যুদ্ধ প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা
সৃষ্টিকর্তা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে এই পৃথিবীকে অপরূপ প্রকৃতি দ্বারা সাজিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের সাধারণ চোখে বিশ্বের এই অপরূপ রূপ ধরা দেয় না। তার কারণ অহংকারী সভ্যতা দ্বারা এ বিশ্বকে কলুষিত করেছি আমরাই। অহংকারী মানবজাতির একটি ভয়ংকর সৃষ্টি হল যুদ্ধ। লোভ, হিংসা, দ্বেষ এসবই মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু এই সকল আবেগকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই মান আর হুঁশ নিয়ে মানুষের জন্ম। অথচ মানুষ নিজের মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিয়ে সেই প্রাচীনকাল থেকে লোভ-হিংসা-দ্বেষ-এর বশবর্তী হয়ে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে মেতে উঠেছে।
যুদ্ধের কারণ
যুদ্ধ হল রাজ্য, সরকার, সমাজ, ভাড়াটে সৈন্য, বিদ্রোহী এবং যে-কোনো প্রকারের সামরিক বাহিনীর মধ্যে একটি তীব্র সশস্ত্র সংঘর্ষ। এক্ষেত্রে মূলত নিয়মিত বা অনিয়মিত সামরিক বাহিনীর ব্যবহারের ফলস্বরূপ হিংস্রতা, আগ্রাসন, ধ্বংসলীলা এবং বহুসংখ্যক মৃত্যু দেখা যায়। অন্যদিকে, যুদ্ধবিগ্রহ বলতে যুদ্ধের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলিকে বা যুদ্ধ সম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপ বা বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধকে বোঝানো হয়ে থাকে। কোনো যুদ্ধ সম্পূর্ণভাবে বৈধ সামরিক লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাও হতে পারে এবং এর ফলে প্রচুর অসামরিক ও সাধারণ মানুষের হতাহতের সম্ভাবনা থাকে। যদিও যুদ্ধ বিশারদরা যুদ্ধকে মানব প্রবৃত্তির সর্বজনীন এবং আদিম দিক হিসেবে গণ্য করেন, কিন্তু কিছু মানুষ একে নির্দিষ্ট সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বা পরিবেশগত পরিস্থিতির ফলাফল বলে মনে করে।
যুদ্ধের ইতিহাস
সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে, বিভিন্ন যুদ্ধ এবং তার পরিণতি ইতিহাসের পাতায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার প্রথম দিকের যুদ্ধ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের আজকের যুদ্ধ পর্যন্ত দ্বন্দ্বগুলি আমাদের বিশ্বকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যুদ্ধ ক্রমশ পরিশীলিত হয়ে উঠেছে। যাই হোক দেখা যাক, পৃথিবীর কিছু বৃহত্তম যুদ্ধের ইতিহাস-
১। দ্য হানড্রেড ইয়ারস ওয়ার: ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স ১৩৩৭ থেকে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হানড্রেড ইয়ারস যুদ্ধে লড়াই করেছিল। এটি ছিল ইউরোপীয় যুদ্ধের একটি সন্ধিক্ষণ, যা সাহসী নাইটদের শেষ এবং ইংরেজ লংবোর প্রবর্তন দেখেছিল।
২। পেকোট যুদ্ধ : সপ্তদশ শতকের নতুন বিশ্বে ঔপনিবেশিকরা আদিবাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় যে যুদ্ধগুলি করেছিল, তার মধ্যে প্রথম সারির একটি পেকোট যুদ্ধ নামে পরিচিত ছিল, যা ১৬৩৬ থেকে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দু-বছর স্থায়ী হয়েছিল।
৩। ইংরেজদের গৃহযুদ্ধ : ইংরেজদের গৃহযুদ্ধ ১৬৪২ থেকে ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছিল। এটি ছিল রাজা চার্লস এবং পার্লামেন্টের মধ্যে ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব।
৪। ফরাসি বিপ্লব এবং নেপোলিয়নীয় যুদ্ধঃ ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ,অতিরিক্ত কর এবং একটি আর্থিক সংকট ফ্রান্সের সাধারণ মানুষকে আঘাত করায় শুরু হয় ফরাসি বিপ্লব। এ ছাড়া ১৮০৩ থেকে ১৮১৫ পর্যন্ত চলেছিল নেপোলিয়নীয় যুদ্ধ।
যুদ্ধের ক্ষতি
যুদ্ধ মানেই মানবতার পরাজয়। যুদ্ধ বয়ে আনে নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর খবর। বিশেষ করে, নারী নির্যাতন ও শিশু মৃত্যুর ঘটনা বিশ্ববিবেককে চমকে দেয়। যুদ্ধে প্রাণহানির সঙ্গে সঙ্গে যে বিপুল সম্পদহানি বা অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় তা পূরণ করতে লেগে যায় দীর্ঘ সময়।
বিশ্বযুদ্ধ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধঃ এটি একটি এমন বিশ্বযুদ্ধ যা ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই ইউরোপে শুরু হয়ে ১১ নভেম্বর ১৯১৮ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। ৬ কোটি ইউরোপীয়সহ আরও ৭ কোটি সামরিক বাহিনীর সদস্য ইতিহাসের বৃহত্তম এই যুদ্ধে একত্রিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্থায়িত্বকাল ছিল ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ। এই বিশ্বযুদ্ধের দুটি পক্ষ ছিল-অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তি। অক্ষশক্তির অন্তর্ভুক্ত প্রধানতম দেশগুলি হল-জার্মানি, ইটালি ও জাপান। মিত্রশক্তির সঙ্গে যুক্ত প্রধানতম দেশগুলি হল-যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্স। মিত্রবাহিনী এই যুদ্ধে জয়লাভ করে।
পরিবেশদূষণ
যুদ্ধের সাফল্য আসে অজস্র রক্তপাত, সংঘাত আর সৈনিক আহত ও নিহত হওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু এর সঙ্গেই অনেক শহর এবং আবাসভূমি ধ্বংস হয়ে যায়। অনেক দেশে বিভিন্ন রোগ মহামারির আকার নেয়। অনেক ধরনের মিসাইল, রাইফেল, গ্রেনেড আর অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যবহারে গোটা পরিবেশটাই মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্তও আছে যে পারমাণবিক বোমার ক্ষতিকর বিকিরণের ফলে চোখ, ত্বক আর ফুসফুসের ক্যানসার নিয়ে একদল মানুষ বংশপরম্পরায় বেঁচে আছে।
প্রতিকার
বিশ্বের বুকে যুদ্ধের ধ্বংসলীলার অবসান ঘটিয়ে সৃষ্টি করতে হবে শান্তির রাজ্য। তাই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে সচেতন হতে হবে। যুদ্ধের চির অবসানের জন্য সারা বিশ্বের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বর্ণবিদ্বেষ দূর করতে হবে, জাতিগত ঈর্ষার অস্তিত্ব মুছে দিতে হবে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য সারা বিশ্বের মানুষকে ঐক্যমতে পৌঁছোতে হবে, আর শান্তির কাজে জাতিসংঘের কর্মসূচিকে বাস্তবায়নের সুযোগ দিতে হবে।
উপসংহার
শান্তিই বিশ্বকে সমৃদ্ধিতে ভরে দিতে পারে। যুদ্ধের ফল কখনও শুভ হতে পারে না। শান্তি সকলেরই কাম্য হওয়া উচিত। কিন্তু মানুষ যদি সৎ না হয়, মানুষের মন থেকে যদি হিংস্রতা দূর না হয় তাহলে শান্তি চিরকাল মানুষের নাগালের বাইরে সোনার হরিণ হয়েই থাকবে।
আরও পড়ুন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা