বাংলার উৎসব প্রবন্ধ রচনা

বাংলার উৎসব প্রবন্ধ রচনা

বাংলার উৎসব প্রবন্ধ রচনা
বাংলার উৎসব প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা

কথায় আছে “বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ”। এই নিয়েই মেতে আছে উৎসব পাগল বাঙালি। কৃষিপ্রধান বাংলা ও তার মেঠো মানুষেরা ঋতুচক্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা ছোটো-বড়ো উৎসব নিয়ে গড়ে তুলেছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক জগৎ। এসব উৎসবের মধ্য দিয়েই তারা ভুলতে চেয়েছে প্রতিদিনের ক্লান্তিকর একঘেয়েমিকে। কোনো শক্তিই কেড়ে নিতে পারেনি বাঙালির এই প্রাণের উচ্ছ্বাসকে। উৎসব তাকে দেয় আনন্দ, প্রসারিত করে তার অস্তিত্বকে।

উৎসবের রকমফের

বাঙালির উৎসবগুলিকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

  • সামাজিক ও পারিবারিক উৎসব,
  • ধর্মীয় উৎসব এবং
  • জাতীয় উৎসব।

১। সামাজিক ও পারিবারিক উৎসব: মানুষ সামাজিক জীব। ব্যক্তিগত আনন্দ-উৎসবকে সে ভাগ করে নিতে চায় আর পাঁচজনের সঙ্গে। বিবাহ, অন্নপ্রাশন, জন্মদিন, উপনয়ন, ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার মতো পরিবারকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানগুলি তাই হয়ে ওঠে বাঙালির সামাজিক উৎসব। এগুলির মধ্য দিয়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গেও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সুদৃঢ় হয় সামাজিক বন্ধন।

২। ধর্মীয় উৎসবঃ নানান সম্প্রদায়ের বাস এ বাংলায়, সকল সম্প্রদায়ই নিজস্ব ধর্মীয় উৎসবে মেতে থাকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা। শরৎকালে দেবী দুর্গার আরাধনাকে কেন্দ্র করে কয়েকদিনের জন্য জাতিধর্মনির্বিশেষে বাঙালি উৎসবে মেতে ওঠে। এরপরেই একে একে আসে লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, সরস্বতী পূজা প্রভৃতি। এ ছাড়াও মুসলিম সম্প্রদায়ের ইদ, মহরম, সবেবরাত এবং খ্রিস্টানদের বড়োদিন, গুডফ্রাইডে শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করা হয় বাংলায়।

৩। জাতীয় উৎসব: বিভিন্ন রকম জাতীয় উৎসবে বাঙালি মুখরিত হয়। যেমন-২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিন, ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস, ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস, ১৪ নভেম্বর শিশুদিবস, ২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধিজির জন্মদিন, ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস, ১৪ এপ্রিল আম্বেদকর দিবস প্রভৃতি। এ ছাড়া ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্র জন্মোৎসবকে বাঙালির জাতীয় উৎসবের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

উৎসবের সেকাল ও একাল

যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উৎসবের আয়োজনের ক্ষেত্রেও ঘটে গেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বর্তমানে উৎসবের আলোকসজ্জা, মণ্ডপ সজ্জা আড়ম্বরে ঢেকে গেছে। এতে নেই কোনো প্রাণ, সেই আন্তরিকতার স্পর্শও যেন আর অনুভব করা যায় না। অথচ পূর্বে উৎসব বলতে বোঝাত সত্যিকারের আন্তরিকতা। আলোকসজ্জা বা জাঁকজমক না থাকলেও উৎসব মানেই ছিল প্রীতি ও প্রেমের মায়াবী বন্ধন।

উৎসবের আনন্দ

উৎসব মানুষের অবসর মুহূর্তের আনন্দঘন প্রকাশ। বহু মানুষের একত্র সমাবেশ ঘটে উৎসবে। প্রাত্যহিক দিনযাপনের কষ্ট থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মেলে রেহাই। আর পাঁচটা দিনের চেয়ে উৎসবের দিনগুলো সম্পূর্ণ আলাদা। চারিদিকে সাজো সাজো রব, আলোর রোশনাই, আচার-অনুষ্ঠান, পোশাক-পরিচ্ছদ। উৎসবের দিনে সবকিছুই হয়ে যায় অন্যরকম। বাঙালি তাই নিত্য অভাব-অনটনের মধ্যেও উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে।

বৈচিত্র্য ও নান্দনিকতা

ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট ভুলে সবার সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠাই উৎসবের প্রধান উদ্দেশ্য। এ ছাড়া উৎসবের মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে মিলনের এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়। উৎসবের ময়দানে জাতিধর্ম-অর্থগত ভেদাভেদের কোনো প্রাচীর থাকে না, পারস্পরিক আনন্দ-প্রীতি বিনিময়ের মধ্য দিয়েই রচিত হয় বন্ধুত্ব। জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলের এ আনন্দে মেতে ওঠা বাঙালির উৎসব পালনকে করে তোলে সার্থক।

উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা

উৎসবকে বাদ দেওয়া মানে জীবনের আনন্দ ছিনিয়ে নেওয়া। তাই এই উৎসবের উদ্দেশ্য বা প্রয়োজনীয়তা কতখানি তা দেখে নেওয়া যাক।

১। উৎসব মনে এক অনাবিল আনন্দ নিয়ে আসে।

২। উৎসবের দিনগুলোতে অনেক মানুষের ব্যাবসা ভালো চলে।

৩। উৎসব উপলক্ষ্যে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা হয়।

৪। রোজকার কর্মরত জীবন থেকে স্বল্প সময়ের জন্য বিরতি মেলে।

৫। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে।

তাই মানবজীবনে উৎসবের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। উৎসবের এই কয়েকটি দিনে মানুষ সারা বছরের জন্য ইতিবাচক শক্তি সংগ্রহ করে প্রকৃতি থেকে।

উপসংহার

বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। আর সেজন্যই বাঙালি সমাজে বারো মাসে তেরো পার্বণের আয়োজন। এইসব উৎসব একের সঙ্গে অন্যকে মিলিয়ে দেওয়ার, নিজের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার মাধ্যম। এইসব উৎসব আছে বলেই সমস্যা জটিল জীবনেও বেঁচে থাকার রসদ পাওয়া যায়, এইসব উৎসবের মধ্যেই রয়ে যায় বাঙালির প্রাণের পরিচয়। কবি ঈশ্বর গুপ্ত যথার্থই বলেছেন- “এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গভরা।।”

আরও পড়ুন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment