস্তু

প্রথম দৃশ্য:

ভোরের অস্পষ্ট আলোয় দেখা যাচ্ছে গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারের ঘরে সংসারের টুকিটাকি জিনিসপত্তর। মেঝের উপর তিন জন ঘুমোচ্ছে। পরিবারের কর্তার ঘুম ভাঙে। সে শুয়ে শুয়েই ভাবে এবার উঠে পড়তে হবে। তাড়াতাড়ি গিয়ে চাল কেনার লাইনে দাঁড়াতে হবে। দেরি হয়ে গেলে আর চাল পাওয়া যাবে না। গত দিনে অনেকেই চাল না পেয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছে। গৃহকর্তা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে। পাশে ঘুমন্ত স্ত্রীকে ঠেলা মেরে জাগাতে চায়। বিক্রি করার জন্য কলমি শাক, দাঁতন কাঠি আর কলা ইত্যাদি যা রাখা আছে সেগুলি তার স্ত্রী বিক্রি করে চালের লাইনে দাঁড়াবে। যত তাড়াতাড়ি লাইন দিতে পারবে, চাল পাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। স্ত্রীকে ঘুম থেকে উঠতে বলে গামছা কাঁধে লোকটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। একটু পরেই উঠে পড়ে গৃহকর্ত্রী এবং ছেলে নিতাইকে ঘুম থেকে জাগায়। ছেলে বিরক্ত হয়ে বলে যে এই এক জ্বালা হয়েছে রোজ চালের লাইনে দাঁড়ানো, ভালো করে একটু ঘুমোনোর উপায় নেই। মা বলে, এখন চল, দুপুরে ঘুমোবি। বাজারে বিক্রির পসরাগুলি নিয়ে মা ও ছেলে দ্রুত বেরিয়ে যায়।

দ্বিতীয় দৃশ্য:

একটা চালাঘরের চৌকাঠের কাছে এক কৃষাণী দাঁড়িয়ে আছে। উঠোনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে এক কৃষাণ তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ কৃষাণীকে আর কটা দিন সবুর করতে বলছে। কারণ চৈত্রের ফসলগুলি ঘরে তুলতে পারলেই তাদের অভাব-অনটন অন্তত কিছুদিনের জন্য মিটবে। কোনো কথা না বলে চাষি-বউ তাকিয়ে থাকে চাষির দিকে। ওই দৃষ্টিতে চাষি যেন প্রেমের প্রকাশ অনুভব করে। চৈতালি ফসল ঘরে তোলা ছাড়াও আরও অনেক পরিকল্পনা ছিল কৃষকটির। কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারেনি সে এখনও। তাই স্ত্রীকে আর একটু কষ্ট করে ধৈর্য ধরে থাকতে বলে। কৃষকটি চলে যেতে যেতে পিছন ফিরে দাঁড়ায়। স্ত্রীকে বলে কেষ্টর মা-র সঙ্গে আগেভাগে গিয়ে সবার প্রথমে চালের লাইনে দাঁড়াতে, আর কাজকর্ম সেরে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে। মাঠের কাজ সেরে ফিরে কৃষকের খুব খিদে পেয়ে যাবে। তাই তার স্ত্রী দেরিতে রান্না বসালে খিদেয় প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হবে। বাইরে কৃষকের পোষা গোরুটা ডেকে ওঠে। কৃষকের মনে হয় গোরুটি মাঠে যাওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠেছে। সবার প্রথমে চালের লাইনে দাঁড়ানোর কথা আরেক বার বউকে মনে করিয়ে দিয়ে কৃষকটি চলে যায়।

তৃতীয় দৃশ্য:

কাক-ডাকা সকালে কারখানার শ্রমিক সতীশ নিজের ঘরের বারান্দায় উবু হয়ে বসে আছে। দূর থেকে ভেসে আসছে কারখানার সাইরেন বাজার শব্দ। ঘরের ভিতর সতীশের বউ-মেয়ে ঘুমোচ্ছে। বিড়ি টানা শেষ করে সতীশ তার মেয়ে ফুলকিকে ডাকে। মা-মেয়ে যেন কুম্ভকর্ণ, সেই সন্ধেবেলায় শুয়েছে, এখনও ঘুম ভাঙেনি। একটু পরে সতীশ তাঁর সহকর্মী জুড়োনকে ডেকে বলে কারখানায় না গিয়ে তো উপায় নেই, কিন্তু মুশকিল হল দৈনিক খাবারের চাল-ডাল জোগাড় করবে কেমন করে। লাইনে দাঁড়ানোর সময় তার নেই। দাঁড়ালেও চাল পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। কাল ফুলকি ও ফুলকির মা সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়েও খালি হাতে ফিরেছে। রাতে দেড় পোয়া চাল মিস্ত্রির কাছ থেকে ধার নিয়ে কোনোরকমে চালিয়েছে। ভুখা পেটে কি কাজে যেতে ইচ্ছে করে। তিন মাস ধরে কোম্পানিও চাল-ডাল দিচ্ছে না।

কোম্পানির উপর, দোকানের উপর-কারোর উপরই ভরসা করা যাচ্ছে না। গাঁটের পয়সা দিয়েও চাল-ডাল পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে সতীশ ফুলকিকে ঘুম থেকে উঠতে বলে। যদি সামান্য কিছু খাবার থাকে, খেয়ে কাজে বেরোতে চায় সে। তার স্ত্রী ক্ষিরি ফুঁসে ওঠে। সকালবেলা কোথা থেকে সে খাবার জোগাড় করবে। স্বামী-স্ত্রী উত্তেজিত। রাগারাগি হয়। ক্ষিরির পরনের কাপড় নেই, পেটে ভাত নেই, কী সুখেই-না সে আছে, কেলোর বাবা কেলোর মাকে কত সুখে রেখেছে। সতীশ কি পুরুষমানুষ। পৌরুষত্বে আঘাত লাগায় সতীশ রেগে গিয়ে বউয়ের উপর চোটপাট করে, যা-তা বলে, পদাঘাত করে। মা-মেয়ে চিৎকার করতে থাকে। শার্ট পরে, কাঁধে গামছা নিয়ে সতীশ দ্রুতবেগে বেরিয়ে যায়।

চতুর্থ দৃশ্য:

কেরানি হরেকৃষ্ণ ও মনোরমার মধ্যবিত্ত পরিবার। সেই পরিবারেও চা-চিনি-চাল নেই। থাকার মধ্যে আছে একটা উনুন, তাও সেটা জ্বালানোর কয়লা নেই। মনোরমা ভোঁদার কাছে শুনেছে আজ নাকি দু-সের করে চাল দেবে। তাই একটু কষ্ট করে স্বামীকে চাল আনতে যেতে বলল। হরেকৃষ্ণর অফিস দশটায়, চালের লাইনে দাঁড়ালে বেলা বারোটা বেজে যাবে, তাও চাল পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। মহামুশকিলে পড়ে হরেকৃষ্ণ। তাদের অফিস থেকে যে চাল-ডাল দেওয়ার কথা ছিল-তার কী হল, মনোরমা জানতে চায়। হরেকৃষ্ণ জানায় কেরানিবাবুদের নাম করে সরকারের থেকে চাল-ডাল- কম দামে কিনে কর্তারা চড়া দামে গোপনে বেচে দিচ্ছে। ম্যানেজার ও তার মোসাহেবরা কালোবাজারি করছে। মনোরমা বলে সেদিনের মতো সিভিক গার্ডকে বলে কিছু চিনি জোগাড় করতে। চালও তো লাগবে। তাই টাকা নিয়ে হরেকৃষ্ণ রওনা দেয়। মনোরমা তাকে ঠাকুর নমস্কার করে যেতে বলে। এতে কোনো সুবিধে হবে কি না সন্দেহ করেও, হরেকৃষ্ণ স্ত্রীর কথামতো দেবতার উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে রওনা দেয়।

পঞ্চম দৃশ্য:

দোকানের সামনে বিশাল লম্বা লাইন। হই-হট্টগোল। লাইনে হরেকৃষ্ণ। সে শুনেছে ওড়িশা থেকে নাকি লক্ষ লক্ষ মন চাল এসেছে। লাইনে এক ওড়িয়া ব্যক্তি ছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করায় সে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারল না। বলল, চাল তো পাওয়া যাচ্ছে না। হরেকৃষ্ণ অবাক হয়ে জানতে চাইল যে, এত চাল গেল কোথায়! দোকান খুলল মোটাসোটা ভুঁড়িওয়ালা এক ব্যক্তি। সিভিক গার্ড-এর কাছে হরেকৃষ্ণ জানতে চায় ক-সের করে চাল দেবে। গার্ড তা জানে না, সে সবাইকে খুচরো পয়সা প্রস্তুত রাখতে বলে। প্রথম পুরুষ বলে তার কাছে টাকা আছে। সিভিক গার্ড তাকে খুচরো করে আনতে বলে। প্রথম পুরুষটির সঙ্গে সিভিক গার্ডের কথা কাটাকাটি চলে। বাইরে থেকে একজন নাকি লাইনে ঢুকে পড়েছে। সিভিক গার্ড ছুটে যায়। দ্বিতীয় পুরুষটি বলে, সে লাইনেই ছিল, বাইরে থেকে ঢোকেনি। তৃতীয় পুরুষ তার কথাকে সমর্থন জানায়। সিভিক গার্ড হঠাৎ অন্য দিকে ছুটে গিয়ে দুস্থ চেহারার একটা লোককে চড় মারে। সে নাকি একাধিক বার লাইনে ঢুকে চাল নিচ্ছে। কিন্তু অভিযুক্ত চতুর্থ পুরুষটি জানায় সে লাইনেই আছে ঘণ্টা খানেক আগে থেকে। তৃতীয় পুরুষও তাকে সমর্থন জানিয়ে চড় মারার প্রতিবাদ করে। লাইনে দাঁড়ানো এক মুসলমান ব্যক্তিও এর প্রতিবাদ জানায়। লাইনে ঢুকতে দেওয়ার জন্য চতুর্থ পুরুষ সিভিক গার্ডের কাছে কাতর আবেদন করে। সে আগে চাল নেয়নি, সে চোর নয়-বলতে বলতে তার শরীর উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। তাকে লাইনের শেষে গিয়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেয় হরেকৃষ্ণ। এই অবাঞ্ছিত ঘটনায় ও সিভিক গার্ডের দুর্বিনীত আচরণে ক্ষুব্ধ-অপমানিত চতুর্থ পুরুষ বলে, চাল না দিলে না দেবে কিন্তু যা-তা বলার অধিকার কারও নেই। লোকে চাল কিনবে পয়সা দিয়ে আবার কুকুরের মতো অপমানিতও হবে। লাইনের সকলেই সিভিক গার্ডের আচরণে বিরক্ত হয়। চতুর্থ পুরুষ সিভিক গার্ডকে ‘জানোয়ার’ বললে তাদের মধ্যে মারামারির উপক্রম হয়। তুমুল হট্টগোলের মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে এক যুবক ‘আগুন আগুন’ বলে ছুটে আসে। সবাই জানতে চায় কোথায়, কীসের আগুন লাগল। যুবক হাতজোড় করে জানায়, আগুন জ্বলছে এইসব মন্বন্তরপীড়িত নিরন্ন মানুষের পেটে। সবাই চাল নিতে থাকে। লাইন সরে সরে যায়। মুসলমান ভাই দোকানিকে বলে, আজ যেন সবাই চাল পায়। দোকানি তাকে বলে, সে তো চাল পেয়েছে, অন্যের খোঁজ তাকে নিতে হবে না। ‘লুঙ্গি-টিকি-পৈতে-টুপি’ অর্থাৎ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মন্বন্তরগ্রস্ত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বুঝে দোকানি অবাক ও ত্রস্ত হয়ে ওঠে। তৃতীয় পুরুষ বলে, বাঁচতে হলে সবাইকে মিলেমিশে থাকতে হবে। হরেকৃষ্ণ সমর্থনের সুরে জানায় যে, এই বোধটাই এখন দরকার। লাইন সরে সরে যায়। একে একে চাল নিয়ে সবাই বেরিয়ে যেতে থাকে। আলো ম্লান হয়ে আসে। পর্দা পড়ে যায়।

বিষয়সংক্ষেপ

পাঁচটি দৃশ্যে বিন্যস্ত ‘আগুন’ নাটকটি টুকরো টুকরো ঘটনার সমষ্টি। হলেও এক সামগ্রিকতার ইঙ্গিতবাহী। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে ধর্ম-শ্রেণি-জাত নির্বিশেষে এককথায় কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্ত শহুরে কেরানি প্রায় সকলেই চাল সংগ্রহের জন্য রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। নাটকের প্রথম দৃশ্যে ভোরের আজানের শব্দ ভেসে আসে, মোরগের ডাক শোনা যায়। সেই গ্রামেরই কোনো এক পরিবারের গৃহকর্তা (পুরুষ) তার স্ত্রীকে সজাগ করে এবং কীভাবে সকাল সকাল রেশনের লাইনে নিয়ে চাল সংগ্রহ করতে হবে সে ব্যাপারে সচেতন করে। দ্বিতীয় দৃশ্যের শুরুতেই জনৈক কৃষাণ কাস্তে দিয়ে পিঠ চুলকাতে চুলকাতে কৃষাণীকে বলে-কীভাবে খুব সকালেই রেশনের লাইনের প্রথমদিকে দাঁড়িয়ে চাল সংগ্রহ নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয় দৃশ্যের সূচনাতেই শোনা যায় দূরের কারখানার বাঁশির শব্দ। সম্ভবত সেই কারখানাতেই কাজ করে সতীশ ও জুড়োন নামক দুজন শ্রমিক। সতীশের পরিবারে রয়েছে তার স্ত্রী ক্ষিরি ও মেয়ে ফুলকি। জুড়োন এখনও সংসার পাতেনি। সে একলা মানুষ। কারখানায় কাজ করেও সময়মতো দু-মুঠো চাল জোগাড় করতে না পারার হতাশা ফুটে উঠেছে তাদের কথায়। এমনকি, এই অভাব-অনটনকে কেন্দ্র করে সতীশের সঙ্গে তার স্ত্রীর ঝগড়াও হয়ে যায়। নাটকের চতুর্থ দৃশ্যে স্থান পেয়েছে কোনো এক শহুরে মধ্যবিত্ত আপাতসচ্ছল পরিবারের কাহিনি। কেরানি স্বামী হরেকৃষ্ণ ও তার গৃহবধূ মনোরমার কথাতে ঘুরে-ফিরে সেই দুষ্প্রাপ্য চাল-ডালের কথাই এসেছে। নাটকের পঞ্চম দৃশ্যে দেখানো হয়েছে এক চলমান ‘কিউ’, সেখানে জোর হট্টগোল হচ্ছে। লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলির বিভিন্ন রকমের সমস্যা হলেও তাদের মিল এক জায়গায়-সকলেই চালের প্রত্যাশী। মনে হয় বিপুল খাদ্যাভাব ও দুর্গতির কিনারা থেকে উঠে এসে সকলেই এক লাইনে দাঁড়িয়েছে। আর এই সারিবদ্ধ মানুষগুলির মধ্য থেকে জনৈক পুরুষ সোচ্চারে বলে উঠেছে- “যথেষ্ট তো হয়েছে। এখন বাঁচতে হবে। বাঁচতে হলে মিলেমিশে থাকতে হবে।” এইভাবেই প্রগতিবাদী সাম্যের – জয়গান শোনা যায়- প্রচারিত হয় সকলের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান। সুতরাং, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে কোনোরূপ বিদ্রোহ ঘোষণা না করেও নাট্যকার – তাঁর নাটক রচনার প্রথম প্রয়াসেই কিছু কোলাজের মধ্য দিয়ে সেকালের জীবন্ত কিছু ছবিকে তুলে ধরেছেন।

আরও পড়ুন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment