নেলসন ম্যান্ডেলা প্রবন্ধ রচনা 800+ শব্দে

নেলসন ম্যান্ডেলা প্রবন্ধ রচনা

নেলসন ম্যান্ডেলা প্রবন্ধ রচনা
নেলসন ম্যান্ডেলা প্রবন্ধ রচনা

নেলসন ম্যান্ডেলা প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা

কৃষ্ণা – জননী আফ্রিকার অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের সন্ধান পেয়ে য়ুরোপের শ্বেত দস্যুরা ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। এইভাবে পঞ্চাশ লক্ষ শ্বেতাঙ্গ-দক্ষিণ-আফ্রিকার দু’কোটি যাট লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গকে শৃঙ্খলিত ও পদানত করে বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রহরে ও চালিয়ে যাচ্ছে তাদের নিমর্ম শোষণ এবং অমানবিক বর্বর অত্যাচার। তিন-শতাব্দী পরে সেই মানুষেরা তুলেছে সম্মিলিত স্লোগান-‘মে আইবুই আফ্রিকা’- ‘আমাদের আফ্রিকা আমাদের ফিরিয়ে দাও।’ যাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ-আফ্রিকার এই সুদীর্ঘ সংগ্রাম, তিনি কৃষ্ণা-জননী আফ্রিকার নয়নের মণি-মুক্তি-তাপস নেলসন ম্যান্ডেলা।

জন্ম

১৮ই জুলাই ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে, দক্ষিণ-আফ্রিকার ট্রানস্কি প্রদেশের কুনু নামক স্থানে। মাতার নাম নোসেকেনি ও পিতার নাম হেনরি গাডলা ম্যান্ডেলা। শৈশবে নেলসন শুনেছেন অতীতের স্বাধীন আফ্রিকার বীরপুরুষদের বীরত্ব ও সাহসিকতার নানা গৌরবময় কাহিনী। কিন্তু মিশনারী স্কুলে ভর্তি হয়ে তিনি দেখলেন, পাঠ্যপুস্তকে শ্বেতাঙ্গদের চক্রান্তে চিত্রিত হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গরা দস্যুরূপে। আসলে হৃদয়হীণতার কারণে শ্বেতাঙ্গরা গুলি করে মারে কৃষ্ণাঙ্গদের, তাদের পশুর মতো খাটায়, জোর করে তাদের জমির অধিকার কেড়ে নিয়েছে, স্বাধীন বিচারের ক্ষেত্রে ও আইনের নিষেধের দন্ডী ঘেরা। খেটে খাবার মতো তাদের নেই জমি, থাকতে হয় কাঁটাতারে ঘেরা আলো-বাতাসহীন ‘ঘেটো বা বস্তিতে।’ বালক নেলসনের মনে এসব ঘটনা গভীরভাবে রেখাপাত করে। তিনি ফোর্ট হেয়ার ইউনিভারসিটি-কলেজ থেকে প্রবেশিকা এবং করেসস্পন্ডেসে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে।

কর্মজীবন

কর্ম-জীবনের শুরুতে নেলসন একটি আইনজীবি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবীশ রূপে যোগ দেন। পরে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে অলিভার টাম্বোর সাথে এ্যাটর্নি হিসাবে কয়েকবছর আইন-ব্যবসা করেন। এই সময় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের অমানবিক আচরণ ও তাদের দুঃখ-যন্ত্রণার শরীক হয়ে কৃষ্ণাঙ্গ জাতিকে শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তির জন্য যাত্রা করেন কঠিন-কন্টাকীর্ন ক্ষুরধার পথে।

অহিংস পথে মুক্তি-সংগ্রাম

মহাত্মা গান্ধীজী দক্ষিণ-আফ্রিকায় এশীয়া বংশোদ্ভবদের মানবিক অধিকার আদায়ের জন্য যে সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন, তা আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে, আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেস তারই ফলশ্রুতি। ১৯৪৪ সালে নেলসন তাতে যোগ দেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জুন দক্ষিণ-আফ্রিকায় শুরু হল দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন। শ্বেতাঙ্গ সরকার নির্বিচারে গ্রেফতার ও অবাধ হত্যাকান্ড শুরু করে। ম্যান্ডেলা নেতৃত্বের পুরোভাগে এলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করার জন্য নির্ভীক ম্যান্ডেলা খুললেন একটি পাঠচক্র। শ্বেতাঙ্গ শাসকের দৃষ্টি পড়ল তার ওপর। পুলিশ ও মিলিটারি পাঠিয়ে তা ভেঙে দিল। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায়, চৌদ্দজন, ৮০০০ জন কৃষ্ণাঙ্গ বন্দী হন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ম্যান্ডেলা বন্দী হলেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা হল রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা। প্রমাণের অভাবে তিনি মুক্তি পেলেন।

ম্যান্ডেলার-বিচার ও বিশ্ব প্রতিক্রিয়া

দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের বিচারে নেলসনকে সবচেয়ে বেশী বিপজ্জনক ব্যক্তি বলে চিহ্নিত করল। এবার শুরু হল ম্যান্ডেলা প্ল্যানে কৃষ্ণাঙ্গদের আগামী দিনের সংগ্রামের জন্য প্রশিক্ষণ। ম্যান্ডেলাকে গ্রেফতার ও বন্দী করে জোহানেসবাগ দুর্গের অন্তরালে রাখা হল। বিচারের জন্য ম্যান্ডেলা ও তাঁর সঙ্গীকে লোহার-খাঁচায় হাজির করা হল। আদালত প্রাঙ্গণে বিশাল জনতার চাপে বিচারক বাধ্য হয়ে তাঁদের খাঁচার বাইরে আনার আদেশ দিলে জনতার ওপর গুলি চালায় পুলিশ। সারা বিশ্ব জুড়ে উঠল প্রতিবাদের ঝড়। বিশ্বের বহু রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রসংঘ সমর্থন জানাল ম্যান্ডেলাকে। তারা ধিক্কার জানাল শ্বেতাঙ্গ সরকারকে।

অহিংস থেকে হিংসার পথে

দক্ষিণ-আফ্রিকায় ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে মুক্তি সংগ্রাম চরম আকার ধারণ করল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান বললেন, আফ্রিকার মরুভূমিতে ঝড় উঠেছে, সেই ঝড়ে এবার উড়ে যাবে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার। শ্বেতাঙ্গ সরকার জরুরী অবস্থা ঘোষণা করল। ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে গঠিত হল গেরিলা বাহিনী ‘উমখানতো ওয়ে সিয়োজে’ বা জাতিরবর্ষা। ম্যান্ডেলা গোপনে জাতির বর্শা বাহিনীর শিক্ষা ও অস্ত্রশস্ত্রের জন্য গেলেন কেনিয়া, জাম্বিয়া, তানজানিয়া, আলজিরিয়া, ইথিওপিয়া প্রভৃতি দেশে। সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফেরার পর শ্বেতাঙ্গ গোয়েন্দার হাতে ধরা পড়ে গেলেন।

রক্তের ঋণ

ম্যান্ডেলা বললেন আদালতে, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বছরের পর বছর খনির অন্ধকারে, কারখানার ও জাহাজের ডকে রক্ত-জলকরা পরিশ্রমে শেতাঙ্গদের হাতে তুলে দিচ্ছে রাশি রাশি ডলার, স্টালিং-পাউন্ড। কিন্তু যখনই তারা চেয়েছে মানুষের মতো বাঁচার অধিকার, তখনই তাদের ওপর বর্ষিত হয়েছে গুলি। শ্বেতাঙ্গরা এখনও পর্যন্ত আমাদের সেই রক্তের ঋণ শোধ করেনি। বিচারে ম্যান্ডেলা ও তাঁর সহযোগীদের বন্দী করে রাখা হল রোবেন দ্বীপের কারাগারে। তাঁদের দিয়ে সমুদ্রতীরের রাস্তা তৈরী, পাথর ভাঙা প্রভৃতি কঠিন শ্রম করাতে লাগল বছরের পর বছর শ্বেতাঙ্গ সরকার। ম্যান্ডেলাকে কারারুদ্ধ করে নির্যাতন করা হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার যুবশক্তি ম্যান্ডেলা নামের যাদুতে বারুদের মতো জ্বলে উঠল, সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে চলল ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। আকাশে বাতাসে শোনা গেল, ‘রিলিজ ম্যান্ডেলা’-ম্যান্ডেলার মুক্তি চাই।

মুক্ত সংগ্রামী নেলসন ম্যান্ডেলা

ম্যান্ডেলা যাবজ্জীবন কারাদন্ডের পর দ্বীপের কারাগারে কাটান ২৭ বছর। কারাগারে থাকার সময় ম্যান্ডেলা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হল পোলসার কারাগারে। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেব্রুয়ারি মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি পি.ডব্লিউ বোথা সমস্ত সংগ্রাম ত্যাগের শর্তসাপেক্ষে ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ম্যান্ডেলাকে ভিক্টর ভার্সাটার কারাগারে স্থানান্তারিত করা হল। যাদুশক্তি যেন ম্যান্ডেলা নামটি।

বিশ্বের কয়েকটি বাণিজ্য-সর্বস্ব দেশ ছাড়া সমগ্র বিশ্বের সকল দেশই শ্বেতাঙ্গ সরকার দক্ষিণ আফ্রিকাকে বয়কট করে। বোথারের পরে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হলেন ক্লার্ক। তাঁর আদেশে দীর্ঘ সাতাশ বছরের কারাবাসের পর ম্যান্ডেলাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয় ১১ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। আজীবন ক্ষমতা ধরে না রেখে নিজেকে তিনি সঁপে দিলেন বিভিন্ন মানবিক আন্দোলনে।

 পুরস্কার

চার দশক ধরে ২৫০টির বেশী পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে দেওয়া হয়েছে নোবেল শাস্তি পুরস্কার। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম,’ কানাডার সর্বোচ্চ সম্মান ‘অর্ডার অব কানাডা,’ ভারত থেকে ‘ভারতরত্ন’, পাকিস্তান থেকে ‘নিশান-ই-পাকিস্তান’, তুরস্ক থেকে ‘আতাতুর্ক’, ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ থেকে ‘অর্ডার অব মেরিট’, ‘রাষ্ট্রসংঘ থেকে তাঁর স্বীকৃতির অবদান হিসাবে ম্যান্ডেলার জন্ম দিন ১৮ জুলাই’ নেলসন ম্যান্ডেলা আর্ন্তজাতিক দিবস’ প্রভৃতি। তিনি বলেছেন ‘আমি জেনেছি, ভয়ের অনুপস্থিতিই সাহস নয়, সাহস হল ভয়ের ওপর বিজয়’।

উপসংহার

২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর নেলসন ম্যান্ডেলা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি অমর হয়ে থাকবেন মানুষের মনে, অন্যায়ের প্রতিবাদী বলিষ্ঠ এক বর্ণবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা হিসাবে।

আরও পড়ুন – রাজা রামমোহন রায় প্রবন্ধ রচনা

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment